জৈষ্ঠ্যের প্রেম পর্ব ১০

0
571

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১০)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২১.
দুপুর বেলায় বাড়ির বড়রা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন হুট করেই। আজ মৌসন্ধ্যার নানা-নানী এবং বাকিসব মামারা এবং তাদের পরিবারের লোকদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নতুন জামাই রেখে তো চলে যাওয়া যায়না! মৌসন্ধ্যার নানা হাফিজ মির্জা প্রস্তাব দিলেন সবাই মিলে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার জন্য। মৌসন্ধ্যার ছোট মামা শিমুলও বাবার মতের সাথে তাল মেলান। এদিকে ছোটরা সব হৈ হুল্লোড় শুরু করে দিল! বর্ষা তো পারেনা খুশির ঠ্যালায় কেঁদেই দেয়! সেই যে হাইস্কুলে ওঠার পর তারা গ্রাম ছেড়েছে তারপর থেকে তো ইদ আর কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া যাওয়া হয় না। সেও তার বাবার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান শুরু করল যাওয়ার জন্য। সবচেয়ে বেশি খুশি হলো এপ্রিল! একা বাড়িতে তাদের দুই বোনের ভালো লাগেনা। সবাই গেলে কত মজা হবে!

বড়রা কেউ আপত্তি করার সুযোগ পেল না। ছেলে মেয়েগুলোর স্কুল কলেজের ঝামেলা নেই। পলাশ মির্জার অফিসের কোনো সমস্যা নেই। তার ম্যানেজার সামলে নিতে পারবেন। হাতে বড় ধরনের কোনো চাপ নেই এই মুহূর্তে। গ্রীষ্মের অফিস থেকেও আরো এক সপ্তাহের ছুটি নেওয়া আছে। এই সুযোগে নাহয় নতুন জামাইকে শ্বশুরের পৈতৃক নিবাস থেকে ঘুরিয়ে আনা হলো। ব্যাপারটা বেশ ভালোই হয়!

ঘোষণা দেওয়া হলো সবাইকে পাঁচটার মধ্যে তৈরি হয়ে যেতে। গ্রীষ্মের মা প্রথমে একটু নিমরাজি ছিলেন পরবর্তীতে ভাবলেন ঠিকই তো! সে হয়তো সেখানে থাকেনা কিন্তু বাড়িটা তারও। তার একমাত্র মেয়ে জামাই একটু ঘুরে আসবেনা সেখান থেকে! এই সফরে তিনি তার বড় আপাকেও সাথে নিলেন। তার শ্বশুরের বাড়িটা বিশাল। আরো দুই চারজন গেলেও সমস্যা নেই।

মৌসন্ধ্যার মেজাজ ভালো নেই। তার এমনিতেও দুইদিন ক্লাস মিস হলো। এখন আরো একসপ্তাহ! মানে কী? সে তার মাকে বারবার বলল,
-‘আমি যাব না। আমার দরকারি ক্লাস আছে।’
-‘বন্ধু বান্ধবদের বল নোট তুলে রাখতে তোর জন্য। ওরা গেলে তুই ওদের জন্য করিস না? এখন তোর দরকারে ওরা করবেনা কেন?’
-‘করবে না মানে? ওরা তো বলেনি যে করবেনা। আমিই যেতে চাইছিনা।’
-‘কেন চাইছিস না?’
-‘ভাইয়াও তো গতকাল রাতে ফিরে গেছে। তুমি তাকে যেতে দিলে আমাকে দিচ্ছ না কেন?’
-‘ও চট্টগ্রামেই তো! ফেনি থেকে কাছে। ডাকলেই আসতে পারবে। আর বড় কথা ওর অফিস আছে।’
-‘আমারও ভার্সিটি আছে।’
-‘থাকুক! শরৎের ইন্টার্নশিপ আছে, বর্ষারও ভার্সিটি আছে তবুও তো ওরা যাচ্ছে। তুই এত বেশি অসামাজিক! একদম বাপের মতো। বাপটাও আমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে আসেনি। আমি বুঝিনা! সব তার শ’য়’তা’নি। আমার বাপের বাড়ির লোকদের তো দেখতে পারেনা। আমাকেও হে’ন’স্তা করতে ছাড়েনা। এখন মেয়েকেও নিজের মতো তৈরি করছে।’
-‘বাবাকে টেনে আনার কি দরকার? আমি যেতে চাইনা এখানে বাবার কি করার আছে! বাবা তো বলল তার কাজ পড়ে গেছে হঠাৎ নয়তো আসতো।’
-‘এত কিছু আমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তুই আমাদের সাথে এখন ফেনী যাবি। আর আমার কথা না শুনলে শুনিস না। আমার দাম তো তোদের বাপ মেয়ের কাছে নাই!’

মৌসন্ধ্যা বুঝল মাকে বলে লাভ নেই। এদিকে বর্ষাও তার ফুফুর সাথে তাল মেলাচ্ছে। সেও মৌসন্ধ্যার উপর রা’গ করে আছে। সে কেন যেতে চাইছেনা? এত ভাব কীসের! সবাই কত করে বলছে!

অগত্যা মুখ বেজার করে মৌসন্ধ্যাকেও তৈরি হতে হলো। ক্লাসমেটদের কল করে বলে দিল তার জন্য নোট করে রাখার জন্য।

এতজন মানুষের জন্য বাড়ির সবকয়টা পার্সোনাল গাড়ি দিয়েও হলো না। আলাদা একটা মাইক্রো ভাড়া করতে হলো। সবাইকে ঠিকঠাক মতোন গাড়িতে গ্রীষ্ম আর শরৎ উঠিয়ে দিল। গ্রীষ্মের গাড়িটা জুনদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ড্রাইভার আছে গাড়ি চালানোর জন্য। জুনের গাড়িতে তার মা আর খালামণির পরিবার। তার মায়ের নিজস্ব গাড়িতে আবার গ্রীষ্মের নানা নানু সহ রয়েছে মৌসন্ধ্যার মা আর মুকিতের মা। ড্রাইভার হিসেবে মুকিতকে সাথে নেওয়া হলো। তাদের বাবার গাড়িতে বাবা, চাচা সবাই। আষাঢ়ের গাড়িতে তার মা আর বাকি দুই চাচী এবং ড্রাইভার হিসেবে শ্রাবণ রয়েছে। মা, চাচীদের সাথে যেতে সে একটুও চায়নি। তবুও তাকে জোর করে তাদের সাথে পাঠানো হলো।

শরৎ এর বাবার গাড়িতে বাকি অন্যান্য কাজিন গুলো। সেখানে সাবাব রয়েছে। তৃণা তার বাচ্চা সহ, হানিয়া আর লামিয়া তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আর তাদের ভাইয়ের বউ রাফিজা ছিল। অর্থাৎ সাবাব তার ফুপাতো ভাইয়ের বউ আর ফুপাতো বোনগুলো নিয়ে রওনা হলো। সাথে ক্যাচর ক্যাচর করা আন্ডাবাচ্চা গুলো তো রয়েছে। সাবাবের এখনই ধৈর্য্য শেষ। সে সারা রাস্তা এদের নিয়ে যাবে কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছেনা! গ্রীষ্মকে বলতেই সে আহরারকে বলল সাবাবের সাথে যেতে। বেচারা পারবেনা একা হাতে সামলাতে। আহরার এসে সাবাবকে বলল সে ড্রাইভ করবে। একটু বাঁধা দিলেও মনে মনে সাবাব খুশি হলো।
আহরারকে গ্রীষ্মই কল করে চলে আসতে বলেছে। সে যদি জানত যে গাড়ির শর্ট পড়বে তবে নিজের গাড়িটা নিয়েই আসত। গ্রীষ্মকে একবার বলতেই গ্রীষ্ম বলল দরকার নেই। সে একটা মাইক্রো বলে রেখেছে। সেটা চলে আসলেই বাকিদের নিয়ে সে চলে যাবে।

অতঃপর একে একে সব গাড়ি ছেড়ে দিল। বাকি পড়ে রইল মৌসন্ধ্যা, বর্ষা, চৈত্র, শরৎ, গ্রীষ্ম, আষাঢ়! মৌসন্ধ্যার মেজাজটা আরো বেশি বিগড়ে গেল এই তিনজন ছেলের সাথে যেতে হবে দেখে। এর থেকে শ্রাবণ আর সাবাব ভালো ছিল। এপ্রিল ওদের সাথে যেতে চাইছিল কিন্তু তার মা তাকে নিজের সাথে রেখে দিল। তার গাড়িতে উঠলে বমি করার বাতিক আছে তো, তাই!

সবাই সদর দরজার সামনে পায়চারি করছে। তাদের ব্যাগ গুলো এক সাইডে রাখা। বাকিদের সবগুলো ব্যাগই ছোট ছোট তবে গ্রীষ্ম আর আষাঢ়ের বিরাট বড় ট্রলি ব্যাগ। গ্রীষ্মের একটা আর আষাঢ়ের দুইটা। তিনভাই গার্ডেনে পাতা চেয়ারে বসে রয়েছে। আর একটু পর পরই মৌসন্ধ্যা, বর্ষা, চৈত্রের দিকে তাকাচ্ছে। তারা আশেপাশে আছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য। তবে তাদের তিনজনের কোনো চিন্তা নেই। তারা আপনমনে হাঁটাহাঁটি করছে। বর্ষা আর চৈত্র সেলফি তুলছে সেই কখন থেকে। শরৎ ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবল, এরা কি পাগল নাকি? এক চেহারা, এক জামা, একই জায়গায় এত গুলো ছবি তোলার মানে হয় কোনো? সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এরা আসলেই
পাগল আর এইসব পাগল ছাড়া আসলেও দুনিয়া চলেনা।

মৌসন্ধ্যার মনটা বি’ক্ষি’প্ত হয়ে আছে। এমনিতেও সে যেতে চায়নি আর যখন যেতে চাইল তখন চেয়েছে আহরারের সাথে যেতে। ক্রাশ নামক বাঁশটা হঠাৎ করেই আবার জেগে উঠল। সাদা টি-শার্ট আর কালো ডেনিম প্যান্ট পরিধান করা আহরারকে আজ কি একটু বেশি সুন্দর লাগছিল? কথাটা ভাবতেই হঠাৎ মৌসন্ধ্যার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তার আকস্মিক এই হাসি একটু দূরেই বসা শরৎ, গ্রীষ্ম, আষাঢ়ের নজরে পড়ল। শরৎ অবাক নয়নে থেকে বিড়বিড় করে বলল,
-‘এটা আরেক পাগল! মিছিমিছি হাসছে।’

আষাঢ় আর গ্রীষ্ম দুজনেই মৌসন্ধ্যার গতিবিধি বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করছে। হঠাৎ কি মনে করে এত লাজুক হাসল সে? কারণটা কি! আষাঢ়ের ভেতর থেকে হঠাৎ একটা কথা নড়াচড়া দিয়ে উঠল। এই মেয়ে প্রেমে পড়েনি তো? এটা তো প্রেমে পড়ার হাসির মতো প্রাণবন্ত হাসি। কার প্রেমে মজেছে? সে শরৎ এর দিকে তাকালো একবার। শরৎ এর দৃষ্টি গেটের দিকে। গাড়ি আসছে কিনা সেটাই দেখছে। গ্রীষ্মের দিকে তাকাতেই দেখল গ্রীষ্ম এক ধ্যানে মৌসন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বারবার মনে হচ্ছে গ্রীষ্মের দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। তারউপর সেদিন যা হয়েছে! তার স’ন্দে’হ হচ্ছে। এদের দুজনার মধ্যে কিছু চলছে না তো!

মৌসন্ধ্যা একটা ট’ক’ট’কে লা’ল গোলাপ ছিঁড়ে নিজের কানের পেছনে গুজে দিল। আচানক তার মনে পড়ল গ্রীষ্ম বলেছে তার গোলাপ প্রিয়। ঠিক এমন ট’ক’ট’কে লা’ল গোলাপ! সে আড়চোখে গ্রীষ্মের দিকে তাকালো। কিন্তু সাথেই সাথেই সে ধরা পড়ে গেল। গ্রীষ্ম তো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটা অস্বস্তিতে মুহূর্তেই সে গাট হয়ে গেল। বড় বড় পা ফেলে বর্ষার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বর্ষা বলল,
-‘আরে! কি সুন্দর ফুলটা! তোকেও সুন্দর লাগছে। আয় একটা ছবি তুলি। এই চৈত্র আমাদের দুই বান্ধবীর একটা ছবি তোল তো!’
চৈত্র বলল,
-‘আমিও তুলি তোমাদের দুজনের সাথে।’
-‘পরে তুলিস। আগে শুধু আমাদের দুইজনের তুলে দে।’

এই কথা বলেই সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল মৌসন্ধ্যাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় তাল হারিয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিল মৌসন্ধ্যা। বর্ষাই ধরে ফেলল। মৌসন্ধ্যা রে’গে গিয়ে বাঁধন ছাড়ে চাইলেই বর্ষা বি’র’ক্ত হয়ে বলল,
-‘এই তুই এমন কেন? একটু ধরলেই কাইকুই শুরু করিস। আমার তো তোর জামাইর জন্য আফসোস হচ্ছে। ব্যাটা তোকে ধরবে কীভাবে!’

কথাটা শুনে মৌসন্ধ্যার চোখ বড় হয়ে গেল। চৈত্র হু হা করে হাসতে লাগল। মৌসন্ধ্যা বর্ষার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘তুই আসলে কী! কোথায়, কখন, কার সামনে কি বলতে হয় না বলতে হয় সেটা জানিস না?’

বর্ষা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। কি এমন বলে ফেলল কার সামনে বলল। তারপর চৈত্রের দিকে তাকিয়ে আগের স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আরেহ! ও? ধুর! ওর সামনে শরম কীসের! ও ছোট নেই এখন আর। বড় হয়েছে। তুই বল! তোকে ধরলে এমন করিস কেন? নাকি তোর মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জামাই ছাড়া আর কোনো পুরুষ কি মহিলাও তোকে ধরতে পারবেনা!’
-‘ছাড় আমাকে। বাজে কথা বলবিনা একদম। ছাড়!’
-‘আমার মনে হয় তোর কোনো সমস্যা রয়েছে। নয়তো মেয়েদের স্পর্শও তোর এমন লাগবে কেন? হ র্নি ফিল করছিস নাকি?’
-‘বর্ষা! চুপ!’

চৈত্র এতক্ষণ এসব শুনে হাসছিল। সে জানে বর্ষা ইচ্ছে করে মৌসন্ধ্যাকে রা’গিয়ে দিচ্ছে। আসলে তখন মৌসন্ধ্যা যাবেনা যাবেনা করছিল তাই বর্ষার তার উপর বেশ ক্ষো’ভ জন্ম নিয়েছে। সেই থেকেই এসব বলছে। কারণ এইসব কথা বার্তা বললেই মৌসন্ধ্যা রে’গে যায়। তাকে এভাবেই সবসময় হে’ন’স্তা করে বর্ষা। তবে মৌসন্ধ্যা আজ বেশিই রে’গে গেছে। হাসতেই হাসতেই সে সামনে তাকায়। তাদের থেকে পাঁচ/ছয় হাত দূরত্বে বসে থাকা শরৎ, গ্রীষ্ম, আষাঢ় তাকিয়ে রয়েছে এদিকে। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়ের সাথে বিব্রত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। সে এবার বুঝতে পারল আসল ব্যাপারটা। ছিঃ ছিঃ বড় ভাইয়েরা যে এখানেই রয়েছে সেটা তাদের ধ্যানেই ছিল না। চৈত্র এদিকে তাকাতেই ছেলেরা সব আরো বেশি বি’ব্র’তকর অবস্থায় পড়ে গেল। গ্রীষ্ম বসা থেকে উঠে বাকি দুই ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘গাড়ি এসে পড়েছে বোধ হয়। আমি সামনের দিকে এগোচ্ছি তোরাও আয়।’

গ্রীষ্মকে সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে মৌসন্ধ্যা
মাথা নিচু করে ফেলল। এইরকম ল’জ্জাজনক পরিস্থিতিতে সে বোধহয় এই প্রথম পড়ল। একে একে আষাঢ় আর শরৎও সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। বর্ষা তাজ্জব বনে গেল। তার হাতটা আপনাআপনি আলগা হয়ে গেল। সে প্রকৃত অর্থেই ভাইদের উপস্থিতি ভুলে বসেছিল। মৌসন্ধ্যা ছাড়া পেয়েই বর্ষার পিঠে ধুমধাম দুই ঘা লাগিয়ে দিল। তারপর ফুঁ’স’তে ফুঁ’স’তে বলল,
-‘তুই কি পাগল? তোর আক্কেল জ্ঞান কবে হবে! তুই কি করলি এইমাত্র বুঝতে পারছিস!’

বর্ষার চোখেমুখে স্পষ্ট অনুতপ্ততা দেখা গেল। সে সবসময় করতে যায় একটা করে ফেলে আরেকটা। গ্রীষ্ম ভাই নাহয় চুপ থাকবে, ক্ষ্যা’পাও কিছু বলবেনা। কিন্তু তার আপন বড় ভাই! ছিঃ ছিঃ সে একটু আগে এমন একটা শব্দের ব্যবহার করেছে যা ব্যবহারের স্থান, কাল পুরোপুরি ভুল ছিল। ভাইয়া হয়তো এখন কিছু বলবেনা। বাড়িতে গিয়ে যদি মা’র দেয়? মায়ের কাছে বিচার দেয়?

গাড়ি এসে গেছে। সবাই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মৌসন্ধ্যার বর্ষার উপর রা’গ থাকলেও সে ল’জ্জায় বাকিদের সামনে দাঁড়াতে পারছেনা। ঠিক করল মাইক্রোর পেছনের সিটে বসে পড়বে চুপচাপ। কিন্তু হঠাৎ এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেল। তারা যখন সবাই গাড়িতে ওঠার প্রস্তুতি নিল তখনিই পেছন থেকে একটা গলা শুনে সবাই অবাক হয়ে পেছনে ফিরল।
-‘কিরে, বাকি সব কই গেল?’

বড় খালামণিকে দেখে মৌসন্ধ্যা সহ বাকি সবার চোখ কপালে। হঠাৎ তাকে এখানে কেউ আশা করেনি। গ্রীষ্ম তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘ফুফু! আপনি এখানে? দাদুদের সাথে যান নাই?’
-‘তোর দাদুরা চলে গেছে? আমার পানের বাটা নিতে ভুলে গেছিলাম। সেটা নিতেই ভেতরে গেছি। পান বাটছি তারপর খাইছি। একটু বসলাম! ঘুম আর ঘুম চোখে। বাতের ব্যাথা! একটু শুইছি। ওই আসমা নামের মাইয়াটা ডাক দিয়া উঠাইল।’

আসমা গ্রীষ্মদের বাসায় কাজ করে। বর্তমানে তার কাছেই বাড়ির দায়িত্ব সপে দিয়ে যাচ্ছে তারা। সাথে অবশ্য আরো দুইজন রয়েছে। অনেক দিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী তারা তিনজন। গ্রীষ্মরা কোথাও গেলে তাদের কাছে বাসা সুরক্ষিত রেখে যায়।

হাসনাহেনা বেগমকে দেখে সবাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বয়স্ক মানুষ নিয়ে যাওয়াতে ঝা’মে’লা আছে। আষাঢ় ভীষণ বি’র’ক্ত হয়ে পড়ল। গ্রীষ্মের রা’গ গিয়ে পড়ল সাবাবের উপর। সে ফুফুদের গাড়িতে ওঠানোর দায়িত্ব সাবাবকে দিয়েছিল। ছেলেটা যে এরকম দায়িত্ব জ্ঞানহীন এর মতো আচরণ করবে কে জানত? সবাই গাড়িতে উঠল কীনা একবার দেখে নিবেনা! গ্রীষ্ম তাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল সবাই ঠিকমতো গাড়িতে উঠেছে কিনা! সে হ্যাঁ হ্যাঁ বলছিল বারবার। ধুর! তার নিজেরও ভুল রয়েছে। একবার নিজে গিয়ে দেখে নিলে ভালো হতো। তার ফুফুর সাথে যাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই। ফুফু তাদের সাথে রিল্যাক্সে যেতে পারবে কীনা সেটা নিয়েই সে চিন্তিত। ফুফুকে বলতেই তিনি জানালেন একেবারের পেছনের সিটটায় তিনি আরাম করে শুয়ে ঘুমিয়ে চলে যেতে পারবেন। কথাটা শুনে মৌসন্ধ্যার মুখটা ছোট হয়ে গেল। সে পেছনে বসে যেতে পারবেনা তবে!

বাড়ি থেকে আসমা বের হয়ে এলো। এসে বলল,
-‘ভাইজান! ফুফু তো ঘুমাই গেছিল। রুমের জানালা দরজা লাগাইতে গিয়া দেখি সোফায় ঘুমায়। ইশ, আরেকটু হইলেই তো আপনারা চইলা যাইতেন, তিনি একা পইড়া থাকত।’
-‘তোমাকে ধন্যবাদ আসমা। ভালো কাজ করেছ। ক’ষ্ট করে আরেকটা কাজ করে দাও। একটা নরম ছোট বালিশ এনে দাও। গেস্ট রুমেই পাবে।’

আসমা বালিশ আনতে গেল। আষাঢ় হাসনাহেনা বেগমকে বললেন,
-‘ফুফু? বাথরুমে কাজ সেরে নিয়েছ?’
-‘হুম। বাথরুমে গেছি।’

বর্ষার হঠাৎ করেই পেটে কামড় পড়ল। একটু আগে কোক খেয়েছিল। এক নম্বরটা সেড়ে আসার দরকার। সে বলল,
-‘ভাই আমি একটু ভেতরে গেলাম।’
-‘কেন?’
-‘বাথরুমে যাব।’

আষাঢ় রে’গে গেল। এতক্ষণ ফাউ সময় ন’ষ্ট করেছে। এখন যাওয়ার সময়ে সে নাকি বাথরুমে যাবে! আষাঢ় কিছু বলার পূর্বেই গ্রীষ্ম বলল,
-‘তাড়াতাড়ি যা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

বর্ষা চলেই যাচ্ছিল পেছনে এসে আবার মৌসন্ধ্যাকে টেনে নিয়ে গেল। বলল,
-‘আমার ভ’য় লাগে। তুই দরজার সামনে দাঁড়াবি। চল!’

২২.
বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগিয়ে দিল বর্ষা। অবশ্য বাথরুমের জন্য অল্প সময় নিলেও মৌসন্ধ্যার রা’গ ভাঙাতেই সময় চলে গেছে খুব। দুজনকে আবার আগের মতো হেসে খেলে ফিরতে দেখে সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ আগেও তো থমথমে পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল।
শরৎ ধ’ম’কে উঠে বলল,
-‘এই বেয়াদবের দল! এত সময় লাগছে কেন? বাথরুম করতে গিয়ে ঘুমাই গেছস! থাবড়ানো দরকার সবকয়টারে।’

ক্ষ্যা’পার থেকে ভালো ব্যবহার কাম্য নয়। তাই দুজনে চুপ করে সয়ে গেল। গাড়িতে উঠতে নিলে বর্ষা বলল তারা দ্বিতীয় সারিতে বসবে। গ্লাস খুললে বাতাস পাবে আর এই দিকটা একটু কমফোর্টেবল। তাই তাদেরকে দ্বিতীয় সারির সিটটা ছেড়ে দেওয়া হলো। গ্রীষ্ম সামনে বসল আর তৃতীয় সারিতে আষাঢ় আর শরৎ। পেছনে তাদের ফুফু। বড় মাইক্রোটাতে সাধারণত ষোলো জন বসতে পারে। তবে তারা আটজন বেশ আরামেই বসে রইল। ফুফু অবশ্য গুটিসুটি মে’রে শুয়ে পড়েছেন। এসি ছাড়লে তার ঠান্ডা লাগে তাই গায়ে একটা শাল পেচিয়ে নিলেন।

গাড়ি নতুন বাস স্ট্যান্ড এর পাশে থামাতেই বর্ষা বলল,
-‘কী হলো? এখানে থামল কেন! বাসে যাব নাকি?’
গ্রীষ্ম গাড়ি থেকে বের হলো। বের হওয়ার আগে বলল,
-‘না, আশ্বিন আসছে।’
বর্ষা অবাক হয়ে গেল। বলল,
-‘আশ্বিন ভাইয়ের পরীক্ষা না?’
পেছন থেকে আষাঢ় বলল,
-‘আজ শেষ হলো।’
চৈত্র উল্লাস করে বলল,
-‘বাহ! কি সুন্দর! সবাই একসাথে যাচ্ছি। আশ্বিন ভাই শুধু মিসিং ছিল। এখন সেটাও পূরণ হয়ে গেল।’

তাদের কথার মাঝেই আশ্বিন আর গ্রীষ্ম একসাথে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। আশ্বিন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীষ্ম পেছনের দরজা খুলে দিতেই বোনদের দেখে হেসে বলল,
-‘কিরে! তোরাও আছিস!’
-‘হু। আমরাও আছি।’ বর্ষা বলল।

আশ্বিনকে পেছনে বসতে বললেই সে বলল,
-‘তুমি ড্রাইভারের সাথে সারারাত গল্প করে যেতে পারবে? এমনিতেও তো কথা কম বলো। শ্রাবণ ভাই কিংবা সাবাব হলে এক কথা ছিল। তোমরা তিনজনই স্বল্প ভাষী। দরকার নেই! আমি সামনে বসছি। পরে দেখা গেল ড্রাইভার সহ সবাই দুইঘন্টার মধ্যেই ঘুমে কাতর আর গাড়ি খাদে।’

আশ্বিনের কথা শুনে বর্ষা, মৌসন্ধ্যা, চৈত্র হেসে ফেলল। গ্রীষ্ম আশ্বিনের পিঠে চাপড় মেরে পেছনে গিয়ে বসল। আষাঢ়কে মাঝে দিয়ে সে ডানপাশে জানালার পাশে বসল। আশ্বিন সামনে উঠে বসল। এতক্ষণে মেয়েদের তিনজনের মুখে হাসি ফুঁটেছে। কথা বলার মানুষ যে পেয়েছে, তাই!

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here