#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (৫)
উষাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে এসেছে আবৃত্তি। ষোড়শী মেয়ে উষা। বুদ্ধিমতি হলেও সময়ে অসময়ে ভীতু বনে যায়। আবৃত্তি সহজ হওয়ার চেষ্টা করল। তবে উষা যেন আঁতকে আছে। মন খারাপ হলো বেশ। পুরো বাড়িটাতে একমাত্র উষার সঙ্গেই আজ এতটা কথা হলো। অথচ সেই মেয়েটা ও ওকে ছেড়ে চলে গেল। এক রাশ মন খারাপ নিয়ে ঘরে এল সে। পরনের কামিজ রেখে শাড়ি পরল। বরাবরের মতোই আঁচলটা মিশে রইল মেঝের সাথে। চুল গুলো হাত খোঁপা করে ব্যলকনি তে আসতেই মনটা ভরে উঠল। এক সপ্তাহ যাবত এ রুমে থাকলে ও ব্যলকনিতে আসা হয় নি। এত সব গাছ লাগানো যে আনন্দে কেঁদে ফেলল প্রায়। ফুলের গাছ গুলোতে ফুল ফুটে আছে। কিছু গাছ একে বেকে নেমে গেছে ব্যলকনির গ্রিল বেয়ে। আবৃত্তি শব্দ করে বসে পড়ল সেখানটায়। একে একে ছুঁয়ে দিতে লাগল সব গুলো গাছ। পাশের ব্যলকনিতে দাঁড়ানো ছিল উন্মেষ। মেয়েটার এমন পাগলামি দেখে শ্বাস ফেলল বার কয়েক। অন্ধকার থাকায় উন্মেষকে দেখতে পেল না আবৃত্তি। কিছু সময় স্থির হয়ে থাকলেও হঠাৎ ই ভীষণ অস্থিরতা জেকে ধরল উন্মেষের। চিনচিন এক ব্যথা বুক বেয়ে নেমে যেতে লাগল পুরো শরীর জুড়ে। এক সময় মনে হলো সর্বাঙ্গে ব্যথা আর ব্যথা।
লেখাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল উন্মেষ। ঘুম ভেঙে যেতেই লেখা হাসল। ছেলেটার উন্মুক্ত বুকে আঙুল দ্বারা কি সব আঁকতে লাগল। বাহুতে স্পর্শ করে সামান্য কেঁপে উঠল সে। ছেলেটার শরীরের তাপ বেড়েছে। জেগে উঠেছে উন্মেষ। পিট পিট করে চোখ মেলল। “এত ভোরে উঠে পড়েছ তুমি?”
“হুম।”
“কেন উঠেছ? ডাক্তার না বলেছে প্রপার ঘুম যেন হয়।”
“তোমার শরীরের তাপ বেড়েছে। দেখতে দাও আমায়।”
কপাল ছুয়ে দেখল লেখা। তারপর গলাতে হাত রেখে বলল, “জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। থার্মোমিটারটা যেন কোথায়।”
“সেটা তো ও ঘরে রাখা। বাদ দাও। এই টুকু জ্বরে আমার কিছু হবে না।”
“চুপ করবে তুমি। জ্বরে শরীর কাবু! আর তুমি কিনা..”
কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়েছে লেখা। ক্র্যাচটা ভেঙে গেছে গত রাতে। সে কথা মনে হতেই মন খারাপ হয়ে গেল।
“থার্মোমিটারটা নিয়ে আসো না।”
“কি দরকার বলো তো?”
“যাও না একটু।”
“উহু লাগবে না থার্মোমিটার। তাছাড়া এই ভোরে দরজা খুলবে কি।”
“দরজা খোলা লাগবে কেন। আমার কাছে তো চাবি আছেই। তুমি গিয়ে জাস্ট নিয়ে আসবে।”
“থাক না লেখা। শুধু শুধু।”
“শুধু শুধু না। তুমি প্লিজ নিয়ে আসো। না হলে আমার শান্তি হচ্ছে না।”
“তুমি যে কি…!”
“তোমার পাগল বউ।”
“নিঃসন্দেহে ম্যাডাম।”
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বেরিয়ে এল উন্মেষ। আবৃত্তির ঘরের কাছে এসে দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল। বেশ কিছু সময় মনোযুদ্ধ চালিয়ে দরজাটা খুলল। শুয়ে আছে আবৃত্তি। কোথায় তার আঁচল আর কোথায় তার পেটিকোট। শাড়িটা হাঁটু তে এসে ঠেকেছে। যার ফলে মসৃণ পা দুটো বেরিয়ে আছে। আঁচল পড়ে আছে অন্য পাশে। সব মিলিয়ে যা তা অবস্থা। হতাশ হলো উন্মেষ। দ্রুত গতিতে থার্মোমিটার নিয়ে বেরিয়ে গেল। দিতিয়া খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। নামাজ পড়ে আবার ঘুমান। সবে ঘুমাতে যাচ্ছিলেন তিনি। ছেলেকে আবৃত্তির ঘর থেকে চোরের মতো বের হতে দেখে বিহ্বল হলেন প্রায়। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেন না! যদি বউয়ের সাথে এক ঘরে থাকতেই হয় তবে প্রকাশ্যে রোজ এত নাটক করার ই বা কি প্রয়োজন?
দিতিয়া আজকাল বেশ চিন্তিত। বিশেষ করে সেদিনের ঘটনাটার পর থেকে। তার দুশ্চিন্তার অনেক গুলো কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লেখা। তিনি চান না জীবন এর শেষ সময়ে মেয়েটি কষ্ট পাক। যতই বোনের সাথে বিয়ে দিক না কেন কোনো মেয়েই পারবে না নিজের স্বামীকে অন্য কারো সাথে দেখতে। তাই তিনি ভাবলেন ছেলের সাথে একান্তে কিছু কথা বলবেন। সারাদিন কাজে ডুবে থাকে উন্মেষ। সেই সকালে বের হলে আসে সন্ধ্যায়। আর ঠিক তারপর পর ই লাইব্রেরি। সারাক্ষণ সেই লাইব্রেরিতে কাঁটিয়ে দেয়। আজ বাসায় ফিরতেই দিতিয়া বললেন,
“আমার ঘরে এসো কথা আছে।”
মায়ের কথায় বিস্মিত হলো উন্মেষ। সহসা এমন রূপের দেখা মেলা ভার। এক বুক চিন্তা নিয়ে পর পর ই ছুটল মায়ের ঘরে। পান সাজাচ্ছিলেন দিতিয়া। ছোট সময়ে ছেলেকে মাঝে সাঝে পান খাওয়াতেন তিনি। খুব পছন্দের ছিল। তবে সর্বদা নয়। উন্মেষ এর দিকে পান বাড়িয়ে দিতেই নাকোচ করল। অবাক হলেন না দিতিয়া। ছেলে যে তার বড় হয়েছে। আজ কাল বড়ো চিন্তিত হতে হয় তাকে। বিস্ময় ঠেকাতে না পেরে উন্মেষ প্রশ্ন করল।
“কিছু বলতে চাইছিলে মা?”
“হ্যাঁ। খুব ই গুরুত্বপূর্ণ কথা। তবে কি ভাবে বলব বুঝতে পারছি না।”
“বলো না কি বলবে।”
“আচ্ছা শোনো তবে.. ” সামন্য থমকালেন তিনি। পর পর ই দীর্ঘশ্বাস নামিয়ে বলতে লাগলেন,”দেখো আমি মানি আবৃত্তি ও তোমার স্ত্রী। তবে লেখার প্রতি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে তোমার। এমন কিছু করো না যাতে শেষ সময়ে এসে মেয়েটাকে কষ্ট পেতে হয়।”
“কি বললে বুঝতে পারি নি মা।”
দিতিয়াকে অস্বস্তি তে দেখে উন্মেষ বলল,
“বুঝিয়ে না বললে বুঝব কি করে? তুমি বলো না,কি বললে।”
“আমি বলতে চাচ্ছি এখনি আবৃত্তি আর তুমি ঝোঁকের বসে বাচ্চা নেওয়ার কথা ভেবে বোসো না।”
অনেকটা অবাক হলো উন্মেষ। দিতিয়ার এমন কথাতে হতবাক হওয়া ছাড়া উপায় রইল না। উন্মেষ বেশ শক্ত পোক্ত কণ্ঠে জবাব দিল। “আমি তো আবৃত্তির সাথে থাকছি না মা। তাহলে বাচ্চা নেওয়ার কথা আসে কোথা থেকে। তুমি ভুল ভাবছ। আর যা সব সময় চোখে দেখা হয় তা সত্যি না ও হতে পারে।”
উঠে চলে গেল উন্মেষ। দিতিয়া খোলা চোখে তাকিয়ে রইলেন। তবে কি সেদিন ভুল ই দেখেছন তিনি?
ছেলের সাথে কথা বলে ও মনের খচখচ ভাবটা গেল না দিতিয়ার। তিনি ভাবলেন উষাকে দিয়ে আবৃত্তির সাথে কথা বলাবে। তবে উষা ছোট মানুষ। এত শত বলতে পারবে কি না এই নিয়ে ও পড়লেন বিপাকে। অবেশেষ সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই কথা বলবেন আবৃত্তির সাথে। সেদিন বাসাতে মেহমান আসার কথা ছিল। সেই সুযোগ এ কলিকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন আবৃত্তিকে। খুশি মনে ছুটে এসেছে আবৃত্তি। মুখটা পাংশুটে রেখেই দিতিয়া বললেন, “এই ফল গুলো কেটে দাও।”
“ঠিক আছে আন্টি।”
ফল কাটতে লাগল আবৃত্তি। দিতিয়ার ভেতরটা কাঁপছে। কি করে প্রশ্ন করবেন ঠিক বুঝে উঠলেন না। তাই কৌশল খাটিয়ে বললেন,
“আজকালকার ছেলে মেয়ে তোমরা। অনেক বেশি সর্তক। তবু বলে রাখা ভালো, পিল টিল খাও তো ঠিক মতো?”
আবৃত্তি বুঝে নি কথাটা। ফল কাটা রেখে তাকাল দ্রুত। দিতিয়ার মুখে আকাশের সব মেঘ জড়ো।
“বলতে চাচ্ছি এখন তো কি সব ঔষধ বের হয়েছে। যাতে যখন তখন বাচ্চা পেটে না আসে। সেসব খাও তো?”
অস্বস্তিতে পড়তে হলো আবৃত্তিকে। তবু শান্ত ভাবে বলল, “আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক তো নেই।”
“অহ।” চুপ করে গেলেন দিতিয়া। তবে ছেলে তার মিথ্যে বলে নি। কিন্তু সেদিন যে তিনি নিচ চোখে দেখলেন আবৃত্তির ঘর থেকে বের হচ্ছে উন্মেষ। চোখের ভুল হলে সব কিছু কেন এতটা তাজা?
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি