#আমি_তারে_দেখেছি
#১৩তম_পর্ব
শান্তর কথায় বেশ লজ্জা পেলো নবনীতা। স্বগোতক্তির স্বরে বলল,
“আমি কি তা বলেছি?”
“তাহলে?”
“আমি বলছি যে আমাকে পৌছে দেবার জন্যই তো আসা। সেই কাজ তো সম্পন্ন। এখন আমি ক্লাসে যাব। অহেতুক দাঁড়িয়ে দেখে তো আপনার কাজ নেই। আপনি বরং চলে যান”
“কে বলেছে আমার কাজ নেই? আমার এখানে অনেক কাজ। সেটা না করে তো আমি যাচ্ছি না।”
“কি কাজ?”
“বাহ রে! শিকার করবো না! খু/নী তো এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে”
কথাটির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না নবনীতা। চোখে মুখে ভেসে উঠল তীব্র বিস্ময়, কৌতুহল। ক্ষণিকের জন্য মনে হল শান্তর চোখের ভাষা বদলে গেছে। এত সময়ের দুষ্টুমি গুলো যেন উবে গেল। মুহূর্তেই তীক্ষ্ণতা পরিলক্ষিত হল, ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা হাসিটুকুও বোধগম্য হল না। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল এই মানুষটিকে অচেনা লাগতে শুরু হল। সচকিত হল নবনীতা। কিন্তু নিজেকে পরমুহূর্তেই সামলে নিল সে। ধীর স্বরে বলল,
“খু/নী ধরা পড়েছে?”
“না, এখনও ধরা পড়ে নি। তবে খু/নী তোমার পরিচিত ই কেউ”
“এতটা নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন?”
শান্ত ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। তার হাসিটায় নবনীতার অনুভব হল, শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত বয়ে গেল। শান্ত হাসি অক্ষত রেখে বলল,
“দোলার বয়ফ্রেন্ড ছিল জানতে?”
“হ্যা, সময় নামের একটি ছেলে”
“একেবারে দশে দশ। এই না হলে পুলিশের বউ। কিন্তু আসলে সময় ছেলেটির সাথে দোলার সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিল। যাকে ইংলিশে বলা হয় ব্রেকাপ। তাদের এই ব্রেকাপটা প্রায় চারমাস পূর্বেই হয়েছে। কিন্তু সেই ছেলেটি মোটেই এটা মেনে নিতে পারছিল না। ট্রু লাভ করত কি না। তাই সে দোলাকে নানা ভাবে হ্যা/রা/স করা শুরু করে। শুধু তাই নয় ছেলেটা তাকে আপত্তিকর ছবি দিয়েও ব্লা/কমে/ই/ল করতে থাকে। এইসব থেকে মুক্তি পেতেই দোলা তাদের ব্রেকাপের কথাটা এক্সপোজ করে না। এনাদার স্টোরি অফ মডার্ণ লাভ। একারণে আমি প্রেম জিনিসটিকে এত অপছন্দ করি। যাক গে, তুমি কি জানো এই ব্রেকাপটি কেন করেছিল দোলা?”
নবনীতার নিকট প্রতিটি তথ্যই নতুন। মানুষের মস্তিষ্ক হুট করেই নতুন তথ্য নিতে পারে না। ঝিমঝিম করতে শুরু করে। মস্তিষ্ককোষগুলো নিজেদের সাথেই দ্বন্দে জুড়ে যায়। নবনীতার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। নিউরণ কোষের ধারণ ক্ষমতা যেন হ্রাস পাচ্ছে। সে মলিন স্বরে বলল,
“কেন?”
“কারণ দোলা অন্য কাউকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল। সময় ব্যাপারটি জেনে যায়। ফলে টক্সিক লাভ ঘৃণার রুপ নেয়। এবার ডে/থ থ্রে/ট দিতে শুরু করে সে। এমনকি শুধু দোলাকে নয়, দোলার নতুন প্রণয়নকেও মে/রে ফেলার হুমকি দেয় সে”
“তাহলে বলতে চাচ্ছেন, ঐ মাস্ক পড়া ছেলেটি সময়?”
“হতেই পারে?”
“কিন্তু সময় নিয়নকে কেন খু/ন করবে? আমার স্বপ্ন অনুযায়ী দুজনের খু/নী এক মানুষ”
শান্তর হাসি বিস্তারিত হল। সে কপালে আসা চুলগুলো দায়সারাভাবে হাতহাতে পেছনে ঠেলে গাঢ় স্বরে বলল,
“দোলার নতুন প্রণয়ন কে জানতে চাইলে না তো?”
শান্তর হাসির অর্থ এবার বুঝতে বাকি রইল না নবনীতার। সচকিত কন্ঠে শুধাল,
“নিয়ন?”
“বিংগো। তুমি দশে দশ পেয়েছ”
“কিন্তু নিয়ন তো……”
“তোমার বান্ধবী শিল্পীকে পছন্দ করত। শিল্পীর বিয়েতে তার হৃদয়ক্ষুন্নও হয়। সেই ভঙ্গুর হৃদয়ের মলম হয়ে দাঁড়ায় দোলা। কারণ নিয়ন, দোলা এবং সময় ভালো বন্ধু ছিল। তুমি বলছিলে দোলা তোমাকে পছন্দ করে না। কারণটি এটাই। কারণ কোথাও না কোথাও সে তোমার বান্ধবীকে অপছন্দ করত। তাই তোমাকেও তার ভালো লাগত না। নিয়নের মৃত্যুতেই সেই সবচেয়ে ভেঙে পড়েছিল। সে এই দুদিন না ঠিক মত খেত না ঘুমাত। সর্বদা আতংকিত থাকত। সিন্থিয়া এবং বীথির ভাষ্যমত সে খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছিল। কোথাও না কোথাও সে নিজেকে দায়ী করত। শুধু তাই নয়, সে তো নিশ্চিতও ছিল সময় ই নিয়নকে খু/ন করেছে”
“কারণ নিয়নের হ/ত্যার দিন সে সময়ের সাথে ছিল”
“এক্সাক্টলি। সেদিন ক্লাসের পর তারা বন্ধুরা একই সাথে আউটিং এ যায়। শুধু তাই নয়। নিয়নের বাসায় বলা ছিল সে বাড়ি ফিরবে না। রাতে তাদের ই এক বন্ধুর বাসায় থাকবে। এর পর ই সকালে উদ্ধার হল তার লা/শ”
“তাহলে সময় খু/ন করছে। আপনি অপেক্ষা করছেন কেন। ওকে গ্রেফতার করুন”
শান্ত এবার সশব্দে হেসে উঠল। হাসির দমকে তার শরীর কাঁপছে। নবনীতা এই লোকটিকে বুঝতে পারে না। এত রহস্য নিয়ে কথা বলবে যেন সাধারণ কথাটি না জানে কতটা রহস্যময়। আবার খুব রহস্যের কথাও সাধারণভাবে বলবে। নবনীতা কিঞ্চিত বিরক্ত হল। তার যে তর সইছে না উত্তর জানার জন্য। কিন্তু এই লোক কখন থেকে হাসছেই। বিরক্তিমাখা স্বরে বলল,
“হাসি থামিয়ে বলুন না, ওকে গ্রেফতার করছেন না কেন?”
“এত সোজা? গ্রেফতার করতে ইচ্ছে হচ্ছে আর করে নিলাম? প্রমাণ কোথায়?”
“এত গুলো প্রমাণ তো আছেই”
“তার চেয়ে বড় প্রমাণ দুজন ই আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে”
“কিন্তু এটা তো বলাই যায়, যে সে দোলাকে ব্লাকমেইল করত। ডে/থ থ্রেট দিত। এটাও ক্রাইম”
“হ্যা, সেজন্য তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছেও। সময় অলরেডি থানায়। আর মেনেই নিলাম সময় খু/ন করেছে। তাহলে সু/ই/সা/ই/ড নোট এ কেন তোমার, রাকা, শ্রীবাস, বিভার নাম উল্লেখ ছিল। তোমরাও কি ষষ্ঠকোন প্রেমে লিপ্ত ছিলে। শুধু তাই নয় আরোও একটি ধাধা আছে, ধর, তোমার রুমমেট ডে/থ থ্রে/ট পাচ্ছে, তুমি কি মনের সুখে শপিং এ যেতে পারবে?”
নবনীতার এবার মাথা ঘুরাবার যোগাড় হল। কেস জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতসময় মনে হল খু/নগুলো করছে সময়। কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে এর মাঝেও অনেক ঘাপলা আছে। শান্ত ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর ব্যস্ত স্বরে বলল,
“তোমার যাওয়া উচিত। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে”
“কিন্তু আপনি তো বললেন না, খু/ন টা সময় করেছে কি না?”
শান্ত আলতো হাতে নবনীতার কোমল গালজোড়া হালকা টিপে বলল,
“এই ধাধাটা তোমার। তুমি ই বের কর সময় খু/নটি করেছে নাকি করে নি। ততসময় আমি বরং একটু তোমার ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলে আসি”
বলেই ভেতর দিকে পা বাড়ালো শান্ত। নবনীতা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। বিস্ময়, চমক, কৌতুহল মুহূর্তেই মধ্যেই লজ্জায় পরিণত হয়েছে। শ্যাম গালজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে! হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে তরান্বিত হল। নবনীতা ঠিক বুঝতে পারল কারণ কি_______
******
ক্লাসের সবার সাথেই মোটামুটি কথা বলেছে শান্ত। প্রতিটি মানুষের নিয়ন এবং দোলা সম্পর্কিত ধারণা এক নয়। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধারণা। সেই সাথে সবার কথাগুলোই ছন্নছাড়া। একটি সুতো ধরে যে আগাবে সেই উপায় নেই। শান্ত কিছুটা চিন্তিত। কারণ দোলার রুমমেট বীথি এবং সিন্থিয়ার কথা গুলো ও একটি অপরের সাথে মিল খাচ্ছে না। বিথীর ভাষ্যমতে,
“দোলা নিয়নের মৃত্যুতে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে দু তিনবার সু/ই/সা/ই/ড করার মনস্থিতি করেছিল”
এবং সিন্থিয়ার ভাষ্য মতে,
“দোলা কিছুদিন যাবৎ ভয়ে ভয়ে থাকত। কিন্তু সুইসাইড করার আগ দিন থেকে সে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। হয়ত ও সময়কে ভয় পাওয়ার রিজন খুঁজে পাচ্ছিল না”
উপরন্তু ক্লাসের সবার মতে সময় অত্যন্ত ভালো ছেলে তার পক্ষে খু/ন কেনো মাছি মা/রাও সম্ভব নয়। তার চেয়ে বড় কথা তার এবং দোলার সম্পর্ক অনেক ভালো ছিল। টক্সিসিটির স্থান ই ছিল না। শুধু তাই নয়, সবার মতে সময়কে আড়াল করেই দোলা নাকে প্রতারণা করেছিল। তবে কার সাথে সেটা সকলের অজ্ঞাত।
প্রতিটি ভাষ্য একে অপরকে নাকোচ কত্তে ব্যস্ত। ফলে শান্ত যেন গভীর রহস্য চোরাবালিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। হাতে থাকা অর্ধখাওয়া সিগারেটে সুখটান দিয়ে নিজের ক্লান্তি, চিন্তার প্যাঁচ নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়াল সে। এমন সময় মেয়েলী স্বর কানে এল,
“আপনি সিগারেট খান?”
কথাটা শুনতেই মাথা তুলে তাকায় শান্ত। হাতে থাকা সিগারেটটি মাটিতে বড্ড অবহেলায় ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে বলল,
“ক্লাস শেষ?”
“হ্যা, আপনার?”
“সেই কখন?”
“তাহলে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?”
“তোমার জন্য”……..
[গতরাতে সেহেরীতে উঠা হয় নি। তাই পোস্ট ও করা হয় নি। অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী]
মুশফিকা রহমান মৈথি