#চাঁদের_কলংক ( ১৪)
#রেহানা_পুতুল
” জেনে রাখ। আদিল মরে গেল বলেই তুমি বেঁচে আছ। আদিল নেই বলেই তুমি এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছ। আদিল চলে গেল বলেই তুমি এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে।”
কথাগুলো বলেই দ্রুত লম্বা লম্বা পায়ে শয়ন রুম থেকে বের হয়ে যায়।
তন্দ্রা ঠায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার চোখে চেয়ে রইলো শয়নের চলে যাওয়ার পানে।
দপ করে খাটের এক কোনে বসে পড়ল। শত প্রশ্ন তার হৃদয়খানিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। তবে কি আদিলের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলনা? সে রাতে কি আমাকে অন্যকেউ দেখে ফেলেছে? তাহলে সেদিক হতে কোন সমস্যা হচ্ছেনা কেন? সেই মেসেজ আর ভিডিও ক্লিপটা কি আজো কারো হাতে পড়েনি? নাকি প্রিয়জন হারানোর শোকে সবাই উম্মাদ হয়ে আছে। তার মোবাইল, ল্যাপটপ খোলার প্রয়োজন মনে করছেনা কেউ? শয়নকে বা বাবাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করা কি সমীচীন হবে?
টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় তন্দ্রা। এলোমেলো পায়ে চলে যায় শায়নার রুমে। বারান্দায় গিয়ে খোলা আকাশপানে উদাস চোখে চায়। ভেসে বেড়ানো পুঞ্জীভূত রাশি রাশি ধূসর মেঘের আনাগোনা চলছে। এক দল অচেনা পাখি দলবদ্ধ হয়ে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। একলা একটি চিল পাখি আকাশের মাঝ বরাবর অনেক উপর দিয়ে দু ‘ ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে গোল হয়ে বৃত্তাকারে । পাশের বাসার ছাদ বাগানে মালি পানি দিয়ে যাচ্ছে আপন মনে গাইতে গাইতে। সফেদা ফল গাছের সরু শাখায় শাখায় কিছু চড়ুই পাখি চিউ চিউ রবে কলরব তুলছে। ছাদে দাঁড়িয়ে ছোট কিছু ছেলেমেয়ে রঙিন ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দে ব্যস্ত হয়ে আছে৷ এসবকিছুই তন্দ্রার প্রচন্ডরকম ভালোলাগার দৃশ্য। কিন্তু তবুও তার মনকে ফেরানো যাচ্ছেনা সেই বিভীষিকাময় দহন থেকে।
শয়ন বাবা মায়ের রুমে গেল। তেজী গলায় জানিয়ে দিল,
” বাবা, মা,আমি সামনের সপ্তাহে চলে যাব।”
“তিনমাস হতে এখনো বাকি আছে যে?”
নরম গলায় বলল তার মা।
” এমন কোন নিয়ম আছে? সময়ের আগে যাওয়া যাবেনা? এই মেয়ের সাথে এক ছাদের নিচে থাকাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
তেজী কন্ঠে বলল শয়ন।
তার কারণ কি, তা জিজ্ঞেস করে শয়নের বিরক্তি বাড়াতে চাইলনা তার বাবা মা। তাই দুজনেই সে বিষয়ে নিজেদের বিরত রাখল।
” এককাজ করিই। বউকে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দিই। তোর তিনমাস পূর্ণ হলেই যাস তুই। সে না হয় তারপরেই আসবে। সে এমন কথা আগেই বলেছে আমাদের। ভোটের কারণে আমিই তাকে আনিয়েছি। ”
ঠান্ডা মেজাজে বলল কামরুল মির্জা।
” তার দরকার নেই বাবা। এখানে আমার অলস সময় কাটে। সেখানে আমার যত ব্যস্ততা। কোন যন্ত্রণা স্পর্শ করবেনা আমাকে। আমি চলে যাওয়াই বেটার হবে।”
” তুই যা ভালো মনে করিস। তাই কর। ”
” আচ্ছা বাবা” শয়ন চলে যায় বাইরের দিকে।
কামরুল মির্জা ও ছেলের পিছন দিয়ে উঠে গেলেন। শাহিদা বেগম বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। শেফালি তার কাজে ব্যস্ত। শায়না তনুকে নিয়ে পাশের বাড়ি আড্ডা দিতে গেল।
শায়নার রুমে গিয়ে কামরুল মির্জা পুত্রবধূকে ডাক দিলেন।রুমের ভিতরে।
” বাবা কি হয়েছে?”
” শয়নের সাথে নতুন করে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তোমার?”
বিরস কন্ঠে জানতে চাইলেন তিনি।
শশুরের এমন জিজ্ঞাসায় তন্দ্রা লজ্জিত বোধ করল। আড়ষ্ট স্বরে বলল,
” বাবা কই তেমন কিছুই হয়নি।”
তিনি রেগে গেলেন। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলেন,
” কিছু না হলে সে এক সপ্তাহ পরেই দেশ ছাড়তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন? তোমার জন্য নয় কি? তারমতো স্বামীর পায়ে পড়ে থাকা উচিত তোমার। কারণ সে তোমার জীবনদাতা। মনে রেখ। নইলে এতদিনে তোমার কবর ঘাসে ছেয়ে যেত। কেমন মেয়ে তুমি? স্বামীর মন ভালো করতে পারনা? আনন্দে রাখতে পারনা? দিনকে দিন আমার ছেলের মনকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছ! তার একরাতের শাস্তি প্রতিমুহূর্তে দিচ্ছ। আমি বাবা হয়ে আর না বলেও পারছিনা। কারণ আদিলের বিষয়ে তোমার শাশুড়ী, শায়না কিছুই জানেনা। তারা জানে এক্সিডেন্ট করেছে। মারা গিয়েছে। ব্যাস।”
” বাবা আমার কি দোষ। উনিতো…”
থামিয়ে দিলেন তিনি তন্দ্রার বাক্য শেষ না হতেই।
কর্কশ কন্ঠে আদেশ দিলেন,
” আমি চাই শয়ন আনন্দ নিয়ে দেশ ছাড়ুক। এবং নিদিষ্ট সময়েই যাক। তার একদিন আগেও নয়। বাকিটা তুমি ডিসাইড করবে৷ ”
” বাবা তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু উনি কিভাবে আমার জীবনদাতা?”
অসহায়ের সুরে কন্ঠকে খাদে নামিয়ে জানতে চাইলো তন্দ্রা।
” সেটা আজ রাতেই শয়ন থেকে জেনে নিবে।”
এই বলে উনি ভারি ভারি পা ফেলে চলে গেল উঠানের দিকে। আজ তন্দ্রার উপর উনি ভীষণ মনঃক্ষুন্ন হলেন। এটা তন্দ্রা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছে।
তন্দ্রার সারা শরীর অসাড় হয়ে এলো। বিছানার উপরে আলগোছে নিজেকে রাখল। নড়ার শক্তিটুকু নিঃশেষ হয়ে আসল যেন। বাঁধ ভাঙ্গা অশ্রুরা নিরবে গড়িয়ে পড়তে লাগল অবিরাম ধারায়। নিস্তেজ হয়ে আসা আঁখিপল্লব দুটো বুঁজে এলো।
তনু শায়নার সাথে বাইরে ছিল বিধায় বিষয়টা অবগত হলনা৷ সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হলো। তবুও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলনা। রাতে সবার খাওয়া শেষে সামান্য ভাত খেল ক্ষুধা নিবারণ করতে না পেরে।
শায়না ও তনু ঘুমাতে এলে তন্দ্রা বলল,
” আমি একটু তোমার ভাইয়ার রুম থেকে আসি। কথা আছে তার সাথে। দরজা বন্ধ করে দিওনা তুমি। আমি দেরি হলেও তোমার সাথেই ঘুমাব।”
শায়না আচ্ছা বলে মাথা ঝোঁকাল মাত্র। এর বেশি কিছু জানার বা শোনার কৌতুহলবোধ করলনা। তনুর সাথে খোশগল্পে মত্ত সে। তনুও বোনের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলোনা তাকে। তাদের মনোমালিন্য চলছে শুরু থেকেই। এটা সে ভালো করেই জানে।
বন্ধ দরজায় টোকা পড়তেই শয়ন উঠে গিয়ে দরজা খুলল। তন্দ্রাকে দেখে ভীষম খেল। এই মুহুর্তে তন্দ্রার দেখা মিলবে। এটা শয়নের কল্পনাতীত। শয়ন কিছুই বললনা। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তন্দ্রা রুমের ভিতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। বিছানার একপাশে গিয়ে বসল।
মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“আমার একটু জরুরী দরকার ছিল আপনার সাথে।”
শয়ন ভণিতায় গেলনা। উঠে বসল দুটো বালিশে হেলান দিয়ে।
মুখেই জিজ্ঞেস করল,
” কি বলবে বল?”
” আপনি যে বিকেলে বললেন আদিল মরে গেল বলেই আমি বেঁচে আছি। এই বিষয়টা জানতে চাই। আদিলের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলনা?”
নাহ বলেই শয়ন বলতে শুরু করল,
” বাবা রাজনীতির লোক। দুরদর্শিতায় পটু। এবার নিয়ে টানা চারবার চেয়ারম্যান পদে বসেন। সেদিন বাজারে ওর কথা শুনে এসে যখন বাসায় বললাম,
তখন বাবা আমাকে সবার আড়ালে নিরালায় ডেকে নেয়। বলেন, আমার কেমন যেন লাগছে। বৌমা কিন্তু ডানপিটে ধরনের৷ তুই বিয়ের রাতে অবিশ্বাস করেছিস। উপেক্ষা করেছিস। সেতো কোন অন্যায় করেনি। এই জেদে আদিলের দূর্ঘটনার সাথে সে কোনভাবে জড়িত কিনা জানা জরুরী। যেহেতু সে চেয়ারম্যান পরিবারের বউ। তাই তার কোন কিছু হওয়া মানে আমাদেরও।
তুই সেই সদর হাসপাতালে গিয়ে আদিলকে দেখে আয়। আর জেনেও আয় বিষয়টা। সেখানের ডাক্তার ও আমার পরিচিত আছে।
বাবা বলার পরে আমার ও মাথায় আসে। আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই হাসপাতালে। খুঁজে বের করি তাকে। তখন সে ছিল অপারেশন রুমে। তার কেবিনে ঢুকি। ওর মা ছিল বসা।
তিনি আমাকে চিনতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে হলো এক্সিডেন্ট আন্টি?
কাঁদতে কাঁদতে বলল রাতে অন্ধকারের মধ্যে বাইক নিয়ে রাস্তার পাশেই পড়ে যায়। ওখানেই পড়ে ছিল। বাড়ির কেউ তখন ওখানে গেলে তার গোঙানি শুনে আমাদের জানায়। তখনই হাসপাতালে নিয়ে আসলাম বাবা।
তাদের বাকি লোকজন তখন ওটি রুমের সামনে ছিল। বালিশের নিচ থেকে ওর মোবাইলটা হাতে নিই। কোন লক ছিলনা। ডায়াল নাম্বার রিসিভ নাম্বার চেক করে কিছু পেলামনা। মেসেজ চেক করেই দেখি তোমার নাম্বার থেকে যাওয়া একটি মেসেজ। মেসেজ পড়ে রিমুভ করে দিই মুহুর্তেই। গ্যালারিতে গেলাম। কোন ভিডিও পেলামনা। কিন্তু গুগল ড্রাইভে সংরক্ষিত ছিল। রিমুভ করে দিলাম। পুরো মোবাইল ভালো করে চেক করে নিলাম। রেখে দিলাম আগের স্থানে।
তার মা বুঝতে পারেনি। তিনি ফোনে নানাজনের সাথে কথা বলছেন। আমি বের হয়ে অপেক্ষা করছি ওটির থেকে দূরে দাঁড়িয়ে। বাবার পরিচিত সেই ডাক্তারকে দেখলাম। উনাকে রোগীর অবস্থা জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, তার পার্সোনাল অর্গান কাটা পড়েছে। এবং সেটা রাতে তারা খুঁজেও পায়নি। রোগীর অবস্থাও শোচনীয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমি বুঝতে পারলাম এটা তুমিই করেছে।
বাবা ফোন দিলে আমি তোমার এই বিষয়টা লুকাই। কেবল সে যে এক্সিডেন্ট করেছে তা জানাই। কিন্তু বাবা পরে সেই ডাক্তারকে ফোন দিয়ে সব জানে। আর বুঝে নেয় অর্গান তুমিই কেটে ফেলেছ। ওই মেসেজ না দেখলে আমি চিন্তাই করতে পারতামনা তোমার কথা।
আমি সেখান থেকে সরাসরি আদিলদের বাড়ি যাই। ঘরে যারা ছিল তাদের বলি আমি আদিলের বন্ধু। ওর ল্যাপটপে আমার একটা দরকার ছিল। ও সুস্থ থাকলে আজ দেওয়ার কথা ছিল। তারা মানা করলোনা। আমি তার রুমে গিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে নিলাম। পাসওয়ার্ড দেওয়া। তাই বাজারে নিয়ে লক খুলে নিলাম। চুপিচুপি তোমার ভিডিওক্লিপ রিমুভ করে দিই।
তন্দ্রা আর শুনতে পারছেনা। মাথার ভিতরে অজস্র বিষাক্ত পোকা যেন কিলবিল করছে৷ চোখের দৃষ্টি দূর্বল হয়ে এসেছে। জ্ঞান হারিয়ে খাটের কিনার হতে কাত হয়ে পড়ে গেল ফ্লোরের উপরে।
ওহ গড! বলে শয়ন তন্দ্রাকে কোলে তুলে নিল। খাটের উপরে শুইয়ে দিল। দুগাল দুহাত দিয়ে চেপে ধরে তন্দ্রা তন্দ্রা বলে ডাকতে লাগল। তন্দ্রা মরা লতার ন্যায় পড়ে আছে। শয়ন পানির ছিটে দিল তার সারামুখে। তবুও কোন কাজ হলনা। এতরাতে সবাইকে ডাকলে হুলুস্থুল কান্ড ঘটে যাবে। শেষ চেষ্টা করে দেখি জ্ঞান ফেরানোর।
এই ভেবেই শয়ন তন্দ্রার গোলাপি শুকনো তুলতুলে অধর জোড়ার উপর নিজের উষ্ণ দুঠোঁট ডুবিয়ে দিল। একইভাবে কিছু সময় অতিক্রম হলে, তন্দ্রার বরফ শীতল অধর দুটো উষ্ণতায় রক্তিম হয়ে গেল। কুঁকিয়ে উঠল তন্দ্রা।
চলবেঃ১৪ ( শেয়ার ও উপযুক্ত মন্তব্য কাম্য।)