ঈদ উপলক্ষে সবার জন্য নতুন জামা- কাপড় কেনা হলেও মা’য়ের জন্য কিছু বরাদ্দ ছিলো না । মিনিট পাঁচেক আগে ঈদের কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরেছে আব্বা। একাই সারাদিন ঘুরে ঘুরে সবকিছু কিনে এনেছে। বাড়ি ফিরেই সবাইকে নিয়ে বসেছেন। যার যার বরাদ্দ জিনিস তার হাতে তুলে দিচ্ছে। মা শুধু দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে। দাদির আব্বার পাশে বসে আছে, দাদির পাশে ছোট ফুফু, একটু দূরে আমি বসে আছি। মা আমাদের থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ফল কাটছে আর সবকিছু দেখছে। মা’য়ের মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। আব্বা ঈদ উপলক্ষে একদিনেই সবার জন্য কাপড়-চোপড় কেনেন, তাই এখানে মা’য়ের জন্য কিছু না থাকলে এই ঈদে মা কিছুই পাবে না। আব্বা দাদির হাতে পাঁচটা ব্যাগ তুলে দিতে দিতে বললেন,
” আম্মা এখানে মিলিদের সবার কাপড়-চোপড় আছে। আপনার কাছে রেখে দিন। মিলি আসলে দিয়ে দিবেন, আর না আসতে পারলে বাদশা গিয়ে দিয়ে আসবে। ঈদের আগে আমার আর সময় হবে না। ”
দাদি স্বযত্নে প্যাকেটগুলো নিজের কাছে নিয়ে রাখলেন। মিলি আমার বড় ফুফুর নাম। প্রতি বছর ঈদে আব্বা ওদের জন্য কাপড়-চোপড়, নানান উপহার পাঠায়। কখনো কৃপণতা করে না, পাঁছে যদি ফুফুকে কারো কাছ থেকে কথা শুনতে হয়। বড় ফুফুর জন্য বরাদ্দ জিনিসগুলো দাদিকে বুঝিয়ে দিয়ে ছোট ফুফুর জন্য কেনা শাড়িটা বের করলেন। খুব সুন্দর জামদানী শাড়ি।
” ছোট তুই বলেছিলি না যে তোর জামদানীর খুব শখ। এইবার ঈদে তুই জামদানী শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়াবি। একদম পরীর মতো লাগবে আমার ছোট বোনটাকে। ”
ছোট ফুফু যে খুব খুশি হলেন তা তার মুখ দেখেই বেশ বোঝা গেলো। এমনিতে শাড়িটা বেশ সুন্দর, যে কেউই এমন উপহার পেলে খুশি হবে। এখন আব্বার কাছে মাত্র দুইটা ব্যাগ পড়ে আছে।
দাদি উৎসুক গলায় বললো, ” বাবা আমার জন্য কিছু আনলি না?”
প্রতিত্তোরে আব্বা মুচকি হেসে দাদির দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলেন।
“এইটা আপনার জন্য এনেছি আম্মা। এর ভিতর সাবান আর সুগন্ধি তেল সব আছে। ”
দাদি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সবকিছু বের করে দেখতে লাগলেন। তেল, সাবান, শাড়ি সবকিছু একদম ঠিকঠাক আছে। খুশি হয়ে হাসতে লাগলেন। অবশিষ্ট ব্যাগটা আব্বা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ” এই নে তোর শার্ট। নীল রঙের এনেছি। ”
শার্টটা হাতে নিতে নিতে বললাম, ” আব্বা মা’য়ের জন্য কিছু আনেননি? সবাইকে তো দিলেন কিন্তু মা তো বাদ পড়ে গেল। ”
আব্বা কিছু বললেন না। কিন্তু দাদি কর্কশ গলায় বললো, ” তোর মায়ের কত কাপড় লাগে? আলমারি ভরা শাড়ি কাপড়। সেখান থেকেই কিছু একটা পরবে ঈদের দিন।”
” হ্যাঁ দাদি, আমার মা’য়ের কিছু লাগে না। মা’য়ের সবকিছু থাকে। আপনার আর আপনার মেয়েদের প্রতি বছর নতুন নতুন কাপড় লাগে। ”
” আহ্ বাদশা, দাদির সাথে ঠিকভাবে কথা বলো। উনি তোমার বয়সে বড়, বড়দের কি করে সম্মান করতে হয় জানো না? ”
আব্বার কথা মেজাজটা বিগড়ে গেলো। রাগী গলায় বললাম, ” বড়রা সম্মান ধরে রাখতে না জানলে তাকে সম্মান করা যায় না। দাদি হয়তো ভুলে গেছেন সে যেমন আপনার মা, আপনার কাছে তার মূল্য যেমন, তেমনি আমার মা-ও আমার কাছে তেমন। আপনি যেমন দাদিকে কেউ কিছু বললে মানতে পারেন না, তেমনই আমার মা’কে কেউ বাজে কথা বললে আমার সহ্য হয় না। ”
ছোট ফুফু ব্যাঙ্গ করে বললেন, ” তা বাদশা তুই না হয় তোর মা’কে ঈদের কাপড় কিনে দে। তোর যখন এতো দরদ মায়ের জন্য। ”
মা এতো সময় কোন কথা বলেনি। চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছিল, ফুফুর কথায় মুখ খুললেন।
” বনু বাদশা কতটুকু ছেলে যে আমাকে কাপড় কিনে দিবে। ও কি নিজে রোজগার করে নাকি? বড় হলে নিশ্চয়ই দিবে। ”
” ভাবি কিছু মনে করো না। যে ছেলে বড় হয়নি, তার মুখে এতো বড় বড় কথা মানায় না। ”
বাবা ছোট ফুফুর দিকে রাগী চোখে তাকালো। ছোট ফুফু নিজের ঘরে চলে গেলেন। দাদি হয়তো কিছু বলতে চাইলেন তবে তার আগে আব্বা সেখান থেকে চলে গেলো। আছরের আজান দিয়েছে বেশ অনেক সময়, জামায়াত শুরু হয়ে যাবে। আব্বা বেশিরভাগ সময় জামায়াতে নামাজ পড়ার চেষ্টা করে। দাদি কিছু না বলে সবগুলো শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটলেন। আব্বা দাদি বা ফুফুদেরকে কাপড় কিনে দেন এই নিয়ে আমার কোন সমস্যা। কিন্তু বড় ফুফুর শশুর শাশুড়ির জন্যও কেন কাপড় কিনতে হয় বুঝি না। আব্বা চাইলে মা’য়ের জন্য কমদামি একটা শাড়ি আনতে পারতেন। তাতেও মা খুব খুশি হতো। ছোট থেকে দেখে আসছি মা’য়ের কোন বিলাসিতা নেই। আব্বা যে কাপড় পছন্দ করে আনতো মা খুশি মনে সেসব পরে দিন কাটিয়ে দিতো। দাদি ফুফুদের কিছু দেওয়া নিয়ে কখনো মা’য়ের অভিযোগ দেখতে পাইনি। মা বরাবরই আব্বাকে সাপোর্ট করতেন। মা’য়ের এই ভালো মানুষির সুযোগ নিয়েই হয়তো মা’কে ঠকানো হচ্ছে আজ-কাল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। মাগরিবের আজান দিতে বিশ মিনিটের মতো বাকি তখন। প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে ইফতার করি আমি। কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না। বাড়ির ইফতারের সবকিছু গোছানো হয়েছে কিনা দেখতে রান্নাঘরে গেলাম। মা তখন ডাল ধূয়ে একটা বাটিতে রাখছেন।
” ও মা, ডাল দিয়ে কি করবে এখন?”
” এই তো পেঁয়াজু বানাবো। মসজিদে যাবি না?”
” না। আজ যেতে ইচ্ছে করছে না, এখন ডাল বেটে কখন পেঁয়াজু বানাবে তুমি? বেশি সময় নেই আজান দিতে। ”
” আরে হয়ে যাবে। তুই ওজু করে আয়। ইচ্ছে না করলে মসজিদে যেতে হবে না। ”
মা’য়ের কথার উত্তর না দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ির সামনে ভাজাপোড়ার দোকান। পকেটে হাত দিয়ে দেখি আশি টাকা আছে। চল্লিশ টাকার পেঁয়াজু কিনে বাড়িতে ফিরে এলাম।
” মা এই নাও পেঁয়াজু। ডাল রেখে দেও। আর হাত মুখ ধূয়ে এসো। ”
” এসব কিনতে গেলি কেন শুধু শুধু? আমার তো হয়েই এসেছিল প্রায়।”
আমি রাগী চোখে মা’য়ের দিকে তাকালাম। মা কিছু না বলে পিঁয়াজুর প্যাকেটটা নিয়ে প্লেটে সাজাতে লাগলো। দাদি তখন বিছানায় শুয়ে আছে, ফুফুকেও আশেপাশে দেখতে পাচ্ছি না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
ফুফু টেবিলে বসে শরবত বানাচ্ছে। কখন আসলো কে জানে! যাওয়ার সময় তো দেখলাম না। যাক ভালোই হয়েছে, না হলে আজ আমি আব্বুর কাছে নালিশ করতাম। মা একা সব কাজ করবে আর এরা মহারানী হয়ে বসে থাকবে এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সকলের সাথে বসে ইফতার করছি। শুধু আব্বা মসজিদে গেছে। পিঁয়াজুতে কামড় বসাতে বসাতে একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। আচ্ছা যদি আমি এসবের দোকান দিই তাহলে কেমন হয়! বেশি লাভ করবো না, অল্প লাভে সবকিছু বিক্রি করবো। আর লাভের টাকা জমিয়ে ঈদে মা’কে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দিবো। বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই চোখ দুইটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। কিন্তু আমি তো এসব কিছু বানাতে পারি না। তাছাড়া ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি লাগে। তারপর ভাজার জন্য কড়াই, কত রকমের জিনিসপত্র লাগে। সেসব কোথায় পাবো! চোখের মাঝে জ্বলে ওঠা স্বপ্নটা মুহুর্তে নিভে গেলো। সে-ই সাথে মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়েই ইফতার শেষ করলাম। মাগরিবের নামাজ শেষ করে পড়তে বসলাম। মন কিছুটা হালকা হয়েছে। আল্লাহ কাছে বলেছি একটা উপায় বের করে দিতে। আল্লাহ চাইলে সবকিছু সম্ভব।
বইখানা সামনে নিয়ে বসে আছি। কিন্তু পড়ায় মন বসছে না। খাতা বের করে অংক করতে আরম্ভ করলাম, যদি একটু মন বসাতে পারি। দুইটা অংক শেষ করতে পারিনি বাড়িতে কিসের চিৎকার চেচামেচি শুরু হলো।
বই খাতা বন্ধ করে সেদিকে হাঁটা দিলাম। কি জানি কি হলো আবার!
আব্বা গম্ভীর হয়ে বসে আছে। ফুফুর হাতে আজকের নতুন শাড়িটা। ফুফু চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছে। দাদি আল্লাহ গো আল্লাহ গো বলে বিলাপ করছে। মা একটু দূরে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত কিছু বুঝতে পারলাম না।
” কি রে ছোট কি হয়েছে? কাঁদিস কেন তুই?”
আব্বার প্রশ্নের বুঝতে পারলাম কাহিনী এখনও শুরু হয়নি। ঠিক সময়ে এসেছি আমি। ফুফু কাঁদতে কাঁদতে বললো, ” দেখ ভাইয়া! আমার শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে। আমি বিকালে একটু দেখে ছিলাম। একদম ভালো শাড়ি আলমারিতে তুলে রেখেছি। এখন বের করে দেখি এতোটা ছিঁড়ে গেছে। ”
” শাড়ি তো ছেঁড়া থাকার কথা না। আমি নিজে হাতে নিয়ে দেখে ভালো শাড়ি এনেছি। ”
” তাহলে হয়তো কেউ শাড়িটা ছিঁড়ে ফেলেছে। কত মানুষেরই তো আমার সুখ সহ্য হয় না। ”
বেশ বুঝতে পারলাম ফুফু আমাকে বা মা’কে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলছে। কিন্তু আমি একাজ করিনি। মা এমনটা করবে আমি দেখলেও বিশ্বাস করবো না। মায়ের কখনো এমন মানসিকতা ছিলো না।
” কে তোর শাড়ি ছিঁড়বে? আচ্ছা দেখি শাড়িটা কেমন ছিঁড়ে গেছে। ”
ফুফু আব্বার হাতে শাড়িটা দিলেন। আব্বা বেশ গভীর ভাবে শাড়িটা পরীক্ষা করছে। শাড়ি দেখা শেষ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ” কি করে ছিঁড়ল কে জানে! ভালো শাড়ি দেখেই তো আনলাম।
” আরে বাবা কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে। কত মানুষ আছে বাড়িতে। তাঁদের আমার মেয়ের সুখ সহ্য হয় না!”
” কি বলতে চাও তুমি? কে করবে এমন কাজ?”
“ভাইয়া এ নিশ্চয়ই ভাবি বা বাদশার কাজ৷ ওরা ছাড়া আর কে শাড়ি ছিঁড়তে আসবে!”
ফুফুর কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি৷ মা দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সবকিছু শুনছে । হয়তো চোখের কোণ অশ্রুকণা জমেছে।
চলবে
সূচনা পর্ব
#কাঁচের_চুরি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল