জৈষ্ঠ্যের প্রেম পর্ব ১৫

0
552

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১৫)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩১.
জৈষ্ঠ্য মাসের কড়া তাপদাহে টেকা মু’শ’কি’ল। মৌসন্ধ্যা ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটু হেঁটে ঘেমে নেয়ে একাকার। গরমে অ’তি’ষ্ট হয়ে ক্যান্টিন থেকে একটা কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে সে মূল ফটকের সামনে গেল। আজ এমন একটা বা’জে অবস্থা যে কোনো রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা মন খা’রা’প নিয়ে হেঁটেই যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল। তখনই চোখে পড়ল রাস্তার ওই পাশে পার্ক করে রাখা কালো বিএমডব্লিউ গাড়িটি। মৌসন্ধ্যা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। এভাবে আর কতদিন চলবে? সে জানে গ্রীষ্ম গাড়িতে বসে আছে। গত সপ্তাহে বেশ কিছু কথা শুনিয়েছিল গ্রীষ্মকে সে। তারপর থেকে ছেলেটা আর সামনে আসেনি। এভাবেই গাড়ি নিয়ে এসে এক জায়গায় পার্ক করে রাখবে নয়তো তার পিছু পিছু যাবে। এখন আর এসে কথা বলে না, বলার চেষ্টাও করে না। হুটহাট কল দিয়ে বির’ক্তও করে না। মৌসন্ধ্যার কাছে হয়তো সেগুলো একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। গ্রীষ্ম তার পেছনে ঘোরাঘুরি করা বন্ধ করুক তা সে নিজেই চাইতো। তবে এই এক সপ্তাহ গ্রীষ্ম তার সাথে কথা বলে না। এমনকি মখুটাও দেখায় না। মৌসন্ধ্যা বুঝতে পারে না তার কেন এত ক’ষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে! সব তো তার ইচ্ছা মতোই হচ্ছে। সে পুনরায় হাঁটা ধরল। পাঁচ, ছয় কদম সামনের দিকে হাঁটেও কিন্তু আবারও ফিরে আসে। এবার রাস্তা পার হয়ে সে গ্রীষ্মের গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

মৌসন্ধ্যাকে এদিকে আসতে দেখে গ্রীষ্ম চমকে গেল। আবার কোনো ভুল করেনি তো সে! মৌসন্ধ্যা যা বলেছিল সে তা-ই করছে। তার কাছে যাচ্ছেনা, কল দিচ্ছে না। বি’র’ক্ত করছে না। তবে?

মৌসন্ধ্যা গাড়ির গ্লাসে টোকা দিল। গ্রীষ্ম গ্লাস নামাতেই মৌসন্ধ্যা দেখতে পায় টিপটপ চলা গ্রীষ্মের নাজেহাল অবস্থা। চোখের নিচে কালো দাগ, চুল এলোমেলো, চেহারায় রু’ক্ষ ভাব। মৌসন্ধ্যার একটু মায়া হলো। পরক্ষণেই নিজেই নিজেকে শা’সা’য়। ভুলে গেলে চলবে না এই লোকের জন্য তার পরিবারকে, তাকে কথা শুনতে হয়েছে। এই লোকের সো কল্ড ক্লাসের জন্য তাকে অ’প’মা’নি’ত হতে হয়েছে। এসব কিছুই ভোলা যাবে না! কিছুতেই না! সে রা’গত স্বরে বলল,

-‘কি করছেন এখানে? আপনাকে আমি কি বলেছিলাম! ফলো করতে মানা করিনি? বলিনি আর আমার আশেপাশেও যাতে না আসেন! বলিনি? তারপরেও কেন হাদার মতো এখানে এসে বসে থাকেন। মান সম্মান কিছু নেই? এই আপনার ক্লাস?’

গ্রীষ্মর এবার আর স’হ্য হলো না। তার জীবনে সে কখনো অ’প’মা’নিত হয়নি। কারো কাছেই সে হারেনি। কিন্তু এই একজনই তাকে বা’জে ভাবে অ’প’মা’ন করেছে। তাকে হারিয়ে দিয়েছে। আর এই একজনকেই সে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে। কেন ভালোবাসে, কি কারণে এত ভালোবাসে, কেন এত অ’প’মা’নি’ত হওয়ার পরেও সে এই মেয়েটির পেছনে পড়ে রয়েছে সে জানে না। সত্যিই জানে না। গ্রীষ্ম অনুতপ্ত! তার নিজের অপারগতার জন্য অনুতপ্ত। মায়ের আর বাবার ব্যবহারের জন্যেও সে অনুতপ্ত। এতবার ক্ষমা চেয়েছে সে। তারপরেও মৌসন্ধ্যার একটু মন গলেনি। মেয়েটা এত বড় পা’ষা’ণ হৃদয়ের কেন? একটু সহানুভূতি কি গ্রীষ্ম তার থেকে পেতে পারে না? এই যে চাকরীর বারোটা বাজিয়ে রোজ রোজ এখানে এসে বসে থাকে, কার জন্য? মৌসন্ধ্যার জন্যই তো! আর সেই মৌসন্ধ্যাই কিনা তাকে এতভাবে কথা শোনায়! গ্রীষ্মকে চুপ করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌসন্ধ্যা আরেকটু চটে গেল। বলল,

-‘এমন তাকিয়ে আছেন কেন? ল’জ্জা নেই! আমি বোন হই আপনার। বোনের চোখে দেখবেন। আর কয়বার বলব?’

গ্রীষ্মের ভীষণ রা’গ হলো। সেও ফটাফট জবাব দিল,
-‘ফুফাতো বোন হও। আপন বোন তো নও। আমি তোমাকে বোনের নজরে দেখিনা। সেটাও আর কয়বার বলব!’

-‘মুখে খৈ ফুটছে দেখছি। তর্ক করা হচ্ছে!’

-‘তর্ক বয়সে ছোটদের সাথে করা হয় না। বড়দের সাথে করা হয়। এটাও তো দেখছি জানো না। আমি তো তোমাকে স্বাভাবিক ভাবেই বলছি। বরং তর্ক তুমি করছ।’

-‘আমি তর্ক করি? আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আসেন কেন আমার কাছে? দূরে থাকলেই তো পারেন।’

-‘তোমার কাছে এসেছি কে বলল! আমি তো এমনিতেই এসেছি। এটা পাবলিক প্রোপার্টি। তোমার ব্যক্তিগত রাস্তা নয়। আমি এখানে আসব, বসে থাকব, দরকার হলে শুয়েও পড়ব। তোমার তাতে কী!’

-‘বাহ! বেশ ভালোই ঝ’গ’ড়া করতে পারেন দেখছি।’

-‘এটা ঝ’গ’ড়া নয়। এটা হলো জবাব দেওয়া।’

-‘তাই নাকি? আপনি জবাব দিতে পারেন! আপনার মধ্যে সেই কোয়ালিটি আছে? না মানে আমি তো জানি আপনি শুধু মাথা নিচু করে শুনতে পারেন। ওহ! আমিও না! কাকে কি বলছি! আপনি তো একটা অহং’কারী, স্বা’র্থ’পর লোক। যখন নিজেকে কেউ কিছু বলে তো চুপ থাকতে পারেন না। আর যখন নিজের সামনে অন্য কাউকে একের পর এক অন্যা’য়ভাবে কথা শোনানো হয় তখন একদম চুপ করে থাকেন। আসলে আপনার থেকে ভালো কিছু আশা করাও বোকামি। বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া, অহমিকাপূর্ণ ছেলে আপনি। আপনার মধ্যে মনুষত্ব্য বলতে কিছু আছে কিনা আমার সেটাতেই স’ন্দে’হ হয়। সত্যি বলতে আপনাকে আমার পুরুষই মনে হয় না। পুরুষ যদি হয়েও থাকেন কা’পুরুষ-ই বলা চলে।’

গ্রীষ্ম স্ত’ব্ধ হয়ে গেল। শেষমেষ কিনা মৌসন্ধ্যা তার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল! সে কিছু বলবে তার আগেই মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘আর কয়বার বললে আপনি বুঝবেন! আর কীভাবে বললে আপনি বুঝবেন? এবার কি তবে আপনার পা ধরতে হবে! তবে দেন, আপনার পা টা দেন। আমি পা ধরে অনুরোধ করে বলি। এমনিতেও আমার ক্লাস নেই। আপনার পা ধরলে আহামির কোনো অসম্মান আমার হবে না। ক্লাললেসের এই এক সুবিধা। তাদের মান-সম্মান বলতে কিছু নাই।’

গ্রীষ্মের এত খা’রা’প লাগল! একটা বিষাদে তার গোটা মন, প্রাণ, দেহ ভরে উঠল। হ’তা’শা’গ্র’স্থ হয়ে পড়ল মিনিটেই। সে কথা বলতে পারল না কোনো। এক দৃষ্টিতে মৌসন্ধ্যার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে চোখে স্পষ্ট তাকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। তাকে নিয়ে মৌসন্ধ্যার আত্মা হাসছে, উপহাস করছে। এত কিছু সে কিছুতেই স’হ্য করতে পারছে না। গ্রীষ্মের সাড়া শব্দ নেই, নড়চড়ও নেই। মৌসন্ধ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

-‘শুনুন! আপনার জী’বন আর আমার জী’বন দু’টো আলাদা। সৌভাগ্য নাকি দু’র্ভাগ্য জানিনা! আপনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে আমার। আমি চাই না সেটি ন’ষ্ট করতে। আপনাদের সেদিনের কথোপকথন আমার মা-বাবা, ভাই কেউই জানে না। আমার মা আপনাকে খুব স্নেহ করেন। আপনাদের সবাইকে ভালোবাসে। আমি চাইনি তার চোখে আপনাদের নিচে নামিয়ে দিতে। তাই আজ পর্যন্ত আমি কাউকে কিছু বলিনি। এমনকি বর্ষার সাথেও এই ব্যাপারে আলাপ করিনি। আপনি একটু ভালো করে ঘুরে দেখলেই আপনার সমকক্ষ কাউকে না কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবেন। আমিও আমার মতো আমার সাথে যার ক্লাস ম্যাচ করবে তাকে বিয়ে করে নিব। দুদিন কাটতেই দেখবেন আজকের করা এসব পাগলামি নিয়ে আপনি আফসোস করবেন। সময় আছে এখনও। আপনি শুধু শুধু নিজের মূল্যবান সময় আমার মতো একটা মেয়ের পেছনে ন’ষ্ট করবেন না। আসি। ভালো থাকবেন। আশা করছি আজকের পর আপনি আর এখানে আসবেন না। যদি আসেন! আমি সত্যি বলছি! আমি নিজে ভার্সিটি ছেড়ে দিব। আপনার নাগালের বাহিরে চলে যাব। আমার এইটুকু ভরসা আপনার উপর আছে যে আপনি অন্তত আমার ক্যারিয়ারটা বরবাদ করবেন না।’

এতগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে মৌসন্ধ্যা চলে গেল। গ্রীষ্ম সেদিকেই অপলক চেয়ে থাকল। সেদিকেই চেয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ ভিজে এলো। এত য’ন্ত্র’না সে সইতে পারছে না। মৌসন্ধ্যা কেন তাকে একটু বুঝছে না? একটু বুঝলে কি হতো! সে কীভাবে পারল এত বড় একটা কথা বলতে! সত্যিই গ্রীষ্ম তাকে এতটা বি’র’ক্ত করছে যে সে আর পড়ালেখাই করবেনা? এত বড় আপদ সে মৌসন্ধ্যার জীবনে! বেশ! তবে তা-ই হোক। সে আর আসবে না। আর এসে বারবার ভালোবাসার কথা বলবে না। আর ভালোবাসা খুঁজবে না। আর চাইবে না। আর না! সে বিড়বিড় করে বলল,
-‘কোথাও শুনেছিলাম “ভালোবাসা মিলনে হয় মলিন, বিরহে উজ্জ্বল”।তোমার আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হোক জৈষ্ঠ্য! এমনিতেও আমার ভালোবাসাটা একপাক্ষীক। বাকি জীনবনটাও আমি নাহয় দূর থেকেই ভালোবাসব।’

৩২.
হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মের মা নাইলা হাসান লিভিং রুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। ছেলেকে এভাবে অসময়ে দেখে বসা থেকে উঠে এলেন। গ্রীষ্ম সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। সে দ্রুত কদম ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। নাইলা হাসান ছেলের এমন উদ্ভ্রান্তের মতোন আচরণ করা দেখে ঘাবড়ে গেলেন। পেছন পেছন তিনিও সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন।
-‘গ্রীষ্ম! হোয়াট হ্যাপেন বাচ্চা? দাঁড়াও, মায়ের কথা শোনো! এই সময় বাড়িতে কেন এসেছ?’

গ্রীষ্ম জবাব দিল না, প্রয়োজন বোধ করল না। নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল ধরাম শব্দ করে। সেই শব্দে নাইলা হাসান কেঁপে ওঠেন। অবাক নয়নে বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখনই ভেতর থেকে বিক’ট আওয়াজে ভা’ঙচু’রের শব্দ শোনা গেল। তিনি এবার আত’ঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তার শান্ত ছেলেটার হঠাৎ কী হয়ে গেল! এমন অশান্ত আচরণ তার গ্রীষ্ম করে না। দরজায় কড়াঘাত করে একাধারে গ্রীষ্মকে ডাকতে থাকে তবুও সাড়া শব্দ নেই। যা শব্দ আছে সব জিনিস পত্র ভা’ঙার। তিনি দৌঁড়ে পাশের ল্যান্ডলাইন থেকে স্বামীকে কল করলেন। পলাশ মির্জা বাড়ির আশেপাশেই ছিলেন বোধ হয়। স্ত্রী কল দেওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনিও উপস্থিত হলেন। দুজন মিলে গ্রীষ্মকে ডাকছে কিন্তু গ্রীষ্ম দরজা খুলছে না। বাড়িতে তারা দুইজন ছাড়া কেউ নেই যে একটু দরজাটা ভা’ঙার চেষ্ট করবে। এমনিতেও মজবুত দরজা ভা’ঙবে কিনা স’ন্দে’হ! একসময় ভেতর থেকে আসা ভা’ঙচু’রের শব্দটাও মিলিয়ে গেল। আর একটুও শব্দ নেই। চারিদিকে পিন পতন নিরবতা। নাইলা বেগম ধপ করে পাশে থাকা ডিভাইনে বসে পড়লেন। তখন পলাশ মির্জার ফোনে কল আসে। জুন কল করেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জুন বলল,
-‘হ্যালো বাবা! মা কোথায়? কতবার কল দিচ্ছি ধরছেই না।’

তিনি কিছু বলতে পারলেন না। স্ত্রীর দিকে ফোন এগিয়ে দিলেন। নাইলা হাসান ফোনটা কানে ধরতেই জুন আবারও বলল,
-‘হ্যালো বাবা! শুনতে পাচ্ছো? মা কোথায়?’
-‘জুন!’
-‘মা? তোমার ফোনে কতবার কল দিলাম। তুমি কোথায় ছিলে?’

নাইলা হাসান এবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, জুন মায়ের কান্নার শব্দে ঘাবড়ে গেল। বলল,
-‘মা, কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?’
-‘তোমার ভাইয়া দরজা খুলছে না। সাড়া শব্দ নেই। এতক্ষণ ভা’ঙচু’র করছিল এখন সেই শব্দও পাচ্ছি না। ছেলেটার কোনো সাড়া নেই!’
বলেই তিনি কান্নায় ভে’ঙে পড়লেন পুনরায়। জুন বলল,
-‘আমি এখনই আসছি, তুমি কেঁদো না মা।’

বিশ মিনিটের মাথায় জুন হাজির। তার আর আবিরের ফ্ল্যাটটা বেশি হলে আধা ঘন্টার দূরত্বে। আজ ভাগ্যক্রমে জ্যাম ছিল না। তাই এত দ্রুত চলে আসতে পেরেছে। অবশ্য এই বিশ মিনিটও কম সময় নয়। গ্রীষ্মের এখনও কোনো রেসপন্স পাওয়া যায়নি। সবাই চিন্তিত।

জুন এসেই গ্রীষ্মের দরজায় টোকা দিল। খুব নরমাল থাকার চেষ্টা করল। দুই তিন বার যখন আস্তে টোকা দিয়েও পারেনি তখন জোরে কড়াঘাত করল। একসময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ভাইয়া! এই ভাইয়া দরজা খোল। ভাইয়া? তোর কি হয়েছে! দরজাটা খোল না! এই ভাইয়া!’

জুনের কান্না বেড়ে গেল। তখনিই খট করে ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো। ভাইকে দেখে জুন ঝা’পি’য়ে পড়ল তার উপর। তারপর বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। গ্রীষ্ম বোনকে মায়ের পাশে বসিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নাইলা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। পলাশ মির্জার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তার প্রেশার বেড়ে গেছে। তিনিও চুপচাপ মেয়ের পাশে বসে রইলেন। কথা তার মা-ই বলুক! নাইলা হাসান শক্ত গলায় বললেন,
-‘এসব কোন ধরনের ব্যবহার গ্রীষ্ম! কি করছিলে তুমি? মাথা খা’রা’প হয়েছে তোমার?’

গ্রীষ্ম হাসে। কথা বলে না। নাইলা হাসান বললেন,
-‘কেন এমন করছ?’

-‘জানো না?’

-‘কি জানব আমি?’

-‘তুমি সত্যিই জানো না মা! জানো না! আমার আজকের এই অবস্থা তোমার জন্য। তোমার সো কল্ড ক্লাস দা’য়ী আমার এই অবস্থার জন্য।’

নাইলা হাসানের টনক নড়ল। তিনি বললেন,
-‘তুমি ওই মেয়েটার জন্য এমন করছ! একটা বাহিরের মেয়ের জন্য মায়ের সাথে মিসবিহেইভ করছ?’

-‘ও বাহিরের মেয়ে না মা। আমি ওকে ভালোবাসি। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।’

জুন চমকে গেল। ভাই আবার কাকে ভালোবাসে? সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবার দিকে তাকাতেই তার বাবা চোখের ইশারায় মা ছেলের কথা শুনতে বললেন। সে অবাক নয়নে ভাই আর মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। তার মা বলছেন,
-‘ভালোবাসা! গ্রীষ্ম আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম!’

এবার গ্রীষ্ম চেঁচিয়ে উঠল,
-‘হ্যাঁ বারণ করেছ। বারণ করেই আসছ। সারাজীবন আমার সবকিছুতেই তোমার বারণ। আমার শখ আহ্লাদে আজীবন তোমার বারণ ছিল। আমি লাল জামা পরতে চাইলে তুমি দিতে কালো জামা। আমি চুপচাপ সেটাই পরতাম। আমি ভাজা পোঁড়া খেতে চাইলে তুমি স্যালাড এনে দিতে আমি চুপচাপ খেয়ে নিতাম, বন্ধুদের সাথে খেলতে যেতে চাইলে তুমি টিউটর এনে আমাকে ঘরবন্ধী করে রাখতে, সেটাও মেনে নিতাম। সারাজীবন আমি ঢাবিতে পড়তে চেয়েছিলাম। তুমি বললে বুয়েটে না পড়তে পারলে সব বৃথা! আমি দিন রাত পরিশ্রম করে বুয়েটে ঢুকলাম। কিন্তু তুমি কখনোই জানো নি এই আমি ঢাবিতেও পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং একশোর ঘরে পজিশন ছিল আমার। আমি এতই হতভাগা যে আমার স্বপ্নের ঢাবিতে চান্স পাওয়ার খুশিতে মেতে উঠতে পারিনি। বাকিদের মতো নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি দ্যাখো মা আমি স্বপ্নের ঢাবিতে চান্স পেয়েছি। বরং আমি তোমার থেকে লুকিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ তুমি মনে করবে যে আমি তোমার কথার প্রাধান্য দেইনি। তুমি মনে ক’ষ্ট পাবে তাই! আমাকে ছুটিতে বাড়িতে যেতে দিতে না কারণ বাড়ির পরিবেশ নাকি ভালো না। বিগড়ে যেতে পারি ওদের সাথে থেকে। পড়ালেখা থেকে নাকি বি’চ্যু’তি তৈরি হতো। অথচ সেই পরিবেশে থেকে শরৎ, আশ্বিন ওরাও ভালো রেজাল্ট করেছে। ভালো জায়গায় পড়ছে। ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে তাদের। তফাৎ কোথায়? যে দাদার বাড়ি নিয়ে তোমার এত সমস্যা যে দাদাকে নিয়ে সমস্যা সেই দাদাই যেদিন আমরা বাড়ি ছেড়েছিলাম সেদিন তার ঘরে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল মায়ের মুখের উপর যেন কখনো কোনো দিন কথা না বলি। মা ক’ষ্ট পেলে একেবারে জাহান্নাম! কেন বলেছিল? কারণ সেই সকালে আমি তোমার উপর রা’গ করে বলেছিলাম আমি ঢাকা যাব না। আমি কখনোই আমার বাড়ি ছাড়তে চাইনি। কখনোই না! কেবল! তোমার জন্য, বাড়ি ছাড়া হলো। বাবাও কোনো দিন তোমার মতের বি’রু’দ্ধে যায় নি। যখন তুমি যা বলেছ তা-ই করেছে। বদৌলতে তুমি পারো নি তার পরিবারকে সম্মান দিতে। বাবার সাথে এই নিয়ে তোমার ঝামেলা চলছিল। সেই দাদা এসেই বাবাকে দিয়ে ওয়াদা করায় যেন আর কখনো তোমাকে কটু কথা না বলে। তোমার উপর কোনো ভাবে চওড়া না হয়। ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও যেন চুপ থাকে। তারপর থেকে বাবা আর কখনো তোমাকে কিছু বলেনি। সেদিন যখন তুমি ফুফুকে এত গুলো কথা বলছিলে আমি বাবার চোখে স্পষ্ট অসহায়ত্ব আর ক’ষ্ট দেখেছিলাম। আমিও পারিনি বাবাও পারেনি তোমাকে কিছু বলতে। তোমার মাথায় কি একবারও আসেনি যে কাকে কি বলছ? ক্লাস তোমার কাছে এতটাই বড়! যার ক্লাস নিয়ে কথা বলেছিলে সে তোমার কিছু না হলেও আমার আর আমার বাবার রক্তই। আমাদের এক রক্ত বইছে শরীরে। আমি হতভাগা কিছু বলতে পারিনি। শরৎ এসে বলল। আর তোমার এত ইগো হার্ট হলো যে তুমি শরৎকে মা’র পর্যন্ত খাওয়ালে। অথচ কাকা কখনোই শরৎকে মা’রেনি। সেদিনই প্রথম ছিল। এই যে মানুষ গুলোকে তুমি এতটা অপছন্দ করো সেই মানুষগুলো সবসময় তোমাকে সম্মান দিয়েছে। তোমার দাম রেখেছে। তোমাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আর তুমি?’

গ্রীষ্ম এবার ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর এতক্ষণ যাবৎ আটকে রাখা কান্না সব বের করে দিল। চিৎকার করে বলল,
-‘তুমি তো সবসময় আমার ভালোই চেয়েছিলে। কিন্তু তুমি জানোই না আমার ভালো কীসে। আমি ভালো নেই মা। আমি একটুও ভালো নেই। জৈষ্ঠ্য আমাকে একটুও ভালোবাসে না। ও আমাকে ঘৃ’ণা করে। ওর চোখে আমার জন্য ঘৃ’ণা দেখতে পেয়ে আমার খুব ক’ষ্ট হচ্ছে মা। আমি তো কখনো শ্রেনী বৈষম্য করিনি! অথচ ও সে কারণ আমাকে ঘৃ’ণা করে। জৈষ্ঠ্য বলেছে আমি আবার কখনো যদি ওর সামনে যাই ও সব ছেড়ে ছুড়ে কোথাও চলে যাবে। আমি কি এতটাই ঘৃ’ণার যোগ্য মা?’

নাইলা হাসানের দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। জুন স্তব্ধ চোখে মা আর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রীষ্ম মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই তার সারা শরীরটা নিজের ভর ছেড়ে দিল। জুন ‘ভাইয়া’ বলে আ’র্ত’নাদ করে উঠল।

#চলবে।
।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here