তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব-১৬
#Taniya Sheikh
মাগরিবের পরপরই ছেলেপক্ষ ইরাকে দেখতে এলো। গৌরবর্ণ, লম্বাটে মোটকথা সুদর্শন ইরার হবু বরটি। হবু জামাতাকে ইমার মামার পরিবারের সবার পছন্দ হলো। ছেলের ঐটুকু আচার ব্যবহার দেখে তারা যে, রীতিমতো মুগ্ধ। তা তাদের চোখের উজ্জ্বলতায় প্রকাশ পাচ্ছে। ইরাকে আগে থেকেই পছন্দ ছিল ছেলেপক্ষের। সুতরাং দু’পক্ষের কথাবার্তা আকদের সিদ্ধান্তে গিয়ে ঠেকল। ইরা একটিবারও ছেলের দিকে তাকাল না। মুখ ফুলিয়ে রইল অবগুন্ঠনের আড়ালে। ছেলেটা অবশ্য মাঝেসাঝে চোখের কোনা দিয়ে দেখল ওকে। ছেলের বাবা, দুলাভাই দু’জন, বড় বোন এবং কিছু আশেপাশের আত্মীয় স্বজনকে আনা হয়েছে আকদ উপলক্ষে। ইরা রুমে আসতেই বিছানার উপর হুমড়ে পড়ে কাঁদছে। তার মনে কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘ জমেছে। ঝড়ের মাত্রা কতোটুকু কেবল সেই জানে।
ইমা চুপিচুপি এলো ইরার রুমে। বোনের কান্না দেখে ইমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। পরের লোকের অন্যায় যত সহজে দমন করা যায়, আপন লোকের বেলায় তত সহজ হয় না। ইমা গিয়েছিল মামির কাছে। তার পুরো কথা শোনার আগেই ইরার মায়ের তিরিক্ষি মেজাজের কোপানলে পড়তে হয়। পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিল সামান্য এক কথাকে কেন্দ্র করে। শেষে মামাদের মধ্যস্থতায় সে যাত্রায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। মায়ের কাছে মার না খেলেও ধমক খুব খেয়েছে ইমা। তারপর থেকেই মায়ের সাথে কথা বন্ধ ওর একপ্রকার। ক্রন্দনরত বোনটির শিওরে বসে মাথায় হাত রাখল ইমা। ইরা মুখ তুলে বোনের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল,
” আপু আমি বিয়ে করব না।”
ইমা নিচু গলায় বললো,
” আমি কী করব বল? দেখলি তো কেমন করছে সবাই। কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না তোর।”
ইরা অসহায়ের মতো চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অভিমানি গলায় বললো,
” সবার জন্য সব পারো কেবল আমার বেলায় কিছুই পারো না। চলে যাও আমার সামনে থেকে। যাও।”
ইরার কথায় যতোটা না কষ্ট পেল। তারচেয়ে দ্বিগুণ রাগ জমলো নিজের উপর। আসলেই তো! এমন দমে যাওয়ার মেয়ে তো সে নয়। তবে কী হলো তার সাহসের!
” তুই আবার আমার মেয়ের রুমে আইছোস?”
মেয়ের জন্য আনা কাপড়ের ব্যাগ বিছানার উপর ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল ইরার মা। তার হুশজ্ঞান রইল না কোনোদিক। রাগে চোখ দু’টো জ্বলছে। সাবিহা ততক্ষণে ছুটে এসেছে। ইমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট জা’কে ধমকের সুরে বললো,
” মাথা খারাপ হইছে তোর? বাড়িভর্তি মেহমান আর তুই কী’না গলা ফাটাইতাচ্ছোস। হেরা শুনলে কী কইব?”
” চিল্লামু না কী করমু। অলক্ষি ঘুরতাছে দেহো না। এই ছেরি আমার মাইয়্যার কপালের সুখ নষ্ট করতে উইঠা পইড়া লাগছে। ও ভাবি, ভাবি গো! আমার ইরার কপালে সুখ ওর সহ্য হচ্ছে না। কিছু করো নয়ত এ বিয়ে ও হইতেই দিতো না।”
ইরার মা পারে না কেঁদে ফেলতে। সাবিহা ছোট জা’র কাঁধে হাত রেখে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো,
” তুই শান্তি দ্যাস না ক্যান আমাগো? তোরে কইছি ইরার আশেপাশে ঘুরিস না। তাও কিসের জন্য ঘুরঘুর করতাছোস? নির্লজ্জ, বেয়াহায় কোনহানকার। যা নয়ত লাথি দিয়া বাইর করুম।”
ইমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ইরার রুম থেকে বের করে দিল ওরা। ইমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তর্জনী তুলে দুই মামিকে বললো,
” অতিরিক্ত হচ্ছে মামি। আমি শুধু বলছি ইরার মর্জির বাইরে বিয়ে দিয়েন না। এর বেশি কিছু কী বলছি বলেন?”
ইরার মা ব্যঙ্গ করে বললো,
” আহা! কী রঙের কথা। মেয়ে আমার। মেয়ের জন্যে কী ভালা না মন্দ সেটাও আমিই দেখুম। তুই এরমধ্যে নাক গলাতে আইছোস কেন? ইরার মর্জি বাইরে যাইয়েন না। তোর মা’র মতো মাইয়্যার কথায় উঠমু বসমু নাকি? রাত বিরাত ঘরের বাইরে কাটাইতে শিখামু মাইয়্যারে। তুই কী করোস না করোস বুঝিনা ভাবছোস।”
বিভা আজ আর প্রতিবাদ না করে পারল না। তাতে যেন আরও চটল দু’জা। মা’মেয়েকে কথার আঘাতে আঘাতে নির্বাক করে ছাড়ল। বিভা কেঁদে ফেলল ভাবিদের কটুকথার আঘাতে। মেয়ের হাত ধরে দোতলায় উঠে এলো। মেয়ে সহ ঘরবন্দী রইল আকদের শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত৷ রাগে শরীর জ্বলতে লাগল ইমার। মামিদের তিক্ত কথা বিষের ছুরি হয়ে বিঁধে আছে তার বুকে। না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে জবাব দিতে সে। মায়ের কথায় আজও তাকে নিরবে মুখ বুঝে থাকতে হলো। বাইরে গাড়ি শব্দ শুনে বুঝল বরপক্ষ চলে যাচ্ছে। ইরার কান্নাসিক্ত মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। শানকে মনে পড়ল ইমার। শান পাশে থাকলে আজ হয়ত কিছু করতে পারত ইরার জন্য। কিন্তু মা’কেই তো এখনও বলা হলো তা শানের কথা। ইমা কয়েকবার ডাকল মা’কে। বিভা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। গভীর নিদ্রা তার ভাঙল না ইমার দু’একবার ডাকা স্বত্বেও।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোবাইল হাতে নিয়ে ছাঁদে এলো ইমা। আকাশে তারার মেলা। ইমা চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল। এই আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় কিছুটা ম্লান আশেপাশের আঁধার। এই রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে মনটা আপনাআপনিই শান্ত হলো। হাতের মোবাইল অন করে প্রিয় মানুষটিকে কল করল সে। রিং কেটে দিয়ে রিং করে শান। কল রিসিভ করতেই ও’পাশ থেকে শানের গলার শব্দ শুনে ইমার জমে থাকা কান্নার জল বাঁধ ভাঙে।
” কী হয়েছে ইমা। এ্যাই!” ও পাশের কন্ঠস্বরটি আতঙ্কিত শোনাল। ইমা নিজেকে সামলে একে একে সব বললো শানকে। শান কিছুসময় কথা বললো না। দু’জন মোবাইলের দু’পাশে চুপ করে রইল। যেন এরাও এই নিস্তব্ধ আঁধারে মিশে গেছে। ইমা জানে শান রেগে আছে। ইমার হঠাৎ মনে হলো এ সময় এ’কথা না জানালেই ঠিক ছিল। এমনিতেই মোবারকের বিষয়টা নিয়ে শান চিন্তিত। মোবারকের কথা মনে পড়তেই ইমা চোখ মুছে বললো,
” মোবারকের বউটার অবস্থা কী?”
ওপাশে একদম নিরবতা। ইমা ঢোক গিলল। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললো,
” শান, কথা বলছেন না কেন?”
” আচ্ছা তোমার কী মনে হয় আমাকে? আপন মনে করো তো না তাই না?” উচু গলায় বললো শান। ইমা বিষন্ন মুখে বললো,
” কী বলছেন এসব?”
দাঁতে দাঁত চেঁপে শান রাগত স্বরে বললো,
” কী বলছি বোঝো না। ওরা তোমাকে এতো অপমান করার পরও কেন ওখানে আছ? এক্ষুণি চলে আসো আমার ফ্লাটে।”
ইমা বললো,
” শান প্লীজ! একটু শান্ত হোন। আমি মা’কে বলতে পারি নি আমাদের কথা৷”
শান রাগ ধরে রেখেই জবাব দিল,
” তোমার দরকার নেই সেটা করার আর। তুমি যে কী পারবে! আমার জানা হয়ে গেছে। আমি আগামী কালই আসছি। তারপর, যা বলার, করার আমিই করব। থাকো তুমি চুপ করে।
” মোবারকের বউ!’
ইমার কথায় শান আবার চুপ হয়ে যায়। ইমা ফের প্রশ্ন করায় বড়সড় ধমক খেয়ে মুখ ফুলিয়ে কল কেটে দিল। সেকেন্ড অতিবাহিত না হতেই শান কল করে। ইমা দুইবার কল ড্রপের পর রিসিভ করতেই শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” আ’ম সরি বউ।”
” আর সরি বলতে হবে না। ধমক দেন।” অভিমানে গলা কাঁপছে ইমা। শান মৃদু হেঁসে বললো,
” ধমক খাওয়ার কাজ করো কেন তাহলে?”
” সেধে কী করি? মেয়েলোকের জীবন আপনাদের মতো স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড হয় না। এবড়োথেবড়ো, কাঁটাবিছানো। যতোই আমি সাহসী, তেজি হই তবুও আমাকে নত হতে হয় পরিবারের সামনে। কেন হতে হয় জানেন? কারন আমি মেয়ে। আমার সিদ্ধান্ত নাকি আমারই মতো দূর্বল। যেখানে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নারী, সেখানে অধিকার আর স্বাধীনতা কতোটা ঠুনকো তাদের জন্য ভাবুন।” ইমার গলা ধড়ে আসল। শান বললো
” আমি এখনই রওনা দিচ্ছি। ”
” না!” নড়েচড়ে দাঁড়াল ইমা। শান বিরক্ত গলায় ঢেলে বললো,
” না কেন?”
” আপনি আগে ঐদিকটা সামলে আসুন প্লীজ।”
” আর তুমি? তোমার প্রয়োজন নেই আমাকে?”
” সবচেয়ে বেশি আপনাকে আমার প্রয়োজন তবুও বলছি মোবারককে একা রেখে আসবেন না। ওর পাশে আপনার দরকারটা বেশি।”
” বেশি নীতিকথা ঝাড়বা না। আমি আসছি এটাই ফাইনাল।”
” শান, আপনি আমার কথা শুনবেন না?”
” তুমি শোনো আমার কথা।”
দু’জনই চুপ হয়ে গেল আবার। শান শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বললো,
” ওকে ফাইন। এদিকটা সামলে তবেই আসব কিন্তু তারজন্য আগামীকালই যথেষ্ট। পরশু ফিরছি আমি।”
ইমা প্রত্যুত্তর করে না। শান পুনরায় বললো,
” তুমি একটা নিষ্ঠুর মেয়েলোক। আমার প্রতি টান তোমার নেই বললেই চলে।”
” হ্যাঁ, আপনাকে বলেছে।”
” বলেইছে তো।”
ইমা ঠোঁট টিপে বলে,
” আপনার মাথা বলেছে।”
” আমার মাথা তাই না?”
শানের কথায় ইমা ফিক করে হেঁসে ওঠে। শান বলে,
“আহ! এতোক্ষণে হৃদয়টা ঠান্ডা হলো। ইমা,”
” হুম।”
” ইমা,” শান টেনে বললো।
” বলেন। ” লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নুয়ে জবাব দিল ইমা।
” আচ্ছা তোমার সামনের দাঁতটা ব্যাকা কেন? ”
ইমা রাগে ফুঁসতে লাগল। বুঝতে পেরে হোঁ হোঁ করে হেঁসে ওঠে শান। ইমার ইচ্ছা করছে মোবাইলের মধ্যে গিয়ে শানের মুখ চেপে ধরতে। দাঁত কামড়ে চাপা স্বরে বললো,
” বদের বদ! আর কথায় বলব না আপনার সাথে। সামনে পায় এর শোধ না নিছি, দেইখেন খালি।”
ওপাশে শুধু হাসির শব্দ শুনতে পেল ইমা। গাল ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
” হাসি থামাবেন নাকি ছাঁদ থেকে লাফ দিব।”
” এক লাফে আমার কাছে আসতে পারলে দাও। নয়ত থাক।”
” পাঁজির পা ঝাড়া আপনি একটা। কথা নেই আপনার সাথে যান।”
ইমা কল কাটতেই কল করে শান। এভাবে খুনশুটিতে দুজনে রাত পার করল। সকালের সূর্য ওঠা এই প্রথম অবলোকন করে ইমা। মিষ্টি একটা সকাল,অথচ দিন গড়াতেই কেমন রুক্ষ, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শানকে বুঝিয়ে মোবাইলে কথা শেষ করে নিচে নেমে এলো ইমা। কেউ দেখার আগে সোজা রুমে গিয়ে মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে।
চলবে,,,