চাঁদের কলংক শেষ পর্ব

0
2160

#চাঁদের_কলংক ( ১৬) সমাপ্তি
#রেহানা_পুতুল
” এই নাম্বারের মেয়েটি এক্সিডেন্ট করেছে আরেকটি মেয়ে সহ। দ্রুত সদর হাসপাতালে চলে আসুন।”

কথাগুলো বলেই অপরপাশের লাইন কেটে গেল। অচেনা পুরুষ কন্ঠ শুনেই,
শয়নের গগনবিদারী চিৎকারে মির্জাভবন ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠল যেন। ছুটে এলেন সবাই। হুড়মুড়িয়ে শয়নের সামনে গিয়ে পড়ল তার বাবা,মা ও শেফালী।

শয়ন পাগল পাগল কন্ঠে জানাল,
” তন্দ্রা ও শায়না এক্সিডেন্ট করেছে।”

কামরুল মির্জা ব্যথাতুর চিত্তে বললেন, “কান্নার সময় নয় এটা। দ্রুত হাসপাতালে চল।”

তারা ওভাবেই উঠানে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। শয়ন কোনরকমে ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়ি ছেড়ে দিল। শেফালী দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। শাহিদা বেগম ম্যাড়ম্যাড়ে গলায় ফোন দিয়ে তন্দ্রার মাকে জানালেন। আল্লাহর নাম জপতে জপতে পুরো পথ এলেন। কামরুল মির্জা তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে সদর হাসপাতালে চলে যেত বলল। রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে হবে।

অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ভবনে পৌঁছে গেল। তন্দ্রার মা বাবা বোনসহ আরো লোকজন উপস্থিত হয়ে গেল। সরকারি নামকরা হাসপাতাল এটা। শয়ন ও তার বাবা এ হাসপাতালের সবই চিনে। শয়ন তন্দ্রার নাম্বারে ফোন দিলে সেই একই ব্যক্তি ফোন রিসিভ করে ওয়ার্ড নং বলে দিল।

কামরুল মির্জা তার পরিচিত দুজন ডাক্তারকে ডেকে আনলেন অনুরোধ করে। বললেন একটা কেবিনের ব্যবস্থা যেন করে দেয়। তার মেয়ে ও পুত্রবধূর সর্বোচ্চ উন্নত চিকিৎসায় যেন কোন গাফলতি না করে। সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাগুলো ভালো হলেও ডাক্তারদের মাঝে গড়িমসি ভাব চলে।

ওয়ার্ডের দুই বেড়ে দুই ননদ ভাবি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। বুঝতে পারল সবাই পার্লারে যাওয়ার পথেই ঘটনা ঘটেছে। নয়তো তন্দ্রার বধুসাজ থাকতো এখন। পরনে থাকত জামাকাপড়ের বদলে শাড়ি।

শয়নসহ তারা সবাই সিটের কাছে যেতেই কর্তব্যরত দুজন ডাক্তার রেগে গেল। রুক্ষ স্বরে বলে উঠল,
রোগীরা মারা যায় আপনাদের জন্যই। মাত্র একজন এখানে থাকেন। বাকি সবাই বারান্দায় চলে যান বলছি। ইমিডিয়েটলি ‘ ও পজেটিভ ‘ ব্লাড যোগাড় করেন তিন ব্যাগ। দ্রুত যান।

শয়নদের পরিবারের কারো সাথেই রক্তের গ্রুপ মিলছেনা। তন্দ্রার বাবার সাথে মিলেছে। তিনি দিলেন এক ব্যাগ মেয়ের জন্য। আর দুই ব্যাগ পরিচিত দুজন থেকে নেওয়া হয়েছে।

শয়ন আধমরার মতো পড়ে আছে কাত চিৎ হয়ে বারান্দায়। বাকিরাও বসে আছে তার পাশে। সবাই কেবলই দুহাত তুলে আল্লাহর করুণা প্রার্থনা করছে। সমস্ত দৌড়ঝাঁপ করছে শয়নের বাবা, তার শশুর ও অন্যান্যজনেরা।

পত্যক্ষদর্শী পথচারী লোকটাকে বিধ্বস্ত স্বরে শয়ন জিজ্ঞেস করলো,
” ভাই কিভাবে হলো এক্সিডেন্ট?”

সে সব খুলে বলল এবং শায়না ও তন্দ্রার সুস্থতা কামনা করে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

রাত বেড়ে গভীর হয়ে গেল। সেই ডাক্তার কেবিন ঠিক করে দিল। শায়না ও তন্দ্রাকে স্ট্রেচারে করে কেবিনে নিয়ে আসা হলো। তাদের জ্ঞান ফিরে এলো। স্যালাইন চলছে৷ ডাক্তার জানাল শায়নার গুরুতর কিছুই হয়নি। পায়ের চামড়া অনেকখানি ছিঁড়ে গিয়েছে। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। একদিন পরেই সে বাসায় চলে যেতে পারবে। শুনে সবাই আল্লাহর দরবারে আবারো কৃতজ্ঞতার হাত তুলল। শয়ন বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। শাহিদা বেগম মেয়ের শিয়রের পাশে বসে আছেন বিদীর্ণ মুখে।

আর তন্দ্রার অবস্থা কিছুটা ক্রিটিক্যাল। তবে আশংকামুক্ত। রিকসা থেকে উপুড় হয়ে পড়েছে। তাই হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছে। অপারেশন করে জোড়া দিতে হবে। সেটা কাল সকালে।

শয়নসহ সবার জানে পানি এলো শুনে।
তন্দ্রার জ্ঞান ফিরে এলেও তাকানোর শক্তিটুকুও তার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। মাথার কাছে তার মা বোন বসে আছে। কেবিনে এতজন থাকা যাবেনা। তাই কেউ কেউ চলে গেল। কেবিনে রয়ে গেল শায়নার মা, শয়ন,তনু,রাহেলা। পুরুষ একজন লাগবেই প্রয়োজনে।

পরেরদিন তন্দ্রার হাঁটুর অপারেশন হয়। শরীরের অনান্য অংশেও ছোটখাট জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এক সপ্তাহ হাসপাতালে ডাক্তারদের অবজারভেশনে রাখতে হয়েছে তন্দ্রাকে। শায়না একদিন পর বাসায় চলে যেতে পেরেছে।

এক সপ্তাহ পরে হাসপাতাল থেকে আজ তন্দ্রাকে রিলিজ নিয়ে বাসায় আনা হলো। প্রিয়জনদের সেবায়, যত্নে,মমতায় তন্দ্রা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। তবে হাঁটুর সমস্যা রয়েই গেল। সারতে সময় লাগবে। ডাক্তার মেডিসিন বুঝিয়ে দিল শয়নকে। অন্তত তিনমাস হাঁটুর উপরে চাপ পড়বে এমন কাজ হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর একমাস থেরাপি দিতে হবে। ব্যায়ামতো মাস্ট করতেই হবে।

শাহিদা বেগম দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন পুত্রবধূর জীবন ফিরিয়ে পেয়েছেন বলে।

শায়নার রুমে নিয়ে তন্দ্রাকে শুইয়ে দেয়া হলো। কারণ তাদের রুম এখনো ফুলে ফুলে ভরা। সেদিনের পর হতেই শয়ন আর সে বিছানায় ঘুমায়নি। হাসপাতালে রয়েছে। এবং বাসায় ঘুমিয়েছে সে হলরুমের সোফায়। রুমে তালা দিয়ে রেখেছে শয়ন।

তন্দ্রা নিজেদের রুমে যেতে চাইল। নয়ন ভরে দেখতে চাইল তার জন্য সাজানো বাসরের ফুলগুলো এখনো ওভাবে আছে কিনা। শয়ন তন্দ্রাকে আস্তে করে ধরে ধরে নিয়ে গেল নিজেদের রুমে। দরজা বন্ধ করে দিল। একটি চেয়ারে আরাম করে বসিয়ে দিল তন্দ্রাকে।

তন্দ্রা স্থানুর মতো অপার মুগ্ধতা নিয়ে শুকিয়ে যাওয়া মৃত ফুলগুলোর দিকে চেয়ে রইলো। ফ্যালফ্যাল চোখে শয়নের মুখপানে চাইল। নিরীহ করুণ কন্ঠে বলল,
যার ভাগ্যে বাসর নেই। যার বাসর ঘর ভেঙ্গে যায় তাসের ঘরের মতো। তার বেঁচে ফেরাই বা কেন। দূর আকাশের চাঁদের মতো দূরেই চলে যেতাম। তাই বোধহয় ভালো হতো।

শয়ন তন্দ্রার মাথাকে আলতো করে নিজের প্রশস্ত বুকটায় চেপে ধরল। প্রেমময় কন্ঠে বলল,
” অমন বলনা বালিকা। একবার ভাব আমার কি হতো। তুমি আমার মাটির বুকের আস্ত একটা সোনালী চাঁদ। তুমি চাঁদটার মাঝে যত কলংক, যত দাগই থাকুকনা কেন, আমার কাছে তুমি নিষ্পাপ! নিষ্কলংক। আমি তোমার আলোয় প্রজ্জ্বলিত হতে চাই প্রতিমুহূর্তে। আমি তোমায় একমুহূর্তও ক্ষয়ে যেতে দেবনা। তোমার হাঁটু ভালো হয়ে গেলে আমি আবার এমন করে বাসর সাজাবো। ”

” আমাকে একটু উঠিয়ে ফুলসজ্জায় মাঝে বসিয়ে দিবেন? ”

শয়ন দুইহাতে তন্দ্রাকে আলগোছে তুলে নিল। বিছানার মাঝ বরাবর বসিয়ে দিল। তন্দ্রা শুকিয়ে যাওয়া সুগন্ধিহীন ফুলের লতাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। শয়ন ও উঠে গিয়ে বিছানায় তন্দ্রার পাশে বসল।

” এগুলো পরিষ্কার করা হয়নি কেন?” জিজ্ঞেস করলো তন্দ্রা।

” তোমাকে দেখানোর জন্যই রেখে দিয়েছি বউ আমার। যে বিছানায় তোমার উষ্ণতায় ঘুমানোর সাধ ছিল আমার। সেই বিছানায় তুমি ছাড়া আমি ঘুমাই কি করে। তুমি না ফিরে এলে আর কোনদিনও এই খাটে এই বিছানায় আমি ঘুমাতামনা। ”

শয়নের কথা কর্ণকুহুরে যেতেই অশ্রুবাণে তন্দ্রার দুচোখ ভরে টইটম্বুর হয়ে গেল বরষার ভরা বিলের মতো। অবোধ শিশুর মতো শয়নের দিকে চেয়ে রইলো।
অনুনয়ের সুরে বলল,
” আমার বউ সাজা হয়নি। তাই ফুলগুলোও শুকিয়ে গেল। শয়ন আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমাই? ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ”

শয়ন দেয়ালে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসল দুই পা লম্বা করে মেলে রেখে। তন্দ্রা হাঁটু ভাঁজ করে শয়নের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। শয়ন তন্দ্রার এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলোকে কানের পাশে গুঁজে দিল। চুলের ভাঁজে ভাঁজে নিজের পাঁচ আঙ্গুল গলিয়ে দিল। বিলি কাটতে লাগল অনবরত।

ধীর গলায় বলল,
” এই প্রথম তুমি নাম ধরে ডাকলে। তুমি বলে সম্বোধন করলে। আগে কতবার চেয়েছি একটিবার শয়ন বলে ডাক। একটিবার তুমি বলে ডাক। তুমি দুষ্টমিষ্ট হাসি দিয়ে বলতে,বাসর রাতে বলব। এখন পারবনা। আহ!কি যে ভালো লাগছে এখন আমার বালিকা। তিনমাস নয় কেবল। সারাটিজীবন আমি প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে পারব তোমাকে একান্তে পাওয়ার জন্য। শয়ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তন্দ্রার মুখের উপর। দেখল ঘুমের ঘোরে ডুবে গিয়েছে তার সেই ছোট্ট বালিকাটি। ”

দরজায় টোকা মেরে শায়না গলা বাড়িয়ে ডাক দিল,
” ভাইয়া ভাবির মেডিসিন খেতে হবে৷ দরজা খোল। ”

” আমিতো নড়তে পারছিনা। তোর ভাবি আমার কোলে ঘুমিয়ে আছে।”

” নিজে শুয়ে আছ। সেটা বললেই হয়। উঠাও ভাবিকে। জলদি।”

শয়নের দরাজ কন্ঠে তন্দ্রার ঘুম ছুটে গেল। শয়ন কৌতুক করে শায়নাকে আরো কিছু বলতে যাবে। অমনি তন্দ্রা শয়নের মুখ চেপে ধরল হাতের তালু দিয়ে। ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে বলল,
” তুমি এত বেকুব হলে কবে থেকে?বউ কোলে শুয়ে আছে সেটা বোনকে বলছ। শেইম! শেইম! ”

শয়ন মুখের উপর থেকে তন্দ্রার হাত নামিয়ে নিল। সেই নরম হাতের পিঠে নিজের উষ্ণ অধরযুগল ঢলতে লাগল ডানবাম করে ।

ভালোবাসা অমর! অক্ষয়! শয়ন তন্দ্রার ভালোবাসার পবিত্র মুহুর্ত বিলীন হতে লাগল অনন্তকালে।

👉সমাপ্তি ( শেয়ার ও মন্তব্য কাম্য। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। গল্পটির স্যাড এন্ডিং দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। আপনাদের আবদারে অনুরোধে হ্যাপি এন্ডিং দিয়ে আপনাদের হ্যাপি করলাম। নতুন গল্প আসবে সহসাই। ভালোবাসায় রাখবেন।💚🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here