#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______৩৬.
৬তলা অফিসের সবচেয়ে বড় এবং আলিশান রুমটাতে বসে আছে অন্তু। পরনে ফরমাল পোশাক। চোখে মুখেও পূর্বের সেই আতংক ভাবটা নেই। কারন যার সঙ্গে ও কথা বলতে এসেছে, তার সামনে কোনোরূপ চিন্তান্বিত ভাব কিংবা আতংকিত চেহারা প্রদর্শন করা চলবেনা। থাকতে হবে একদম নিখুঁত ও পরিপাটি। যেন, লোকটা চাইলেই ওকে ছোট করে চলে যেতে না পারে। শুনেছে বড় ভাবওয়ালা মানুষ। অবশ্য ভাব থাকাটাও দোষের কিছু নয়। কত বড় একজন বিখ্যাত গায়ক। তার তো ভাব থাকবেই।
বাইরে থেকে দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসতে নড়েচড়ে শার্টের কলারটা টেনেটুনে নিজেকে ঠিক করে নেয় অন্তু। বুটের খটখট শব্দ তুলে কেউ হেঁটে আসছে ভেতরে। অন্তুর হৃদপিণ্ড একটু একটু কাঁপছে। ধীরেধীরে বুটের শব্দ কানের কাছে আওয়াজ তুলতে অন্তু চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে স্মিত হেসে গুড মর্নিং জানায়। লোকটা শুনতে পেয়েছে কিনা ঠিক বোঝা গেলোনা। হাত ইশারায় অন্তুকে থামিয়ে দিয়ে বসতে ইশারা করে সেও বসলো তার জন্য সাজিয়ে রাখা চেয়ারটাতে। অন্তু গাল ফুলিয়ে সবার অগোচরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বসে পূণরায়। লোকটার পিছুপিছু দু’জন বডিগার্ড এবং একজন পার্সোনাল এসিসট্যান্টও আসে। লোকটা চেয়ারে ঠিক ভাবে বসলে বডিগার্ড দু’জন স্থানান্তর করে। এখন তাদের কাজ রুমের বাইরে পাহারা দেওয়া। লোকটার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট একজন মেয়ে। বয়স ২৩-২৪। বসের ন্যায় তারও বেশ দামি পোশাক চড়ানো গায়ে। অন্তু মেয়েটাকে একপলক দেখেছে ঢোকার সময়। মুখ না দেখলেও পেছন থেকে মেয়েটার স্ট্রেইট করা চুল গুলো নজরে পড়েছে তার।
—-” স্যার, মিহাদ আবরিশাম রাদ।”
মেয়েটা নীচু স্বরে অদূরে বসে থাকা ছেলেটাকে ইশারা করে বলল কথাটা। লোকটা অর্থাৎ বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রেজা খান পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখলো অন্তুকে। সে তাকাতেই অন্তু ভদ্রতা সূচক হাসলো। হাসলো রেজা খানও। তবে দাম্ভিক হাসি। অন্তুকে ডেকে বসতে বললো তার সামনের চেয়ারটায়। অন্তু উঠে এসে বসলো তার সম্মুখে। অতঃপর নিজেকে খানিক ধাতস্থ করে বলে উঠলো অন্তু,
—-” ফার্স্ট অফ অল,আই এম অ্যাপোলাইজিং, বিকজ অফ মাই ব্রাদার! আজ আপনার সাথে ওর মিটিংটা থাকলেও ও একটা পারসোনাল প্রবলেমের জন্য আসতে পারেনি।”
—-” আপনার ভাই?”
—-” আব.. আই মিন, রাদ। আমি রাদ নই। রাদের ভাই। অন্তু।”
—-” আচ্ছা আচ্ছা, এতো ইম্পরট্যান্ট একটা মিটিং সে আসতে পারলোনা! ভেরি ডিস্যাপ্পোয়েন্টিং।”
—-” প্লিজ ডোন্ট বি ডিস্যাপ্পোন্টেড! ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। রাদই আমাকে পাঠিয়েছে এই মিটিংটা এটেন্ড করতে।”
—-” ও। ওকে দ্যেন। মিমি, ফাইলটা দাও উনাকে।”
লোকটা তার পিএকে উদ্দেশ্য করে বলল। ‘মিমি’ নামটায় একটু হোঁচট খেলো অন্তু। রেজা খানের ডাকের উৎস ধরে অন্তু দ্বিতীয় বারের মতো তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও ওর পানেই তাকিয়েছিলো। হঠাৎ অন্তু তাকাতে চোখাচোখি হলো দু’জনের। মেয়েটা সৌজন্যমূলক হেসে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো অন্তুর পানে।
—-” এখানে জমিটার সমস্ত ডিটেইলস দেওয়া আছে। আপনি চাইলে একবার চেক করে নিতে পারেন। তারপর নীচের ওখানটায় সাইন করে ডিলটা ফাইনাল করুন।”
—-” সিওর।”
অন্তু বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে ফাইলটা। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে কেউ একজন একধ্যানে তাকিয়ে কেবল ওকেই দেখছে। যার দরুন ফাইল দেখতে নিয়েও বারবার মনোযোগ ঘেটে যাচ্ছে ওর। তাই আর চেয়েও পুরো ফাইলটা দেখতে পারলোনা। মাঝপথেই সাইনটা করে দিয়ে ডিলটা ফাইনাল করলো।
—-” থ্যাঙ্ক ইউ। রাদ সাহেবকে একবার দেখা করতে বলবেন সময় করে। বাই দ্য ওয়ে, উনার কোনো মেজর প্রবলেম হয়নি তো?”
—-” হ্যাঁ মেজর প্রবলেমই বটে। এক্টচুয়ালি ওর ওয়াইফ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেভেন মান্থ’স প্রেগন্যান্ট। হসপিটালে নিতে হয়েছে। তাই..”
—-” ও আই সি। এখন সে কেমন আছে?”
—-” জানিনা এখনও! হোপ সো, সে ঠিক হয়ে যাবে।”
—-” ইয়াহ ইয়াহ, অফকোর্স।”
—-” থ্যাংঙ্ক ইউ। আজ আমি আসি তবে।”
—-” সিওর। নাইস টু মিট ইউ।”
—-” সেম হেয়ার।”
এই বলে অন্তু উঠে যেতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে আবার উঠলো না।
—-” কিছু বলবেন?”
রেজা খান প্রশ্ন করলে অন্তু অদ্ভুত হেসে কন্ঠটা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করল,
—-” স্যার, আপনার একটা মেয়ে ছিলোনা? কি যেন নাম!( মনে করার চেষ্টা করে) ও হ্যাঁ, ইলহাম। ইলহাম কেমন আছে?”
আকস্মিক অন্তুর থেকে এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন একদমই আশা করেনি রেজা সাহেব। তার হাসিখুশি মুখখানা আকস্মিক অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। মিমি কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকালো রেজা সাহেবের দিকে। ও যেন আকাশ থেকে পড়েছে। রেজা খানের মেয়ে আছে? কই, ও তো কোনোদিন শোনেনি!
—-” এখন তো নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। তাই না স্যার!”
এবার যেন রেজা সাহেবের গলা চে/পে ধরলো কেউ। চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে উঠলো। তার মেয়ের কথা এই ছেলেটা কিভাবে জানলো? যে ইতিহাস তিনি আরও ২৩বছর পূর্বে গলা চে/পে হ//ত্যা করেছে সেই ক/বর কে খুঁড়ল!
—-” হোয়াট ডু ইউ মিন! কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”
ভ/য়ানক রে/গে গেলেন রেজা সাহেব। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবেন অন্তুকে। অন্তু অবাক হওয়ার ভান করলো। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
—-” আপনি এতো রে/গে যাচ্ছেন কেন! কুহেলিকা ম্যামের মৃ//ত্যুর পর আপনি ইলহামকে নিয়ে আসেননি আপনার কাছে?”
কুহেলিকা খান’ ইলহামের মা। এক সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। মিমি নামের মেয়েটা একের পর এক হোঁচট খেয়ে চলেছে। তবে কি ইলহাম রেজা খান এবং কুহেলিকা খানের একমাত্র মেয়ে। আর রেজা সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী অর্থাৎ লাবনী ম্যাম নিঃসন্তান। লোকমুখে মিমি শুনেছে রেজা সাহেবের একটা মেয়ে আছে। তবে সে যে কুহেলিকা ম্যাম এবং রেজা সাহেবের মেয়ে সে কথা মিমির ধারণাতীত ছিলো।
—-” দেখুন মিস্টার অন্তু। আমি আপনাদের সাথে কোনো পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে ডিসকাস করার ডিল করিনি। ডিল করেছি টাকার এবং কনস্ট্রাকশনের। এগুলো সম্পূর্ণই আমার পার্সোনাল ম্যাটার। আমি খুশি হবো, আপনি আমার পারসোনাল প্রবলেম নিয়ে আর কোনো কথা না বাড়ালে।”
—-” সরি স্যার! সামান্য কৌতুহল বশত আপনাকে বিব্রতবোধে ফেলে দিলাম। আই এম রিয়েলি সরি।”
জবাবে আর কিছুই বললেন না রেজা সাহেব। শুধু ভেতরে ভেতরে ক্ষো//ভে ফেটে পড়তে লাগলেন। এতোবছর বাদে হঠাৎ অতীত নিয়ে প্রশ্ন উঠবে ভাবতেই পারেননি তিনি।
তবে, অন্তু মনেমনে পৈ/শাচিক আনন্দে হাসলো। যে উদ্দেশ্যে এসেছিলো, সে উদ্দেশ্য তো সফল হয়ে গেছে। এবার কেবল সমস্ত সত্যিটা সামনে আসার পালা।
—-” আসি।”
এই বলে উঠে বেরিয়ে গেলো অন্তু। অন্তু বেরিয়ে যেতেই টেবিলের উপর জোরে একটা বারি বসিয়ে নিজের রা//গটাকে কন্ট্রোল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালেন রেজা সাহেব। কিন্তু রা/গ যে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছেনা।”
_____________
খাবারের প্রতি অনিয়ম এবং অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ইলহামের শারিরীক কন্ডিশনের বেহাল দশা হয়েছে। ডক্টর যখন কথাগুলো বললেন, সবার মুখ চোখ শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো। জীবনের এমন একটা পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় শ//ত্রুও তো কারোর এতো বড় ক্ষ//তি করেনা যতটা ইলহাম নিজেই নিজের করেছে। রাদ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। আসলে তারই ভুল হয়েছে। যবে থেকে ইলহাম ওর মায়ের মৃ//ত্যুর সম্মন্ধে এবং রন আঙ্কেলের সম্মন্ধে জানিয়েছে তবে থেকেই ওর এই রো/গ হয়েছে। সারাদিন শুধু এসব নিয়ে ভাবতে থাকতো। রাদ অনেকবার বারন করেছিলো তাকে, কিন্তু ইলহাম বারন শুনেও নিজেকে শুধরাতে পারেনি। আর সেই রো/গেই আজ সবটা শেষ হতে বসেছিলো। হয়তো উপরওয়ালা সহায় হয়েছেন ওদের উপর। তাই সবটা শেষ হতে হতেও ঠিক হয়ে গেলো।
ইলহামকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। সবাই এক এক করে দেখা করে গেলেও রাদ এলোনা দেখা করতে। মাকে বলে বেরিয়ে পড়েছে সে কোথাও। এটা হলো ইলহামের শা/স্তি। খুব অনিয়ম করা হয়েছে না নিজের উপর? এবার আরও অনিয়ম করুক! সব ধ্বং//স করে দিক! এই বলেই চলে গেছে সে। ইলহাম সবার দেখা পেলেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা না পেয়ে ভ/ঙ্গ হৃদয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো।
রাত করে কেউ একজন এলো ওর কেবিনে। ইলহাম ভেবে খুশি হলো যে এটা রাদ। কিন্তু রাদ আসেনি। এসেছে অন্তু। কেবিনে প্রবেশ করে ইলহামকে এমন চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্তু মুচকি হাসলো। এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
—-” রাদের অপেক্ষা করছিলে বুঝি?”
ইলহাম মন খারাপ করে চোখ সরিয়ে নিলো। কাতর কন্ঠে বলল,
—-” উনি ভীষণ রা/গ করেছেন আমার উপর তাই না?”
—-” হু, রাগ তো একটু করেইছে। বাট ইউ ডোন্ট ওয়ারি। আমি আছি তো।”
অন্তুর কথায় ভরসা পেলো ইলহাম। কিন্তু ভীষণ কান্না কান্না পাচ্ছে তার। নিজেকে কেন যেন কন্ট্রোল করতে পারছেনা। হঠাৎ কেঁদে উঠলো বাচ্চাদের ন্যায়। ওর এরূপ কান্না দেখে ভড়কে গেলো অন্তু। আমতাআমতা করতে করতে চটজলদি ফোন বের করে কল দিলো রাদকে। অসহায় গলায় জানালো,
—-” এ ভাই, তোর বউ কাঁদছে। জলদি ফিরে আয়।”
অন্তুর কথায় কাজ হয়েছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় ঝড়ের বেগে এসে হাজির হলো রাদ। কোথা থেকে এলো, কেমন করে এলো ভাবতে গিয়ে কান্না থেমে গেলো ইলহামের। রাদ ব্যস্ত হয়ে গেলো ওর কান্না দেখে। পা/গলের মতো করতে লাগলো। কি হয়েছে, কোথাও পে/ইন হচ্ছে কি-না, ক/ষ্ট হচ্ছে কি-না এমন হাজারোও প্রশ্ন তার। ইলহাম রাদের পা/গলামি দেখে কি জবাব দিবে বুঝে কুলোতে পারলোনা। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাদকে। রাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো ইলহামের কান্ডে। ইলহাম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
—-” আমাকে রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি! আপনাকে দেখতে না পেয়েই তো কাঁদছিলাম।”
ইলহামের স্বভাব সুলভ জবাবে রাদ যেন কথা খুঁজে পেলোনা। এদিকে অন্তু আর কাবাবমে হাড্ডি হতে না চাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। রাদ জবাব খুঁজে না পেয়ে জড়িয়ে ধরলো ইলহামকে। রা/গারা/গি পরেও করা যাবে। এই মুহুর্তে ইলহামের মেন্টাল সাপোর্টটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
#চলবে