আমি তারে দেখেছি পর্ব ১০

0
445

#আমি_তারে_দেখেছি (কপি করা নিষেধ)
#১০তম_পর্ব

শান্তর নির্লিপ্ত প্রশ্নে হতচকিত হল নীলয়। সাথেই সাথেই কাঁচ ভাঙার তীব্র ঝংকার কানে এলো। সামনে তাকাতেই দেখা গেল। নবনীতার হাত থেকে গলগলিয়ে পড়ছে রক্ত। শান্ত সাথে সাথে বসা থেকে উঠে ছুটে গেলো তার কাছে। চায়ের কাপ সহ ট্রেটি পরে গেছে হাত থেকে। সেই ভাঙা কাঁচেই হাত কেটেছে। শান্ত কাছে যেতেই নবনীতা বিড়বিড় করে বলল,
“আমি এবার ও পারলাম না, ওকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু ও শুনল না। শুনল না আমার কথা”

নবনীতার প্রলাপের মাত্রা বাড়ল। তার হাত থেকে র/ক্ত পড়ছে কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। এমন কি এটাও ভুলে গেলো সেখানে নীলয় ও আছে। নবনীতা শান্তর মুখের দিকে চেয়ে অসহায় স্বরে বলল,
“আমি ওকে বলেছিলাম। ও বিশ্বাস করেনি”

শান্ত তার কথা উপেক্ষা করে পকেট থেকে রুমাল বের করে চেপে ধরলো মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত হাত। বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটির তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সাদা রুমালটি নিমিষেই রঙিন হল লোলিহ বর্ণে। শান্ত নিজের শক্ত রুক্ষ হাতে আগলে রাখল আ/হ/ত হাতটি। চোখে অস্থিরতা। যেন এই ক্ষত তাকে বড্ড বিচলিত করছে। এদিকে বিড়বিড় করে বলা কথাটা নীলয়ের শ্রবণেন্দ্রিয় এড়ালো না, সে বিস্মিত স্বরে বলল,
“কাকে সাবধান করার কথা বলছিস? দোলার মৃ/ত্যু তুই জানতি?”

নীলয়ের দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকাল নবনীতা। তার চোখে মুখে অব্যক্ত আতংক। কিছু বলার পূর্বেই নিপুন হাতে শান্ত সামলে নিলো ব্যাপারটা। খানিকটা জোরালো স্বরেই বলল,
“সি ইজ ব্লিডিং, এখন অহেতুক কথা বলার সময় নাকি তাকে ফাস্ট এইড কিভাবে তাড়াতাড়ি দেওয়া যায় সেটা ভাবা উচিত”

নীলয় কিঞ্চিত লজ্জিত হল। সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“মেডিসিন কোথায়?”

শান্তর কণ্ঠ নবনীতার ঘোরে ছেদ ঘটাল। নিজেকে কোন মতে সামলে বলল,
“রান্নাঘরের বা সাইডের দ্বিতীয় কেবিনেটে”

নীলয় সেদিকে যেতেই শান্ত রুমালটি সরিয়ে দেখলো র/ক্ত/পাত কমলো কি না! তারপর গাঢ় স্বরে বলল,
“এত বেখেয়ালি একটা মানুষ কি করে হতে পারে?”
“সরি, হুট করে কথাটা মস্তিষ্ক নিতে পারে নি। ভুলেই গিয়েছিল নীলয় রয়েছে। আর হবে না।”
“আমি সেটা বলি নি। আমার চিন্তা বেখেয়ালিতে নিজের স্বপ্নের কথা ওই চো/রা ছেলেটিকে বলা নয়। আমার চিন্তা তোমার এই চোট নিয়ে। বেখেয়ালিতে এই যে হাতটা কেটে গেল খুব ভাল হল এতে? কতটা গভীর ভাবে কেটেছে, ইশ! শুনেছি বয়স নাকি বাইশ। তাহলে আ/বু/দ্দার মতো আচারণ কেন?”

শান্তর কথা অবাক করল নবনীতাকে। সে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা শ্যাম পুরুষের দিকে। লোকটির চোখে মুখে চিন্তার রেশ, তাও শুধু মাত্র নবনীতার জন্য। গত দুদিন যাবৎ তাকে কেমন ই ছ্যাবলার মত লেগেছে, অহেতুক কারণে রসিকতা। অহেতুক কারণে ফাজলামি, ছ্যাবলামি। কিন্তু এখন তেমন লাগছে না। আচ্ছা সিরিয়াস অবস্থায় কি সব পুরুষদের ই এতটা মোহনীয় লাগে! নবনীতার সম্বিত ফিরল নীলয়ের কথায়। সে ব্যস্ত গলায় বলল,
“হাতটা দেখি। রক্ত বন্ধ হয়েছে?”

শান্ত তার অযাচিতভাবে দরদ দেখানোতে বিরক্ত হল। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি নবনীতার হাত থেকে রুমালটি খুলে অবহেলায় ফেলে দিলো মেঝেতে। তারপর হেক্সাসল দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্তটুকু মুছে দিলো যত্নের সাথে। এরপর স্যাভলন লাগিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,
“গভীর ভাবে কেটেছে। একটা টিটেনাস নিয়ে নিস”
“কাচে কাটলেও টিটেনাস দিতে হয় প্রথম শুনলাম”

তীক্ষ্ণ স্বরে কথাটা বলল শান্ত। নীলয় কিছু বলার পূর্বেই নবনীতা বলল,
“আমি ঠিক আছি। অহেতুক চিন্তায় ফেলানোর জন্য সরি”
“নীতু, নিজের ইনহিউম্যান ভাবা বন্ধ কর। সবাই চোট পায়, সবাই আ/হ/ত হয়, যন্ত্রণা হয় সবার হয়। সেটা প্রকাশ করা দোষের নয়। তাই এই রোবট হওয়াটা বন্ধ কর”

নবনীতা নিজের ক্ষতবিক্ষত হাতের দিকের তাকাল। তার সত্যি এই ক্ষত এর যন্ত্রণা উপলব্ধি হচ্ছে না। যে যন্ত্রণা সমস্ত হৃদয় জুড়ে বিস্তৃত তার সামনে এই সামান্য রক্তক্ষরণ ছেলেমানুষ মাত্র। শান্ত নবনীতাকের বাহুধরে মেঝে থেকে তুলল। সোফায় বসিয়ে নীলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন তোমার বাড়ি যাওয়া উচিত। রাত অনেক হয়েছে। আর নবনীতার রেস্টের প্রয়োজন”
“আর আপনি?”
“আজ এখানে কাঁথা কম্বল পেতে বসার ইচ্ছে আছে। আপত্তি আছে তোমার?”

শান্তর কথা শুনে নবনীতার চোখ বিস্ফারিত হল। এই লোক আজ সত্যি এখানেই ঘাঁটি গাড়বে? পাগল নাকি? নবনীতা কিছু বলার আগেই শান্ত তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার হবু শ্বাশুড়ি মায়ের আদেশ। আমি আবার আদেশ পালনে এক্সপার্ট। আর মাদার বাংলাদেশের আদেশ তো শিরোধার্য। তাই আজ এখানে থাকছি”

নবনীতা তর্কে গেল না। এমনিতেই আজ মনটা বড্ড দূর্বল। দোলার মৃত্যু মানতে পারছে না সে। কেন যেন নিজেকে দোষি মনে হচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে নিলেই হয়তো বিপদ কেটে যেত। আফসোস তেমনটা হল না____

*******

নীলয়কে বাহির অবধি ছাড়তে এল শান্ত। ছেলেটিকে তার প্রচুর সন্দেহ হচ্ছে। অহেতুক বটেই তবে ছেলেটির চোখে মুখে সন্দেহের লক্ষণ আছে। তাই ভনীতা না করেই শুধাল,
“দোলার খু/নের কথাটা শুনতেই চমকে উঠেছিলে কেন?”

শান্তর প্রশ্নে নীলয় খানিকটা অস্বস্তিবোধ করল। আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আমি শুনেছি সেটা আ/ত্ম/হ/ত্যা, তাই খু/ন শুনতেই চমকে গিয়েছিলাম। দোলা সত্যি খু/ন হয়েছে? তাহলে মিডিয়াতে যে বলল……”
“আমরা মিডিয়াতে ব্যাপারটা খোলাসা করি নি। কিন্তু তুমি সত্যি জানতে না এটা খু/ন?”
“নাহ, সত্যি জানতাম না”
“তাহলে এই রাতে নবনীতার বাড়িতে আসার হেতু কি?”

শান্তর চোখের তীক্ষ্ণ সন্দেহ আরোও বেশি বিব্রত করছে নীলয়কে। সে যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। শীতল বাতাসেও তার কপালে ঘাম। গলা শুকিয়ে আসছে তৃষ্ণায়। কিন্তু শান্তর চোখে যেন ধরা না পড়ে তাই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি। এতেও এত প্রশ্ন? আপনি তো এখন ই খবরদারি করছেন। না জানি বিয়ের পর কি করবেন? আমি বুঝলাম না নীতু কি দেখে আপনাকে পছন্দ করলো? কোথায় তুষার ছিল, আর কোথায় আপনি?”

নীলয়ের মুখে অন্য পুরুষের নাম শুনতেই অবাক হল শান্ত। বিস্মিত স্বরে শুধাল,
“কে তুষার?”

নীলয় উপলদ্ধ করল সে এমন কিছু বলে বসেছে যা বলা উচিত হয় নি। এখন কথা ঘুরাবার স্থান ও খুঁজে পাচ্ছে না। শান্ত আবার ও শীতল স্বরে শুধাল,
“তুষার কে?”
“নবনীতার থেকেই জেনে নিয়েন। আমি বলতে পারব না”

বলেই হনহন করে হাটা শুরু করল নীলয়। শান্তকে কিছু বলার সুযোগ ও দিলো না সে। এদিকে শান্ত শান্ত চিত্ত অশান্ত হয়ে উঠল। “তুষার” নামক অদৃশ্য, অচেনা মানুষটি তাকে বক্ষস্থলের শান্তিটাকে মুহূর্তেই নাড়িয়ে দিল। এটা কি কেবল ই কৌতুহল ছিল নাকি অন্যকিছু জানে না শান্ত। তবে এই রহস্যটাও পর্দাচ্যুত করবে সে______

********

খাবার টেবিলে একেবারে সাধারণ খাবারের আয়োজন। আড়ম্বরতার ছিটে ও নেই। মা থাকলে যে ক্ষেপতেন তার সন্দেহ নেই। কিন্তু শান্ত ই বলেছে সে নাকি মাছে ভাতে বাঙালি নয়, আলু ভাতে বাঙালি। তাই তো গরম ভাত, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর ঘি দেওয়া হয়েছে। এবং মদনমোহন তর্কালংকার তা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন ও। এক এক লোকমা মুখে তুলছেন আর বলছে,
“অমৃত”

নবনীতা বুঝল না, এই সাধারণ খাবারে অমৃতের কি কাছে। নবনীতার সামনে কফি। খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেছে। দোলার মৃত্যুটি খুব ই রহস্যজনক। তাকে মে/রে ফ্যানের সাথে ঝু/লি/য়ে দেওয়া হয়েছে অথচ ওই সময় বাহিরের থেকে কেউ ভেতরে যায় নি। অদ্ভুত। নবনীতা যখন চিন্তায় বিভোর তখন শান্তর কণ্ঠ কানে এল,
“আচ্ছা, এই তুষার টা কে?……………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here