জৈষ্ঠ্যের প্রেম পর্ব ২

0
621

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-২)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩.
মৌসন্ধ্যা কিছুতেই চোখ থেকে একটা দৃশ্য সরাতে পারছেনা। কালো শার্ট, প্যান্ট পরিহিত ফরমাল ড্রেসআপে থাকা গ্রীষ্মের সেই পা ছড়িয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকর দৃশ্যটা তাকে যেন তাড়া করছে। সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসছে গ্রীষ্মের সেই তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি, সেই দৃষ্টি যেন এখনও তার গায়ে এসে বিঁ’ধ’ছে।

গ্রীষ্মকে বেশ কয়েক বছর পর মৌসন্ধ্যা দেখতে পেল। চারবছর আগে সে শেষবার গ্রীষ্মকে দেখেছিল। এতবছর পর দেখা হওয়ার কারণ, সে যখন নানাবাড়িতে যায় তখন গ্রীষ্মরা থাকেনা কারণ তারা ঢাকাতেই সেটেলড্। আর তার নানার বাড়ি হলো ফেনীতে। গ্রীষ্মরা যখন ছুটি কা’টাতে আসে তখন আবার তারা থাকেনা। মৌসন্ধ্যার বাবার বাড়ি হলো চট্টগ্রাম। যদিও ফেনী থেকে দূরত্ব অত বেশি না তবুও গ্রীষ্মরা কখনো ফেনীতে এলে চট্টগ্রাম যেত না। আর মৌসন্ধ্যা তো ঢাকাতেই যাতায়াত করত না। যার ফলে গ্রীষ্মদের বাড়িতে আসা হয়নি এর আগে কখনো। অবশ্য মৌসন্ধ্যা না এলেও তার মা এবং ভাই এসেছে।

এটা গ্রীষ্মদের নতুন বাড়ি, মৌসন্ধ্যা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে একবার যখন ঢাকা এসেছিল তখন গ্রীষ্মরা থাকত বনানীতে নিজস্ব ফ্ল্যাটে। এখনও সেই ফ্ল্যাটটা আছে, তবে বাড়ি হওয়ার পর তারা পাঁচ/ছয় বছর হলো এখানে অবস্থান করছে। শেষ যখন তার গ্রীষ্মের সাথে দেখা হয়েছিল তখন সে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে ছুটি কা’টাতে তার নানাবাড়ি গিয়েছিল। সে যখন গেল তখন দেখল গ্রীষ্মরা ঢাকা ফিরছে। ওই তখনও কেবল চোখের দেখা যা দেখেছে। গ্রীষ্মের সাথে তার কথা হয়নি। তার বুঝ হওয়ার পর থেকে এ যাবৎকাল সে গ্রীষ্মের সাথে একটা দীর্ঘ আলাপন করেছে বলে তার মনে পড়েনা।

মৌসন্ধ্যাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বর্ষা মৌসন্ধ্যার মায়েরা যে রুমে থাকছেন সেই রুম আসে। দেখল মৌসন্ধ্যা সেখানেই বিছানায় পা দুলিয়ে বসে আছে। বর্ষা পাশে গিয়ে বসল। আলতো ভাবে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘ওই ভাবে চলে এলি কেন? চৈত্র তো গায়ে বড় হয়েছে মাথায় যে কিছু নেই সেটা তো তুই জানিস। এসব ভেবে রা’গতে নেই।’
-‘না রে। ওর উপর আমি রা’গ করিনি। আসলে!’
-‘কী?’
-‘গ্রীষ্ম ভাইয়ার সামনের আনকম্ফোর্টেবল ফিল হচ্ছিল।’
-‘তবে চৈত্র ভুল বলেনি।’
বর্ষা মৃদু হাসে। মৌসন্ধ্যা নিজের শরীর থেকে বর্ষার হাত সরিয়ে বলে,
-‘ওর কথার মধ্যে অন্য একটা অর্থ ছিল। মানে ও হয়তো ওইভাবে বলেনি কিন্তু ব্যাপারটা সেই পরিস্থিতিতে অন্যকিছু বোঝাচ্ছিল।’
-‘আমরা কেউ তো সেই অন্যকিছু বুঝিনি। তুই এত বুঝেছিস কী জানি! তোর মনে কী আছে!’
বর্ষা ঠোঁট টিপে হাসছে। মৌসন্ধ্যার সেই হাসি দেখে মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিছু বলবে তার আগেই রুমে জুন আসে। জুনকে দেখে মৌসন্ধ্যা বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। জুন তাকে দেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
-‘তুমি সাজলেনা কেন?’
-‘আপু আমার আসলে সমস্যা আছে।’
-‘যেমন?’
-‘স্ক্রিন প্রবলেম। এলা’র্জি হয়ে যায়।’
-‘হবে না এ’লা’র্জি। তুমি আমার সাথে আসো।’
-‘কেন?’
-‘তোমাকে সাজিয়ে দিব।’
-‘না না আপু। আমি এভাবেই ঠিক আছি।’
-‘আমি বলছি ঠিক নেই। এই বর্ষা! ওকে আমার রুমে নিয়ে আয়।’
বর্ষা বসা থেকে উঠে বড় বোনের কথায় মাথা নেড়ে সায় জানায়। যার অর্থ ঠিক আছে। তবে মৌসন্ধ্যা বলে উঠল-
-‘আপু প্লিজ! আমার ইচ্ছে করছেনা।’
-‘সবাই সাজবে আর তুমি কেন সাজবেনা! ভ’য় পেও না। আমার কসমেটিক্স গুলোর কোনো সাইড ইফেক্ট হবেনা। একদম কোয়ালিটি পূর্ণ। ভরসা রাখতে পারো।’

জুনের সাথে কখনো এভাবে কথা হবে মৌসন্ধ্যা ভাবেনি। জুন সবসময় চুপচাপ গম্ভীর এমনটাই সে দেখে এসেছে। আজো ব্যতিক্রম নয়। তবে আজ সে তার সাথে নিজে থেকে এসে কথা বলছে। সাজার জন্য জোর দিচ্ছে। এই মেয়েটিকে না বলে ফিরিয়ে দিতে তাই তার মন সায় দিচ্ছেনা। সে বলল,
-‘আপু আপনি ক’ষ্ট করবেন না। আপনি বরং বর্ষার হাতে পাঠিয়ে দিন। আমি এখানেই নিজে সেজে নিতে পারব।’
-‘সিউর?’
-‘জ্বি আপু।’

বর্ষার হাতে একটা বড় বাক্স ধরিয়ে দিল জুন। সেই বাক্স দেখে মৌসন্ধ্যার মুখ এতবড় এক হা হয়ে গেল। ভেতরে কতরকম কসমেটিক্স। কত কত শেডের মধ্যে একেকটা লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন! মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘আমি তো এতসবের সঠিক ব্যবহার পদ্ধতিই জানিনা। কী করব!’
-‘চাপ নিচ্ছিস কেন? আমি সাজিয়ে দিচ্ছি। তুই চুপচাপ বসে থাক।’

মৌসন্ধ্যাকে বর্ষা বেশ যত্ন করে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। আয়নায় নিজেকে এমন সজ্জিত অবস্থায় দেখে মৌসন্ধ্যার বেশ ল’জ্জা লাগছিল। তার এক্সপ্রেশন দেখে বর্ষা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। এসময় এপ্রিল ছুটে এলো কোথা থেকে। এসে বলল,
-‘এই তোমরা এখানে কেন? অনুষ্ঠান শুরু হবে তাড়াতাড়ি চলো।’
-‘কী বলছিস! এখনও এক ঘন্টার মতো সময় আছে।’
-‘সেটা তো জানি। তবে নাঁচ প্র্যাক্টিস করতে ডাকছে জুন আপু। এই সময়ের মধ্যেই সবাইকে নাঁচ শিখে নিতে হবে।’
-‘নাঁচতে হবে? কই আগে থেকে তো জানাস নি!’
-‘জুন আপু তো ভেবেছিল আমরা নাঁচব। তবে আমরা যে এইরকম প্ল্যান করিনি সে তো জানত না। তার ফ্রেন্ডরা গ্রীষ্ম ভাইয়ের ফ্রেন্ডরা নাঁচবে। এখন আমরা নাঁচব না শুনে সে রা’গারা’গি করছে। শ্রাবণ ভাইয়ের চুল ছিঁ’ড়া বাকি রেখেছে। সবাইকে নাঁচতে হবে এটা তার শেষ কথা।’
-‘আরে নাঁচব কীভাবে! আমরা তো কোনো প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি।’
-‘সেই জন্যেই এখন শিখতে হবে। চলো চলো। দেরি হচ্ছে।’

মৌসন্ধ্যা এবার অ’স্বস্তিতে জমে গেল। এখন যদি তাকেও জোর করে নাঁচায়? না, সে কখনোই এমন ভরা লোকের সামনে নাঁচবেনা।

সবাই মিলে গান সিলেক্ট করে নাঁচ প্র্যাক্টিস করছে। নাঁচ শেখাচ্ছে জুনের বান্ধবী। বেশ দ্রুত সহজ একটি গানে চৈত্র, বর্ষা, এপ্রিলকে সে নাঁচ শিখিয়ে দিল। তারপর ঠিক হলো ছেলে মেয়ে সবাই একসাথে নাঁচবে। সবার জুটি হলো। তবে দুইজনের কোনো জুটি পাওয়া গেল না। আহরার আর মৌসন্ধ্যা হলো সেই দুইজন। আহরার পার্টনার পাচ্ছেনা আর মৌসন্ধ্যা চাচ্ছেইনা। সে নাঁচবেনা স্পষ্ট বলে দিল। এ ব্যাপারে জুন তাকে জোর করল না কোনো প্রকার। তবে আহরার বারবার কানের সামনে এসে বলছে,
-‘আমার সাথে একটু জুটি বাঁধতেই পারো। আমি পার্টনার হিসেবে বেস্ট। তোমার জন্য এত ভালো একজন শিল্পী নিজের শিল্প লোকের সামনে তুলে ধরতে পারবেনা। তুমি কী এমনই চাইছ?’
-‘তুলে ধরবেন না মেলে ধরবেন আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিনা। আপনি অন্য কাউকে খুঁজুন প্লিজ! আমি নাঁচব না। শত অনুরোধ করেও লাভ নেই। দুঃখীত।’
আহরারের মৌসন্ধ্যার কথা শুনে মুখটা ছোট হয়ে গেল। সে ভেবেছিল মৌসন্ধ্যার সাথে জুটি করবে। তাই তো বর্ষার সাথে বা চৈত্রর সাথে জুটি বাঁধেনি। আর এখন সে এইকূল ও হারালো ওইকূল ও হারালো। অগত্যা গোমড়া মুখ করে গিয়ে এক কোণায় চুপচাপ বসে রইল। আর মৌসন্ধ্যার সাথে চোখে চোখ পড়লেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। মৌসন্ধ্যা বুঝে পেল না লোকটা এতটা কেন ডেস্পারেট হয়ে গেছে নাঁচার জন্য! সে আহরারকে পছন্দ করে তারমানে এই নয় তার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মানবে। তার নিজস্ব মতামত আছে। কেউ তার উপর চাপিয়ে দিবে কিছু তার একদমই তার পছন্দ না।

৪.
নাঁচ প্র্যাক্টিস করতে করতে এক ঘন্টার জায়গায় দেড় ঘন্টা পার করে দিল সবাই। এরই মধ্যে জুনদের বাসার কাজের ছেলেটা দৌঁড়ে এসে জানালো তাকে গ্রীষ্ম পাঠিয়েছে। এটা বলতে যে, সবাইকে এবার ছাদে যেতে। এমনিতেও বেশ দেরি হয়ে গেছে। যার ফলে মুরব্বিরা চেঁচামেচি করছে। গ্রীষ্মের কথা শুনে প্রত্যেকটা নড়ে চড়ে উঠল। তারপর মেয়েরা ছয়জন জুনের মাথার উপর কাপড় দিয়ে তাকে নিয়ে ছাদে গেল। মৌসন্ধ্যা তাদের সাথে গেল না। বর্ষা বেশ রে’গে গেছে সেই জন্য। মৌসন্ধ্যা একেবারে সবাই যাওয়ার পর ধীরে সুস্থ্যে ছাদে গেল। এখন সবাই চেয়ারে বসে আছে। কেউ কেউ ছবি তুলছে এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে। জুনকে স্টেজে বসিয়ে রাখা হয়েছে। প্রথমেই জুনের বাবা-মা গেল হলুদ ছোঁয়াতে। পরে সবাই গ্রীষ্মকে ডাকতে থাকে। গ্রীষ্ম তখন রেডি হতে নিজের রুমে গিয়েছিল। ডাকাডাকি খোঁজাখুঁজির পর গ্রীষ্ম ছাদে এলো। দুই তিনজন ছেলেও তার সাথে ছিল। গ্রীষ্ম ছাদে আসতেই দূরে বসে থাকা মৌসন্ধ্যা তাকে আড়চোখে দেখে। হলুদ পাঞ্জাবীটা ফর্সা, সুগঠিত শরীরটাতে কী সুন্দর ভাবে ফুঁটে আছে। তারই সাথে গ্রীষ্মর সেই নজর কাড়া আন্তরিক হাসি। মৌসন্ধ্যার মনে হলো সে বুঝি এই প্রথম গ্রীষ্মকে হাসতে দেখেছে।

বেশ বুঝানোর পর বর্ষার মন গলে। মৌসন্ধ্যা বলল-
-‘তুই তো জানিস আমি ক্রাউড পছন্দ করিনা। আমি তো তোর মতো এক্সট্রোভার্ট না আমি ইন্ট্রোভার্ট। বুঝিস না কেন?’
-‘আচ্ছা বুঝব যদি তুই এখন আমাদের সাথে ফটোশ্যুট করিস।’
-‘আচ্ছা সেটাতে সমস্যা নেই।’

মৌসন্ধ্যা আর বর্ষা ক্যামেরাম্যানকে বলল ছবি তুলে দিতে। সে বেশ ব্যস্ত বাকিদের ছবি তোলায়। আসছি আসছি বলেও আসছেনা এখনও। বর্ষার রা’গ তুঙ্গে। আর একুটপর মেকাপ ঠিক থাকবেনা। এখন ঠিক থাকতে কয়েকটা ছবি তুলে নিলে কী হয়! মৌসন্ধ্যা ভরসা দিয়ে বলল,
-‘তুই রা’গ করিস না। আমি আজ তোর ফটোগ্রাফার। আমার ফোনের ক্যামেরা বেশ ভালো। আর ছবিও ভালো তুলতে পারি। তুই পোজ দে!’

মৌসন্ধ্যা বর্ষার ছবি তুলে দিচ্ছে। কখনো কখনো জায়গা পছন্দ হচ্ছে না আবার কখনো কখনো ছবি সুন্দর উঠছেনা। বর্ষার এত অ’ভি’যো’গম মুখ বুজে স’হ্য করে যাচ্ছে মৌসন্ধ্যা। এবার তারা এসেছে সিঁড়ির কাছে, বর্ষা এবার এখানে ছবি তুলবে। মৌসন্ধ্যা উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় তার পেছনে কে আসছে বা যাচ্ছে খেয়াল করেনি। আর সেও ছবি তোলায় এতটাই মগ্ন যে পা পেছাতে পেছাতে যে দরজা আ’টকে ধরেছে সেই খেয়ালও নেই। বর্ষা তো আরেকটু দূরে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছে তাই তারও এদিকে খেয়াল নেই। মৌসন্ধ্যা মোবাইলে বেশ মন দিয়ে বর্ষাকে ফোকাস করছে তখনিই তার পেছন থেকে একজন পুরুষ গলা শোনা গেল। ভরাট পুরুষালি কন্ঠ। শুনতে আকর্ষণীয়।
-‘এক্সকিউজ মি!’
আচানক কথাটা শুনে মৌসন্ধ্যা এক পা পেছনে ফেলে পড়ে যেতে নিতেই গ্রীষ্ম তার হাত শক্ত করে ধরে আগের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর আবারও সেই গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
-‘এই জায়গাটা ছবি তোলার জন্য পার্ফেক্ট না। তোমরা ভেতরে যাও বা নিচে যেতে পারো। সেখানেও ফটোশ্যুট করার জন্য ডেকোরেট করা আছে।’

মৌসন্ধ্যা কী বলবে বুঝে পেল না। সে গ্রীষ্মের দিকে তাকিয়েই রইল। পেছন থেকে বর্ষা বলল,
-‘ভাইয়া? তোমার ফোনটা দাও না! আমরা ছবি তুলব।’
গ্রীষ্ম ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘আমার ফোন কেন?’
-‘ওই ইতর ক্যামেরাম্যানটা আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছেনা। আমরা একজন আরেকজনের ক্যামেরাম্যান হয়ে গেছি এখন। কিন্তু ছবি তেমন ভালো আসছেনা। তোমার আইফোন ফোর্টিন প্রো ম্যাক্সটার ছবি তো বেশ ভালো আসবে। দাও না!’
গ্রীষ্ম একবার জৈষ্ঠ্যের দিকে তাকালো। জৈষ্ঠ্য মাথা নিচু করে রেখেছে। সে বর্ষার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘পাসওয়ার্ড হলো ডাবল সেভেন ডাবল টু ডাবল জিরো। মনে থাকবে?’
-‘থাকবে।’
-‘আর শোন! এরকম রি’স্কি জায়গায় ছবি তোলার দরকার নেই। পড়ে টড়ে হাত পা ভাঙবি তোরা আর দো’ষ হবে আমাদের। তাই স’ত’র্ক থাকবি আগে থেকেই বলে দিলাম।’

এই কথা শুনে ফট করে মৌসন্ধ্যা মাথা তুলে গ্রীষ্মের দিকে তাকালো। গ্রীষ্মও সেই আজব রকম প্রাণী। মৌসন্ধ্যার চোখের দিকে সরাসরি তাকায়। যার ফলে মৌসন্ধ্যা নিজেই তালহারা হয়ে যায়। বর্ষা ভাইকে মনে থাকবে বলে মৌসন্ধ্যার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল নিচে।

নিচে দুইবোন বেশ কিছু ছবি তুলল। ক্যামেরাম্যান পরে নিজে এসে তাদের ছবি তুলে দিল সময় লাগিয়ে। অবশ্য ক্যামেরাম্যানটাকে গ্রীষ্মই পাঠিয়েছিল। নইলে সে আসতো কিনা স’ন্দে’হ আছে। বর্ষা তো ফট করে বলেই দিল,
-‘হঠাৎ করে এত ভালো হয়ে গেলেন কীভাবে ভাই!’
জবাবে ক্যামেরাম্যান শুকনা হাসি দিল। তার চোখ মুখের ভাষাই বলে দিচ্ছে সে বেশ বিরক্ত।

ছবি তোলা শেষে বর্ষা গ্রীষ্মের ফোনটা মৌসন্ধ্যার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘চট জলদি ভাইকে ফোনটা দিয়ে আয়। আমার বড় জোর ওয়াশরুম চেপেছে। এখনই না গেলে নয়!’

বর্ষা দৌঁড়ে তার রুমে চলে গেল যাওয়ার আগে মৌসন্ধ্যাকে গ্রীষ্মের রুম দেখিয়ে দিল। অনিচ্চাস্বত্তেও ফোনটা হাতে নিয়ে সে গ্রীষ্মের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে দরজা দেওয়া। সে আলতো হাতে নক করল। ক্ষাণিক পর দরজাটা খোলা হয়। আহরার দরজা খুলল, তারপর সে দরজা ধরে দাঁড়িয়েই বলল,
-‘কী চাই?’
-‘ওনাকে।’
কথাটা বলেই ফট করে জিভে কা’মড় দিল সে। কথা ঠিক করে বলল,
-‘গ্রীষ্ম ভাইয়াকে।’
-‘কেন?’
-‘উনার ফোনটা ফেরত দিতে এসেছিলাম।’
-‘ওর ফোন তোমার কাছে কেন?’
-‘আপনি এত প্রশ্ন করছেন কী জন্যে? উনি কী এখানে আছে নাকি নেই! সেটা বলুন আগে।’
-‘গ্রীষ্ম ছাদে।’
-‘আগেই বলতে পারতেন!’
মৌসন্ধ্যার বিরক্তিমাখা মুখ দেখে আহরার হেসে ফেলল। তারপর বলল,
-‘তোমাকে ডিস্টার্ব করতে ভালো লাগছিল।’

মৌসন্ধ্যা চুপচাপ সেখান থেকে চলে এলো। এই পাজির উপর সে কোন আক্কেলে ক্রাশ খেতে গেল? ধুর! ক্রাশ তো নয় যেন আস্ত এক বাঁশ। তবুও! ছেলেটাকে তার ভালো লাগে। হয়তো এই দুষ্টু মিষ্টি স্বভাবটাই তাকে পছন্দ করার কারণ!

ছাদে গিয়ে বেশ কিছু ছেলেদের ভীড় দেখে মৌসন্ধ্যা ফিরে আসছিল। তখনিই পেছন থেকে গ্রীষ্ম ডাক দিল,
-‘জৈষ্ঠ্য!’
গ্রীষ্মের মুখে নিজের এই অপছন্দের নামটা শুনে মৌসন্ধ্যা স্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রীষ্ম যে কখনো এই নামে তাকে ডাকবে সে ভাবতেই পারেনি। গ্রীষ্ম কখনো এই নামে ডেকেছিল কীনা তার তো সেটাও মনে পড়ছেনা। শ্রাবণ হলে হয়তো দু একটা কথা শুনিয়ে দিত। গ্রীষ্ম দেখেই পারছেনা। গ্রীষ্ম আরো কাছে এগিয়ে এলো। বলল,
-‘কিছু দরকার?’
-‘না।’
-‘তবে?’
মৌসন্ধ্যা যেন কথা হারিয়ে ফেলল। সে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের কাছে আসলেই কেন মুখের কথা হারিয়ে যায়? এত বেশি অ’স্ব’স্তি কেন হয়? হাত পা কেন ঠান্ডা হয়ে আসে?
গ্রীষ্ম খেয়াল করল মৌসন্ধ্যার হাতে তার ফোন। কিন্তু সে একবারও বলছেনা যে সে ফোনটা ফেরত দিতে এসেছে। গ্রীষ্ম আন্দাজ করেই ফেলল যে ফোনটা ফেরত দিতেই এসেছে। তাই সে ধীমি স্বরে বলল,
-‘ফোনটা ফেরত দিতে এসেছ?’
মৌসন্ধ্যা চট করেই মাথা ঝাকাতে থাকে। এমন করছে যেন এটাই বলার ছিল। তবে একবারও মুখে বলছেনা। গ্রীষ্ম হেসে বলল,
-‘আচ্ছা দাও।’
মৌসন্ধ্যা ফোনটা গ্রীষ্মের দিকে দিতেই গ্রীষ্ম হাতে নিল। তারপর বলল,
-‘আর কিছু বলার আছে!’
মৌসন্ধ্যা খেয়াল করল সে চলে যাচ্ছেনা। শুধু শুধুই দাঁড়িয়ে আছে। বহু ক’ষ্টে সে মুখ ফুঁটে বলল,
-‘না!’

তারপর ছুটে চলে গেল নিচে। গ্রীষ্ম তা দেখে মুঁচকি হাসে। মৌসন্ধ্যার আচার আচরণ তার ভালোই লাগছে।

৫.
রুমে এসে মৌসন্ধ্যা প্রথমে গয়না গুলো খুলল। তারপর যখন চুড়ি গুলো এক এক করে হাত থেকে খুলছিল তখন বর্ষা বলল,
-‘এই ভাইয়াকে ফোনটা দিয়েছিস তো!’
-‘হুম।’
-‘ধন্যবাদ। শোন মৌ! আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরার থেকেও আমাদের গ্রীষ্ম ভাইয়ের ফোনের ক্যামেরার ছবি গুলো দারুন হয়েছে। ইশ! তোর মুঁচকি হেসে মাথা উপরের দিকে তোলার ছবিটা যা হয়েছিল! সমস্যা একটাই সেফটি পিন টা ভেঙে যাওয়াতে শাড়ির আঁচলটা পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ।’
-‘হু। তুই তো ডিলিট করেই দিয়েছিস। এখন আর ওই সুন্দর ছবির শোক লাগাবিনা।’
-‘কে বলল ডিলিট করেছি? আমি একটাও ছবি ডিলিট করিনি। সব ভাইয়ার ফোনেই।’
মৌসন্ধ্যা আ’ৎকে উঠে বলল,
-‘কী! তুই বলিস নি ছবিটা ডিলিট করে দিবি? বলিস নি যে আঁচল পড়ে গেছে এই ছবিটাতে সুন্দর হলেও ডিলিট করতে হবে।’
-‘আমি করতে হবে বলেছি। করিনি তো। করব ভেবেছিলাম পরে ভেবেছিলাম কে’টে নিলেই হবে। তাই রেখে দিয়েছিলাম। আর এরপর ওয়াশরুমে যাওয়ার তাড়াহুড়োয় তো সেটা হলো না।’
মৌসন্ধ্যা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-‘তুই এটা কী বলছিস! তুই জানিস আমার কতবড় সর্বনা’শ তুই করে ফেললি?’

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here