প্রেম পিয়াসী পর্ব ৩৮

0
521

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______৩৮.

সকাল ৭টা। ভোরের দিকের পাখিদের কিচিরমিচির কলরব আর শোনা যাচ্ছে না। ঘরময় বিচরণ করছে গা পো/ড়া/নো গরম। ইলহাম শুয়ে আছে বিছানায়। ক’টা দিন যাবত ওর শু’তে, বসতে কিংবা হাঁটতে একটু স’ম’স্যা হচ্ছে। এসময়ে নাকি এসব নর্মাল। মা বলেছে। খানিকক্ষণ বাদে উঠে বসলো ইলহাম। আর শুয়ে থাকতে পারছেনা। অস্থির অস্থির করছে শরীরটা। রাদ কোথায়? ঘরে নেই! আধঘন্টা আগে, দশ মিনিটের কথা বলে কোথাও বেরিয়েছে। দশ মিনিট পেরিয়ে আধঘন্টা হয়ে এলো। দেখা নেই বান্দার। শিরিনটাই বা কোথায়? এক্ষনি তো এখানে ছিলো?”

—-” শিরিন? শিরিন?”

অস্থির গলাতেই দু’বার ডাকলো শিরিনকে। ডাক পেয়ে ব্যালকনি থেকে ছুটে এলো শিরিন।

—-” জে ভাবি? কিছু লাগবে?”

—-” তোমার ভাইজান কোথায় গেছে?”

—-” বইলা যায়নাই তো ভাবি।”

—-” আচ্ছা, মা কোথায়? মাকে একবার ডাকবে!”

—-” ভাবি খালাম্মায় আর বাকিরাও তো নাই! অন্তু ভাইজানের বাপে অসুস্থ হইয়া পরছেনা? তারে নিয়া ডাক্তারের কাছে গেছে নাকি। খালাম্মায় আর বাকিরা তো ওনেই গেলো।”

—-” ওহ্।”

ইলহাম ঘামছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,

—-” আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। ত..তুমি আমাকে একটু পানি দাও। আচ্ছা থাক.. তুমি তোমার ভাইজানকে একটা কল দাও!”

ইলহামের শরীর ঠিক লাগছেনা শুনে চিন্তায় শিরিনের কপালে ভাজ পড়লো। ইতিমধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠলো শিরিন। ব্যস্ত গলায় বলল,

—-” আল্লাহ কি কইতাছেন ভাবি! আচ্ছা, খারান আমি আগে আফনেরে পানি খাওয়াই। হ্যাসে ভাইজানরে কল দেই!”

—-” আ..আচ্ছাহ্! তাই দাও।”

শিরিন চটজলদি পানি এনে খাওয়ালো ইলহামকে। ইলহাম তখনও ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে যাচ্ছে। ওর যে বেশ ক*ষ্ট হচ্ছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

—-” হেলো ভাইজান? তারাতাড়ি বাসায় আসেন। ভাবি জানি কেমন করতাছে!”

ওপাশ থেকে শিরিনের গলা শুনতে পেলো ইলহাম। কিন্তু রাদ কি বলল আর শোনা হলো না।

___________

ডাক্তার চেকআপ করছে ইলহামকে। ইলহাম চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। পাশেই ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে রাদ। ডাক্তারের পেছনে প্রণয়, অনন্যা আর অন্তু। আর তাদের থেকে খানিক দূরে শিরিন। সবার মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। প্রেগন্যান্সিতে একটু বেশিই ক/ষ্ট পাচ্ছে ইলহাম। রাদ বারেবারে ভাবে এরচেয়ে ওরা নিঃসন্তান থাকতো। তবুও মেয়েটাকে এতোটা ক/ষ্ট পেতে দিতোনা।

—-” উনার প্রতি ডাবল কেয়ার নিন। আশাকরি ঠিক হয়ে যাবে। আর এখানে স্বল্প কিছু ঔষধ দিয়েছি। নিয়ম করে খাওয়াতে থাকুন। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা! এই মুহুর্তে উনার কোনো মেন্টাল প্রেশার নেওয়া বারন। অন্যায়ই বলতে পারেন। সেই দিকটা একটু খেয়াল রাখবেন।”

ডক্টর একটা প্রেসক্রিপশন রাদের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল কথাগুলো। রাদ মলিন চাহনিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকা তার ইলহামকে একবার দেখলো। অতঃপর প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে অন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে ডক্টরের উদ্দেশ্যে বলল,

—-” ক’টা দিন আপনাকে একটু ক/ষ্ট করে আসতে হবে ডক্টর। এছাড়া আর ওয়ে দেখছিনা।”

—-” সে না হয় আসবো। আমি রেগুলার এসে উনার চেকআপ করে যাবো। আপনি টেনশন মুক্ত থাকুন।”

—-” থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।”

—-” মাই প্লেজার।”

ডক্টর চলে গেলেন। রাদ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইলহামের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। অনন্যা এসে বসলো ইলহামের পাশে। সবার মুখেই মন খারাপের ছাপ স্পষ্ট। ভবিষ্যত ভেবে সকলেই ভীত। কি হবে জানেনা কেউ।

—-” ভাইয়া, ভাবিকে আর এমন অবস্থায় দেখতে ভালো লাগছেনা। কিছু একটা করো প্লিজ!”

—-” কি করি বল! আমি নিজেই ভেবে পাচ্ছি না এসব কেন হচ্ছে।”

কথাটা বলে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাদ। প্রেগন্যান্সির সকল নর্মাল সিচুয়েশন পেরিয়ে গিয়েছে ইলহাম। এখন যা হচ্ছে সবটাই বাড়াবাড়ি।

—-” আমার মনে হয়, ইলহাম একটু বেশিই প্রেশার নিচ্ছে মাথায়। ওর এই প্রেশার কি কোনো ভাবে কম করা যায়না?”

—-” হ্যাঁ, আমিও একই কথা বলতাম। আমাদের উচিৎ ভাবির জন্য কিছু করা।”

অন্তুর কথার পিঠে বলল প্রণয়। রাদ ভাবনায় ডুব দিলো। কি এমন করা যায়, যাতে ওর মেন্টাল প্রেশার গুলো একদম ঝেড়ে পড়ে?

—-” ভাইয়া, ছোটখাটো একটা বনভোজন করলে কেমন হয়! আই মিন, পিকনিক? সেখানে আমরা আমাদের সবার ফ্রেন্ডদের ইনভাইট করবো। ইলহামও ওর ফ্রেন্ডদের ডাকবে। সবাই একটা সন্ধ্যা কাটালাম। কি দারুণ হবে তাইনা?”

উৎসাহী গলায় নিজের বক্তব্য রাখলো অনন্যা। আইডিয়াটা মন্দ নয়। এই মুহুর্তে ইলহামের মন ঘুরাতে ওকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয়। কিন্তু সবাই মিলে বাসায় এই আয়োজনটা তো দিব্যি করা যাবে।

—-” গ্রেট ছোটি! তোর মাথায় তো ভালো বুদ্ধি আছে। আগে জানতাম না কিন্তু!”

খোঁচা মে/রে বলল অন্তু। প্রণয় হেসে ফেললো। প্রণয়ের হাসি এবং অন্তুর কথায় তেতে উঠলো অনন্যা। নাকের ডগায় রা/গ এনে বলল,

—-” মানে কি? আমার মাথায় কি গোবর থাকে বলে তোমাদের ধারণা?”

—-” হ্যাঁ, ওমনই ভাবতাম রে!”

বলে ফিক করে হেসে দিলো অন্তু। তাল দিলো প্রণয়। অনন্যা নাক ফুলিয়ে বলল,

—-” দু’জনের খুব জমেছে তাইনা?”

—-“আচ্ছা আচ্ছা চুপ কর তোরা। আগে প্ল্যান কর পিকনিকের আয়োজন কবে হবে? আর কিভাবে কি করবি?”

রাদের কথায় রা/গ-মজা বাদ দিয়ে সবাই আবার সিরিয়াস হয়ে গেলো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো আজই পিকনিক হবে এবং সন্ধ্যার পরে। তাই এখনি শুরু হলো ইনভাইটেশন প্রসেস।

____________

বাসার ছাঁদ আর ছাঁদ নেই। ওটাকে রাদ অনেক পূর্বেই একটা ছোট খাটো গার্ডেনে পরিনত করেছে। তাই রান্না-বান্নার সকল কার্যক্রম নীচে থেকেই হবে বলে ঠিক করা হয়েছে। বিকেলের মধ্যে ইনভাইট করা যাত্রীদের আগমন সম্পন্ন হয়েছে। ইলহাম দুই ফ্রেন্ড উপমা আর আলভিও এসেছে। আর তাদের সঙ্গে এসেছে উপমার বর রিহানও। তবে সবার মাঝে একজন স্পেশাল গেস্টও এসেছে। আর সে হলো মিমি। মিমির সাথে এ’কদিনে অন্তুর বেশ ভালো একটা ফ্রেন্ডশিপ তৈরী হয়ে গেছে। আর যেহেতু সব ফ্রেন্ডদেরই ইনভাইট করা হয়েছে তাই অন্তু মিমিকেও স্পেশালি ইনভাইটেশন পাঠালো। এবং সেই সাথে জানালো আজ তাকে একজন স্পেশাল মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।

বিকেল হতেই বাড়ি ভরে গেলো জনগনে। হঠাৎ এতো মানুষের সমাগম দেখে ইলহাম বিহ্বলিত হয়ে বসে আছে। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, এরা কারা কিংবা ওর ফ্রেন্ডরা হঠাৎ এলো কেন সবটাই ওর মস্তিষ্ক অতিক্রম করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে অবশেষে যখন জানতে পারলো আজ বাসায় পিকনিক হচ্ছে, তখন তার আনন্দ আর দেখে কে। আপাতত, রাদের সামনে মুখ ভার করে বসে আছে, রেডি হয়ে ছাদে যাওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে।

—-” কি হয়েছে সুইটহার্ট? মুখটা এমন করে রেখেছো কেন বলবে তো? কিছু হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে না তো আবার?”

—-” না!”(মুখ ভার করে)

—-” তবে? কি হলো আমার পাখিটার? এই পাখি? মিষ্টিপাখি? কি হয়েছে বলো আমাকে?”

—-” কিছু হয়নি।”

রাদ সরু চোখে তাকালো ইলহামের পানে। অতঃপর বরাবরের ন্যায় হাঁটু মুড়ে বসলো ওর সামনে। ওর হাত দুটো হাতের মুঠোয় আগলে নিয়ে বলল,

—-” রাদ কি কিছু করেছে? তার প্রিয়দর্শিনীকে হার্ট করেছে? সুইটহার্ট কি হার্ট হয়েছে?”

—-” বললাম তো না!”

—-” তাহলে কি? কি হয়েছে! না বললে আমি কি করে বুঝবো বলো?”

—-” কি হবে! হয়েছে আমার কপাল। আমার কপাল পু-ড়ে গেছে। ফুটো হয়ে গেছে। এই দেখুন!”

ইলহাম কপালে আঙ্গুল ঘষে দেখালো। রাদ বেশ সিরিয়াস হয়ে দেখছে ওর ফুটো কপাল। যা দেখে ইলহাম ধুম করে একটা মা/র বসিয়ে দিলো রাদের কাঁধে। মা/র খেয়ে রাদের সিরিয়াস ভঙ্গিমা ছুটে গেলো। না পেরে হেসে উঠলো সে। নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারলোনা ইলহামও। হাসলো রাদের সঙ্গে। অতঃপর পূণরায় পূর্বের ভাবমূর্তি। রাদ এবার অসহায় চোখে তাকালো। বলল,

—-” আবার কি হলো?”

—-” আমার একটাও ভালো জামা নেই! যা আছে সব জিরো ফিগার। এখন আপনিই বলুন আমি কি এখনোও সেই জিরো ফিগার আছি? আমি তো এখন মাম্মা ফিগারে আপডেট হয়েছি। আমার একটাও ভালো জামা নেই। এএএ এএএএ!”

এই বলেই কান্না জুড়লো ইলহাম। রাদ ওর কথা ও কান্ডে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মুহুর্তেই কোনো কথা খুঁজে পেলোনা ইলহাম কে বলার জন্য। আসলেই তো। কথা তো ঠিক।

—-” আ..আ আচ্ছা! আচ্ছা বাবা কাঁদতে হবেনা। তাকাও আমার দিকে, শুনো? আহা শুনোনা?”

—-” কি?”(একচোখে তাকিয়ে)

—-” তোমার কি ড্রেস চাই বলো? আমি এক্ষনি সব আনিয়ে দিচ্ছি। কত ড্রেস লাগবে। তুমি শুধু বলো?

ইলহাম গালে হাত দিয়ে ভাবছে। চোখ মুখ কুঁচকে, সরু করেছে ভেবেই যাচ্ছে। কিন্তু ভেবে আর কূলকিনারা হচ্ছে না। তাই রাদ ওর ভাবনা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—-” আপাতত একটা ড্রেসে চলবে? নাকি অনেকগুলো চাই?”

—-“আপাতত একটা ড্রেসই কাফি হ্যায়।”

—-” ওকে। তাহলে তুমি চোখটা বন্ধ করো। আমি এক্ষনি তোমার একটা ড্রেস হাজির করছি।”

—-” সত্যি?”

—-” হু। চোখ বন্ধ.. বন্ধ! একদম খুলবেনা।”

—-” হুম।”

ইলহাম চোখ বুঁজে মাথা কাত করলো। অর্থাৎ সে একদমই চোখ খুলবেনা। রাদ মুচকি হেসে ওর গাল টেনে উঠে গেলো। ড্রয়ার খুলে একটা শপিং ব্যাগ বের করে এনে আবার বসলো ওর সামনে। শপিং ব্যাগটা ওর সামনে তুলে ধরে বলল,

—-” নাও, এবার চোখ খুলো!”

ইলহাম ফট করে চোখ মেললো। চোখ মেলে তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো অদ্ভুত সুন্দর একটা শপিং ব্যাগ। ইলহামের মুখে হাসির ঝিলিক খেলে গেলো। প্রসন্ন চোখ জোড়া বার কয়েক ঝাপটে আমোদিত গলায় বলল,

—-” নতুন ড্রেস?”

—-” ইয়েস! খুলে দেখো।”

ইলহাম ঝটপট ব্যাগ থেকে বের করে আনলো। লেভেন্ডার কালারের ভীষণ মিষ্টি একটা থ্রিপিছ। ইলহামের চোখ জোড়া ফের ঝলমলিয়ে উঠলো। আনন্দ যেন ঝেকে বসলো সমস্ত শরীরে। হুট করে জড়িয়ে ধরলো রাদকে। আহ্লাদে বিদিশা হয়ে রাদের গালে টাইট একটা চুমু খেয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় রাদ। মানে কোথা থেকে কি ঘটে গেলো বুঝে উঠতে পারলোনা সে।

—-” আপনি কত্ত ভালো একটা বর। আই লাভ ইউ!”

রাদ পূণরায় শকড। প্রেগন্যান্সিতে মেয়েদের মুড সুয়িং কি মা/রাত্মক হয়, বুঝতে আর বাকি রইলোনা রাদের। হাসলো সে মনেমনে। অতঃপর ইলহামের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে বলল,

—-” ভালোবাসি। এসো, রেডি হয়ে নাও। তারপর ছাদে যাবে। সবাই আমার কুইনকে দেখবে বলে অপেক্ষা করে আছে তো।”

—-” আমি কুইন? ইশশ! কি যে বলেন না!”

—-” অবশ্যই তুমি কুইন। আমার কুইন।”

—-” ধ্যাৎ।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here