আমি তারে দেখেছি পর্ব ১২

0
418

#আমি_তারে_দেখেছি
#১২তম_পর্ব

হেনা বেগম জসীম সাহেবের সম্মুখে বসে রয়েছেন। তার মুখে হাসি। বৃদ্ধার লাল ঠোঁটে হাসিটা মোটেই মানাচ্ছে না। বড্ড বেমানান লাগছে জসীম সাহেবের কাছে। তার সামনে খোসা ছাড়ানো আপেলের টুকরো। হাসপাতালে অন্য কোনো ফল দেবার রীতি নেই। শুধু ঠুসে ঠুসে আপেল খাওয়ানো হচ্ছে। অরুচি হয়ে গিয়েছে তাই আপেলের উপর। হেনা বেগম ও আপেল ই নিয়ে এসেছেন। তার ঠিক পেছনে গা/ধা পুলিশটা পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এত ঘটা করে আসার হেতুটা বুঝে উঠতে পারছে না সে। হেনা বেগম ই নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন,
“আমাকে তোমার এখনও অপছন্দ তাই না জসীম?”

হেনা বেগমের প্রশ্নে খুব একটা ভাবমূর্তির পরিবর্তন হল না জসীম সাহেবের। অন্যদিকে শান্তের চোখখানা ছানাবড়া হল। হবু বেয়াইকে তুমি সম্মোধন করতে আজ অবধি কাউকে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না তার। আপনি আজ্ঞা ছেড়ে একেবারে তুমি? উপরন্তু মাদার বাংলাদেশ যে প্রশ্নটি করেছেন তা ছোটখাটো বো/ম্বের সমতুল্য। অথচ জসীম সাহেবের মুখশ্রী দেখে তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। যেন খুব স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন করেছেন হেনা বেগম। শান্ত আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো নবনীতাকে একনজর দেখল। সেও ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রয়েছে। সুতরাং ধরে দেওয়া যাক ব্যপারটি একা শান্তর কাছে অবাককর নয়। হেনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“কিছুই করার নেই, তুমি পছন্দ কর বা না কর নবনীতা আমার ঘরের বউ হচ্ছে। এবং তোমার আমাকে ইহকাল সহ্য করতে হবে”
“মামার বাড়ির আবদার”
“আবদার বল বা রা/হা/জা/নি বল, এইটুকু অধিকার আমার আছে। আর আমার ছেলে তো কম নয় কিছুতে”
“নিজের নোট ছেড়া হলেও সবাই সেটা কোনো চালিয়ে দিতে চায়। তোমার অবস্থা তেমন হয়েছে”

জসীম সাহেবের কথায় শব্দ করেই হাসলেন হেনা বেগম। মোটামুটি তার অমতকে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“যেমনটা তুমি নিজেকে চালাতে চেয়েছিলে?”

মাদার বাংলাদেশ এবং জসীম সাহেবের কথোপকথনে খটকা লাগলো শান্তর। আনমনেই একটি নিন্দনীয় চিন্তা উঁকি দিল। যদিও ছেলে হিসেবে এমনটা ভাবা নিতান্তই অশোভনীয় কিন্তু মানুষের চিত্তে সর্বদাই নিকৃষ্ট চিন্তাটাই প্রথমে হানা দেয়। তাই অবান্তর চিন্তাটি শান্তর মাথায় এল, কোন সময়ে কি এদের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিল! অর্থাৎ প্রেমঘটিত সম্পর্ক। সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে চিন্তাটিকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল সে। মাদার বাংলাদেশের মত চরিত্রের পক্ষে জসীম সাহেবকে পছন্দ করা অসম্ভব। কিন্তু এটুকু সে নিশ্চিত কেবল সামিয়া ভাবিকে বাগে পাওয়ার জন্য নবনীতাকে পছন্দ করা নয়। কারণটি অন্য।

সামিয়া শান্তর বড় ভাই মারুফের স্ত্রী। কথায় আছে— “এক বনে কেবল একটি রাজাই থাকতে পারে”। কথাটি হেনা বেগমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তার এতদিনের সংসারটি হল তার রাজত্ব। সেই রাজত্বে হুট করে অন্য রমনীর হস্তক্ষেপ তো মেনে নেওয়া যায় না। তাও যদি টক্করের কেউ। সামিয়া মেয়েটি যেমন গুণবতী, তেমন ই বুদ্ধিমতী। সে এক হাতে তার চাকরি সামলাচ্ছে, অন্য হাতে সংসার। কোনো স্থানে কোনো কমতি নেই। কিন্তু সেখানেই সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি হল। সে সর্বদাই হেনা বেগমের সব কথায় বা হাত ডান হাতের সাথে সাথে নিজেও ঢুকে পরে। হেনা বেগম যদি ডানে যেতে বলে সে যায় বামে। হেনা বেগমের সনাতন বা সেকেলে মানসিকতায় সর্বদাই আধুনিকতার যুক্তি টানে। ঠিক একারণেই সে প্রথমে হেনা বেগমের চোখের মণি হলেও এখন চক্ষুশুল হয়ে গেল। যেহেতু মারুফ এবং সামিয়ার বিয়েটি প্রেমের ছিল তাই পণ নিলেন শান্ত জীবনে কিছুতেই প্রেমের আগমণ ঘটতেই দিবেন না। ভাগ্যবশত হলো ও তাই। সারাজীবন নারীসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন শান্তর বিয়ে ঠিক করা হল নবনীতার সাথে। শান্ত শিষ্ট, গোবেচারা টাইপ একটি মেয়ে। যাকে প্রথম দর্শনে শান্তর মনে হয়েছিল, নিরীহ গাভী। তবে হাসপাতালে আসার পর থেকে তার ধারণা বদলে গেছে। হেনা বেগম শুধু নিরীহ বিধায় নবনীতাকে পছন্দ করেন নি। এর পেছনে রয়েছে আরোও একটি অব্যক্ত রহস্য। এই নবনীতা মেয়েটিকে কেন্দ্র করে আর কত কোটি রহস্য আছে তা কেবল স্রষ্টাই জানেন_____

শান্ত উন্মুখ হয়ে আছে রহস্য উন্মোচনের জন্য। কিন্তু তা হল না। হেনা বেগম কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন,
“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। আমি বেশি দেরি করব না। অসুস্থতার ভান দেখিয়ে শুয়ে থাকলে তুমি ব্যতীত ই বিয়ে হবে”
“কি বলতে চাও! আমি ভান করি?”
“তোমার স্বভাব আমার অচেনা নয়। কলেজে কতবার এই অসুস্থতার ভান করে ধরা খেয়েছো মনে নেই? তা কি বয়সের সাথে সাথে ভুলে গিলে নিয়েছ?”

হেনা বেগমের বিদ্রুপ ভীষণভাবে গায়ে লাগল জসীম সাহেবের। তিনি বেশ বিব্রতবোধ করলেন। আরোও লজ্জা পেলেন যখন দেখলেন শান্ত হাসছে। হেনা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। শান্তকে বললেন,
“তুমি কি বাড়ি যাচ্ছো?”
“নাহ, নবনীতাকে কলেজে ছাড়তে যাব”

শান্ত এমন একটা ভাব করলো যেন নবনীতাকে কলেজে দিয়ে আসা তার নিত্যদিনের কাজ। খুব সাবলীল তার মুখোভাব। কিন্তু নবনীতা মোটেই স্বাভাবিক নয়। লোকটির এমন ব্যবহারের সাথে বড্ড অপরিচিত সে। হেনা বেগম ও স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“আচ্ছা”

হেনা বেগমকে গাড়িতে তুলে দিয়েই শান্ত নবনীতার উদ্দেশ্যে বলল,
“চল, ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে”
“আপনি সত্যি আমায় পৌছে দিবেন?”
“মিথ্যে পৌছে কি করে দেয়?”
“আমি ভাবলাম আপনি হয়ত আন্টিকে বাহানা দিয়েছেন”
“তুমি আমায় মিথ্যুক ভাবলে? আমি কি না মাকে মিথ্যে বলব? ছি ছি নবনীতা! এ ঘোর পাপ, আর আমি কি না আমার মায়ের আদর্শ ছেলে হয়ে এমন ঘোর পাপ করবো। এতটা নিচ আমাকে ভাবতে পারলে? কষ্ট পেলাম। আমার হৃদয় চুরমার হয়ে গেল”

শান্তর কথার নাটকীয়তা ধরতে বেশি সময় লাগল না নবনীতার। সে যে এসব তাকে জ্বালাবার হেতুতে বলছে তাতে সন্দেহ নেই। এই লোককে প্রথমে যতটা গুরুগম্ভীর ভেবেছিল তার ছিটেফোঁটাও এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নবনীতা নিঃশব্দে হাসল। বিনা বাক্যে উঠে বসল শান্তর মোটর সাইকেলে। শান্তর কাধে নিজ হাত রাখলো। নরম হাতের স্পর্শটা মন্দ লাগলো না শান্তর। ঠোঁট চিরে প্রশান্তির হাসি উন্মোচিত হল। তারপর স্টার্ট দিলো মোটর সাইকেল। গন্তব্য এখন কলেজ।

*****
শান্তর বাইক থামলো ঠিক নবনীতাদের একাডেমিক বিল্ডিং এর সামনে। ফলে উপস্থিত জনতার চোখজোড়া তাদের দিকেই আটকে গেল। দিনদুপুরে ক্লাসের তথাকথিত সিঙ্গেল রমনী একটি সুঠাম দেহী তালগাছ সম মানুষের বাইক থেকে নামছে ব্যাপারটা তাদের কাছে নতুন একটি আলোচ্য বিষয়। সেই সাথে বহু পুরুষের চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয়ের আর্তনাদও বটে। নবনীতা প্রচণ্ড সুন্দরী না হলেও আকর্ষণীয় বটে। তার চেহারায় সুচিত্রা সেনের একটি ছাপ রয়েছে৷ যা ক্লাসের প্রায় ছেলেদের ই আকর্ষণ করে। তাই তো এক না একবার তার প্রতি নিজের প্রেম নিবেদনটা তারা করেছিলো। সে অন্যব্যাপার নবনীতা ভীষণ বিনয়ী ভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবুও সেই মোহনীয় নারীর পাশে অচেনা পুরুষকে যেন তারা মানতে পারছে না।

সকলের বুভুক্ষু চোখজোড়া বেশ অস্বস্তি লাগছে নবনীতার। তাই ধীর স্বরে বলল,
“আপনি চলে যান”

নবনীতার কথায় অবাক হল শান্ত। বিস্মিত স্বরে বলল,
“কেন?”
“সবাই দেখছে তো”
“তো?”
“অহেতুক কথা বানাবে”
“বানালে বানাবে। তোমার কি?”
“আমাকে নিয়ে তো বানাবে”
“বাহ রে নারী নিজের হবু বরের সাথে কথা রটলেও আপত্তি? আমি কি এতই খারাপ?”

শান্তর কথায় বেশ লজ্জা পেলো নবনীতা। স্বগোতক্তির স্বরে বলল,
“আমি কি তা বলেছি?”
“তাহলে?”
“আমি বলছি যে আমাকে পৌছে দেবার জন্যই তো আসা। সেই কাজ তো সম্পন্ন। এখন আমি ক্লাসে যাব। অহেতুক দাঁড়িয়ে দেখে তো আপনার কাজ নেই। আপনি বরং চলে যান”
“কে বলেছে আমার কাজ নেই? আমার এখানে অনেক কাজ। সেটা না করে তো আমি যাচ্ছি না।”
“কি কাজ?”
“বাহ রে! শিকার করবো না! খু/নী তো এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে…….”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here