#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১৯
#লেখিকা:সারা মেহেক
ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলকে দেখে কিয়ৎক্ষণ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি৷ আমার বিস্ময়ের মাত্রা আকাশচুম্বী হতে না হতেই প্রত্যাশা আপু এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। চোখের ইশারায় ফিসফিস করে বললো,
” মাথায় ওড়না দে মেয়ে! এভাবে হবু শ্বশুর, শাশুড়ীর সামনে কেউ যায় নাকি!”
আপুর মুখে এহেন কথা শুনে বিস্ময়ে হা হয়ে লোকলজ্জার কথা ভুলো বসলাম। অতি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,
” কিহ!”
আপু সাথে সাথে চোখের ইশারায় আমায় চুপ হতে বললো। বুঝলাম, ভুল জায়গায় ভুল আচরণ করে বসেছি। আমি সাথে সাথে জিব কেটে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপু আর কথা না বাড়িয়ে আমার মাথায় ওড়না টেনে দিয়ে আমায় নিয়ে সোফায় বসালো। আমি বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লাম। তবে আমার মাথায় বইতে লাগলো একরাশ প্রশ্নের ঝর্ণা। এরই প্রেক্ষিতে আমি প্রশ্নাতুর চাহনিতে অভ্র ভাইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম৷ ওদিকে অভ্র ভাইও আমার দিকে চেয়ে আছে। তবে উনার চাহনি আমার ন্যায় নয়। বরং উনার চাহনিতে বিশাল এক অর্জনের খুশি প্রকাশ পাচ্ছে। উনার ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে স্নিগ্ধ হাসি।
” আজকালকার ছেলেপুলেদের দেখি লাজ শরম সব হাওয়া হয়ে গেছে। বড়দের সামনেও কেমন করে একে অপরের দিকে তাকায় আছে দেখো!”
অকস্মাৎ নানুর কণ্ঠে সচকিত দৃষ্টিতে নানুর দিকে তাকালাম এবং তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নিম্নে এনে বসে রইলাম।
নানুর এহেন কথায় খোদেজা মামি হেসে বলে উঠলেন,
” আরে চাচি, বুঝেন না, ছোট থেকে পরিচয় একে অপরের সাথে। এভাবে তাকিয়ে থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। ”
মামি বললেন,
” যাই বলেন না ভাবী, এভাবে সবার সামনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাটা কেমন দেখায় না!”
” ওসব কথা বাদ দিন ভাবী। যে কাজে এসেছি সে কাজটা তো করি। বলুন, বরযাত্রী নিয়ে কবে আসবো আমরা?”
খোদেজা মামির শেষোক্ত কথাটি কর্ণপাত হতেই আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে দৃষ্টি তুলে চাইলাম আমি। কি হচ্ছে এসব! সকাল থেকে একের পর এক ধাক্কা খেয়েই চলছি। প্রথমত অভ্র ভাইয়ের এমন অকস্মাৎ আগমন। উপরন্তু এখন বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত করা! সেটাও আবার আমার মতামত না জেনে! বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত আমার মতামতবিহীন এগুনোয় ভীষণ রাগ হলো। ফলস্বরূপ তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বললাম,
” আমার বিয়ে অথচ আমার মতামত না নিয়েই সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে! এ কেমন কথা!”
আমার এহেন কথায় মামি ও খোদেজা মামির মধ্যে চলা কথাবার্তা মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেলো। আমার কথার প্রেক্ষিতে মামা মুহূর্তেই বলে উঠলেন,
” ধু’র পা’গ’ল মেয়ে! তোর মতামত ছাড়া তোর বিয়ে দিবো, এটা ভাবলি কি করে? তোর মতামত ছাড়া কিছুই হবে না। তোর মামিরা একটু মজা করছিলো শুধু৷
গতকাল রাতেই ইয়াসির ভাই আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। উনার সাথে দেখা হওয়ার পর উনি তোর আর অভ্রর ব্যাপারে বললেন। এও বললেন যে অভ্র তোকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। এসব শুনে ইয়াসির ভাইকে বললাম, কালকে ভাবীসহ অভ্রকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। সবার সামনেই কথা বলে বিয়ের ব্যাপারে আগাবো। তবে এর আগে তোর মতামত নিবো। আর তোর মতামতটাই সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া তোর নানু,মামি আর আমার এ বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই৷ তুই হ্যাঁ বললেই হ্যাঁ।”
এই বলে মামা চুপ হয়ে গেলেন। সাথে সাথে ড্রইংরুমে উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তির দৃষ্টি আমার উপর এসে স্থির হলো। এ মুহূর্তে আমিই তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাদের এ চাহনিতে আমার মধ্যে অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে গেলো। চরম অস্বস্তিতে পড়ে মাথা নিচু করে দু হাত দিয়ে ওড়না খুঁটতে লাগলাম৷ এমতাবস্থায় নানু বললো,
” আমাদেরও বুদ্ধিজ্ঞান সব লোপ পেয়েছে। একটা মেয়েকে এভাবে সবার সামনে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে কেউ! আমি না হয় বুড়ি হয়ে গেছি। তোরা তো এখনও জোয়ান আছিস!
ইশ প্রত্যাশা! যা তো। চন্দ্রিমাকে নিয়ে রুমে যা। আক্কেলজ্ঞান তো কিছু নেই! যা। আমরা রুমে এসেই কথা বলছি ওর সাথে। ”
নানুর এ কথায় আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বিতিকিচ্ছিরি এবং উদ্ভট এ পরিস্থিতি হতে নিস্তার পেতে মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালাম। প্রত্যাশা আপুর অপেক্ষায় না থেকে আমি একাই ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের রুমে চলে এলাম৷ এসেই দরজা লাগিয়ে দিলাম। এ মুহূর্তে আমার মাঝে ঠিক কি অনুভূত হচ্ছে তা নিয়ে আমি নিজেই দ্বিধান্বিত। কেমন এক খুশি, লজ্জা, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা সকল মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে আমার মাঝে। তবে এর মধ্যে অস্থিরতাই অনুভূত হচ্ছে বেশি। হাত পা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে আসছে। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছি, আমার কি এ বিয়েতে রাজি হওয়া উচিত? অভ্র ভাইকে কি নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করা উচিত? এসব প্রশ্নের জবাব হিসেবে কিছু সময় আমার মন কুঠির একদম শূন্য পাতার ন্যায় জবাবহীন হয়ে আসছে। আবার কিছু সময় সে মন কুঠিরে শূন্য পাতায় রঙিন কালি দিয়ে লিখে জানাচ্ছে, হ্যাঁ, অভ্র ভাইকে বিয়ে করা উচিত। কারণ উনার সাথে আমি কখনো অসুখী হবো না। যে মানুষ আমাকে এতো বছর ধরে নীরবে, নিঃস্বার্থে ভালোবেসে গিয়েছে সে নিশ্চয়ই আমার জন্য খারাপ বলে বিবেচিত হবে না।
আমার এ ভাবনার মাঝে দরজায় কড়া নাড়লো আপু। আমি দরজা খুলে দিতেই আপু, নানু ও মামি আমার রুমে প্রবেশ করলেন। নানু আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” বস চন্দ্রিমা। বসেই কথা বলি।”
আমি খাটে বসলাম। আমার সোজাসুজি বসলো নানু। আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” অভ্রকে পছন্দ করিস?”
আমি খানিক ইতস্ততার সহিত বললাম,
” আমি কখনো অভ্র ভাইকে পছন্দ করার নজরে দেখিনি নানু।”
” হুম। বুঝলাম। কিন্তু অভ্র যে তোকে ভীষণ ভালোবাসে চন্দ্রিমা। চার বছর যাবত তোকে ভালোবাসে ও। কম কথা!
আচ্ছা, এখন বিয়ের কথায় আসি। তোর এ বিয়েতে মত কি? অভ্রকে পছন্দ, অপছন্দ করাটা ব্যাপার না। কারন তোর নানা আর আমার বিয়ের সময়ও এমন আগে থেকে পছন্দ বা ভালোবাসার কোনো ব্যাপার ছিলো না। আমি পুরো সিদ্ধান্তটাই আমার পরিবারের উপর দিয়ে দিয়েছিলাম। তারাই পরে বিয়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো। এখন যেহেতু তোদের বিয়ের প্রস্তাবে একপক্ষ হতে পছন্দের বিষয়টা আসে সেহেতু অপরপক্ষের মত নেওয়াটাও জরুরি। এবার বল, তোর কি মনে হয়।”
নিজের মাঝে এতক্ষণ যাবত যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলমান ছিলো, নানুর কথায় সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেলো। বাড়লো অস্থিরতার মাত্রা।
মামি জিজ্ঞেস আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে নম্র কণ্ঠে বললেন,
” তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি আমরা তাই করবো। তুই না বললে আমার বিয়ের কথা আগাবো না। ”
আপুও মামির কথার সুরে সুর মিলিয়ে বললো,
” হ্যাঁ চন্দ্রিমা। তুই যে ডিসিশন নিবি সেটাই ফাইনাল। তবে আমার মতামত যদি জানতে চাস তাহলে বলবো, লাইফ পার্টনার হিসেবে অভ্রর চেয়ে ভালো ছেলে মনে হয় না পাবি। এজন্য একটু ভেবেচিন্তে জবাব দিস। ”
আমি পড়লাম এবার মহা দ্বিধায়। কি করবো, কি করবো চিন্তা করেই আমার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে এলো। একবার দৃষ্টি ঘুরাফিরা করলো একবার নানুর উপর,একবার মামির উপর, একবার আপুর উপর। সর্বশেষ আমার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো দরজার বাইরে থাকা অভ্র ভাইয়ের উপর। অভ্র ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। দরজার বাইরে হেলান দিয়ে দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে মুচকি হাসি সহিত দাঁড়িয়ে আছেন উনি। উনার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন প্রোজ্জ্বল ভাই।
আমার মাঝে এতোক্ষন যাবত চলমান দ্বিধার উত্তাল সাগর অভ্র ভাইয়ের হাসির রেশ ধরে আরো উত্তাল হয়ে উঠলো। তবে এ উত্তল সাগরেই আমার দ্বিধান্বিত মন দিশা খুঁজে পেলো যেনো। মুহূর্তেই মাথা নিচু করে নানুকে বললাম,
” নানু, তোমরা আমার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাতেই রাজি। তোমরা যদি এ বিয়েতে আমার ভালো মনে করো, তবে আমি এ বিয়েতে রাজি। ”
আমার কথা শোনামাত্র নানু আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার পিঠে আদরের পরশ বুলিয়ে বলে,
” আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। তোর এ সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমাদের সবার ইচ্ছা, অভ্রর সাথেই তুই বাকিটা জীবন কাটা। আলহামদুলিল্লাহ, আজই অভ্রর সাথে তোর বিয়ের তারিখ পাকাপাকি করবো আমরা। ”
®সারা মেহেক
#চলবে