২.
বৈশাখ মাস যেন হুড়মুড় করে এলো,আবার হুড়মুড় করে চলে গেলো। সে কী উষ্ণতার দহন। শরীর যেন গরমে পুড়ে কয়লা হয়েছে সবার। এয়ারকন্ডিশনার টাও কমাতে পারে না সে উত্তপ্ততা। শহরে প্রায় সব স্বচ্ছল পরিবারে এয়ারকন্ডিশন বিদ্যমান থাকে। রুমের ভিতর যতটা শীতল, বাহিরে যেন ততটাই জ্বলন্ত লেলিহান শিখা।
অবশ্য জ্যৈষ্ঠমাস আসার সাথে সাথে ভীষণ ঝড়ের তান্ডব। এইতো আজ পহেলা জ্যৈষ্ঠ। গতকাল রাত হতে টানা বর্ষণ। থামাথামির কোনো নাম নেই। ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও ঠিক যে কালবৈশাখী ঝড় বৈশাখে না হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসে হচ্ছে। জ্যৈষ্ঠকে দারুণ ভাবে স্বাগত জানাচ্ছে প্রকৃতি।
সময়টা’কে ঠিক ঝড়ময় বিকেল বলা যায়। চারপাশে ভারী বর্ষণ। রাস্তায় মানুষজন নেই বললেই চলে। খুব সীমিত পরিমাণে চলছে গাড়ি। বর্ণের মেজাজ চরম পর্যায়ের খারাপ। এই সময়ই গাড়িটা নষ্ট হতে হলো? ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরবে সে? উফ্ এত বিরক্ত রাখবে কোথায় সে?
শরীরের সাথে কফি কালারের শার্টটা আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে। কাঁধের দু দিকে ভিজে গিয়ে কালো রঙে রূপান্তরিত হয়েছে। সুঠাম তার দেহ। বড় বড় গুছানো চুল গুলো ভিজে চুপসে গেছে। টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে সেথা থেকে। ডাক্তার সাহেবে’র মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ। সবসময় তার সাথেই এমন হয়। প্রয়োজনে’র সময় ঝামেলা হতে হয়।
হঠাৎ রিক্সা থেমে যাওয়াতে অসাবধনতা বশত ঝুঁকে যায় বর্ণ। সামনের নীল রাঙা পলিথিন টা সবে সরিয়েছে রিক্সা চালককে দু একটা কঠিন কথা বলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কঠিন কথা আর বলা হলো না। কণ্ঠের কথা কণ্ঠতেই আটকে গেলো। বিরক্ত ভরা মুখমন্ডলে ভর করলো মুগ্ধতা। বিস্মিত কণ্ঠে উচ্চারিত করলো,
“দূর্বাফুল!”
অবিরাম বৃষ্টি ধারার মাঝে ভেসে এলো রিনরিনে নারী কণ্ঠ,
“মনে রেখেছেন তবে?”
নারীকণ্ঠে ছিলো উচ্ছ্বাসে টইটুম্বুর। তাকে যে মানুষটা চিনতে পেরেছে, সেটাই সে ভাবতে পারছে না।
বর্ণের ধ্যান ভাঙলো রিক্সা চালকের কথায়। সে বিরক্তির স্বরে বলছে,
“ধূর আফা,সরেন তো সামনে থেইকা। বৃষ্টির মাঝে আপনাগো ভিজতে ভাল্লাগতাসে কিন্তু আমাগো না। সরেন।”
রিকসাওয়ালা’র কথার ধরণে বিনা নোটিশেই বর্ণে’র মাথায় রাগ জেগে উঠলো। শরীরেও জেগে উঠলো সে রাগ। মেয়েটার সাথে এমন ভাবে কথা বলছে কেনো লোকটা? অদ্ভুত!
রাগ সংবরণ না করতে পেরে রিক্সা থেকে এক লাফে নেমে গেলো বর্ণ। পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করেই একশ টাকার নোট টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার গন্তব্য এসে গেছি। আপনি চলে যান।”
“ওমা,আপনি না সাভারের মোড়ে নামবেন? এহনো তো ম্যালা দূর।”
রিকসাওয়ালা’র কণ্ঠে আকাশসম বিষ্ময়। বর্ণ গটগট পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আপনার রিক্সায় চড়ে অতটুকু অব্দি যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।”
রিকসাওয়ালা তাজ্জব বনে কেবল চেয়ে রইলো। নীলাম্বরী দ্রুত ছুটলো বর্ণের পিছে। ঢাকা শহরের রাস্তা তখন পানিতে ডুবে যাবে মনে হচ্ছে। নীল আকাশ এখন কালো মেঘে ঘেরা। অবিরাম বর্ষণে মিনিট দুয়েক এর মাঝে ভিজে চুপসে গেছে মানব মানবী।
প্রায় বেশ খানিকটা দূরে আসতেই মুখ খুললো নীলাম্বরী। হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
“একটু দাঁড়ান না। এই বৃষ্টিতেও হাঁপিয়ে উঠেছি। একটু জিড়িয়ে নেই?”
মানবে’র ব্যস্ত পদচারণ থেমে গেলো। তার এতক্ষণে হুঁশ হলো সে এখন একা হাঁটছে না রাস্তায়। হঠাৎ নিজের করা একটু আগের কাজটার কথা ভেবে আহম্মক বনে গেলো সে। হঠাৎ এ রাগটার কারণ কী! এমন অহেতুক রাগ তার মতন মানুষের সাজে? নিজেকেই মনে মনে গালাগাল দিতে ইচ্ছে হয় বর্ণের।
বর্ণকে থেমে যেতে দেখেই নীলাম্বরী দম নেয়। সামান্য থেমে বলে,
“আমায় ভুলেন নি আপনি? বাব্বা! তা কোথায় যাচ্ছিলেন ডাক্তার সাহেব?”
“আপনার মতন তো আমি ভবঘুরে পেত্নী না যে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবো। আমার নির্দিষ্ট কাজ আছে সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। তাই না?”
বর্ণের কণ্ঠে সুস্পষ্ট গাম্ভীর্যের ভাব। নীলাম্বরী খিলখিল করে হেসে উঠলো। এ যেনো সদ্য অষ্টাদশী’র কন্যা। মেয়েটার বয়স একুশ-বাইশ তো হবেই, কিন্তু চালচলন একদম যেন কিশোরীদের ন্যায়।
হাসতে হাসতে মেয়েটার যেন দম যায়। কী এমন হাসির কথা বলেছে সে? অদ্ভুত!
নীলাম্বরী মনমতো হেসে ক্লান্ত হলো। অতঃপর হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
“এই,এই আমি ভবঘুরে পেত্নী! কী দেখে আমায় পেত্নী মনে হলো? চেহারা সুরত তো আল্লাহ্ দিলে খারাপ না। তবে? ওহ্ আচ্ছা, বুজেছি। গায়ের রঙ দেখে বলেছেন?”
মানবীর কথায় বর্ণ হোঁচট খায় মনে মনে। আহত দৃষ্টিতে তাকায় সিক্ত নারী’র পানে। মেয়েটা এমন কেনো? কথায় কথায় নিজেকে ভীষণ অবহেলা করে! ছোট্ট শ্বাস ফেলে ব্যর্থ মানব। কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
“তা,দীর্ঘ একমাস পর কোথা থেকে উদয় হলেন, দূর্বাফুল? সে যে রমনার ভীড়ে হারালেন আর কোনো খোঁজই নেই যে?”
“সত্যিই খোঁজ নেই বুঝি? হসপিটালের চেম্বারে রোগী দেখার ব্যস্ততার ভীড় কমার পর যখন ক্লান্তি ভর করে শরীরে,তখন তো আমার ভাবনাও ভর করতো মনে। তাই না? আপনার সাথে তো আমার মনের খোঁজ প্রতি নিয়তই হচ্ছে।”
বর্ণ সামান্য চমকে গেলো। হ্যাঁ, সেদিনের পর তার অবসাদটা এই রমনীর নামেই যেন লিখতে হয়েছে না চাইতেও। ভীষণ ব্যস্ততার পর ডাক্তার সাহেবের অবসাদ মেলে নি। রমনী তাকে প্রতি নিয়ত ভাবিয়েছে। নাম ধাম হীন দূর্বাফুলের কী যে মুগ্ধতা!
“দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে যে,ডাক্তার সাহেব। সময় থাকলে এই বৃষ্টিতে ভিজে এক কাপ চা খাওয়ার অনুমতি পেতে পারি?”
বর্ণ কিছুক্ষণ ভাবলো। প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মুখ বলে উঠলো,
“কেবল পাঁচ মিনিট।”
নিজে বলে, নিজেই অবাক হলো। সে তো প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলো তবে হ্যাঁ আসলো কেনো! তবে কী মাঝে মাঝে মনও নিয়ন্ত্রণ হারায়?
নীলাম্বরী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“মিনিট পাঁচ’ই ঢের সময়, প্রেম কুড়তে সখা,
প্রেমের ঘাটে দীর্ঘকিছুই, যায় না তেমন দেখা।”
বর্ণ হতভম্ব। এ মেয়ে কী আদৌও স্বাভাবিক মানুষ! ততক্ষণে উধাও নীলাম্বরী। ঐ তো, সামনের টং দোকানে সাদা শাড়ি পড়া,ভিজে চুপ চুপে হওয়া রমনী। মাথায় তার সেদিনের মতনই দূর্বাফুল। মেয়েটা নিজেকে যতটা অসুন্দর বলে দাবি করে ততটা অসুন্দর সে না। তবে,সুন্দরও না। মেয়েটা মায়াবতী। মানুষের রূপ তথাকথিত সমাজে দু’রকম প্রচলিত হলেও আসলে মানুষের রূপ তিন রকম। এক, সুন্দর। যারা ধবধবে ফর্সা, তাদের প্রথম ধাপে রাখা যায়। ফর্সা মানেই সুন্দর। দ্বিতীয়, অসুন্দর। যাদের গায়ের বর্ণ কালো তাদেরকে সবাই দ্বিতীয় ধাপে রাখে। মূলত,সমাজ সেটাই করে। আর,আরেকটা ধাপ হলো মায়াবতী। এই ধাপটাতে খুব কম মানুষই থাকে। যাদের চেহারার মাধুর্যতা গায়ের রঙকে হার মানায় তারাই একমাত্র এই ধাপে পড়ে। আর নির্দ্বিধায় বলা যায়, টং দোকানে দাঁড়ানো মানবী সে-ই দলের। শ্যামলা শরীরে শুভ্র শাড়ি। পিঠের মাঝে ঢিলে খোপা, যা বৃষ্টির দাপটে লেপ্টে আছে পিঠে। সেখানে অগোছালো ভাবে লাগানো দূর্বাফুল। কপালে কালো রঙের টিপ। মুখটা গোলগাল,ছোট্ট। থুতনিতে বেশ গভীর একটা টেপ। এ মেয়েকে মায়াবতী’র খাতায় না ফেললে বড্ড অন্যায় করা হবে যে।
বর্ণের ভাবনার মাঝে ছুটন্ত,উড়ন্ত,দূরন্ত,চঞ্চল দূর্বাফুল হাজির। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়েছে বর্নের সামনে। চোখ দিয়ে ইশারা করে চায়ের কাপটা নেওয়ার জন্য বললো।
বর্ণ ভ্রু কুঁচকে চায়ের কাপটা হাতে নিলো। হাঁটতে হাঁটতে চুমুক দিলো চায়ের কাঁপে। নীলাম্বরী হাসতে হাসতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বললো,
“এক কাপ চায়ে আমি,তোমাকে চাই।”
“হ্যাঁ, এক কাপ চা খাইয়ে আমার পুরো একটা মাস অশান্তিতে কাটান আরকি।”
“বাহ্, খোঁজ নিলেই তো খুঁজে পেতেন। খোঁজ নিলেন না যে?”
“পুরো প্রেমময় শহরে,একজন অপরিচিত প্রেমিকা বুঝি খুঁজে পাওয়া যায়?”
“বাহ্,ডাক্তার সাহেব বেশ কাব্যিক হলো যে?”
“ভবঘুরে পেত্নী’র ভাবনা ভর করেছে তাই।”
বর্ণের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মানবী। চায়ের কাপের শেষ চুমুকটা দিয়ে তাকালো বর্ণের দিকে। মেয়েটাকে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে দেখে বর্ণ অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“কী দেখছেন?”
“চায়ের কাপ।”
মানবীর এমন উত্তরে হা হয়ে যায় ডাক্তার সাহেব। তাজ্জব বনে গিয়ে, বিস্মিত স্বরে বললো,
“মানে! চায়ের কাপ কী এই প্রথম দেখেছেন?”
“আপনার অধর ছুঁয়ানো চায়ের কাপ তো প্রথমই দেখলাম। তাই না?”
“আপনার সাথে কথা বলা বড় দায়।”
নীলাম্বরী আবার হাসলো। বর্ণের চায়ের কাপটা তার হাত থেকে কেড়ে নিলো। কিন্তু ভুলবশতও ছোঁয়া লাগলো না ছেলেটার হাতে।
নীলাম্বরী’র এহেন আচরণে অবাক হয় বর্ণ। তাকে আরও দ্বিগুণ অবাক করে দিয়ে নীলাম্বরী নিজের আর বর্ণের চায়ের মাটির ছোট্ট কাপগুলো তার ব্যাগটাতে গুছিয়ে রেখে দেয়।
বর্ণ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“কী করছেন? এ কাপ গুলো রাখলেন কেনো?”
“স্মৃতি হিসেবে থাকবে বলে।”
বর্ণ ভেবে পায় না মেয়েটার আচরণের মানে। মেয়েটা এমন কেনো? এই মেয়ের সাথে যেদিন দেখা হয়, সেদিনটা তার অবাক হতে হতে কেটে যায়।
বর্ণকে হা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলাম্বরী নিজের ব্যাগ থেকে ছোট একটা রঙিন কাগজে মোড়ানো বক্স বের করলো। বর্ণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আরও কয়েক বসন্ত,লিখবো নতুন ছন্দ তোমার সনে
মনে মনে,
তুমি মুক্ত বিহঙ্গ হয়েও,আমায় রাখবে আগলে খুব যতনে
মনে মনে।
তুমি এসেছো বলে, ফুল ভিজে শিশির জলে চেয়ে আকাশ পানে,
তুমি রেখো আমায় খুব যতনে,মনে মনে।
আমি তোমায় উপহার দিলাম এক কাপ চা
বর্ষন সন্ধ্যার সঙ্গে,
তুমি বেঁচে থাকো পৃথিবীতে এমন হাজার খানেক জন্মদিনের দারুণ রঙে।
শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা প্রিয়,
স্মৃতি গুলো আগলে নিও।
আমি পথের ধারের দূর্বাফুল,
কেউবা বলে পাপ,কেউবা বলে ভুল।
তুমি নাহয় একটু হইও আকুল।”
বৃষ্টি সেই কখন থেমেছে। সাভারের রাস্তার মোড়ে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো আবার দূর্বাফুল। বর্ণ কেবল তাকিয়েই রইলো। খুঁজলো না সে কাউকেই। খুঁজে কী লাভ? সে তো জানে, মেয়েটা আবার আষাঢ়ে মেঘ হয়ে পহেলা আষাঢ়ে আসবে। মেয়েটা তার অপরিচিত হয়েও যেন পরিচিতা।
বর্ণ উপহার বক্সটা আগলে নিলো। মুচকি হেসে বললো,
“আমি আবারও একটু বর্ষণ চাই, এক কাপ চায়ের সাথে,
সাথে মানবী দূর্বাফুল চাই,যে আমায় নিয়ে উন্মাদনায় মাতে।”
#পথের_ধারে_দূর্বাফুল
©মম