#প্রিয়তমা_প্রজাপতি🩷 [পর্ব-০৯]
~আফিয়া আফরিন
‘তুই যখন আমাদের বাসায় আসছিলি তোকে তখন কি রকম দেখাচ্ছিল তুই জানিস?’
মিফান শুধুমাত্র চোখ তুলে তাকাল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। বলবেও না, কেন কথা বলবে? অনিন্দিতা এতদিন বহুৎ জালাইছে, এইবার সে ও একটু জ্বলুক। জ্বলার মজা কেমন একটু টের পাক।
মিফানকে চুপচাপ থাকতে দেখে অনিন্দিতা নিজে থেকেই বলল, ‘তোকে একদম পাক্কা মুরগি চোরের মত লাগছিল। আমি তো ভেবেছি মুরগি চুরি করতে গিয়ে পাবলিকের কাছে ধরা খেয়েছিস, কোনোমতে পালিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিস। সিরিয়াসলি, আমি সেই মুহূর্তে এটাই ভেবেছিলাম। এলোমেলো চুল, পরনের টি শার্ট পর্যন্ত এলোমেলো ছিল।’
মিফান নিশ্চুপ। অনিন্দিতা নিজের মতো কথা বলেই যাচ্ছে। এই মেয়ের পেটের মধ্যে যে এত কথা, আগে তো কখনো বোঝা যায় নাই। সব সময় তো একটা রাগী রাগী গম্ভীর মুখ করে থাকে। আর এখন, মুখে খই ফুটছে।
মিফান যে কখন থেকে চুপচাপ বসে আছে, সেই দিকে ম্যাডামের কোন খোঁজ খবর নেই। একটু ভালোবেসে আদর করে জিজ্ঞেস করলেই তো পারে, মন খারাপ করে বসে থাকার কারণটা কি? এইভাবে জিজ্ঞেস করলে মিফান কি আর রাগ করে থাকতে পারে? সে তো সাথে সাথেই আইসক্রিমের মতো গলে গলে পড়বে। অনিন্দিতা কেন তাকে একটু বোঝেনা?
মিফানের ভাবনা চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে অনিন্দিতা বলল, ‘এরকম চুপচাপ বসে আছিস কেন? এমনিতে সবসময় বকবক করতে করতে মাথা খাস, এখন চুপ করে বসে আছিস যে? সেন্টি সেন্টি মুখ করে বসে আছিস কেন? হাস একটু!’
‘কেন হাসবো আমি?’
‘তুই কি রামগরুড়ের ছানা যে তোর হাসতে মানা?’
‘তোমার সাথে আমার হাসতে ইচ্ছে করছে না আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
‘ওহ আচ্ছা? এখন সবাই যখন মেনে নিল তখন আমি পুরাতন হয়ে গেছি তাইনা? কাকে ভালো লাগে এখন? তোর ওই পিরিতের নেহাকে?’
মিফান কিছু বলল না। অনিন্দিতা রাগে গজগজ করতে লাগলো। অনিন্দিতার রাগ দেখে মিফান মনে মনে না হেসে পারলো না। এখন হিংসে হচ্ছে? মিফানের ও হয়েছিলো। বুকের ভেতরের জমিনটা পুরে ছাই হয়ে গেছিল। অনিন্দিতা একদিনও আসেনি, আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। তখন তো মিফানের ও অভিমান হয়েছিল। তার অভিমানের কি কোন দাম নেই নাকি?
নিরবতা ভেঙ্গে মিফান বলল, ‘সব সময় সব কিছুতেই নেহাকে নিয়ে টানাটানি করো কেন?’
‘আমি নেহাকে নিয়ে টানাটানি করি? এটা বলতে পারলি তুই আমাকে? এখন এতো নেহা নেহা করিস কেন? দু’দিন আগ পর্যন্ত তো আমার পিছে পড়েছিলি।’
‘তুমি তো পাত্তা দাও নাই।’
‘আচ্ছা। তো যা নেহার কাছে। আমার বাসায় এসে বসে আছিস কেন?’
‘এটা তোমার বাসা? হুহ! আমি আমার বড়ো আব্বুর বাসায় এসেছি। তোমার সমস্যা?’
অনিন্দিতা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মিফান বলল, ‘আর ইউ জেলাস?’
‘জেলাস? আমি? তাও আবার তোকে নিয়ে, অসম্ভব ব্যাপার। তোর এসব ফালতু লো ক্লাস বিষয় নিয়ে আমি এত জেলাস ফিল করি না। এত জেলাসি আবার আমার আসে না।’
মিফান নির্বিকার ভাবে বলল, ‘ও আচ্ছা, তাই!’
মিফান উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে অনিন্দিতার দেখে এগিয়ে দিল। অনিন্দিতা বলল, ‘এটা আমাকে কেন দিচ্ছিস? তোর ওই নেহা নাকি ফেহা তাকে গিয়ে দে। আমি এসব আলতু ফালতু জিনিস মুখে নেই না।’
মিফান মনে মনে হাসলো। তারপর অনিন্দিতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘চকলেট যে আমি তোমার জন্য এনেছি সেটা কখন বললাম? এটাতো আমি নেহাকেই দিব। তোমাকে শুধুমাত্র দেখালাম, চকলেট টা খুব সুন্দর তাই না! নেহার খুব পছন্দ হবে বলো।’
অনিন্দিতা বিস্ফোরিত নয়নে মিফানের দিকে তাকালো। সম্ভব হলে এক্ষুনি, ১০০ বার কানে ধরিয়ে উঠবস করাতো।
ওই তো ছোটবেলায় করাতো না, পান থেকে চুন খষলেই; কান ধরে উঠবস কর।
এমনও অনেকদিন গিয়েছে, মিফান কে গাছের সাথে দড়ি দিয়ে পর্যন্ত বেঁধেও রেখেছে। ছেলেটা কি ভদ্র ছিল! অনিন্দিতা যে তার সাথে এত কিছু করেছে, এই নিয়ে বাসায় কখনো কারো কাছে নালিশ করে নাই। বরং উল্টো সারাদিন অনিন্দিতার পিছু পিছু ঘুরতো।
আর এখন সেই ছেলে বড় হয়ে নেহা নেহা শুরু করেছে। সাহস কতো বড়ো, বুকের পাটা কতো বড়ো! অনিন্দিতা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, বাসার সবাই যেহেতু মেনেই নিয়েছে দুজনের সম্পর্কটাকে তাহলে তো কিছু সময় পর তাদের বিয়েও হবে। বিয়ের পর মিফানের এই খামখেয়ালিপনা কথাবার্তার শোধ হারে হারে তুলবে। এক বেলা খেতে দেবে আর বাকি দুই বেলা নিজের সেবা যত্ন করাবে।
অনিন্দিতা ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলো। ঠিক ওই মুহূর্তে মিফান স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো, ‘প্রজাপতিদের প্রজাপতির মতোই হতে হয়। নাকের ডগায় এত রাগ নিয়ে ঘুরলে হয় বলো? আমার সেই প্রজাপতি কখনো কুঠুরিতে বদ্ধ হবে না, সব সময় আকাশে ডানা মেলে উড়বে। আমার প্রজাপতির রং হবে সাত রাঙা! সাতরাঙ্গা রঙে আমরা সাত জন্ম বেঁচে থাকব। প্রজাপতি তার সাথ রাঙা রঙে আমায় সাত জন্ম ভালোবেসে যাবে। পরের জন্মে যদি কখনো আরেকটাবার জন্মাবার সুযোগ থাকে, সেই জন্মে না হয় তোমার থেকে বয়সে বড় হয়ে জন্মাবো। এই জন্মের দ্বিধা সংকোচ ওই জন্মে ঘুচিয়ে দিব। এই জন্মে যদি আমার অজান্তে কোন অপূর্ণতা থেকে থাকে, অভিমান না করে ধরিয়ে দিও সেটা; পরের জন্মে আর ওই অপূর্ণতা বাঁচিয়ে রাখবো না। আচ্ছা প্রজাপতি, আগামি সাত জন্ম তোমার ভালোবাসা পেতে আমায় কি করতে হবে? মৃত্যু ছাড়া তুমি যে হুকুম দিবে, আমি মাথা পেতে তাতেই রাজি। যদি বলো আকাশের চাঁদ এনে দিতে, আমি আমরণ সেটা চেষ্টা করব। তবুও তো আমার আশা থাকবে, এই প্রজাপতিটাকে আমি পাচ্ছি।
তোমার সাথে খুব সাদামাটা সম্পর্ক থাকবে আমার। একদম সাদামাটা আর সাধারণ ধরনের সম্পর্ক; যেখানে শো অফ থাকবে না, বাহিরের মানুষকে দেখানোর কোন আকাঙ্ক্ষা অভিলাষ থাকবে না। একটু ভালোবাসা চাইছি তোমার কাছে প্রজাপতি, তোমার জায়গা জমি তো চেয়ে বসি নাই।’
এতো মুগ্ধতায় অনিন্দিতার চোখ ঝাপসা হয়ে এল নিমিষেই। মিফান এত কথা বলল, কিন্তু সে কি বলবে? এই পাগল পাড়া ভালবাসা এতদিন সে পায়ে ঠেলে ফেলছিল। আর মত পাগল কি আসলে দুনিয়াতে আর একটাও আছে? যে ছেলেটা এত ভালবাসতে পারে, এই ছেলেটা যে কোন পরিস্থিতিতে ভালো রাখতেও পারে!
অনিন্দিতা ভেজা কন্ঠে থেমে থেমে বলল, ‘আমি শুধু চাই দিনশেষে আমার গন্তব্য তোর কাছেই হোক! এতদিন কেন জানিনা বুঝি নাই। তবে আজ সৃষ্টিকর্তার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতেছি!’
.
.
‘বুঝলি অনি, আমরা আসলে জীবনে পার্মানেন্ট মানুষের যে পারফেক্ট খুঁজি বেশি। কার সাথে আমাদের বেশি মানাবে, কার সাথে দাঁড়ালে সোসাইটিতে নিজের স্টেজ মেইন্টেন করা যাবে। কার পাশে নিজেদেরকে বেশি মানাবে।
এই রকম ধরনের পারফেক্ট মানুষ খুঁজতে গিয়ে আমরা জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলি। সবচেয়ে দামি জিনিস, ভালোবাসা সেটা নিঃশেষ হয়ে যায় আর যেটা বেঁচে থাকে সেটা হচ্ছে শুধুমাত্র দায়িত্ববোধ।
পারফেক্ট মানুষটা আমাদের প্রতি সব ধরনের দায়িত্ব পালন করে ঠিকঠাক, কিন্তু দিন শেষে যে আমাদের একটা ভালোবাসার প্রয়োজন হয়; সেই ভালোবাসাটা কি আদৌ আমরা তাদের কাছ থেকে পাই? আর ভালোবাসা ছাড়া কি কখনো মানুষের জীবন বাঁচে! তোর জীবনে মিফান হচ্ছে পার্মানেন্ট একটা পরিচ্ছেদ। সে তোর প্রতি দায়িত্ব পালন করবে, আবার মন প্রাণ উজাড় করে ভালবাসবে। ছোটো বেলাকার ভালোবাসা তো, দেখে নিস টুকটাক পাগলামি ও করবে। ওর সাথে থাকলে তুই ফ্রি মাইন্ডে থাকতে পারবি, খুশি থাকতে পারবি। তোকে কখনো ফরমালিটি মেইন্টেন করতে হবে না। বয়সে তোর ছোট তো, সে তোকে শাসন করবে না তুই উল্টো শাসন করতে পারবি। সব মিলিয়ে মিফান তোর জন্য একদম পারফেক্ট। আর এমন একজন মানুষ লাইফে বড্ড প্রয়োজন!’
অনিন্দিতা অবনীর কথা শুনে আর কিছু বলল না। বলার প্রয়োজনও মনে করলো না। অবনী তো তার ভেতরটা বুঝে গেছে। যেখানে মনে মনে কথোপকথন হয়, সেখানে আর মুখে মুখে কথাবার্তার কি দরকার?
ইদানিং মিফান ত্যাড়ামি শুরু করছে। অনিন্দিতা বুঝতে পারে মিফান এসব ইচ্ছে করেই করছে। তাকে রাগানোর জন্য এর ওর সাথে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। অনিন্দিতা এসব দেখে আর লুচির মত ফুলে ফুলে ওঠে। সে তো মিফানকে বলেই দিয়েছে, তোর এইসব ফালতু লো ক্লাস বিষয় নিয়ে আমি জেলাস করি না।
এটা শুধুমাত্র অনিন্দিতার মুখের কথা। মিফানের এসব কর্মকাণ্ড দেখলে সে একেবারে ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায়।
মন চুরি করে এখন বিষের ছুরি মারছে। মারুক, অনিন্দিতা সব নির্বিকারে সহ্য করে নিবে। তার সাথে রহস্য করা হচ্ছে। সমস্যা নাই, বিয়ের আগে যা খুশি করুক। বিয়ের পর তো আর এসব করার সাহস পাবে না।
ভাবতেই অনিন্দিতা ঠোঁট বাঁকিয়ে বাচ্চাদের মতো হাসি দিলো।
.
.
অনিন্দিতা আচমকা মিফানের শার্টের কলার টেনে ধরল। মিফান ফিসফিস করে বলল, ‘কি হচ্ছে কি? সবার সামনে আমার মান সম্মানের ষষ্ঠী পূজা করবে নাকি?’
‘তোর আবার মান-সম্মান আছে? এতো মেসেজ দিছি, রিপ্লাই নাই? কেনো? এখন পেয়ে গেছো, তাই ভাল্লাগে না তাইনা? আর জীবনেও আমার সামনে আসবি না, অভদ্র ছেলে কোথাকার!’
‘আরে ফোন সাইলেন্ট রেখে আমি ঘুমাচ্ছি। না হয় তোমার একটা ফোন কল অথবা মেসেজ কি আমি কখনো মিস করি?’
‘চুপ! আমার মুখে মুখে একটাও কথা বলবি না। নেহার সাথে নতুন করে পিরিত লাগাইছিস? কেন, একটা দিয়ে চলে না তোর? কয়টা লাগে?’
মিফান মাথার চুলকে উত্তর দিলো, ‘একটা আসলেই হয় না, চার-পাঁচ টা হলে একটু বেশিই ভালো হয়। এই ধরো, একজন আমার সেবা করবে। আরেকজন রান্না বান্না করবে। আরেক জন ঘর ঝাড়ু দিয়ে ঘর মুছবে। আর তুমি? তুমি তো আমার ঘরের রাজরানী, তোমাকে আমি মাথায় তুলে রাখবো। সংসারে তোমার কোনো কাজকর্ম নাই। তুমি তো শুধু…..!’
অনিন্দিতা মিফান কে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হচ্ছে তোর দাঁড়া। এইটুকু মাথার মধ্যে এত বড় মাস্টার প্ল্যান নিয়ে বসে আছিস তুই?’
‘বাদ দাও, চলো লং ড্রাইভে যাই।’
‘লং ড্রাইভ?’ অনিন্দিতা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ। সাইকেলে করে, চলো।’
অনিন্দিতা রাজি হলো। ছোট্টো করে বলল, ‘চল।’
দুজনে মিলে বড়ো মাঠটায় এলো। প্রকৃতি নিজের অপার সৌন্দর্য ডানা ছড়িয়ে দিয়েছি। মৃদু বাতাসে গাছপালা উড়ছে।
অনিন্দিতা নিজ মনে বলল, ‘আজকের এই দখিনা হাওয়া আর তুই দুটোই আমার ব্যক্তিগত!’
কিন্তু মুখে মিফানকে বলল, ‘শোন, তোর সাথে আমি আর বেশি কথা বলব না। তুই মানুষটা খুব একটা ভালো না। আজকে ঘুরতে আসার কথা বললেই তাই এলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আর আসব না। তুই বরং তোর ওই নেহা কে নিয়ে থাক। তবে ভাবিস না, এসব কিন্তু আমি তো ঠিক ফ্রি ফ্রি করতে দিচ্ছি না। এর শোধ পরে আমি একদম সুদে আসলে তুলে ছাড়বো। সে পর্যন্ত ভালো থাক, আনন্দে থাক। আমি পাকাপোক্তভাবে তোর জীবনে এলে, এই ছন্নছাড়া টাইপের আনন্দ একদম হারাম করে ছাড়বো।’
মিফান মাঠের মাঝখানে পা দিয়ে ঘাস মাড়াচ্ছিল। অনিন্দিতার কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপি দিয়ে বলল, ‘সে দেখাই যাবে!’
.
.
.
চলবে…..!
আগামী পর্ব এবং শেষ পর্ব ঈদের পরদিন দিব ইনশাআল্লাহ। ধন্যবাদ ❣️
[কার্টেসি ছাড়া কপি করি নিষেধ]