হবু বউকে থানায় বসে থাকতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেলো শান্ত। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বহুসময়। মেয়েটি সাব ইন্সপেক্টর ইরশাদের সম্মুখে বসে রয়েছে। জবুথবু মুখশ্রী, চোখ মুখে বিভৎস ভয়। মেয়েটির হাতের মাঝে পৃষ্ট হচ্ছে তার ওড়নার ত্রিকোন। শান্ত হাবিলদার সোহেলকে ডেকে নিভু গলায় শুধালো,
“নীল সালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েটি এখানে কেনো এসেছে?”
“স্যার, আজ সকালের যে আ/ত্ম/হ/ত্যার কেসটা আসছে না, ঔডার জন্য উনারে ডাকা হইছে”
“ওটার জন্য কেন?”
“ব্যাটার সুসাইড নোটে ম্যাডামের নাম লিখে রাখছিলো তো। তাই তো ইরশাদ স্যারে উনারে ডাকছে”
সোহেলের কথা শুনতেই কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো শান্ত এর। দৃষ্টি তীর্যক হল। নবনীতা, তার জীবনের একমাত্র রহস্যময়ী। রহস্যময়ী মানুষের সাথে সর্বদাই রহস্যের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। কিন্তু ইহজীবনেও ভাবতে পারে নি রহস্যটা মৃত্যু সংক্রান্ত হবে। আজ প্রাতঃকালে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ডিআইজি আজমল মাহমুদের কলে। ফোনটি ধরতেই বুড়ো মানুষটির শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠ কানে ভেসে উঠে,
“শান্ত, কোথায় আছো? তাড়াতাড়ি বুড়িগঙ্গার কাছে আসো”
“জি স্যার?”
“জি স্যার হ্যা স্যার পরেও করতে পারবে আপাতত বুড়িগঙ্গায় আসো”
চোখ কচলে উঠে বসলো শান্ত। সাথে সাথেই তীক্ষ্ণ ব্যাথা মস্তিষ্ককে দূর্বল করে তুললো। খানিকটা বিরক্তিও লাগলো। বিয়ে জনিত মহা মূল্যবান ঘটনার জন্য সে দশদিনের ছুটিতে আছে। তবুও ডিআইজি সাহেবের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। তিনি সকাল সাতটায় তাকে ঘুমথেকে তুলে বলে “বুড়িগঙ্গায় আসো”। শান্ত গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর মুখ ঘষতে ঘষতে বলল,
“কেনো স্যার?”
“সাতার প্রতিযোগিতা করবো। আরে বেটা কাজ আছে তাই তো আসতে বলছি। জেলা প্রশাসক সাহেবের ছোট ছেলে আ/ত্ন/হ/ত্যা করেছে। কেসটা তোমাকেই নিতে হবে”
বলেই খট করে ফোন রেখে দিলেন বান্দা। লোকটি পদে ডিআইজি হলেও শান্তের মনে হয় সে আসলে তার ছেড়া পাবলিক। শুধু তার ছেড়া নয় তার গুনে গুনে চৌষট্টিটা তার ছেড়া। নেহাত তার প্রয়াত বাবার বন্ধু, তাই আজমল সাহেবের সাথে তার সখ্যতা অনেক। সখ্যতা হওয়ার যতটা ভালো দিক আছে খারাপ দিক তার থেকে দ্বিগুন রয়েছে। তাই তো ছুটিতে থাকা স্বত্তেও শান্তকে তার মূল্যবান ঘুমের জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ছুটে যেতে হচ্ছে বুড়িগঙ্গা।
বুড়িগঙ্গার উপরে ভাসমান এক নৌকার মাঝি আজ ভোর বেলায় একটি যুবকের লা/শকে ফুলে ফেপে উঠতে দেখে আতংকিত হয়ে পড়ে। ফলে উপায়ন্তর না পেয়ে ফোন ঘোরায় থানায়। লা/শটি তীরে আনতেই জানা যায় এটি আর কেউ নয় বরং জেলা প্রশাসক মামুন আর রশিদের ছোট পুত্র নিয়ন। রীতিমতো শহরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তাই তো ডিআইজি স্যারকেও সব ফেলে ছুটে আসতে হয়।
নিয়নের লা/শটি সূক্ষ্ণ ভাবে বিবেচনা করার পর পুলিশের মাথায় হাত পরে। সারা দেহে মশা কামড়ের ও আচড় নেই। অথচ মামুন সাহেবের এক বাক্য তার ছেলেকে কেউ খু/ন করেছে। ইনভেস্টিশন অফিসার হিসেবে এএসপি আরেফিন শান্তের বেশ সুনাম পুলিশ ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। আজ অবধি মোট বাইশটি কেস সে সলভ করেছে। ত্রিশ বছরের ক্ষুদ্র সময়ে এটা বিশাল একটি কৃতিত্ব। তাই তো আজমল সাহেবের বিশ্বাস এই কেস শান্ত ই সমাপ্ত করতে পারবে। শান্ত বহুবার বুঝাতে চাইলো,
“স্যার আমি ছুটিতে আছি। অন্যরাও তো আছে”
“নাহ! এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেস। তাই এটা তুমি ই নিবে। এবং রহস্যের সমাধান করবে”
“কিন্তু স্যার আমার বিয়ে”
“আরে রাখো বিয়ে, মেয়ে গেলে মেয়ে পাবে কিন্তু মেডেল জিতার সুযোগ গেলে সেটা পাবে না। আর তুমি হচ্ছো টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম গায়। তোমার দশ বছর পরও বিয়ে হলে সমস্যা হবে না”
শান্ত মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখলো। এই পাগলের সাথে কথা বলে লাভ নেই, এ বুঝবার নয়। এখন মাদার বাংলাদেশ বুঝলে হয়_____
শান্ত এগিয়ে টেবিলের কাছে গেলো। ইরশাদ তাকে দেখতেই বলল,
“স্যার কিছু বলবেন?”
“উনার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে কেবিনে পাঠিয়ে দিও”
নবনীতা চোখ তুলে একবার চাইলো শান্তের দিকে। শান্তের মুখপানে চাইতেই তার বিষন্ন চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। ভীত কন্ঠে বলল,
“আমি বাড়ি যাবো”
শ্যাম মুখে গড়িয়ে পড়লো এতো সময়ের জমে থাকা বিষাদসিন্ধুর বিন্দু। দূর্বল কায়া এখনো কাঁপছে। গোলাপ পল্লবের ন্যায় নিটোল অধর নড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। শান্তের মনটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেলো। কেনো হলো জানা নেই। হয়তো মেয়েটিকে অসহায়ের মতো দেখতে ভালো লাগছে না। অবশ্য হবে না কেনো? মেয়েটিকে এর পূর্বে যখন দেখেছিলো তখন সে ছিলো কাশফুলের ন্যায় চঞ্চল। এখনো মনে আছে চার মাসের আগের ঘটনা।
মাদার বাংলাদেশ অর্থাৎ হেনা বেগমের চরম অত্যাচার এবং ঘ্যানঘ্যান থেকে মুক্তি পাবার জন্য অবশেষে বিয়ে নামক ঘন্টাটি গলায় ঝুলাতে সম্মতি প্রদান করে শান্ত। ফলে নিজ থেকে গুনে গুনে আট বছর ছোট একটি মেয়েকে দেখাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বসুন্ধরা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাকে এবং কনে একটি নির্জন ঘরে বন্দি করা হয় কথা বার্তার জন্য। সেখানেই প্রথম বারের মতো শান্তের পরিচয় হয় তার হবু সহধর্মিনীর সাথে। শান্ত নিপুন ভাবে মেয়েটিকে অবলোকন করে বহু সময়। ভেবেছিলো মেয়েটি অতিশয় নরম গাভীর মতো নিরীহ। কিন্তু মূহুর্তেই তার সকল ধারণা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় যখন কানে আসে,
“আমাকে বিয়ে করলে আপনি হবেন বাংলাদেশের ভাগ্যবানদের একজন। কারণ আমার মধ্যে একটি সুপারপাওয়ার আছে। আমি স্বপ্নে যা দেখি তা বাস্তবে ঘটে। ”
চায়ের প্রথম চুমুক মুখে তুলতেই বিষম খেলো শান্ত। খকখক করে কেশে নিলো মিনিট দুয়েক। কোনো মতে নিজেকে সামলালো। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকালো সামনে বসে থাকা সাদাসিধে গড়ণের শ্যামবর্নের মেয়েটির মুখশ্রীতে। মেয়েটির নাম নবনীতা। অনেক সময় তাকিয়ে থাকার পরও মেয়েটির মুখভাব বদলালো না। এখনো তার গাম্ভীর্য অমলিন। তার মুখোভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে কি মজা করছে নাকি সিরিয়াস। মজা করে থাকলে মেয়েটি উন্মাদ। আর যদি সিরিয়াসভাবে বলে থাকে তবে সে বদ্ধ উন্মাদ। শান্ত কিছু বলতে যাবার আগেই মেয়েটি ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“মজা করছি না। সত্যি বলছি। অনেক প্রমাণ আছে। ধরুন আমি দেখলাম, আপনি মর্নিং ওয়াক করতে গেছেন আর একটা কুকুর আপনার পশ্চাতে কামড় দিয়েছে সেটা সত্যি ঘটবে”
নবনীতার কথায় ভ্রু কুচকে গেলো শান্তের। সে তীর্যক দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখছে। মেয়েটি হাসছে, কি উদ্ভট হাসি! নবনীতা আবারো হাসি থামিয়ে বললো,
“আগে মনে করতাম ঘটনাগুলো কাকতালীয় কিন্তু আসলে না। এটা আমার সুপ্ত সুপার পাওয়ার। আমি স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দেখি”
শান্তের হুট করেই সাধাসিধে গড়নের নিরীহ গাভীর ন্যায় নারীকে মনে হতে থাকলো ধূর্ত খেকশিয়াল। মেয়েটির স্বচ্ছ চোখের মাঝে উঁকি দিচ্ছে অজস্র অব্যক্ত রহস্য। মা শেষমেশ কিনা খুঁজে খুঁজে একটা পাগল মেয়েকে পছন্দ করলো! শান্ত বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“মজা করার জায়গা পেলেন না? নাকি আজকের মুরগী আমি”
“বিশ্বাস করলেন না তো। কেউ করে না। কিন্তু যখন বাস্তবের মুখোমুখি হয় তখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। আচ্ছা, আপনাদের তো গত পরশু আসার কথা ছিলো! এলেন না কেন? আসবেন কি করে আপনার বাইকটা যে চুরি গেছে।”
নবনীতার শীতল কন্ঠের কথাটা শুনতেই মস্তিষ্কে ঝংকার উঠলো শান্তের। এই কথাটি তো কেউ জানে না। এমন কি মাও না। তাহলে মেয়েটি জানলো কি করে! নবনীতা হাসছে, ভয়ংকর সুন্দর সেই হাসির দমক। সুন্দর জিনিস কি সর্বদাই ভয়ংকর হয়? কে জানে! শান্ত যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন তখন ই নবনীতা দ্বিতীয় বারের মতো তাকে চমকে দিয়ে বলল,
“আমি কিভাবে জানলাম ভাবছেন তো? আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। আচ্ছা বাইকটা গতকাল বিকেলে পেয়েছেন তাই না? বাংলামটরস এর মোড়ে”
শান্তের মুখে বিমূঢ়তা। সে কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। সে সত্যি গতকাল বাংলামটরস এর মোড়ে বাইকটি পেয়েছিলো। কিন্তু এই ঘটনা সে এবং তার কলিগ ইরশাদ ছাড়া কেউ জানে না। মেয়েটি কি করে জানলো? জানতেই পারে, হয়তো সে স্টক করছিলো তাকে। শান্তের শান্ত মস্তিষ্ক নিমিষেই স্থির হলো। নিউরণের রেষারেষি থেমে গেলো। বেশ শীতল স্বরে বলল,
“চমকে দেবার পদ্ধতি ভালো ছিলো। কিন্তু ম্যাডাম আমি পুলিশ, যুক্তি খাটিয়ে কেস সমাধান করি। তাই এসব চালাকি আমার সাথে না”
নবনীতা হাসলো। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ হাসি। সেই সাথে বা গালে টোল পড়লো। সাথে দেখা গেলো তার গ্যাজদাঁত। গ্যাজদাঁতের মেয়েদের হাসলে মুক্তো ঝরে। এতোদিন বই এ পড়েছিলো আজ দেখছে। নবনীতা হাসি থামিয়ে বলল,
“বিশ্বাস অবিশ্বাস মানুষের ব্যাক্তিগত। তাই আমি জোর করবো না। তবে যাবার সময় গাড়িটা সাবধানে চালাবেন। আজকাল বাইক ওয়ালা গুলো স্ট্যান্টের নামে হুটহাট ঠুকে দেয়। আর একটি কথা আমি শুধু স্বপ্নে ভবিষ্যত ই দেখি না, সেটা কিঞ্চিত পরিবর্তন ও করতে পারি। কিন্তু সেটা অতীব সামান্য, তাই সাবধান”
তখন মেয়েটির কথা আমলে না নিলেও শান্ত সত্যি ই দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলো। সত্যি একটি বাইক তাদের গাড়িতে ঠুকে দিয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যবশত হেডলাইট ভাঙ্গা ছাড়া আর কিছুই হয় নি। নয়তো দূর্ঘটনাটি মারাত্মক রুপ নিলে গাড়ি ফ্লাইওভার থেকে পড়ে যাবার ও সম্ভাবনা ছিলো। দূর্ঘটনাটি ঘটার পর বার বার নবনীতার কথাগুলো মস্তিষ্কে ভাসছিলো শান্তের। এটা কি শুধু কাকতালীয় ঘটনা নাকি মেয়েটি সত্যি বলছিলো! কিন্তু সেই রহস্যের সমাধান ঘটাতে পারে নি সে। কারণ হবু বধুর রহস্য সমাধানের চেয়ে শহরের খু/নি, ডা/কাত ধরা বেশি জরুরি। ফলে মাদার বাংলাদেশ যে তার বিয়েও পাকা করে ফেলেছে সেটাও সে জেনেছে সপ্তাহ খানেক। চারমাস পর আজ মেয়েটিকে দেখছে। তাও থানায়। ভাবতেই অবাক লাগছে।
নবনীতার সামনে চায়ের কাপ। ঠান্ডা হয়ে গেছে চা। শান্তের কেবিনে জবুথুবু হয়ে বসে আছে সে। লম্বা মেয়েটি পিঠ বাকিয়ে বসায় খুব ই ছোট লাগছে। শান্ত ফাইলটা এক নজর দেখতে দেখতে বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“এই মৃত্যু কি স্বপ্নে দেখেছিলে?”
“এটা খু/ন”
নবনীতার কথা শুনতেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো শান্তের। কপালে ভাঁজ গাঢ় হলো। সে তো বাজিয়ে দেখছিলো। কিন্তু তার উত্তরে অবাক না হয়ে পারলো না। অবাক স্বরে বলল,
“খু/ন? তুমি জানলে কি করে?”
“কারণ আমি তারে দেখেছি”…………
চলবে
{নতুন কনসেপ্ট, নতুন এক্সপেরিমেন্ট। আপনাদের সাপোর্ট চাই। জানাবেন কমেন্টে। শান্ত নবনীতাকে কেমন লাগলো? আমার লেখা প্রথম বইটি পেয়ে যাবেন বুকশেলফ.কম এ}
#আমি_তারে_দেখেছি
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি