#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_২২
স্মরণের অসময়ের এই ঘুম দীর্ঘ হতে দিতে পারলাম না আমি। তার হাতের মুঠোয় আটকে রাখা শাড়ির আঁচল আলগোছে ছাড়াতে গিয়ে ব্যার্থ হলাম দারুণ ভাবে। এক ঝলক তার পানে তাকাতেই বুকে শুরু হয়ে ছিলো ধুকপুক ধুকপুক। আঁচল ছাড়ানোর দরুন তার হাত স্পর্শ করতে গিয়ে আরো বিপত্তি বাঁধলো আমার। ধুর ছাই! প্রিয় মানুষ গুলো বড্ড খারাপ হয়। হার্ড অ্যাটাকের কারণ হয় তারা। হৃদপিণ্ডের জন্য এরা ভীষণ ক্ষতিকর। শতবার চেষ্টায় নয়, মাত্র দুবারের মাথাতেই তার হাতে আচমকা আঁচড় পরলো আমার। সে তড়িৎ গতিতে যেন জেগে উঠলো। শুধু চোখ খুলেই খ্যান্ত নয়, উঠে বসে পরলো। আমি ভয়ে একহাতে মুখ চেপে ধরলাম নিজের। স্মরণ নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো। সব ধ্যন জ্ঞান সজাগ করে নিয়ে আমার দিকে কেমনতর এক দৃষ্টি ফেলেই ছেড়ে দিলো শাড়ির আচল। আমি গুটিয়ে নিলাম আঁচল । সে ঠাস করে আবারও শুয়ে পরলো। আমি আবারও অনিচ্ছা নিয়ে তার ঘুমের বিরোধীতা করে বললাম
— সেহেরি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
স্মরণ বন্ধ চোখ টেনেটুনে খুলে তাকালো আমার দিকে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল
— আসছি।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলছিল। প্রিয়ায় বাবা, অঙ্কনের বাবা, অঙ্কন, রিফাত উপস্থিত ছিলো সেখানে। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে আমি কিচেনে যাচ্ছিলাম। চলতি দশায় একবার না চাইতেও চোখ গেলো অঙ্কনের পানে। আকস্মিক ভাবে চোখাচোখি হয়ে গেলো। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে যেন ছুটতে লাগালাম। রান্নাঘরে চাচি আম্মাসহ তার সদ্য হওয়ার বেয়াইন ছিলেন। প্রিয়ার মা ছিলো। অঙ্কনের মাও ছিলেন। সকলে গল্পে গল্পে কাজ করছে। আমি টুকটাক কিছু করতে চাইলে বাঁধা দিলো সকলে। শুধু ছোট একটা দায়িত্ব দিলো। প্রিয়া আর ওয়ারেসিয়াকে ঘুম থেকে ওঠানোর দায়িত্ব। দায়িত্ব মাথায় নিয়ে যথারীতি যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে দিলাম ওদের রুমে গিয়ে। একটাকে টেনে ওঠাতেই আরেকটা ঠাস। আরেকটাকে বকতে গেলেই অন্যটা কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমের সাথে হাত মেলাচ্ছে। আমি তাদের এ নাটক বেশি সময় সহ্য করতে পারলাম না। ধৈর্য হারিয়ে প্রিয়ার মেরুদণ্ড বাঁকা করার মতো একটা কিল মেরে হনহন করে কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে নড়চড় হীন দাড়িয়ে রইলাম। মারের বিকট শব্দ শুনে ওয়ারেসিয়া চমকে উঠে বসে পরলো। প্রিয়াও উঠে পরেছে। সে এক মিনিটের জন্য যেন কোমায় চলে গেলো। অতঃপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বুলি ছুড়লো
— আরে ভাই মাত্রই হৃদয় পোড়া ডাক্তার আমাকে আই লাভ.. বলছিল। ইউটা বলতে দিলি না। এরপর আমি ওরে বলতাম
” আঁত্তে তুয়ারে বেশি গঅঁম লাগে”
কথাটা বলেই প্রিয়া ছলছল চোখের অভিব্যাক্তি মুখে জমিয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর একটা ভেংচি কাটলো। বিছানা থেকে নেমে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। ওয়ারেসিয়া তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। হুট করে বলে উঠলো
— তুই আজকে ভাইয়াকে বলিসনি? দ্বিতীয় বার বিয়ে হলো তোদের। ভাইয়াও তোকে বলেনি? তোদের তো বিড়াট সুযোগ।
— কি বলবে?
— এই যে, আঁত্তে তুয়ারে বেশি গঅঁম লাগে। আমি তো রিফাতকে বলছি। প্রিয়া আপু গত রাতে আমাকে বলেছে এটা আমাদের সংস্কৃতি। এটা নতুন সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের মেয়ে হয়ে স্বামীকে প্রথম রাতে চাটগাঁইয়া ভাষায় ভালোবাসা জানাতে হয়। তাহলে নাকি নিজের ভাষার প্রতি যেমন আমাদের মনে টান থাকে তেমনি নাকি স্বামীরও আমাদের প্রতি অনেক টান হয়।
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম ওয়ারেসিয়ার মুখে প্রিয়ার যুক্তি শুনে। মাথা ঘুরে উঠলো এমন প্যচযুক্ত, জটিল যুক্ত যুক্তি শুনে। ও আবার সংস্কৃতির পেছনে কবে পরলো?
— গত রাতে আমার দুইশো পেইজের খাতা একশো পেইজ করে ফেলেছে প্রিয়া আপু। শুধু অঙ্কন ভাইয়ার নামে চিঠি লিখেছে আর ছিড়ে ফেলেছে।
কথাটা বলেই ওয়ারেসিয়া ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বিছানা ছাড়লো। চলে গেলো আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরের বাইরে। প্রিয়া আর চিঠি? এ যেন মরুভূমিতে পানি। আমি মনে ঝাঁক ঝাঁক বিস্ময়ের আনাগোনা নিয়ে বিছানা গুছিয়ে রাখার জন্য হাত বাড়ালাম বালিশের দিকে। প্রিয়ার বালিশটা তুলে ওয়ারেসিয়ার বালিশের ওপর রাখাতেই চোখে ধরা দিলো উন্মুক্ত একটা চিঠি। পৃষ্ঠা ভরা খোলা চিঠি। চোখের পলক পরছিলো না আমার। অন্যের ব্যাক্তিগত জিনিস দেখতে নেই কথাটা বিবেক ভেতর থেকে বলে উঠলেও নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলাম অস্পর্শে।
প্রিয় ডাক্তার,
কিভাবে চিঠি লিখতে হয় আমি জানি না। পরীক্ষার খাতায় চিঠি লেখা ছাড়া কখনো যে চিঠি লিখতে বসেছি এই কথা আমার ক্ষেত্রে একটুও সত্য নয়। কখনো এমন হয়েছে, এপ্লিকেশন না দিলে স্যার ছুটি দেবে না জেনেও এপ্লিকেশন না দিয়ে অসুস্থ শরীর দিয়ে বসে থেকেছি স্কুল, কলেজে। আর যদি পালিয়ে আসার সুযোগ পেতাম তাহলে তো কথাই নেই। সেই আমি আজ চিঠি লিখছি। শুধু আপনার জন্য। আমি হাজার দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনাকে বোধ হয় আমি মন দিয়ে ফেলেছি। ভুল নিশ্চয়ই করিনি তাই না? আমি তো আমার কর্তাকেই মন দিলাম। হোক না কর্তার মন পোড়া, কর্তার হৃদয়ে দগদগে ক্ষত। কিন্তু ভালোবাসা তো অদগ্ধ হৃদয় দেখে হয় না। যখন স্মরণ ভাইয়া এসে বলল খেয়া তার বউ। তখন আপনার মুখের অভিব্যাক্তি আমি দেখেছি৷ বুঝতে কষ্ট হয়নি আপনি খেয়াকে ভালোবাসেন। আচ্ছা কর্তা এটা শুনবেন না? আমি আপনাকে কখন মন দিয়েছি? গত রাতের দশ মিনিটের ঝগড়ার মাঝে মন দিয়ে দিয়েছি। এই ঝগড়ার পর আমার মনে হয়েছিল, আমার এই হৃদয় পোড়া ডাক্তারের বউ না হলে জীবনে বড়সর একটা বিপর্যয় ঘটবে৷…….
ভীষণ মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো মন একীভূত করে পড়ছিলাম আমি। মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম। এরইমাঝে হুট ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ। আমি তৎক্ষনাৎ হাতের পাশে থাকা বালিশটা অবলীলায় ছেড়ে দিলাম চিঠির ওপর। আড়াল হলো আগের মতো। প্রিয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে এসে আমার নিকট দাড়িয়ে বলল
— চল।
আমি হুম বলে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। এই মেয়েটাও এতো গভীর অনুরাগে ডুব দিয়ে পত্র লিখতে পারে? অকল্পনীয় ছিল। প্রিয়ার সঙ্গে হাটা শুরু করলাম ডাইনিং-এ যাওয়ার জন্য। অবাধ্য, বেয়াদব মন তখনও প্রিয়ার চিঠির কাছে পরে ছিলো। পুরো চিঠি দেখার জন্য আনচান করে উঠা মনকে শাসিয়ে নিলাম। ছোট খাটো অন্যায় করার পরও আমার মনের কোনো অপরাধ বোধ নেই যেন। সে বরং শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে, যাক! মেয়েটা অবশেষে কাউকে ভীষণ ভাবে ভালোবাসতে চায়। আর ছেলেটা এই ভালোবাসা মোটেও ফিরিয়ে দিতে পারবে না। বিয়েতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিমত দেখিনি। সেও নিশ্চয়ই চায় সব দমিয়ে নতুন একটা মনের মালিক হতে। সব ভুলে কারো হাতে হাত রেখে এই ছোট জীবন সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে।
.
খাবার টেবিলে তিন জামাইয়ের জন্য করা হয়েছিল অল্প সময়ে যথেষ্ট আয়োজন। অঙ্কন, রিফাত পাশাপাশি বসেছিল। আর তাদের পাশে একটা চেয়ার ফাঁকা ছিলো স্মরণের জন্য। মেয়েরা কেউ ওদের সাথে খাওয়ার টেবিলে নেই। বাবারা সব বসে গেছে জামাইদের নিয়ে। মায়েরা মেয়েদের নিয়ে বসেছে চাচি আম্মার রুমে। কেউবা বিছানায়, কেউ চেয়ারে, কেউ একটা সিঙ্গেল সোফায়। চাচি আম্মা আর প্রিয়ার মা ছিলেন খাবার পরিবেশন করার দায়িত্বে। ভীষণ ব্যাস্ত ছিলেন তারা নতুন জামাইদের নিয়ে। আমি প্রিয়ার পাশে বসে ছিলাম বিছানায়। হাতে খাবারের প্লেট ছিলো। হাত ধুয়ে এসে প্লেট ধরবো আমি এমন সময় হঠাৎ চাচি আম্মা ডেকে বলে উঠলেন
— খেয়া, স্মরণ কোথায়? দেখছি না তো? তুইকি ডাকিসনি?
আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। এই মানুষটাকে না ডেকে এলাম আমি।
— সেহেরীর সময় শেষ হয়ে যাবে তো। জলদি ডেকে নিয়ে আয়। সবাই বসে আছে।
আমি যাচ্ছি বলে রওনা হলাম নিজের ঘরে। রুমে প্রবেশ করে লাইট অন করে পিছু ফিরতেই বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো। ধীর গতিতে চোখে ঘুরিয়ে আনলাম পুরো রুম থেকে। কিন্তু সে কোথাও নেই। আশ্চর্য হলাম। এটুকু সময়ের মাঝে সেহেরীর আগ মুহূর্তে সে কোথায় যাবে? বেলকনি, ড্রয়িং রুম, ছাদ, চারটে বেড রুম আমি ধুকপুক করা বুক নিয়ে নিঃশব্দে খুজলাম। হতাশ হলাম আমি। সে নেই। ভীষণ রেগেও গেলাম এই মুহূর্তে। সে কি চলে গেছে? চলে গেলেওবা কাউকে বলে গেলো না কেন? এটা কেমন হেঁয়ালি?
চলবে… ইনশাআল্লাহ 🤍