#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৯
_________________
মেঘের গর্জন আর বৃষ্টির পানির শব্দে মুখরিত চারপাশ। বিষন্ন মাখা রাত। দুশ্চিন্তায় পঞ্চমুখ একটি মানুষ। অপূর্বের কি হলো, কেন হলো, কে করলো এই প্রশ্নে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম তার। প্রিয়তা আপাতত সব প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে রেখে আস্তে আস্তে অপূর্বকে ধরে নিয়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। প্রিয়তার চোখ বেয়ে অশ্রু জড়ছে,নিশ্বাস আসছে আঁটকে। প্রিয়তার অবস্থাটা বরাবরে মতো আজও যেন বুঝলো অপূর্ব কারন সে যে জ্ঞান হারায় নি খানিকটা ক্লান্তিতার জন্য চোখ বন্ধ করে চুপ করে ছিল কতক্ষণ। কেমন যেন হুট করে প্রিয়তা জড়িয়ে ধরায় অপূর্ব নিশ্চুপ বনে যায়। জীবনে প্রথমবার কোনো মা ব্যতীত কোনো নারী তাকে ছুলো। কেমন যেন অনুভূতি হলো, তার যন্ত্রনায় কাতর হওয়া শরীরটাও কেমন যেন অবশ হয়ে পড়েছিল। অপূর্ব খানিকটা নড়লো। শীতল ভেজা কন্ঠে বললো,
‘ আরে মেয়ে তুমি কাঁদছো কেন, পাগল হলে বুঝি?’
প্রিয়তা যেন চমকে উঠলো। অপূর্ব জ্ঞান হারায় নি তবে। প্রিয়তা দ্রুত নিজের চোখের পানি মুছে অপূর্বকে খাটে বসালো তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
‘ আপনার পিঠে রক্ত অপূর্ব?’
অপূর্ব খানিকটা হাসে। বলে,
‘ রক্তের কি দোষ বলো শরীরটাতেই তো আঘাতে ভরা।’
বলেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো অপূর্ব। আর সহ্য হচ্ছে না এবার বুঝি সত্যি সত্যি জ্ঞান হারাতে চলেছে অপূর্ব। প্রিয়তা অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমি কি ডাক্তার ডাকবো অপূর্ব?’
উওরে অপূর্ব উপুড় হয়ে শুয়েই বললো প্রিয়তাকে,
‘ না তার দরকার নেই।’
‘ তাহলে ঠিক হবেন কিভাবে?’
প্রিয়তার কথা শুনে হাল্কা হেঁসে মিষ্টি সুরে বলে অপূর্ব,
‘ আমায় একটু ছুঁয়ে দিবে মেয়ে, তুমি ছুঁয়ে দিলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো দেখে নিও।’
প্রিয়তা শুনলো অপূর্বের কথা,অদ্ভুত শিহরণ বইলো তার ভিতর দিয়ে অবাকও হয়েছে সাথে। প্রিয়তা বিছানার পাশ দিয়ে বসে বললো,
‘ আমি কি ডাক্তার ডাকবো না অপূর্ব?’
অপূর্ব জবাব দেয় না। আবারও চোখ বুঝিয়ে ফেলেছে সে। বাহিরে ঝড় উঠেছে, মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে এই মুহূর্তে ডাক্তার ডাকার কথাটাও যে বড্ড বেমানান এটাও বুঝতে পেরেছে প্রিয়তা। প্রিয়তা ভেবে পাচ্ছে না কি করবে সে। প্রিয়তা অপূর্বের পিঠের দিকে তাকালো।
কালো শার্টটার পিছন থেকে অনেক জায়গা দিয়ে ছিঁড়ে গেছে যেন কেউ বেশ কয়েকবার ছুঁড়ি দিয়ে পিঠে আঘাত করেছিল খুব। রক্তে পিঠ ভিজে গেছে অপূর্বের। প্রিয়তার চোখ বেয়ে আবার পানি পড়তে নিলো, সঙ্গে সঙ্গে পানিটুকু মুছে নিজেকে সামলালো প্রিয়তা। এভাবে বসে থাকলে চলবে না কিছু একটা করতেই হবে। এই মুহূর্তে অপূর্বকে সুস্থ করাই তার মূখ্য উদ্দেশ্য যেন। কিন্তু কি করবে প্রিয়তা। বাড়িতে গ্র্যান্ডমা ছাড়া আর কেউ নেই। প্রিয়তা অনেক ভেবে চিন্তে বুঝতে পারলো যা করার তাকে একাই করতে হবে। ডাক্তার বা গ্র্যান্ডমা কেউই কিছু করতে পারবে না এখন। এই মুহূর্তে সর্বপ্রথম তাকে ফাস্ট এইডের বক্সটা আনতে হবে। যেটা গ্র্যান্ডমার রুমে গেলেই পাওয়া যাবে। প্রিয়তা অপূর্বের চেহারার পানে একপলক তাকিয়েই চলে গেল রুমের বাহিরে।’
ঘড়িয়ে তখন সাড়ে দশটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। গভীর ঘুমে মগ্ন গ্র্যান্ডমা। প্রিয়তা তার মোবাইল লাইটটা অন করে চুপিচুপি ঢুকলো রুমের ভিতরে তারপর ড্রয়ার খুলে খুব সাবধানে ফাস্ট এইডের বক্সটা বের করে হাতে নিলো প্রিয়তা। তারপর আস্তে আস্তে বের হলো রুমে থেকে হঠাৎই দড়িতে টানানো আয়মানের একটা শার্টের দিকে চোখ গেল প্রিয়তার। প্রিয়তা কি ভেবে যেন শার্টটা নিয়ে নিলো হাতে তারপর আর বেশি না ভেবে দ্রুত ছুটলো নিজ রুমের উদ্দেশ্যে।’
রুমে ঢুকেই আগের ন্যায় অপূর্বকে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল প্রিয়তা বসলো অপূর্বের পাশ দিয়ে কিভাবে কি শুরু করবো ভেবে পায় না সে। কিছু করতে হলে অপূর্বের গায়ে জড়ানো শার্টটা খুলতে হবে তাকে। খানিকটা সংকোচতা ফিল হচ্ছে প্রিয়তার। প্রিয়তা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। তারপর একা মনে আওড়ালো,
‘ এই মুহূর্তে কোনো সংকোচতাকেই বেশি আশকারা দেয়া যাবে না প্রিয়তা, ভুলে যাস না তুই যখন অসুস্থ ছিলি তখন এই ছেলেটাই তোকে সাহায্য করেছে নিজ হাত খাইয়ে দিয়েছে।’
এই রকম নানা কিছু ভেবে প্রিয়তা অপূর্বকে উল্টালো, তারপর আস্তে আস্তে শার্টের বোতাম খুললো সব, তারপর শার্ট খুলে রাখলো নিচে, তারপর আবার উপুড় করে শুয়ে দিলো অপূর্বকে। ফর্সা পিঠটার ক্ষতের দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো প্রিয়তা। ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। এভাবে কে আঘাত করলো অপূর্বকে? কেনই বা করলো এমন।’
প্রিয়তা বেশি ভাবলো না আস্তে আস্তে ফাস্ট এইড বক্সটা খুলে স্যাভলন আর তুলো দিয়ে ক্ষতের জায়গাগুলো পরিষ্কার করে মলম দিতে লাগলো সে।’
নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি পড়ছে খুব, আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা, গাছের পাতার শাঁ শাঁ শব্দ, হিম শীতল ভেজা বাতাসে জানালার পর্দারা নড়ছে খুব, রুমে কারেন্ট নেই যার দরুন এই ঝড়ে ভাসা প্রকৃতির ভিড়েই মোমবাতির বিন্দু বিন্দু আলোতে নিজের কাজ করছে প্রিয়তা। মাথার ভিতর হাজারো প্রশ্ন সাথে বুক ভরা বিষন্নতা নিয়েই অপূর্বের চিকিৎসা করছে সে।’
আর অপূর্ব আঘাতে জর্জরিত হয়ে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়,কেউ যে খুব যত্ন নিয়ে তার চিকিৎসা করছে এটা আপাতত চোখে পড়লো না তার। চোখে পড়লে হয়তো এই মুহূর্তে খুব খুশি হতো সে।’
____
সূর্যের প্রখর তেজ। রোদ্দুর উঠেছে আকাশ ছুঁয়ে। সেই রোদ্দুরের ছোঁয়া আসছে জানালা বেয়ে। পাখি ডাকছে কিচিরমিচির শব্দ করে, পানিতে থইথই করছে বাড়ি পিছনে নিচু জায়গাটা। তবে কাল রাতে যে খুব ভয়ংকর ভাবে ঝড় উঠেছিল তার ছিটেফোঁটাও বোঝা যাচ্ছে না রুমের ভিতর থেকে। কারন রুমটা যে আলোতে ভরপুর।’
আর এসবের মাঝেই বিছানার ওপর মাথা রেখে নিচে বসে ঘুমাচ্ছে প্রিয়তা। কাল শেষ রাতের দিকে অপূর্বকে পিঠে মলম আর ব্যান্ডেজ লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রিয়তা। আর অপূর্বও সেই যে চোখ বুঝিয়েছিল আর খোলে নি। বেঘোরে ঘুমিয়ে ছিল সেও।’
হঠাৎই চোখ খুললো অপূর্ব, কিছু একটা মনে পড়লো তার। কাল রাতের হুট করে আসা এটাকের কথা মনে পড়লো অপূর্বের, আচমকাই অপূর্ব শোয়া থেকে উঠে বসলো, কাল রাতে কার লোক ছিল ওই গুন্ডাগুলো, কার ইশারায় এইভাবে তাকে পিছন থেকে এটাক করলো। তাকে এইভাবে আঘাত করলো জানতেই হবে। আর ওই ফোন কলটাও কার ছিল এটাও জানতে হবে অপূর্বকে।’
ফ্লাসবেক কাল রাতে,
অপূর্ব যখন গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছিল তখন একাই ছিল সে। তবে মাথায় ছিল প্রিয়তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। মেয়েটার সাথে কথা হয় না তার এক সপ্তাহ যাবৎ। অপূর্ব ইচ্ছে করেই নিজের ফোন বন্ধ রাখে, নিজেই কথা বলে না প্রিয়তার সাথে, অজানা ভয় তাকে হানা দেয় খুব। প্রেম, ভালোবাসা নামক যেদিকে পা বাড়াতে চায় না সে সেদিকেই বার বার ঝুকে পড়ছিল অপূর্ব, বলতে গেলে মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল অপূর্ব। না পারছিল প্রিয়তাকে মনের কথা খুুলে বলতে না পারছিল প্রিয়তাকে ছেড়ে দূরে সরতে।’
অপূর্ব যখন এসব ভাবনায় মগ্ন হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই ইচ্ছাকৃতভাবে পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে অপূর্বকে। হুট করে এমনটা হওয়াতে পুরোই অপ্রস্তুত ছিল অপূর্ব। যার দরুন তার গাড়ি ধাক্কা খায় একটা গাছের সাথে। তবে অপূর্ব বেঁচে যায় গাড়ি থেকে নামেও তখনই কতগুলো গুন্ডা এসে ঘিরে ধরে অপূর্বে। কোনো কারন ছাড়াই তুমুল বেগে মারামারি হয় তাদের সাথে কিন্তু শেষের দিকে তিনটে ছেলে ছুড়ি দিয়ে পিঠে আঘাত করে অপূর্বকে। আঘাত করেই পালিয়ে যায় তারা। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা কল আসে অপূর্বের ফোনে। উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে কেউ,
‘ কিরে আঘাত পেয়েছিস তো অপূর্ব? তোকে আঘাত পেতে দেখলে না আমার বেশ লাগে। যদিও দূর থেকে দেখছি। তবে একটা কথা মনে রাখবি আজকের টা ডেমো ছিল শুধু। তুই যেভাবে আমায় আঘাত দিয়েছিস আমিও ঠিক সেইভাবেই তোকে আঘাত দিবো অপূর্ব। জাস্ট একটু সময়ের অপেক্ষা।’
বলেই হাসতে থাকে ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি। অপূর্ব যেন এই হাসিটা চেনে, সাথে কন্ঠ স্বরটা শুনেও খানিকটা চমকায়। বিচলিত কন্ঠে বলে,
‘ কে?’
উওরে জবাব দেয় না ফোন কেটে দেয় তক্ষৎনাত।’
আকাশে তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, অপূর্ব বুঝেছিল বৃষ্টি নামবে, তার সাথে এও বুঝেছিল তার সাহায্য লাগবে আর সেই তখনই প্রিয়তার বাসার কথা মনে পড়ে অপূ্র্বের। ব্যস কোনো কিছু না ভেবেই চলে আসে এখানে।’
পর পর কথা ভেবেই আশেপাশে তাকালো অপূর্ব। না জানি প্রিয়তা মেয়েটাকে কতটা বিপাকে ফেলেছিল অপূর্ব। অপূর্ব নিজের দিকে তাকালো শরীরে শার্ট নেই ব্যান্ডেজ করা শুধু। অপূর্ব কি ভেবে যেন মুচকি হাসলো। তারপর তাকালো প্রিয়তার ঘুমন্ত মুখের দিকে। এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হলো অপূর্বের মাঝে। প্রিয়তার কপাল জুড়ে ছড়িয়ে ছিল কিছু অবাধ্য চুল। অপূর্ব কি ভেবে যেন চুলগুলো প্রিয়তার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে খুব স্বল্প স্বরে বললো,
‘ তুমি বড্ড ভালো মেয়ে,
আর আমি খারাপ।
তুমি খুব সাধারণ আর আমার শত্রুতে ভরা।
তুমি চুপচাপ, আমি গম্ভীর।
তোমার পৃথিবী অন্ধকারের ভিড়েও রঙিন খুব আর আমার রঙিনের ভিড়ে কালো রঙের ধূসরতা।
তাই এত অমিলের মিলন না হওয়াই উওম।’
___
হঠাৎই ঘুমের ঘোরে কিছু অস্পষ্টনীয় কথা কানে বাজতেই ঘুম ভাঙলো প্রিয়তার। চোখের সামনেই অপূর্বকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো সে,
‘ আপনি কি কিছু বললেন অপূর্ব?’
অপূর্ব কোনো রিয়াকশন দেয় না। খুব সরলভাবেই বলে,
‘ কই না তো।’
প্রিয়তা মাথা তুলে বসে। কতক্ষণ চুপ থেকে ফট করেই বলে উঠল আবার,
‘ আমি আপনার চোখে কিছু দেখি অপূর্ব সেটা কি আধও সত্যি?’
অপূর্ব কি চমকালো, মোটেও চমকালো না উল্টো খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
‘ মানে?’
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে]
#TanjiL_Mim♥️