#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____২৮
স্কুল ব্যাগটা বুকে ঝাপটে ধরে বাড়ির অভিমুখে হাঁটা ধরল নিশাত। টালমাটাল পায়ে,ধীরে ধীরেই অগ্রসর হচ্ছে ও। ভীতসন্ত্রস্ত মন, নিরীহ হাল নিয়ে গুণে গুণে তিন পা ফেলে থেমে যায় হঠাৎ। তাকায় পশ্চাতে। অচিরেই চোখ গিয়ে আঁটকালো তরল ঈষৎ লাল রক্তে ভিজে ওঠা শার্টের দিক। নিশাতের অনুভূত হলো ওর চোখ ভারী হয়ে উঠেছে, জ্বলছে প্রচন্ড। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে নিমিষেই হয়ে পড়ল ক্ষমতাশূণ্য। ঝুঁকল, নেতিয়ে পড়ল অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিযুগল। অটল হয়ে রইল সেখানেই।
প্রহর বাইকে হেলান দিয়ে থেকে সবটা লক্ষ্য করল। দ্রুত গভীর চাহনি নিক্ষেপ করল ডান বাহুতে। সাদা পট্টির উপর অতি সূক্ষ্মভাবে,নির্বিঘ্নে ভেসে উঠেছে লালচে রঙ। টনক নড়ে ওঠে তার মুহূর্তেই। মস্তিষ্কে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটতে থাকে একটা বিষয়। ক্ষত পায়ে দ্রুত হতে দ্রুত বেগে এসে আঁকড়ে ধরল নিশাতের দুর্বল শরীর। বন্দিনী বানাল বক্ষস্থলে। শক্ত বন্ধনক্রিয়ায় আবদ্ধ করে ছাড়ে পরম স্বস্তির নিঃশ্বাস। সর্বক্ষণ ক্ষেপাটে থাকা কণ্ঠটা হয় কোমল। শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ মুখ তুলবি না। স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস ফেল। র*ক্ত দেখলেই কেন এমন করতে হবে?’
প্রহর নিরব হয়ে গেল এটুকু বলে। পুনরায় চাপা ক্লেশে বলে উঠে, ‘ আমার কাছাকাছি এলেই অনিরাপদ তুই। সেটার ছোটোখাটো প্রমাণ আজ পেলি তো? প্রিয় কোনো জিনিসকে কখনো কেউ নিরাপদহীনতায় ভুগতে দেয় না। তেমন আমিও দেবো না। তুই হলি আমার কাছে শখের পুতুল, যার দেহে আঁচড় লাগলেও আমার জ্বলন নিশ্চিত। ‘
নিশাত দুই হাতে প্রহরের পিঠ আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। কথা হলো প্রহরের হাতের র*ক্ত দেখেই ভেঙে পড়েছে সে। ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকালে বোধহয় এমনতর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তাছাড়া আসার পথে যা ঘটেছে তাতেই দুর্বিষহ অবস্থা। ভ-য় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ঘর বানিয়েছে মানসপটে। এখনও অভ্যন্তর ধড়ফরানোতে ব্যস্ত। চক্ষু গহ্বরে বার বার হানা দিয়ে চলছে সুদূর হতে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা বু**লেট টার ঠিক তার এবং প্রহরের পাশ দিয়ে যাওয়ার দমবন্ধকর দৃশ্যখানি। ভাগ্য সহায় ছিল বলে এটার কবল থেকে রেহাই পেয়েছে তারা। কিন্তু উল্টো হাতে ওকে সামলাতে গিয়ে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে ইটের কণা গেঁথেছে প্রহরের বাহুতে। ওর শরীরে খুব একটা লাগে নি। যা ধকল গিয়েছে সবটা সানন্দে গ্রহণ করেছে প্রহর। পথিমধ্যে ফার্মেসিতে ব্যান্ডেজ সারিয়ে নিয়েছে।
‘ বাড়ির পেছনের হিজল গাছের নিচে নিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। তুই পাঁচ মিনিটে আসবি। ‘
শক্ত, আদেশমূলক কণ্ঠ শুনে নিশাত নড়চড়ে উঠল। সম্বিৎ ফিরে পেল সে। বুক থেকে সরে আসতে নিলে প্রহর কোমর চেপে ধরে। রুষ্ট হয়ে বলল,
‘ পড়ে যাবি তুই। ‘
নিস্তেজ গলায় নত দৃষ্টে বলে উঠল ও,
‘ আমি যেতে পারব। তুমি হাতে আবার ব্যান্ডেজ করিয়ে নিও ভাইয়া। ‘
প্রহর হুকুম করে,
‘ চোখ তুলে আমার দিকে তাকা। দৃষ্টি শুধু আমার মুখের দিকেই রাখবি। ‘
নিশাত কচ্ছপের গতিতে চোখ দু’টোর দৃষ্টি সঁপে দিল মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষটার প্রগাঢ় চাহনিতে। বুকের ভেতর ভয়ংকর যন্ত্রটা বেতাল হয়ে ছুটতে শুরু করে নিমিষেই। পুরুষোচিত দৃষ্টির কবলে থাকতে পারছে না ও। পল্লব জোড়া নুইয়ে পড়ছে বারংবার। প্রহর ঘোর আপত্তি জানাল এতে,
‘ চোখ লুকাচ্ছিস কেন? তাকাতে বলেছি না তোকে? ‘
তন্মধ্যে নিরাবেগ গলায় উত্তর দিল নিশাত,
‘ পারব না। ‘
প্রহর ঘন সন্দেহের চোখে তাকায়। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ কেন পারবি না? আমার চোখের দিকে তাকালে তুই কী ধ্বংস হয়ে যাবি?’
নিশাতের অতিশয় ক্ষীণ কণ্ঠস্বর,
‘ শেষ হয়ে যাব একেবারে। ‘
‘ এটুকু বয়সে শেষ হলে হবে তোর? তোকে শেষ করার জন্য কত কত প্ল্যান করে রেখেছি। চোখে চোখ পড়লে শেষ হবি না তুই। তাকা আমার দিকে। ‘
হৃদয়কুহর বেকাবু,বেসামাল, নিয়ন্ত্রণহীন। জড়োসড়ো হয়ে পড়ল নিশাত। সে অতীব নিচু কণ্ঠে, আনমনেই বলেছিল কথাটুকু। ভাবে নি প্রহরের শ্রবণশক্তি এত তুখোড়। অপ্রকৃতস্থ চাহনি মেলে ধরল প্রহরের সমুখে। মনের অলিন্দে পায়চারি করতে থাকল উচ্ছ্বসিত আবেগ,প্রেম, আকাঙ্ক্ষা। কি সুন্দর মিচমিচে কালো মণির ওই নেত্রযুগল! কত সুন্দর এই শ্যামপুরুষ! কালো মণির আশপাশ অল্পস্বল্প লাল। এ যাত্রায় চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল নিশাত। চেয়ে রইল অনিমেষ, পলকহীন৷ প্রহর কোমরের বাঁধন সামান্য শিথিল করে। বা হাতে ওর চোখের কোণে জমায়িত অশ্রু কণা মুছে দেয় আঙুলের সহায়তায়। আলিঙ্গনে রেখেই বলে,
“চোখ দুইটা লাল তোর
ছিন্ন হইতেছে আমার অন্তর
চরম কষ্টে ছটফট করছে আমার প্রাণ
এর কারণ কী তুই সুইটহার্ট?”
বেগতিক হারে রক্ত ছুটতে থাকে শরীরে। নিশাত জমে গেল,থমকে গেল। বরফ ন্যায় পরিণত হলো সমস্ত কায়া। কিশোরী সে,তবে অতটাও অবুঝ নয় যে প্রেমবাক্য,অনুভূতি বুঝবে না। তবে কী প্রহর ভাই! মুখের কথাগুলো একটুও মিছে লাগছে না ওর কাছে। বরঞ্চ ইচ্ছে করছে সামনের মানুষটাকে ঝাপটে ধরতে। প্রশ্ন করতে, ‘ কবে থেকে আমার জন্য তোমার অন্তর এমন করেই ছটফট করে প্রহর ভাই? ‘ কিন্তু হায় সে পারবে না,যতক্ষণ না গোপনের ভালোবাসা হচ্ছে পরিস্ফুটিত। তবে একটু আধটু উপলব্ধি করতে সফল ও এবার আর তার ভাবনা নিছক নয়। আগে ভালোবাসা শিখে গেলে হয়ত! হয়ত ও শাসন,আদর সবকিছুতে খুঁজে পেত প্রেম।
___________________________
শিমুল বিরক্তির চূড়ান্ত অবস্থায় বিরাজমান। চোখ মুখ কুঁচকে জেদ চেপে যাচ্ছে অতি সন্তপর্ণে। এত এত বিরক্তির কারণ হলো তনুজা। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে সবেমাত্র সদর দরজা ডিঙিয়েছিল ও। এরই মধ্যে তনুজা পিছু ডেকে বসল। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে তুলতে দু তিনটে প্রশ্ন ছুঁড়ে মা–রল আমুদে গলায়,
‘ কোথায় যাচ্ছো ননদিনী? মাগরিবের আজান দিচ্ছে। এ সময় কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে?’
শিমুলের চিল্লিয়ে বলতে মন চাইল,’ না নিয়ে যাওয়া যাবে না,উড়ে এসে জুড়ে বসে ভাবী হতে চাওয়া নীল বাবরিওয়ালি। ‘
অথচ বলল না। বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখায়। এ বাড়ির একটা নিয়ম আছে। কখনোই কোনো অতিথির সাথে কিঞ্চিৎ বা*জে আচরণ করা যাবে না। নিয়মটা বড় কাকার বানানো। ফলস্বরূপ তনুজার সাথে কখনোই না। শত হোক ভাবী হবে এ বাড়ির যদি প্রহর বিয়ে করে আরকি! বলাবাহুল্য তনুজার ব্যবহার যথেষ্ট অমায়িক। সুতরাং খারাপ কোনো গুণাগুণ না পেয়ে অবহেলা কিংবা ঘৃ**ণা করার মতো কান্ড না করতে পেরে শিমুল বড্ড হতাশ।
‘ এক সখির বাড়িতে যাব। এই যাব এই আসব। ‘
তনুজা উজবুকের ন্যায় তাকালো। মুখটা বিকৃত করে বলল,
‘ সখি?’
শিমুলের মস্তিষ্কে এলো শহুরে,বিদেশীনি মেয়ে এই ওয়ার্ড এ জনমে শুনেছে কিনা সন্দেহাতীত। বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
‘ সখি মানে ফ্রেন্ড। ‘
তনুজা উৎকণ্ঠিত, ‘ আমাকে নিয়ে চলো না শিমুল। ওয়েদারটা বেশ সুন্দর। হাঁটতে ইচ্ছে করছে। তোমার ভাইয়াও সেই যে বের হলো খবর নেই। তার জন্য এখানে ছুটে এলাম, নেতাসাহেবই আমাকে ফেলে লাপাত্তা। ‘
শিমুলের অবস্থা বেগতিক। দুনিয়া ভেসে গেলে যাক। তবুও তনুজাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিয়ে গেলে আজ ওর সমাপ্তি অধ্যায় চলে আসবে। ভাইয়ের শিষ্য হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে চিরতরে। সেই সাথে সকল সুযোগ সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যাবে। ভাইয়ের কথা মোতাবেক চললে সে সর্বপ্রথম যেই বেনিফিটটা পাবে সেটা হলো সৌরভের সাথে বিয়ের ব্যাপারে সমর্থন। এটাই ওর জীবনের চাওয়া,ড্রিম। কী করে হাতছাড়া করবে তিলে তিলে গড়া এ স্বপ্ন! চটপটে গলায়, মুখের ওপর বলে উঠল,
‘ আপনাকে নেওয়া যাবে না এখন। আমার দেরি হচ্ছে, যাই।’
বলেই এক পা ফেলল। তক্ষুনি ভরাট,থমথমে কণ্ঠ এলো কর্ণকুহরে।
‘ কোথায় যাচ্ছিস এ অবেলায়? ওরে কেন নিয়ে যাচ্ছিস না?’
মোশতাক সাহেব ভাইকে নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন কেবল। তনুজার কথা খানিকটা শুনেছেন তিনি। খনখনে গলায় বললেন,
‘ তনুজা মামণিকেও নিয়ে যা। আর জলদি ফিরে আসিস। ‘
বড় কাকার সামনে ভিজে বেড়াল শিমুল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,নিয়ে যাবে। মলিন স্বরে তনুজার উদ্দেশ্যে বলে,’ চলেন আপু। ‘
‘ হেই শিমুল,মাই ননদিনী। আপু ডেকো না। ভাবী ডাকলে খুশি হব। ‘- আনন্দিত কণ্ঠস্বর তনুজার।
শিমুল নিরাসক্ত হয়ে বলল,’ ঠিক আছে। ‘
অমানিশা ধরণীতলে ছেয়ে যাওয়ার সূচনা ঘটিয়েছে। রশ্মিকে আড়াল করে প্রদর্শন করে চলেছে আস্তে আস্তে স্বয়ং রাজত্ব। বিস্তর অম্বরে কালো মেঘেরা খিলখিল করে হাসছে যেন। শাঁই শাঁই করে দক্ষিণ হতে উত্তরে বইছে শীতল বায়ু। মোবাইলের মৃদুমন্দ আলোতে শিমুল ক্ষেত পর্যন্ত এলো। আইল ধরেই মজুমদার বাড়ির পেছনে গিয়ে উঠবে। তার পূর্বে তনুজার একটা ব্যবস্থা করতে হবে ওর। নয়ত যাওয়া যাবে না। পাঁচ মিনিটের স্থলে সেই কবে দশমিনিট অতিক্রান্ত হয়ে এগারো চলছে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। ভাইকে জমের মতো ভয় পায় সে। এদিক সেদিক আলো ফেলতেই চট করে চমকে উঠল,বুদ্ধি পেল। যদিও রিস্কি, এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কমছে কম আঁটকে রাখা যাবে গুটি কয়েক মিনিট।
নিচে বসে চিকন, ক্ষুদ্র লাঠিটা হাতে তুলে নেয় শিমুল। অধর কোণে তার সুপ্ত হাসি লুটোপুটি খাচ্ছে। অতি সূক্ষ্মভাবে জোঁকটা লাঠিতে তুলল। তনুজা প্রচন্ড উদ্বিগ্ন,
‘ কী করছো তুমি বসে বসে? অন্ধকার হয়ে গিয়েছে সব। ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না আমি। চলো,চলে যাই শিমুল। ‘
‘ আমি যেতে পারব না। আপনি চলে যান। ‘
‘ না না আমি যাব না৷ গা কেমন ছমছম করছে। তুমি চলো না প্লিজ। ‘
সকরুণ আর্তনাদ তনুজার। শিমুল মন পাল্টে ফেলার উদ্যোগ নেয়। পরক্ষণেই ভাবনা জাগে এছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই। লাঠিটা খুব সাবধানে, অগোচরে তনুজার শাড়ির কুঁচিতে ফেলে দিল। কথার তালে তালে নজরে এলো না তনুজার। শিমুল চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকে,
‘ দেখুন আপনার শাড়িতে জোঁক। নড়বেন না ভাবী। নড়লে এটা আপনার সব র**ক্ত খেয়ে ফেলবে। ‘
তনুজা ভরকে গেল। ঠান্ডার মাঝেও তার সাদা ললাটে ঘাম বিন্দু জড়ো হতে লাগল অকস্মাৎ। নড়ল না একটুও। জোঁকের নাম সে শুনেছে,দেখে নি কোনোকালে। শাড়ির পাড়ের দিকে এটা লেপ্টে আছে বিশদ। রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল পা। আর্দ্র গলায় প্রশ্ন করল,
‘ এখন কী হবে? ‘
শিমুল ঠোঁটের হাসিটা আড়াল করে মিষ্টি আওয়াজে বলল,
‘ আপনি দাঁড়ান। বেশি না দুই মিনিট দাঁড়ান। আমি আমার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে দেখি এটা সরানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। ‘
‘ কী!’- তনুজা চমকে উঠল। তোতলাতে তোতলাতে বলল আবারও,
‘ আমি এতক্ষণ এটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। প্লিজ সেভ মি। তুমি যেও না ননদিনী। ‘
‘ আমি না গেলে আপনার এটা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আপনার হাতে মোবাইল আছে না? ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে একটুখানি অপেক্ষা করুন। ‘
শিমুল আর সেকেন্ড সময়টুকুও বিলম্ব করে নি। ভীত তনুজাকে ফেলে পুকুর পাড় দিয়ে দৌড়ে এলো। বড় বড়, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বিমোচন করে দেয় প্রকৃতিতে। ওই তো ভাইকে দেখা যাচ্ছে পেছন দিক থেকে। দ্রুতপদে হেঁটে এলো সেখানটায়। ডাকল,
‘ ভাই। ‘
প্রহরের হাত নিশাতের চিকন কোমর হতে ঢিল হয়ে এলো। আলতো করে সামলে রাখল ওকে। বোনের চেহারায় ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফেলে কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই।
‘ তোর আসতে এত সময় লাগল কেন? রাত হয়ে গেছে। মামীকে আমি বলেছিলাম নিশু তোর সাথে ছিল। ব্লা**ড দেখে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ওকে আমি নিয়ে যেতে পারব না। তুই ওকে সামলা। আমি মামীকে কল দিচ্ছি। আর হ্যাঁ বলবি ও গরমে একটু সিক হয়ে গেছে। কল দিয়েই এখান থেকে চলে যাব আমি। ‘
শিমুল হ্যাঁ বলতে গিয়ে আঁতকে উঠল। রুহু কেঁপে উঠল মেয়েটার। তড়তড় করে কণ্ঠনালি গলিয়ে বের হলো,
‘ তোমার হাতে কী হয়েছে ভাইয়া?’
প্রহর প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ভাবুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ তনুজার ভাই সমীরণ বাসায় ছিল সারাটাদিন? ‘
‘ ছিল। রুমেই ছিল সারাদিন। দুপুরে খাওয়ার সময় দেখেছিলাম। তারপর আম্মুর কাছ থেকে জানলাম রুমেই আছে। কেন ভাইয়া?’
‘ কিছু না। তুই নিশুকে ধর। ‘
নিশাত নরম কণ্ঠে বাঁধ সাধল,
‘ আমি যেতে পারব ভাইয়া। ‘
‘ তুই আমার থেকে বেশি বুঝিস?’– ভারিক্কি স্বর প্রহরের।
শিমুল এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরল। বলল,
‘ তোকে দুর্বল দেখাচ্ছে নিশু। সমস্যা নেই মামী আসা পর্যন্ত আমি থাকি। ‘
প্রহরের মাথায় রা**গ দাপাদাপি করছে। মস্তিষ্ক অতিকায় উত্তপ্ত। রোকেয়াকে কল দিয়ে উল্টো ঘুরল যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
‘ ওকে মামীর হাতে তুলে দিয়েই আসবি। প্রত্যয় আছে বাজারের দিকে। ও এসে নিয়ে যাবে তোকে। একা যাস না। ‘
শিমুলের তনুজার কথা মনে পড়তেই নিম্নস্বরে হাঁক ছাড়ল,
‘ তনুজা আপু এসেছে আমার সাথে। উনাকে জোঁকের ভয় দেখিয়ে ক্ষেতের মাঝে রেখে চলে এসেছি ভাইয়া। ‘
প্রহর হাতের জ্বলনে চোখ মুখ খিঁচে বিড়বিড় করল,
‘ এই দুই ভাই বোন আমার জান নিয়েই ঠান্ডা হবে। শুধুমাত্র খেলার গুটি বলে এত এত যত্নআত্তি। ‘
গলায় ঈষৎ ঝাঁঝ এনে বলল,’ আচ্ছা আমি দেখছি। ‘
ব্যাস! বড় বড় পা ফেলে চলে গেল প্রহর। বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে গেল নিশাতের সারা অঙ্গে। মা’কে আসতে দেখে কিছুটা ধাতস্থ হলো ও। রোকেয়া ভ্রুঁকুটি করলেন। জহুরি চক্ষে পরখ করলেন মেয়েকে। শিমুলের পানে চেয়ে বেশ অসন্তুষ্টির সুর তুললেন,
‘ তোরা এত দেরি করছস ক্যান? আলতা কইল আজানের আগে পাঠায় দিব নিশুরে। তোর বড় মামা বাড়িত। আমি উনারে কইছি নিশু স্কুল থাইকা ফিরা ঘুমাইতেছে। এমন করলে নিশুরে চাইলেও আর তোদের বাড়িতে দিতে পারমু না। ‘
মুখ হা হয়ে গেল শিমুলের। তার মানে ভাইয়ার সাথে মা-ও যোগ! মিহি কণ্ঠে প্রতুত্তর করে,
‘ একটু দেরি হয়ে গেল মামী। বাড়িতে মেহমান ছিল। সবাই নিশুরে ছাড়তে চাইছিল না। কাল ওকে পাঠিয়ে দিয়েন প্লিজ। ‘
‘ আর সম্ভব না। তোর মামার থাইকা লুকাইয়া এইসব করতে পারমু না আমি। দোয়া করি প্রহরের আংটি পড়ানোর অনুষ্ঠানটা ঠিকঠাক হইয়া যাক। তুই কেমনে যাবি?’
‘ প্রত্যয় ভাইয়া আছে মোড়ে। নিয়ে যাইবে। ‘
‘ আচ্ছা ভালোমতে যাইস। আর গিয়া আমারে ফোন দিস,নইলে চিন্তা লাইগা থাকব। ‘
‘ আচ্ছা মামী। ‘
রোকেয়া নিশাতকে ধরে ঘরের দিকে রওনা হলেন। কলে প্রহর বলেছে নিশাতের শরীর খারাপ, খুব মাথা ব্যথা নাকি! মেয়েকে আজ জেরার তোপে ফেলবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রহরের প্রতি নিশাতের মনে যে প্রেমলীলা জন্মেছে সেটা উনি দূর করেই ক্ষান্ত হবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।
‘ তুই ঘুরেফিরে এই বাড়িতে কী করিস?’
গম্ভীর, তীক্ষ্ণ স্বর। শিমুল আতঙ্কিত। শংকিত, বিস্মিত নেত্রে তাকাল পাশ ফিরে। সৌরভ বক্র চাউনি মেলে রেখেছে স্পষ্টত। জামার ওপর দিয়েই ভয়কে ঠেলেঠুলে ভাগাতে ছোট্টবেলার মতোন বুকে কয়েকটা থু থু দিল ফটাফট। স্মিতহাস্যে,লাজুকতা মিশিয়ে শুধালো,
‘ আমার চাঁদ এ বাড়িতে। রাত হইছে, চাঁদ দেখতে আসমু না?’
এলাচির এলোমেলো ঘ্রাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে বাতাসে,বাতাসে। তোড়জোড় রান্না চলছে বোধহয়। সৌরভ ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে সদ্য নেমে আসা নিশীথের আকাশে রাখল দু চোখ। একাগ্রচিত্তে বলে,
‘ শিমুল! চাঁদ তুই। আর আমি হলাম দাগ। মোহনীয় চাঁদের গায়ে কখনো আমি হতে চাই না কলুষ। ‘
#চলবে,,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার অনুরোধ রইল।)