#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-১০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
অল্প শোকে মানুষ কাতর হয়। আর অধিক শোকে হয় পাথর। আচ্ছা, পাথরের চাইতেও শক্ত কি হতে পারে? প্রিয়াঞ্জনার জানা নেই। সে স্তব্ধ হয়ে নিজের ঘরের ফ্লোরে বসে আছে। তার মুখ অত্যধিক লালবর্ণ। সিলেট থেকে ফিরার সময় সারাটা পথ সে কেঁদেছে। তীব্র মাথা যন্ত্রণায় ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছিলোনা। বাস থেকে নামার সময় প্রায় মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলো। শাহবাজ ধরে ফেলায় রক্ষা। নয়তো রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়তো। শরীর ভিষণ দুর্বল থাকায় কি হচ্ছে না হচ্ছে ঠিকভাবে বুঝেও উঠতে পারছিলোনা প্রিয়াঞ্জনা। বাসায় আসার পর যা হলো! এই পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে। মুখ ফুটে একটা কথা প্রতিবাদও করতে পারেনি। শাহ্কে ভাই আঘাত করেছে। তার চোখের সামনে! সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠে প্রিয়াঞ্জনা। দু’হাতে ঢেকে ফেলে মুখ। এতটা অসহায় শাহ্কে তো সে কখনোই দেখেনি। একাই যে লোক তার জন্য বখাটেদের সাথে লড়েছিলো সে লোক এখন কতটা নিষ্প্রাণ। আগের শাহবাজ চৌধুরী গর্জন করতো বাঘের মতো। মন ম রে গেলে শরীরও নিস্তেজ হয়ে যায়। প্রতিবাদ করতে না পারার কষ্টে ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে প্রিয়াঞ্জনার। প্রিয়াঞ্জনা বিড়বিড় করে,
“আল্লাহ তুমি তো বিপদগ্রস্ত অসহায় ব্যক্তির দু’আ তাড়াতাড়ি কবুল করো। আমার দু’আটাও কবুল করো আল্লাহ। আমি যেন আমার শাহ্ এর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করতে পারি। আজ আমার জননী ভরা মজলিসে আমার স্বামীকে অপমান করেছে আল্লাহ। আমার ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে তুমি তো জানো। তুমি তাকে ভুল প্রমাণ করে দাও আল্লাহ।”
দরজায় টোকা পড়ে। জোহরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রিয়াঞ্জনাও ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। জোহরার সাথে প্রীতম, প্রবীরও দাঁড়িয়ে।
“প্রিয়া, দরজা খোল।”
প্রিয়াঞ্জনা ভাবলেশহীন ভাবে দরজার পানে তাকায়। এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছে তার নেই। এই বাড়ির সবাইকে তার বিরক্ত লাগছে। ভাবীকে তো সে বিশ্বাস করেছিলো। ভাবীও এমন করলো! আর কাউকে বিশ্বাস করবেনা প্রিয়াঞ্জনা। কাউকে না। বারবার দরজায় টোকা পড়ছে।
“প্রিয়া, দরজা খোল। আমি কিন্তু ভেঙে ফেলবো।”
প্রীতম দরজায় লাথি দিয়ে চিৎকার করে বলে। প্রিয়াঞ্জনার গলা বসে গেছে। আওয়াজ বের হচ্ছেনা। তবুও দরজার কাছে এসে ক্ষীণ সুরে বলল,
“অনেক নাটক হয়েছে। এই রাতের বেলা আর নাটক করো না। তোমাদের টেনশন নেওয়ার কারণ নেই।
ম র বো না আমি। আমি ম র লে তো তোমার আমেরিকা যাওয়া হবেনা। তাই না ভাইয়া?”
প্রীতম খানিক থতমত খায়। এই খবর প্রিয়া জানলো কি করে! নিশ্চিত সুমনা বলেছে। আজ সুমনার রক্ষা নাই। এটা ঠিক মায়ের সাথে তাল মেলানোর বড় একটা কারণ হচ্ছে ফাহিমের লোভনীয় অফার। ফাহিম বলেছে প্রীতমকে আমেরিকা নিয়ে যাবে। ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে। প্রীতম অনেকদিন যাবতই বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কোনোক্রমেই হয়ে উঠছেনা। ফাহিম বিদেশে সেটেল্ড। খুব ভালোভাবেই সেটেল্ড। বোনের মাধ্যমে যদি বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে ক্ষতি কি! জোহরা বেগম অবশ্য এ বিষয়ে জানেন না। তিনি ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। প্রীতম কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
“তুই আবোল-তাবোল কথা বাদ দিয়া দরজা খোল।”
প্রিয়াঞ্জনা উচ্চস্বরে বললো,
“সবাই এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাবে। নয়তো খুব খারাপ কিছু করে ফেলবো।”
প্রীতম কিছু বলতে যাচ্ছিলো প্রবীর বাঁধা দিলেন। জোহরা বেগমকে খাবার দিতে বলে তিনি বারান্দায় চলে গেলেন। সিগারেট ধরাবেন। জোহরা প্রীতমকে কিছু বলার আগেই সে নিজের ঘরে চলে এলো।
পৃথিবীতে সবাই নিজের স্বার্থকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। তাহোক পরিবারের লোকজন। প্রিয়াঞ্জনাকে শাহ্ এর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে নিজের জেদ পূরণ করতে চাইছেন জোহরা। অথচ তিনি বোঝাচ্ছেন এই কাজটি তিনি করছেন সন্তানের ভালোর জন্য। শাহদাত চৌধুরীর সন্তানকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়াই তার মূল লক্ষ্য। ভাইটা ছিলো তার কলিজার টুকরা। কেবল ভাইয়ের পড়াশোনা চালাতে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। স্বামীর এক টাকাও ভাইয়ের পিছনে খরচ করেন নি। যে ভাইকে জন্মের পর থেকে আদরে আদরে মানুষ করেছেন সেই ভাই তার আত্ম’হ’ত্যা করেছে। এক তুচ্ছ নারীর জন্য। যে নারী কিনা ছিনিয়ে নিয়েছিলো শাহদাত চৌধুরী। জোহরা সামনে পেলে তাকে খু ন করতেন। সেই লোকের সন্তানকে তিনি মেয়ের জামাই করেছেন। শাহবাজকে দেখলেই তার র’ক্ত মাথায় উঠে যেতো। মেয়ের কাছে হার মেনে ছিলেন তিনি। কিন্তু এবারের সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন না। বাবার শাস্তি না হয় পুত্রই পাক!
প্রীতম ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকালো। চমকে উঠে সুমনা। দ্রুত চোখ মুছে নেয়। বিছানা থেকে উঠার আগেই প্রীতম তার চুলের মুঠি ধরলো।
“প্রিয়া আমার আমেরিকা যাওয়ার খবর জানলো কেমনে?”
এমন আকস্মিক ঘটনার জন্য সুমনা একটুও প্রস্তুত ছিলোনা। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। প্রীতম ধমকে উঠলো।
“চুপ! ঘরের খবর বাইরে বলার খুব শখ না তোর!”
“ছাড়ো প্রীতম।”
“মা গী। আজকে তোকে আমি কঠিন শাস্তি দিবো।”
“এইসব শিখাও তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের! ওরা তোমার এই রূপ সম্পর্কে জানে?”
“মুখে মুখে তর্ক করিস না সুমনা।”
“তুমি অনেক পাল্টে গেছো প্রীতম! তোমার এমন
জা নো য়া র রূপ আছে আগে জানলে আমি জীবনেও বিয়ে করতাম না তোমাকে।”
চুলে আরো টান পড়ায় কুঁকড়ে উঠে সুমনা। এখন প্রীতম তাকে আদর করবে। কিন্তু এই আদর ভয়ংকর আদর। অনেকে বলে ম্যারিটাল রে’প।
“প্লিজ না প্রীতম। আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আর বিশ্বাস করো আমি প্রিয়াকে কিছু বলিনি।”
প্রীতম সুমনার কথা শুনেনি। অসংখ্য আঘাতে সুমনা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। শরীর অসার হয়ে পড়ে তার। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষ’ত। দীর্ঘ সময় পড়ে সুমনাকে ছাড়ে প্রীতম। কানের কাছে আস্তে করে বলে,
“প্রিয়াঞ্জনার বিনিময়ে আমি বিদেশ যাবো এই কথাটা যেন কারো কানে না যায়। নয়তো তোমার আরো খারাপ অবস্থা করবো জান।”
এই পৃথিবীতে কত বিচিত্র মানুষের বসবাস!
________________
“আমাকে চিনেছেন?”
বেঁটে ধরনের এক লোক। পরনে নীল পাঞ্জাবি। প্ল্যাটফর্মের লাইটের আলোতে চিকচিক করছে তার টাক মাথা।
“ঠিক চিনতে পারিনি। বসুন, চা খাবেন।”
লোকটি বসলেন।
“চাচা কি দুধ চা খাবেন?”
“খাওয়া যায়।”
বেশ রাত হয়েছে। স্টেশনের জমজমাট ভাবটা আবার কমে গেছে। এখন কেবল নিস্তব্ধতা চারপাশে।
“দিলু, দুকাপ দুধ চা দাও।”
নয় বছরের ছেলেটা হেসে বললো,
“দিতাছি, ভাইজান।”
লোকটি বললেন,
“আমি বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। আপনার বাবা এককালে আমাকে পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করেছিলেন। আর্থিক সাহায্য। এখন আমি শিবপুরে সরকারি শহীদ আসাদ কলেজে শিক্ষকতা করছি। শেখের চড়ে আপনার দোকানে গিয়েছিলাম একদিন। আপনার মনে হয় খেয়াল নেই।”
দিলু দুকাপ দুধ চা দিয়ে গেলো।
“ক্ষমা করবেন, আমার সত্যিই খেয়াল নেই।”
“সমস্যা নেই শাহবাজ। আপনি ব্যস্ত মানুষ। আর আমি আপনার সাথে দেখা করেছিলাম সে কত বছর আগের কথা! এখন কেমন যাচ্ছে দিনকাল? এত রাতে স্টেশনে কি করছেন?”
“তেমন কিছু না।”
শাহবাজ কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। তার জীবন সীমাবদ্ধ ছিলো বসুন্ধরা টু শেখের চড়। আবার শেখের চড় টু বসুন্ধরা। হঠাৎ একটা ঝড়েই তো সব তছনছ হয়ে গেলো। বদরুজ্জামান ভূঁইয়া নামক লোকটির মোবাইল বেজে উঠলো।
“হ্যালো, শিবু।”
অপর পাশে কি বললো শোনা গেলো না।
“আচ্ছা, ভালো শিক্ষক পেলে জানাবো।”
ফোন পাঞ্জাবির পকেটে রেখে লোকটি বললেন,
“আমার বন্ধু কয়েকজন মিলে শিবপুরে একটা প্রাইভেট কলেজ খুলেছে। কিন্তু আজকাল ভালো শিক্ষক কি আর পাওয়া যায় বলুন তো। আমাকে বলছে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খুঁজে দিতে।”
“কি বিষয়ের শিক্ষক?”
“পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এসবই।”
“আপনার নাম্বারটা দেন চাচা। আমার জানা একজন ভালো শিক্ষক আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স করেছে।”
“সে কি আর এতদূরে গিয়ে শিক্ষকতা করবে?”
“করবে চাচা, বিপদে পড়লে মানুষ সবই করে।”
______________
প্রীতি সকালবেলা প্রিয়াঞ্জনাকে ডেকে তুললো। তার মোবাইলটা প্রীতম ফেরত দিয়েছিলো।
শাহবাজ কল করেছে। গলা বসে যাওয়ায় স্বর পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে প্রিয়াঞ্জনার।
“আসসালামু আলাইকুম, প্রিয়াঞ্জনা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন শাহ্?”
মাথায় আঘাত লাগার ব্যাপারটা প্রিয়াঞ্জনা জানেনা। শাহবাজও জানালো না।
“খুব কান্না করেছো তাই না?”
“আপনি আমাকে নিয়ে চলুন শাহ্। আমি আর এখানে থাকবো না।”
“সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর কয়েকটা দিন। তারপর আমরা দূরে চলে যাবো প্রিয়াঞ্জনা।”
“শাহ্…
“হুম?”
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।”
(চলবে)….