চাঁদের কলংক পর্ব ১৫

0
1571

#চাঁদের_কলংক ( ১৫)
#রেহানা_পুতুল
শয়ন নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিলেও ঝুঁকেছিল তন্দ্রার মুখের উপরে। তন্দ্রা চোখ মেলেই নিজের ঠোঁটের উপর হাত বুলাল। অনুভব করতে পারল শয়নের স্পর্শ। ক্ষীন স্বরে পানি চাইল খাওয়ার জন্য। শয়ন পানি খাওয়াল তন্দ্রার মাথা তুলে ধরে। তন্দ্রা উঠে বসল।
ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করলো,
” কি করেছেন আপনি আমাকে?”

” আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারলামনা। বিয়ে না হলেই বোধহয় ভালো হতো। আগে দুজনে দূরে থেকেও হৃদয়ের কাছাকাছি ছিলাম নিবিড়ভাবে। আলিঙ্গনে। উষ্ণতায়। আর এখন কাছাকাছি থেকেও দূরে আছি। হয়ে আছি অচেনার মতন। যাইহোক। তুমি কথার মাঝে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে। তাই কিছু একটা করতে হয়েছে। ”

লজ্জায় তন্দ্রার সারামুখ রক্তজবার মতো রাঙা হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে মুখ ঢেকে ফেলল দুইহাত দিয়ে। নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগছে তার। শয়ন বুঝতে পারল।
সে তন্দ্রার দুহাত চেপে ধরল যত্ন করে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তন্দ্রার দিকে চেয়ে বলল,
” তোমাকে হারানোর চেয়ে কাউকে খু’ন করাও আমার কাছে সহজ মনে হয়েছে। আমি আদিলকে মেরে ফেলেছি তন্দ্রা। যখন স্যালাইন চলছিল। আমি অতি গোপনে তার স্যালাইন অফ করে দিয়েছি। আমি সারাজীবনের জন্য খুনি হয়ে গেলাম। তবুও তোমাকে চাই তন্দ্রা। নয়তো ও বেঁচে ফিরলে তোমাকে মেরে ফেলতো। এটা চরম সত্যি। আমি তোমাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে নিঃস্বাস ও নিতে পারবনা তন্দ্রা। ভালোবাসা যেমনি মহান। তেমনি নিষ্ঠুর। আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য খুনি হতেও এক মুহুর্ত ভাবিনি তন্দ্রা। এছাড়া আর কিভাবে তোমাকে ভুল করে ভুল বুঝে দেওয়া যন্ত্রণার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারতাম। তুমিই বলনা। ”

শয়নের গলা ভার হয়ে এলো। ভেজা গলায় আরো বলল,
“আমি নিঃশ্ব তোমাকে ছাড়া। আমার প্রতিটি রাত কাটে সিগারেটের ধোঁয়ায় আর চোখের অশ্রুতে। তোমার উপর আমার কোন ক্ষোভ নেই। সন্দেহ নেই। ভুল বুঝাবুঝি নেই। বরং বিনাকারণে তোমাকে বিয়ের রাতে সকল আনন্দ হতে বঞ্চিত করেছি। নিজেও বঞ্চিত হয়েছি। আমাকে আর কষ্ট দিওনা প্লিজ। আর একা রেখনা। ফিরে এসো আমার ভুবনে আমার সেই বালিকাটি হয়ে। বলতে বলতে তন্দ্রাকে বুকে লেপ্টে নিল শয়ন। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ”

পাহাড়ের মতো অবিচল থাকা শয়ন এই মাঝ নিশিতে ডানা ভাঙ্গা ডাহুকের মতো আহাজারি করছে। তন্দ্রা বিষ্পোরিত নয়নে শয়নকে আকূল হয়ে দেখল আর ভাবল। আমার জন্য শয়ন প্রতিটিমুহুর্তের একটা আত্মগ্লানি সঞ্চয় করে নিল। যা কিনা জনমভর তাকে পোড়াবে। ও সত্যি বলেছে। আদিল তো আমায় হুমকিই দিল। বেঁচে ফিরলে আমাকে মেরে ফেলবে। শুধু কি আমাকেই। আমার পুরো পরিবারকে ছারখার করে দিত। সত্যিইতো। বাবা যে বলল শয়ন আমার জীবনদাতা। একদম তাই। এজন্যই বাবা এত রাগ হয়েছে আমার উপর। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তন্দ্রা নিচু গলায় মিনমিনিয়ে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমার জন্য আজ আপনি খুনি। কিন্তু সেই রাতে নিজের সর্বনাশের প্রতিশোধ যদি নিজ হাতে না নিতাম। তখন না নিজে স্বস্তি পেতাম। না আপনার ভুল ভাঙ্গতো। আপনি বলেন আমি কি করতে পারি আপনার জন্য?”

” তন্দ্রার পেলব অঙ্গখানি ছুঁয়ে বলল শয়ন,আমি শধু তোমাকে চাই। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে চাই। তুমি আমার হাজার রাতের চাঁদ। তোমার মাঝে কোন দাগ নেই। কোন কলংক নেই। তোমার মায়াবি আলোচ্ছটায় আমি ভুলে যেতে চাই ওই সামান্য দাগ ও কলংকের কথা। যদি কখনো ভুল করে মনে পড়ে যায়। ধরে নিব সেটা আমার দৃষ্টিভ্রম। নয়তো আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। তোমার উপর আমার আর কোন অনুযোগ, অভিযোগ নেই। তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে এমন হাজার বাসর রাত উপহার দিব। প্রমিজ। ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিব তোমার শয়ন শয্যা। তুমি দেখে নিও। ”

” আপনি আর মন খারাপ করে থাকবেন না একদম। অনেক রাত হয়েছে। ওরা কি ভাববে। আমি এখন যাই। ”
” চলে যাবে? ”

প্রেমিক হৃদয়ের ব্যকুল আর্তিতে তন্দ্রার ভীষণ মায়া লাগল। তবুও রইলোনা। শয়নের দিকে চেয়ে বলল,
“হুম চলে যাব। বললেন না ফিরিয়ে দিবেন আমার স্বপ্নের বাসর রাত। সেই রাতেই উজাড় করে বিলিয়ে দিব নিজেকে আপনার মাঝে।”

” সত্যিই বলছ প্রিয়তমা? ”
তন্দ্রার কোমর চেপে ধরে বলল শয়ন।

” হুম সত্যিই। হাজার সত্যিই। লক্ষ কোটি সত্যি। ”

তন্দ্রা ধীর নিঃশব্দ পায়ে চলে যায় শয়নের সামনে থেকে। শায়নার পাশে গিয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়ে। শয়নের জন্য তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। নিরপরাধ একজন মানুষ স্ত্রীকে বাঁচাতে মেরে ফেলল একজন রেপিস্টকে! গোপনে হত্যার দায় মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকবে সারাজীবন! হায় খোদা! হায় নিয়তি! একি নির্মমতায় ভরে গেল আমাদের দুজনের জীবন।

পরেদিন সকালেই শয়নের মন ফুরফুরে হয়ে গেল। তার পরিবর্তিত আচরণে শাহিদা বেগম,কামরুল মির্জা,শায়না আনন্দিত হলো দারুণভাবে। তনুর সাথেও নানান দুষ্টমি মজা করে সময় কাটাল শয়ন। তিনদিন হয়ে গেলে তনু চলে যেতে জোরাজোরি করলো।

শয়ন নিজ থেকেই বলল,
” মা আমি তনুকে দিয়ে আসি? আর উনাদের সাথেও দেখা করে আসি। বিয়ের পর হতেতো যাওয়াই হয়নি কারণবশত।”

” আলহামদুলিল্লাহ বাবা। খুব ভালো হয় তাহলে। খুবি ভালো হয়। উনারা অনেক খুশি হবে তুই গেলে।”

তনু সাথে সাথে লুকিয়ে তার বাবাকে মেসেজে জানিয়ে দিল শয়ন যাওয়ার কথাটা।

” আমি যাব মা? বলল তন্দ্রা।”

” তোমাকে নিয়ে আমি একসাথে যাব পরে। এখন তনুকে দিয়ে আসি।”
বলল শয়ন।

তন্দ্রা বিনা বাক্যব্যায়ে স্বামীর কথা মেনে নিল।

বিকেলে তনুকে নিয়ে শয়ন শশুর বাড়ি গেল। গাড়ি বোঝাই ছিল অনেক ফল ফলাদি,মিঠাই,বড় মাছ আরো অনেককিছু। তাহের উদ্দীনও তখন বাড়িতে ছিল।

শয়ন মার্জিতভাবে তাদের সালাম দিতেই বাঁধভাঙা আনন্দে তাদের চোখে অশ্রুতে টলমল হয়ে গেল।

কুশলাদি বিনিময় শেষে তনুকে দিয়ে বাহারিপদের নাস্তা পাঠিয়ে দিল রাহেলা। শয়নকে দেখতে বাড়ির অনেকেই এলো তাহের উদ্দীনের ঘরে। সবাই শয়নকে দেখে তাহের উদ্দীনকে বলল,
জামাই পাইছ একখান। তোমার তো রাজ কপাল।

শয়ন শাশুড়ীকে হেসে বলল,
” মা এত পিঠাপুলি,এত কিছু কখন করলেন? ”

” তনু আমাকে জানাল তুমি আসবে।”

“তনু কাজটা ঠিক করনি মায়ের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়ে।” বলল শয়ন।

” ইসসরে। পরে আমার জামাইও এসব খাবার থেকে বঞ্চিত হবে। আম্মু বলবে আমার বড় মেয়ের জামাইর জন্য অতিরিক্ত কিছুই বানায়নি। তোর জামাইর জন্যও করবনা। আম্মুর অভ্যাস করাতে হবেতো।”

” মা শুনলেন ওর কথা। কি কঠিন ফন্দী। ”

রাহেলা বেগম হেসে ফেললেন,
” তোমার সাথে মজা করছে বাবা।”

শয়ন অনেক কিছুই খেল শাশুড়ীর হাতে বানানো। পরে চলে যেতে চাইলে তারা আসতে দিলনা। রাতে খেয়ে যেতে বলল। শয়ন ও রয়ে গেল অবাধ্য না হয়ে।

তাহের উদ্দীনের রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে রান্না হচ্ছে নানান পদের। শয়নকে নিয়ে তনু তাদের বাড়ির চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখাল। তাদের অনেক ফলের গাছ রয়েছে। শয়ন আতাফল গাছ থেকে লাফিয়ে একটা আতাফল ছিঁড়ে নিল। তনুকে নিয়ে ভাগ করে খেল।

রাত হয়ে গিয়েছে। শয়ন নৈশভোজ সেরেই শশুর শাশুড়ীর থেকে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। এশার নামাজ শেষে মোনাজাতে হাত তুললেন রাহেলা। সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ায় মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন।

শয়ন তাদের বাসায় ঢুকল। শেফালীকে ডাক দিয়ে গাড়ির ভিতর থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো আনতে বলল।

শেফালী সব রান্নাঘরে নিয়ে গেল। তন্দ্রা, শায়না,কামরুল মির্জা,শাহিদা বেগম দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন খাবারগুলো,
শেফালী চোখ কপালে তুলে একে একে সব খাবারের বক্স উম্মুক্ত করতে লাগল।
“ও আল্লাগো আল্লাহ। খালাম্মা দেখেন কতকিছু দিল মজার মজার।”

তন্দ্রা দাঁড়ানো থেকেই শাশুড়ির দিকে চেয়ে,
” মা এটা আমাদের পালা মুরগীর মাংস। এটাতে আমাদের পুকুরের রুই মাছ। ডিম ও আমাদের পালা হাঁসের ডিমের। পুডিং ফিরনি আমাদের বাড়ির একজনের পালা গরুর। পিঠাগুলো আমাদের ক্ষেতের আতপ চালের গুড়ির। ”

আপা এত ঝামেলা করে কি দরকার ছিল দেওয়ার। বললেন শাহিদা বেগম।

” এমন দিতে হয় মেয়ে বিয়ে দিলে। নাগো ভাবিজান।” চকচক মুখে বলল শেফালী।

” তুই বেশি বকবক করিস। সব টেবিলে নিয়ে আয়। তোর খালু খেয়ে ঔষধ খাবে।”

সবাই গল্পগুজবে আয়েশ করে সময় নিয়ে তন্দ্রাদের বাড়ির পাঠানো খাবাগুলো দিয়েই ডিনার সারল।

পরেরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পর শায়না মা বাবাকে বলল,
” বিয়ের রাতে যারা বাসর ঘর সাজিয়েছে। তারা আজ বিকেলে আসবে। কাঁচাফুল দিয়ে আবার ভাইয়ার রুম সাজাবে। ভাইয়া তাদের ফোন দিয়ে বলছে। আর ভাবিকে নিয়ে আমি বিকেলে পার্লারে যাব। বউ সাজিয়ে আনার জন্য। সবকিছু সেইম বিয়ের দিনের মতোই হবে ভাইয়া বলছে। ভাইয়া আমাকে বলছে তোমাদের জানাতে। নিজে সংকোচে বলতে পারছেনা। ”

” আলহামদুলিল্লাহ। এতো আনন্দের কথা। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর থাকলে সেই সংসারে ফেরেশতাদের রহমত নাযিল হয়। ”

স্বস্তির দম ফেলে বললেন শাহিদা বেগম।

তন্দ্রাকে ডেকে নিল শয়ন নিজের রুমে। দরজা আটকে দিল ভিতর থেকে। বলল,
” সুন্দর করে শাওয়ার নিবে। চুলে শ্যাম্পু মাখবে বেশি। যেন নাক ডুবিয়ে সুগন্ধি নিতে পারি। বিকেলে পার্লারে যাবে। সেইম বিয়ের দিনের মতো নববধুরূপে আজ রাতেই পেতে চাই। লোক এসে বিকেলেই বাসর সাজিয়ে দিয়ে যাবে। ”

” কি বলছেন? আজ রাতেই কেন। দুই একদিন পার হোক। একটি ইজি হই।”

লজ্জাবনত মুখে দৃষ্টি নামিয়ে বলল তন্দ্রা।
” আমি ছাড়া ইজি হবে কেমন করে বালিকা। অপেক্ষা যে কি কষ্ট দেয় বোঝাই কেমনে। এই নিশিকে করব উতলা, পেলে তোমাকে নিরালা।”

বলেই শয়ন তন্দ্রার ঘাড়ে ঠোঁট চেপে ধরল। এদিক এদিক ঠোঁট নিতেই তন্দ্রা বিদুৎশকের মতো কেঁপে উঠল। শয়ন বুঝতে পেরে কিছু ঠোঁট সরিয়ে নিল। হাতের পিঠ দিয়ে তন্দ্রার গালে আদুরে স্পর্শ দিলে। দুচোখের পাতায় কোমল চুমু খেল। তন্দ্রা এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল।

তন্দ্রা সন্ধ্যায় রিকশায় করে পার্লারে গেল শায়না সহ। দামী পার্লারটা একটু দুরেই। রিক্সায় যেতে যেতে সুখ সুখ মনে অনেক গল্প করল শায়নার সাথে।

সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকারকে সঙ্গী করে ফুলে ফুলে শোভিত ফুলসজ্জা তৈরি হয়ে গেল। দেয়ালে আর্ট করে লিখা, স্বাগতম ‘ শয়ন ও তন্দ্রার ফুলসজ্জা।’

শয়ন চেয়ারে বসে অপলক চোখে ফুলসজ্জার বিছানা দেখছে ও সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। মোবাইল বেজে চলছে। শয়নের ঘোর ভাঙ্গল। হাত বাড়িয়ে রিসিভ করলো। তন্দ্রার ফোন।

“হ্যালো বালিকা এনি প্রবলেম? ”

” এই নাম্বারের মেয়েটি এক্সিডেন্ট করেছে আরেকটি মেয়ে সহ। দ্রুত সদর হাসপাতালে চলে আসুন।”
কথাগুলো বলেই অপরপাশের লাইন কেটে গেল।

অচেনা পুরুষ কন্ঠ শুনেই,
শয়নের গগনবিদারী চিৎকারে মির্জাভবন ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠল যেন। ছুটে এলেন সবাই।

চলবেঃ ১৫ ( শেয়ার ও মন্তব্য কাম্য।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here