#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_সারা মেহেক
মাঝ রাতে প্রচণ্ড শীত শীত অনুভব হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো। ডিম লাইটের মৃদু আলোতে দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই গুটিশুটি মে’রে অপর পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। উনার অবস্থা দেখে নিমিষেই আঁচ করলাম উনার বেশ শীত করছে। এদিকে আমারও বেশ শীত শীত লাগছে। তাই শোয়া থেকে উঠে আলমারি থেকে একটা পাতলা কম্বল বের করে আনলাম। কম্বলটা ভালোভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সমস্ত শরীর ঢেকে দিলাম।
বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। রুমের একটা জানালা খোলা থাকায় দ্রুত গিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলাম। হয়তো বৃষ্টির কারণে শীতল বাতাস পুরো রুম জুড়ে বিচরণ করছিলো বলেই মাঝ রাতে এতো শীত লাগছিলো আমাদের।
রুমের অন্যান্য জানালা আর বারান্দার দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ কি মনে করে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কপালে হাত দিলাম। সাথে সাথে অনুভব করলাম উনার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বুঝতে সময় লাগলো না যে বৃষ্টিতে ভিজে উনি জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছেন৷ শরীরে পাতলা কম্বল থাকা সত্ত্বেও উনি এখনও শীতে কাঁপছেন। বুঝলাম জ্বর বাঁধিয়ে ফেলায় এই পাতলা কম্বলেও কাজ হচ্ছে না উনার। উনার এ শীত কমানোর জন্য আমি আমার রুমে গিয়ে আমার জন্য তুলে রাখা আরেকটা পাতলা কম্বল নিয়ে এসে উনার শরীরে জড়িয়ে দিলাম। উনার জ্বর কমানোর জন্য আপাতত জলপট্টির ব্যবস্থা করলাম।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে খাটের পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিলাম৷ মাঝে দু একবার অন্য একটি ভেজা কাপড় দিয়ে উনার গলা ও বুকের উপরের অংশ, কাঁধ থেকে হাতের তালু পর্যন্ত ও পায়ের তালু মুছে দিলাম। ভাবলাম এতে হয়তো উনার জ্বর কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন উনার জ্বর কমলো না তখন আমার চিন্তা বাড়তে লাগলো। এতোক্ষণ যাবত কিছুটা চিন্তা হলেও এখন তা প্রবল আকার ধারণ করলো। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম উনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে ওষুধ খাইয়ে দিবো। সে অনুযায়ীই একটা প্যারাসিটেমল এনে উনাকে আস্তেধীরে জাগিয়ে তুললাম। উনি আমার ডাক শুনে ধীরেধীরে চোখ মেলে আমার দিকে তাকালেন। উনার এ চাহনি আমাকে ভেতর থেকে প্রায় ভেঙে দিলো যেনো। মনে হলো উনি ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্টে আছেন। আমাকে যেনো বলছেন, উনাকে এ কষ্টকর অনুভূতিগুলো থেকে দ্রুত বের করে নিয়ে আসি।
আমি দাঁড়িয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে আধশোয়া করিয়ে এক হাত ঘাড়ের পিছনে দিয়ে ভর দিয়ে রাখলাম। অপর হাত দিয়ে উনাকে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। উনি কোনোপ্রকার কথাবার্তা ছাড়াই শুয়ে পড়লেন। আমি আবারো উনার কপালে জলপট্টি দিলাম।
আজ হঠাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এমন দূর্বল অবস্থা দেখে উনার প্রতি আমার ভীষণ মায়া হচ্ছে। উনার চাহনি, তীব্র জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর দেখে মনে হচ্ছে, যদি আমি এ মুহূর্তেই উনার এ কষ্টটা লাঘব করতে পারতাম!
আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কপালে জলপট্টি দিয়ে আলতো হাতে উনার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ড পর উনি দূ্র্বল ও কম্পিত কণ্ঠে আমায় সম্বোধন করলেন। আমি তৎক্ষনাৎ জবাব দিলাম। ব্যস্ত ও চিন্তিত কণ্ঠে বললাম,
” হ্যাঁ প্রোজ্জ্বল ভাই বলুন। আপনার কিছু লাগবে? আমি এখানেই আছি। আপনার পাশেই বসে আছি। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই চোখ মেলে তাকালেন না। তবে একটা ঢোক গিলে জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলেন। পূর্বের ন্যায় দূর্বল কণ্ঠে বললেন,
” তোর হাতটা আমার বুকের উপর রাখ না চন্দ্রিমা…..”
উনার আবদার শোনার সাথে সাথেই আমি ডান হাতটা উনার বুকের উপর রাখলাম। জলে ভেজা সিক্ত ও শীতল হাতখানা দিয়ে অনুভব করলাম উনার হৃৎস্পন্দন। সাথে উপলব্ধি করলাম উনার হৃৎস্পন্দনের সাথে আমার স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। বরং ক্রমশ আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলছে। আমার এ হৃৎস্পন্দনের গতি যেনো আরেক দফা বাড়াতেই প্রোজ্জ্বল ভাই উনার দুটো হাত দিয়ে আমার হাতটা উনার বুকের উপর আরো চেপে ধরলেন। তীব্র জ্বরে পুড়ে যাওয়া উনার দুটো হাত আমার দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিলো। এখনও উনার জ্বর কমছে না কেনো!
প্রোজ্জ্বল ভাই পূর্বের ন্যায় বললেন,
” চন্দ্রিমা, তোর হাত দুটো সবসময় এভাবে ধরে রাখবো আমি। আমি তোকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে চাই না। সবসময় আমি তোকে আমার সাথে রাখতে চাই। থাকবি তো আমার সাথে?”
উনার এরূপ প্রশ্নে আমি খানিক অপ্রস্তুত হলাম। ক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ প্রোজ্জ্বল ভাই, আমি আপনার সাথেই আছি।”
” সবসময় এভাবে থাকবি তো?”
” হ্যাঁ, সবসময় এভাবেই থাকবো।”
” প্রমিস?”
” হ্যাঁ, প্রমিস।”
বাচ্চাদের মতো প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এমন ওয়াদা করিয়ে নেওয়া দেখে আমার ভীষণ মায়া হলো। হয়তো জ্বরের ঘোরে আছেন বলেই এমন করছেন উনি। সুস্থ থাকলে এমন কিছুই হয়তো বলতেন না উনি।
প্রোজ্জ্বল ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” চন্দ্রিমা? এখনও কি অভ্রকে ভালোবাসিস তুই?”
উনার এহেন প্রশ্নে চমকে উঠলাম আমি। ক্ষণিকের জন্য বাকহারা হয়ে গেলাম। উনি পুনরায় বললেন,
” বল না চন্দ্রিমা। এখনও কি অভ্রকে ভালোবাসিস? আমাকে কি ভালোবাসিস না? আমি কি তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না চন্দ্রিমা?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রশ্নগুলো আমার চিন্তাশক্তিকে জমাট বাঁধিয়ে দিলো যেনো। আমি নির্বাক ও হতভম্ব চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। খেয়াল করলাম ইতোমধ্যে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দু চোখের কার্নিশ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। উনি কাঁদছেন! যে প্রোজ্জ্বল ভাইকে আমি কখনো তেমন কাঁদতে দেখিনি সে প্রোজ্জ্বল ভাই আজ আমায় এমন প্রশ্ন করে কাঁদছেন! যেনো জ্বরের ঘোরে এক নিষ্পাপ শিশু হয়ে গিয়েছেন উনি।
প্রোজ্জ্বল ভাই সেই কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
” আমায় ভালোবাসবি চন্দ্রিমা? তোর ভালোবাসা পেতে খুব ইচ্ছে করে আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরি। জানিস? অভ্রকে দেখে আমার খুব হিংসা হতো। মনে হতো ও এ পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষদের একজন। কারণ ও তোর ভালোবাসা পেয়েছে। চন্দ্রিমা, আমাকেও ভালোবাসবি ওর মতো? না না, অভ্রর চেয়েও বেশি ভালোবাসবি আমাকে?”
প্রোজ্জ্বল ভাই আর কথা এগুতে পারলেন না। উনার কথা জড়িয়ে এলো। উনি আর কথা বলার চেষ্টাও করলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন নিশ্চিন্তে। অথচ ঘুমানোর পূর্বে আমাকে ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে গেলেন। আমায় বাধ্য করলেন উনার প্রতিটি কথা নিয়ে ভাবনায় মশগুল হতে।
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের নিকট হতে এমন কিছু শুনতে পাবো তা কখনও আশা করিনি আমি। উনি আমায় নিয়ে এতোটা গভীরভাবে ভাবছেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি কখনো। উনার এ ব্যাকুলতা, জ্বরের ঘোরে আমার প্রতি করা এমন আবদারের অর্থ যেনো বুঝতে গিয়েও বুঝতে চাইছি না আমি। মানতে পারছি না উনার এ আবদারের পেছনের অপ্রত্যক্ষ অনুভূতি প্রকাশ। আমি হতভম্ব চাহনিতে বেশ কিছুক্ষণ উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনার নিঃসংকোচ এ প্রশ্নগুলো আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিলো। চোখের দু পাতা এক করতে পারলাম না বাকি রাতটুকু।
.
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে চমকে উঠলাম আমি। চোখ মেলে দেখলাম সকাল প্রায় দশটা বাজে। অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি৷ গতকাল বাকি রাতটুকু আমি অনেক ভাবনা চিন্তায় কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ফজর নামাজের আধ ঘণ্টা পর দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিলো। তখন চেয়ারে বসেই প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ এখন উঠে দেখি উনি বিছানায় নেই। ওদিকে ওয়াশরুম হতে পানির শব্দ পাচ্ছি। অর্থাৎ প্রোজ্জ্বল ভাই ওয়াশরুমে গিয়েছেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানা গুছিয়ে নিলাম। ততক্ষণে প্রোজ্জ্বল ভাই বেড়িয়ে এসেছেন। উনাকে দেখা মাত্র আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” এখন সুস্থ আছেন তো? জ্বর নেমে গিয়েছে?”
প্রোজ্জ্বল ভাই তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
” হ্যাঁ। এখন আর জ্বর নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর শরীরটা একটু ব্যাথা করছিলো। গোসল করে এখন ভালো লাগছে। ”
” আপনি কখন উঠেছেন?”
” আধ ঘণ্টা হলো প্রায়। আচ্ছা শোন চন্দ্রিমা, আজ কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি। তোর কথাও বলে দিয়েছি। আজ আর কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। ”
” আচ্ছা। ”
এই বলে আমি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। উনার সাথে আর কথা বাড়ালাম না।
–
সকালে নাস্তা করে সবার জন্য চা বানিয়ে আমার আর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের জন্য দু কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসলাম। আজকের আকাশ একদম ঝকঝকে পরিষ্কার। চারপাশের আবহাওয়াও একদম নির্মল। গাছের প্রতিটি পাতা তাদের প্রকৃত রঙে মেতে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৃষ্টি পরবর্তী আবহাওয়াটাও দারুণ উপভোগ্য।
আমি বারান্দা পরিষ্কার করে খালি মেঝেতেই বসে পড়লাম। আমার পাশে এসে বসলেন প্রোজ্জ্বল ভাইও। উনার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেওয়া মাত্রই উনি তাতে চুমুক দিলেন। বললেন,
” তোর হাতের কফিটা যেমন সুস্বাদু। চা-ও ঠিক তেমন সুস্বাদু। ”
আমি এ কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিলাম। প্রোজ্জ্বল ভাই একদিকে চা খাচ্ছেন এবং অপর দিকে চারপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। আর আমি সরাসরি উনার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর গতকাল রাতের স্মৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছি। ভাবছি উনার সেই প্রশ্নগুলোর কথা, আবদারের কথা।
হঠাৎ আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই সন্দেহপ্রবণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার চন্দ্রিমা? আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে কি ভাবছিস? আমায় নিয়ে কি ভাবনায় মশগুল হয়েছিস, হুম?”
আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এ প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিঃসংকোচ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” অভ্র ভাইকে কখনো প্রচণ্ড হিংসা করেছেন আপনি? ” ( পরশুদিন গল্প দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আবার গতকাল বাসায় ফিরেছি। এজন্য ব্যস্ত ছিলাম।
#চলবে