#পথের_ধারে_দূর্বাফুল
৫.
শ্রাবণের পর ভাদ্র এলো, ঋতু বদলে গেলো, আকাশের রঙ বদলালো সাথে বদলালো ফুল পাখিদের জায়গা কেবল বদলে যায় নি প্রেমিক পুরুষের মনের আবহাওয়া। শ্রাবণের শীতল বৃষ্টিতে প্রেমিকার গ্রীবায় আঁকা উষ্ণ ছোঁয়া তাকে রোজ জ্বালায়৷ ঘুম আসে চোখের পাতায় কিন্তু মস্তিষ্কে থাকা প্রেমিকা তাকে ঘুমাতে দেয় না। চোখ বন্ধ হতেই সে কোথা থেকে যেন চলে আসে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার মস্তিষ্ক জুড়ে। এরপর কত-শত কল্প-গল্প হয় রাত ভরে কিন্তু ঘুম আর হয় না। পুরো মাস দ্রুত অতিবাহিত হওয়ার অদম্য ইচ্ছে প্রেমিক বুকে পুষে রাখে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ প্রেমিক হতেই কেমন আহ্লাদী হয়ে উঠে! সে চায় প্রতি মাস কেবল তার জন্য একদিনের হোক, প্রেয়সীর সাথে দেখা করার ইচ্ছে যে তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না।
কিন্তু এইবারের প্রেমিকের অপেক্ষার দীর্ঘ পরীক্ষায় নামলো প্রেমিকা। পহেলা ভাদ্র পেরিয়ে দোসরা, তেসরা ভাদ্র চলে যায়, যেতে যেতে ভাদ্র মাসের পনেরো টা দিন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কিন্তু দূর্বাফুল ধরা দেয় না তার ডাক্তার সাহেবের কাছে। তুমুল বৃষ্টিতে লজ্জা মাখা হাসি নিয়ে সেই যে হারালো এরপর আর কোনো দেখা নেই! এদিক দিয়ে ডাক্তার সাহেবের দিন রাত অসহ্য থেকে অসহ্য হয়ে উঠেছে। চারদিক তার কাছে তুমুল বিরক্তকর কোনো কুহেলিকা হয়ে উঠেছে। সে শ্বাস নিচ্ছে অথচ মনে হচ্ছে বেঁচে নেই। কি অদ্ভুত! একটা মেয়ে তার জীবনটা এমন পানসে করে দিয়ে গেলো? কীভাবে! কীভাবে! প্রশ্নের পর প্রশ্ন জন্মে তবে উত্তর মেলে না। বর্ণ অধৈর্য্য হয়ে উঠে, মস্তিষ্ক তাকে অবাধ্য ঘোষণা করে দেয়। খাওয়া দাওয়া ভুলে সে প্রায় দেবদাস হওয়ার পথে। এমনই একটা দিনের কথা, দিনটা ছিলো ভাদ্র মাসের আঠারো তারিখ। শুক্রবার দিনটাতে বর্ণদের পরিবারের সকলে একসাথে বাড়িতে থাকে কিন্তু আজ শুক্রবার হওয়া স্বত্তেও কেউ বাড়িতে নেই, সবাই আত্মীয়ের কোনো একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছে। পুরো বাড়িতে বর্ণ আর তাদের বাড়ির দেখাশোনা করা মেয়েটা ছাড়া কেউই বাড়িতে নেই। বর্ণ কয়েকদিন হলো হসপিটাল যায় না, ছুটি নিয়েছে। মনে শান্তি না থাকলে কাজে কী আর মন বসে!
চারদিকে আজানের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে। ভাদ্র মাসের কাঠ ফাঁটা রোদ্দুর তখন প্রায় নির্বাসিত হওয়ার পথে। সারাদিনের উত্তপ্তার কারণে বাড়ির ছাঁদের মেঝে কিছুটা গরম হয়ে আছে। আবহাওয়াও উষ্ণ। ছাঁদের রেলিঙের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার সাহেবের ললাট বেয়ে মুক্তোর দানার মতন ঘামের উপস্থিতি দেখা গেলো। ডাক্তার সাহেবের দৃষ্টি ডুবন্ত সূর্যের দিকে আর মন ধোঁয়াশা রমণীর কাছে। ঠিক সে সময়ে বর্ণের সামনে লম্বা একটা লেবুর শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিলো একটি মেয়েলি হাত। বর্ণ আগের মতন আকাশে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই গ্লাসটা নিলো। আনমনেই চুমুক দিয়ে তার কপাল কুঁচকে এলো। চোখ-মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ফেলে শরবতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটা কিসের শরবত করেছো! মিষ্টি বলতে কোনো অস্তিত্বই এটাতে নেই!”
কথাটা বলেই পেছনে তাকাতে সে চমকে উঠে। সে ভেবেছিল তাদের ঘরের গৃহকর্মী টা হয়তো শরবত এনেছে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তার সামনে ছিলো তার কাঙ্খিত মানবী। যাকে দেখার জন্য তার মন, প্রাণ তৃষ্ণায় চৌচির হয়ে উঠেছিল৷ যাকে দেখতে না পেয়ে গোটা পৃথিবী তার কাছে অসহ্য ঠেকেছিল। সেই নারীই তার সামনে মিষ্টি হাসি মুখে টেনে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধারের মাঝে দূর রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো মেয়েটার চোখে মুখে নিবিড় আদুরে চুম্বন এঁকে দিচ্ছে। বর্ণ মুগ্ধ চোখে কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়ে রইলো সে নারীর দিকে। বর্ণ যতবার এই রমনীকে দেখেছে, ঠিক ততবারই তার কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ভিন্ন ভিন্ন আকারে ধরা দিয়েছে। কখনো বা সৌন্দর্য মানে মনে হয়েছে বৃষ্টিতে ভেজা সিক্ত দূর্বাফুল, কখনো বা মনে হয়েছে প্রেমিকের আদরে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া লজ্জাবতী আর আজ সৌন্দর্য মানে মনে হচ্ছে, ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোয় ঝলমল করে উঠা নারী নক্ষত্র।
মুগ্ধতায় মগ্ন হওয়া প্রেমিককে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো রমনী, ঠাট্টা করে শুধালো,
“ডাক্তার সাহেবের কী নড়চড় করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে?”
বর্ণের ধ্যান ভাঙলো নীলাম্বরীর কথায়। সাথে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো লেলিহান শিখার মতন রাগ। সে মুহূর্তেই রেগে গেলো, মুখ ফুলিয়ে বললো,
“এখানে কী আপনার? কেন এসেছেন!”
নীলাম্বরী তার ডাক্তার সাহেবের বাচ্চামো রাগ দেখে সদ্য জন্মানো পুষ্পের ন্যায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে হেসে উঠলো। হালকা আকাশী রাঙা শাড়িটার আঁচল গুছিয়ে পেছন থেকে এনে কোমরে গুঁজে নিলো পটু হাতে। দুই হাত দুই পাশের কোমরে রেখে চোখ ছোটো ছোটো করে বললো,
“চলে যাবো? সত্যি সত্যিই চলে যাবো? বলেন?”
বর্ণ আড়চোখে তাকালো, আকাশ পানে তাকিয়ে বললো,
“চলে যেতেই তো আসেন, আমার বলাতে যদি কিছু হতো তাহলে আপনার শাড়ির ভাঁজে আমার অস্তিত্ব লেপ্টে থাকতো।”
ডাক্তার সাহেবের যে ভয়ঙ্কর রকমের রাগ হয়েছে তা বুঝতে এক মিনিটও দেরী করলো প্রেম রমনীর। সে দুই পা এগিয়ে এলো, নিজের দুই হাতে পেঁচিয়ে ধরলো ডাক্তার সাহেবের গলা, চোখে চোখ রেখে মোহনীয় কণ্ঠে বললো,
“একটি বার যদি আপনি থেকে যেতে বলতেন, আমি হিমালয় সমান অসুবিধা ঠেলেও থেকে যেতাম, কিন্তু আপনি তো কখনো বললেনই না।”
মেয়েলি কণ্ঠস্বর টা কেঁপে উঠতেই বর্ণ আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মেয়েলি ছোট্টো মুখটার দিকে সেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। দূর্বাফুলের চোখে তখন অবহেলার কিছু জলের ঝলমল দেখা গেলো। এতদিনের চেনা চোখে অচেনা প্রতিচ্ছবি দেখে বর্ণ ভ্রু কুঁচকালো, কিছুটা ব্যস্ত হয়ে গেলো প্রেমিক। প্রেমিকার অশ্রু প্রেমিকদের চির শত্রু। কোনো প্রেমিকই বোধ করি তার প্রেয়সীর অশ্রু সহ্য করতে পারে না। তাদের পুরো পৃথিবী তখন বিষাক্ত মনে হয়। বর্ণের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলো না, সেও ব্যতিব্যস্ত হলো, অধৈর্য্য কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছেন কেন?”
মুহূর্তেই নীলাম্বরীর চোখ যেন রূপকথার রাক্ষসীর মতন হাপুস করে গিলে ফেললো নিজের অনাকাঙ্খিত জল টুকু। নীলাম্বরী ঠাট্টা করে বললো,
“প্রেমিককে দেখতে না পেয়ে দু-চোখ আমার অন্ধ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এত সুন্দর একটা নারী অন্ধ হলে ভালো লাগবে! আর আমি অন্ধ হলে আমার ডাক্তার সাহেবকে দু’চোখ ভরে কে দেখবে! এমনেতেই তো এক জনমে আপনাকে দেখার সাধ আমার মিটবে না তার উপর যদি অন্ধ হয়ে যাই তবে চিরজীবন আমার আফসোসে কাটাতে হবে। আমি বুদ্ধিমতী নারী, নিজের প্রতি এমন অন্যায় আমি কখনো মানতে পারবো না, তাই চলে এলাম নিজের চোখকে ধন্য করতে।”
বর্ণের যে আকাশ সমান রাগটা উদয় হয়েছিল তা মুহূর্তে মুখ লুকিয়ে যেন পালিয়ে গেলো। এমন একটা নারীর মোহনীয় প্রেম ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে কী আদৌও কোনো পুরুষের হবে! পুরুষ সবসময় চায় তার প্রেমিকা হবে আহ্লাদী, কথায় কথায় যার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে মুগ্ধতা ঝরে পড়বে। প্রেমিক সেই কোমল প্রেমিকাকেই বুকে এঁকে একটা জীবন নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিতে পারে। বর্ণও ঠিক তেমন প্রেমিকই। প্রেমিকার আহ্লাদ তাকে মোটেও পাথরের মতন শক্ত থাকতে দিলো না বরং বরফের ন্যায় রাগকে শীতল তাপে গলিয়ে দিয়েছে। বর্ণ হেসে উঠলো, কিছুটা অভিমান নিয়ে বললো,
“আপনি এবার আসতে অনেক সময় নিয়েছেন। জানেন না, আপনার বিরহে আমার মন খারাপ হয়!”
“আচ্ছা! তাই নাকি। আর কী কী হয়?”
বর্ণ এবার হাতের গ্লাসটা রেলিঙে রেখে দু’হাতে কোমর জড়িয়ে ধরলো রমনীর। মুচকি হেসে বললো,
“তারপর আপনাকে সামনে দেখার পর সেই মন খারাপ তুমুল প্রেমে রূপান্তরিত হয়, আর সেই তুমুল প্রেম আমাকে ছোটো খাটো ভুল করতে বলে। যেমন- আপনার গাল, কপাল, ঠোঁট,,, ”
বাকি কথা সমাপ্ত করতে পারলো না বর্ণ, তার আগেই তার মুখ চেপে ধরে নীলাম্বরী। চোখ রাঙিয়ে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় ডাক্তার সাহেবের দিকে, মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,
“আপাতত শরবতটা পান করে নিন।”
“কিন্তু এটা ভীষণ মিষ্টি ছাড়া যে!”
নীলাম্বরী শরবতটাতে এক চুমুক দিলো অবাক কণ্ঠে বললো,
“কই মিষ্টি ছাড়া! ভীষণ মিষ্টি তো!”
বর্ণ বাঁকা হাসলো, তার দৃষ্টি ঠেকালো প্রেমিকার ঠোঁটে, প্রেমিকার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিয়ে চুমুক দিলো প্রাণ ভরে, তারপর ফিচলে হেসে বললো,
“এবার তো মিষ্টি লাগছে। কী আশ্চর্য! আপনি ছাড়া আমি সহ পুরো পৃথিবী কেমর পাংশুটে! বর্ণের পুরো পৃথিবী মধুময় করতে থেকে যান না, যত্ন করে রেখে দিবো।”
নীলাম্বরী লজ্জায় মাথা কিছুটা নুইয়ে ফেললো। তা দেখে বেশ উচ্চস্বরে হেসে উঠলো বর্ণ। খুব গোপনে গ্লাসে ঠেকানো ওষ্ঠ টা ঠেকলো প্রেমিকার লজ্জা রাঙা গালে। তা দেখে স্বয়ং চাঁদ লজ্জায় যেন মূর্ছে গেলো। মেঘ গুলো অসময়ের বাদল হয় প্রতিধ্বনি করলো,
“এ কী মিষ্টি লজ্জা!”
#চলবে,,,
©মম সাহা