#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (৬)
নিজ ঘরে শুয়ে ছিল আবৃত্তি। ভালো লাগছে না হঠাৎ। ওমন প্রশ্ন করাতে ওর ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। তখনি ঘরে এল লেখা। নতুন ক্র্যাচে ভর করে আসছে। তৎক্ষনাৎ তাকাল না আবৃত্তি। চোখ মুখ স্বাভাবিক করে বলল, “তুই আবার হাঁটতে শুরু করেছিস আপু?”
“কত সময় শুয়ে বসে থাকা যায় বল তো। মানুষ তো আমি।”
“তাও ঠিক।”
“বাবা মা আসবে আজ।”
“জানি।”
“তোকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। তোর কি কিছু হয়েছে?”
“কই না তো।”
“মিথ্যে বলিস না।”
“সত্যিই কিছু হয় নি। আচ্ছা আপু বাবা কি এখনো রেগে আছে আমার উপর?”
“ধুর বোকা। বাবা তো রাগ করেন নি। শুধু একটু অভিমান করেছিলেন।”
“তাহলেই ভালো। আমার খুব কষ্ট হয়। আমি বোধহয় সবাইকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।”
আবৃত্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে লেখা বলল, “বাজে কথা বলিস না তো। বাবা মা তোকে কতটা ভালোবাসে সেটা কি বলে দিতে হবে। আর সবটা তো আমি করেছি। বরং তোর কাছে আমি ঋণী।”
কিছু বলল না আবৃত্তি। লেখা উঠতে উঠতে বলল,’রান্না ঘরে ছিলি?”
“হুম।”
“ঝোল ভরিয়ে ফেলেছিস শাড়িতে। যা বদলে নে।”
“ইচ্ছে করছে না।”
“বাবা মা এসে তোকে এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে বল তো। যা বদলে আয়।”
হেলেদুলে জামা বদলাতে গেল আবৃত্তি। ভালো লাগছে না কিছু। সব কেমন জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশ। এক অনিশ্চিত জীবনে দিশাহীন ভাবে হেঁটে চলেছে। জীবনের এক একটা সময় যেন বেশ যন্ত্রণার। হঠাৎ ই আবৃত্তি নিজেকে আবিষ্কার করল এই পৃথিবীতে ভীষণ একা। কেউ নেই কোথাও। চার পাশের সবটাই অমানিশা আর অমানিশা।
চা পানের সাথে সাথে অনেক কথাই হলো দু পরিবারের। এই অনিশ্চয়তার মাঝে কেউ আর দুঃখ টেনে আনলেন না। বরং বিষয়টা কে মসৃণ করার আপ্রাণ চেষ্টা। চা কাপটা নামিয়ে রেখেই তরল রসিকতা করলেন ললিতা বেগম। ওনার এক একটা কথাতে বেশ হাসি তামাশা হচ্ছিল। শব্দের জোর খুব বেশি হওয়াতে নিজ ঘর থেকে শুনতে পেল আবৃত্তি। ভীষণ ভাবে মন ছুটে যেতে চায়। তবে কোথাও একটা আড়ষ্টতা জড়িয়ে রেখেছে। পা যেন আকড়ে ধরেছে মেঝে। এত বেশি অস্থির লাগল যে বের হতে পারল না আর। কিছু সময় যেতেই ললিতা বেগম এলেন। কথার খেই হারিয়ে ফেলা আবৃত্তি হঠাৎ ই কেঁদে উঠল। বুকে জড়িয়ে পরম যত্নে আগলে নিলেন ললিতা।,”সোনা মেয়েরা কখনো কাঁদে না।”
“আমি তো তোমার সোনা মেয়ে না মামুনি। খুব বাজে আমি।”
“রাখো সেসব কথা। তোমাকে কত দিন ধরে দেখিনা। আগে প্রাণ ভরে দেখতে দাও তো।”
“আমি সরি মামুনি।”
“আবার! কত বার দুঃখ প্রকাশ করে মানুষ। হয়েছে তো।”
“আমার খুব গিল্টি ফিল হচ্ছে। অশান্তিতে মস্তিষ্ক ফেঁটে যাচ্ছে। বাবার সামনে যাওয়ার মুখ নেই।”
“লক্ষি মেয়েরা কখনো এমন বলে না আবৃত্তি। তাছাড়া এতে তোমার দোষ কোথায়। সবটা ঘটেছে লেখার ইচ্ছেতে। তুমি কেবল বাধ্য পাখি।”
তবু ও কান্না থামল না আবৃত্তির। বেশ অনেক টা সময় কাঁদল জড়িয়ে। একটা সময় স্থির হলো। নাক টেনে টেনে বলল, “আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসি। তুমি বসো।”
বাথরুম থেকে পানি দিয়ে এসে নিজের ঘরে বাবাকে আবিষ্কার করে আরেক বার কান্নায় ভেঙে পড়ল আবৃত্তি।আসাদ সাহেব ধমকে উঠলেন। রাশ ভারী কণ্ঠ তার।,”আমি জানতাম সাহসী তুমি। কবে থেকে এমন ভীতু হলে? এমন মেয়েটা তো আমার নয়।”
“আমাকে ক্ষমা করো বাবা।”
“ক্ষমা করব না। তুমি আমাকে ব্যথিত করলে। আমি ভাবি নি তোমাকে এমন বিধ্বস্ত দেখতে পাব। আশাহত করলে আমায়।”
কথা আটকে যাচ্ছে আবৃত্তির। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন আসাদ সাহেব। মাঝে মধ্যেই তরল রসিকতা করছেন ললিতা। না হেসে পারছে না আবৃত্তি। দু চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,”আই লাভ ইউ মামুনি, বাবা। আই লাভ ইউ সো ভেরি মাচ।”
স্রোত হারিয়ে খেয়া যেমন লুটিয়ে পড়ে আবৃত্তির অবস্থা ও তেমন। গত তিন মাস বার বার লুটিয়ে পড়েছে অগচরে আবডালে। সুক্ষ্ম বেদনা গুলো গ**লা টি**পে ধরেছে যেন। সব মিলিয়ে অসহ্য এক জীবন। লেখা আজকাল একটু বেশিই অসুস্থ। দিন শেষে কথা বলার মানুষ অবধি থাকে না আবৃত্তির। এই তো গত দিন জ্বরে বমি করল তাও বেশ কয়েক বার। কেউ ছিল না পাশে। লেখার অসুস্থতা আবৃত্তি কে বুঝিয়ে দিল কঠিন হতে চলেছে ভবিষ্যৎ। সকাল সকাল ই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তবে বৃষ্টিটা এত বেশি যে বাড়ির বাইরে এক পা ফেলা মুশকিল। একটা গাড়ি ও দেখা যাচ্ছে না। ক্র্যাচে ভর করে আসে লেখা। হাতে দই মিষ্টি। আবৃত্তি অবাক হয় নি। এ বাড়িতে একজন ই ওর আপন জন। হাজারো ব্যথার মাঝে ও মনে রেখেছে ওর পরীক্ষার কথা। আবৃত্তি সামনে এল। আপুকে দু হাতে আলিঙ্গন করল।
“ভালো করে পরীক্ষা দিবি। যা পড়েছিস ইনশাআল্লাহ সব ই আসবে দেখে নিস।”
“হুম আপু। আগে বল তোর শরীরটা কেমন এখন। আমি তো গত দুদিন একটু খোঁজ ই নেই নি।”
“যাচ্ছে দিন। আমি ঠিক আছি। তোর তো পরীক্ষা তুই কি করে খোঁজ খবর নিবি। এমনিতে ও কত সময় নষ্ট হলো। এখন হা কর তো।”
দই মিষ্টি খাওয়াল লেখা। আবৃত্তির ললাটে চুম্বন করে বলল,”জীবনে সফলতা আসুক।”
“আমি যাচ্ছি তাহলে। আপু তুই ঘরে যা।”
“কি করে যাবি?”
“ছাতা নিয়ে যাই। সামনের মোড়ে হয়ত রিক্সা পাব।”
“কোনো দরকার নেই।”
“তাহলে?”
“উন্মেষ তোকে পৌছে দিবে।”
“কোনো দরকার নেই আপু। আমি একাই যেতে পারব। ঐ টুকু পথ। তারপর ই তো রিক্সা বাস কিছু একটা পেয়ে যাব।”
“কথা বলিস না তো।”
শার্টের হাতা ফোল্ড করে বেরিয়ে এল উন্মেষ। মুখটা স্বাভাবিক। আবৃত্তি বুঝে ছেলেটা খুব বেশি খুশি নয়। তবে মুখে একটা আলাদা ভাব ঝুলিয়ে রেখেছে। লেখা দেখল টাইটা ঠিক নেই। অবশ্য ঠিক হবেই বা কি করে। বিগত তিন বছর ধরে লেখা পরিয়ে দিয়েছে টাই। একদম ই অভ্যেসহীন হয়ে গেছে উন্মেষ। টাইটা ঠিক করে দিল লেখা। আবৃত্তি হাত কচলাচ্ছে শুধু। চোখের দৃষ্টি মেঝেতে।
“সাবধানে যাবে। পৌছে দিয়ে আমায় কল করবে।”
“ঠিক আছে।”
“আর আবৃত্তির এক্সাম শেষ হলে নিয়েও আসবে। বৃষ্টি আজ থামবে বলে মনে হচ্ছে না।”
“হুম।”
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলেন গার্ড নুরুল চাচা। গত দিন কাঁদা ছিল খুব। সে জন্যেই ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলেন। লেখা আবৃত্তি কে নানান পরামর্শ দিচ্ছে। গাড়িতে উঠার সময় উন্মেষ বলল, “সামনে এসে বসো।”
বসল আবৃত্তি। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওর। এই যে তিন মাস চলে গেল অথচ কখনো উন্মেষের সাথে একটার বেশি দুটো কথা হয় নি। আড়চোখে তাকাতেই লক্ষ্য হলো উন্মেষের খোঁচা দাড়ি গুলো নেই। ক্লিন সেভ করা মসৃন গালটা দেখে আবৃত্তির রাগ হলো। সব ভুলে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,”ক্লিন সেভ কেন করেছেন। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভীষণ ভালো দেখায়।”
আচরণ অত্যন্ত স্বাভাবিক। আবৃত্তি ভুলে গেছে গত তিন মাসের কথা। তাদের জীবন বদলে গেছে। উন্মেষ নড়েচড়ে উঠে। খেয়াল হয় আবৃত্তির। এক রাশ লজ্জা আর অস্বস্তি এসে স্পর্শ করে পুরো শরীরে। মৌনতা বজায় রাখে দুজনেই। এক পর্যায়ে উন্মেষ শুধায়,
“শরীর কেমন এখন?”
“হু?”
“কাল অসুস্থ ছিলে। জ্বর কমেছে?”
“জী।”
উন্মেষ আর কিছু বলে নি। আবৃত্তি ভারী অবাক। উন্মেষ কি করে জানে ওর অসুস্থ হওয়ার কথা?
পরীক্ষা গুলো ভালো হয়েছে আবৃত্তির। গত বিশ দিন প্রায় পড়াশোনায় ডুবে গিয়েছিল। সমস্ত কিছু ফেলে একটাই মনোযোগ। আজ একদম ফ্রি। আকাশটা মেঘলা। খিচুড়ি বসিয়েছেন দিতিয়া। সাথে বেগুন ভাজা আর ঝাল করে রান্না করা খাসির মাংস। খাবারটা ভীষণ প্রিয় ওর। গন্ধে পেটের ক্ষিধেটা বেড়ে গেল কয়েক গুন। ডাইনিং এ ছিল উন্মেষ। আজ ছেলেটার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভালো লাগল আবৃত্তির। মেয়েটি ডাইনিং এ সময় না ব্যয় করে রান্না ঘরে এল। দিতিয়া একটু স্বাভাবিক। টুকটাক কথা বলেন।
“আমি নিয়ে যাব আন্টি?”
“হ্যাঁ নিয়ে যাও।”
তরকারির বাটি নিয়ে গেল আবৃত্তি। লেখা জানে খিচুড়ি খুব ভালোবাসে মেয়েটি। তাই বলল,”বসে পর তুই।”
“না আমি পরে খাব। তুই বোস তো।”
লেখা বসল। উন্মেষ নিজে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। লেখার চোখটা ভীষণ জ্বলছে। উন্মেষের মতো কাউ কে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হলো। উন্মেষ বলল,”খাচ্ছ না কেন?”
“খাচ্ছি তো।”
“কোথায়?”
“এই তো।”
খাবারের লোকমা মুখে দিল লেখা। আচমকা গলায় উঠে গেল। আবৃত্তি পানি দিল। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উন্মেষ। দুজন যেন লেখার জীবনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“খাবারে মনোযোগ রাখো লেখা। অসুস্থ শরীরটা কে আরো অসুস্থ করে দিও না।”
“আরেকটু পানি খাবি আপু?”
“না ঠিক আছি।”
পানির গ্লাস সরিয়ে নিল আবৃত্তি। দিতিয়া ডিম ভাজি রেখে বললেন,”বসে যাও আবৃত্তি। লেট করো না।”
“পরে খাচ্ছি আন্টি।”
“এখনি বসো।”
একটাই চেয়ার খালি। সেটা হচ্ছে উন্মেষ এর বা পাশ। ডান পাশে বসা লেখা। হাত দিয়ে ওড়নার কোণ গুটাতে লাগল আবৃত্তি। লেখা চোখ দিয়ে ইশারা করল বসতে। আবৃত্তি বসল ঠিক। তবে ভেতরটা অশিষ্ট। উন্মেষ নিজেও খুব একটা খেতে পারল না।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
।**