#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব________৩৩.
—-” ইলহাম!”
একটা পরিচিত ডাকে ইলহামের পা জোড়া দাঁড়িয়ে পড়লো। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন পেছন মুড়ে তাকালো তখন যেন ব/জ্রাহত হলো তার দৃষ্টি। একরাশ ঘৃ/না জাঁতা দিলো মন পুকুরে। ওর সামনে কিছুটা অদূরে দাঁড়িয়ে আছে অন্তু। পড়নে লাল শার্ট আর কালো প্যান্ট। দৃষ্টি মলিন। চোখে মুখে উদাসীন একটা ভাব। পূর্বের চেয়ে অনেকটা পরিবর্তন অন্তুর। ইলহাম অবশ্য অন্তুর সেই পরিবর্তন দেখার মতো অবস্থায় নেই। তার গা ঘিনঘিন করছে ঘৃ/ণা! ইলহাম দাঁড়াতে চাইলোনা। অন্তুকে দেখেও ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হলে অন্তু ফের ডাকে,
—-” কেমন আছো, ইলহাম?”
ইলহাম প্রতিত্তোর করেনা সেই ডাকের। কাঠকাঠ গলাতে পাল্টা প্রশ্ন করে,
—-” তুমি এখানে কেন এসেছো? নতুন করে আবার কি ক্ষ/তি করার বাকি আছে তোমার!”
ইলহামের ঝাঁঝাল কন্ঠে মিইয়ে পড়লো অন্তু। মাথাটা নীচু করে কয়েক সেকেন্ড কিছু বললো না। অতঃপর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম গলায় বলল,
—-” মানুষ যখন হারাতে শুরু করে তখন একে একে সব হারাতে থাকে। তাই বলে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। হয়তো ক্ষো/ভ কিংবা জে/দ থেকে তোমার আর রাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছিলাম! আবার তোমার মনে রাদের জন্য ঘৃ/ণা/র উদ্রেক ঘটানোর পেছনেও আমিই দায়ী ছিলাম। আজ এসব স্বীকার করাতে কোনো আক্ষেপ নেই বা গিল্টি নেই। তবে একটা বিষয়ে আক্ষেপ সারাজীবন থাকবে! আমি তোমাকে ভ/য়া/নক রকমের ভালোবাসলেও সেটা কখনোও নিজে ফিল করতে পারিনি। তোমাকে আগলে রাখতে পারিনি। আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আমি আমার করে রাখতে পারিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও ইলহাম। জানি, আমার অপরাধ গুলো ক্ষমার অযোগ্য। তবুও বলবো, প্লিজ ইলহাম! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আমার ভুলগুলোর জন্য অনেক বেশি অপরাধবোধে ভুগছি। আজ থেকে নয়, প্রায় অনেকদিন ধরে। অবশ্য এর পেছনে রাদেরই কৃতিত্ব আছে। রাদ আমাকে সবটা না জানালে, না বোঝালে হয়তো আমি তোমাদের আরও অনেক বড় ক্ষ/তি করে ফেলতাম।”
প্রথমে ভীষণ ঘৃণা হলেও ক্রমে ক্রমে তা কুয়াশার ন্যায় কেটে যেতে লাগলো। ইলহাম ঢের বুঝতে পারছে অন্তুর কথাগুলো ওর মনের ঘৃ/ণা গুলো উপ্রে ফেলতে সার্থক হয়েছে। অন্তু বদলে গেছে, কথাটা যে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! আর এই অবিশ্বাসযোগ্য সত্যিটাই ঘটছে ওর সামনে। ওর মুখে আর রা’ কাটলো না। অনেকটা সময় লাগলো কথা গোছাতে। অবাক কন্ঠে নরম গলায় বলল,
—-” মানে!”
ইলহামের অবাক করা কন্ঠটি অস্বাভাবিক লাগলোনা অন্তুর। সে মুচকি হাসলো ইলহামের পানে চেয়ে। বলল
—-” তুমি ঠিকই শুনেছো। এবার বলো, আমাকে কি একটাবার মাফ করা যায়না?”
—-” তুমি বদলে গেছো! অন্তু বদলে গেছে?”
—-” হ্যাঁ ইলহাম। সেই নোং/রা মস্তিষ্কের বিক/লা/ঙ্গ ছেলেটা বদলে গেছে। ইট’স হ্যাপেন্ড।”
ইলহাম মুখে হাত চাপলো। ওর হাতটা কাঁপছে হয়তো। খারাপ লাগায় নয়, বরং ভালো লাগায়। আনন্দে। রাদ এই মানুষটাকেও বদলে দিলো?
—-” এখন থেকে তুমি শুধুই আমার ভাবি। আমার ভাইয়ের একমাত্র মিষ্টি বউ। আমাদের মধ্যে কয়েকটা দিনের যে সম্পর্কটা হয়েছিলো সেটা একদম মনে রাখবেনা। ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও। আমিও ভুলে যাবো। আর হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতো একটা মেয়ে খুঁজে দিও তো? বিয়ে করবো।”
বলে হেসে দিলো অন্তু। হাসলো ইলহামও। কতটা বদলে গেছে ছেলেটা। ভাবাই যায়না।
—-” আমার জবাবটা কিন্তু পেলাম না?”
—-” কি জবাব?”
—-” আমাকে ক্ষমা করার বিষয়টা! আচ্ছা, নো চাপ। আমাকে ক্ষমা করতে তোমার যত টাইম লাগে নাও। তবে হ্যাঁ, ক্ষমা কিন্তু আমার চাই-ই চাই। আজ হোক কিংবা কাল কিংবা আরও দশ বছর পর। তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে যে আমি শান্তিতে নিশ্বাসও নিতে পারবোনা।”
অন্তুর কথা গুলো মনে দাগ কাটলো ইলহামের। মানুষ যখন নিজের ভুল গুলো উপলব্ধি করতে পারে, নিজের ভুল গুলো বুঝতে পারে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই হতে পারেনা। এরপরও তাদের ক্ষমা না করাটা ভীষণ বোকামো। ইলহাম স্মিত হাসলো। অন্তুর দিকে একপলক দেখে বলল,
—-” আচ্ছা দশ বছর অপেক্ষা করতে হবেনা। এক্ষনি ক্ষমা করে দিচ্ছি। তুমি অশান্তির নিশ্বাস নিয়ে মনেমনে আমাকে বকবে তা কিন্তু হবেনা!”
ইলহামের কথা শুনে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকালো অন্তু। পরক্ষনে আবার দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। অন্তু বলল,
—-” তুমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো থেকো। আর আমার ভাইকে এত্তো এত্তো ভালোবেসো। আমি দূর থেকে দোয়া করবো তোমাদের জন্য।”
—-” দূর থেকে কেন? কাছ থেকেই করো। সমস্যা তো নেই।”
—-” কাছ থেকে আর বেশিদিন পারবোনা বোধহয়।”
—-” কেন!”
—-“আব.. চলে যাচ্ছি ইউএসএ-তে। ওখানে হায়ার স্টাডি শেষ করে একটা জব নিয়ে নিবো। বাকিটা জীবন ওখানেই কাটানোর ইচ্ছে!”
—-” এ বাবা! কেন? হায়ার স্টাডি করতে ইউএসএ পারি জামাতে হবে কেন? এখানে কি দোষ করলো? আর আমাকে যে এক্ষনি বললে,ঠিক আমার মতো কাউকে খুঁজে দিতে! সেটার কি হবে?”
অন্তু মলিন হেসে বলল,
—-” বেঁচে থাকলে সবই হবে। আপাতত এসবে জড়াতে চাইনা। আর এখানেও থাকতে চাইনা!”
—-” এই ছেলে, নিজেকে পরিবর্তন করেছো বলে কি এতো ভে/ঙে পড়তে হবে হ্যাঁ? তুমি আগেতো এমন ছিলেনা। বি স্ট্রং অন্তু। আমরা তোমার পর নই। তুমি এখানে থেকেই সব করবে। কোনো বিদেশ যাওয়া চলবেনা।”
অন্তু স্থির দৃষ্টিতে একবার দেখলো ইলহামকে। মেয়েটা অদ্ভুত ভালো। কত সহজেই একটা খারাপ মানুষকেও আপন করে নিতে পারে।
—-” আচ্ছা যাবোনা। তাহলে কিন্তু আমার জন্য সত্যি সত্যি মেয়ে চাই। ঠিক তোমার মতো ভালো।”
ইলহাম মুচকি হেসে বলল,
—-” ঠিকাছে। খুঁজে দিবো। নীচে যাবে তো? এসো।”
—-” হু। চলো।”
__________________
মানুষ যা চায় তা পায়না। আর যা পায়, তা চায়না। মানব জীবনের চাকাটা হয়তো ঠিক এমন গতিতেই ঘোরে। তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকা ইলহামের মনটা এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে চায়। শরীর তো অনেক পূর্বেই অসার হয়ে আসে। কিন্তু তবুও এতক্ষণ মনের জোরই অপেক্ষা করে গেছে প্রিয় মানুষটার। তবুও দেখা মেলেনি তার। নিঝুমের জন্মদিনের পার্টির ইতি ঘটে রাত ৯টায়। ইনভাইটে আসা সমস্ত মেহমানরা চলে যায় নিজেদের বাড়ি। অন্তুরাও ফিরে যায় দশটার দিকে। সারা সন্ধ্যে জনগনে গমগম করা ফ্লোর এখন নিস্তব্ধ। রাতের খাবার খেয়ে এতক্ষণে সবার এক ঘুম হয়েও গেছে। কিন্তু ইলহাম কিছু না খেয়ে লাগাতার অপেক্ষা করে গেছে রাদের।
রাদ ফিরলো রাত ৩টায়। আজকের দিনটা তার জন্য খুবই খা/রাপ কেটেছে। হাতে একের পর এক ঝামেলা এসে জুটেছে। আর সবগুলোরই সমাধান আজই করতে হয়েছে। এখানে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের ঝা/মেলা তো ওখানে টাকা মা/ই/র খাওয়ার ঝা/মেলা। এতো এতো কাজের চাপে ইলহামকে দেওয়া কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে। তবে যেই মুহুর্তে নেতানো গোলাপের ভ্যাপ্সা গ/ন্ধ এসে নাকে ঠেকলো ঠিক সেই মুহুর্তে মনে পড়লো আজ ইলহাম তাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিলো। কথাটা মনে হতেই বুকের ভেতরটা কেমন কুঁকড়ে গেলো। রুমের মধ্যে এসে দাঁড়াতে তার আর বুঝতে বাকি রইলোনা, ইলহাম তার জন্য সারপ্রাইজ তৈরি করেছিলো। আর যা কেবল তার জন্য ন/ষ্ট হলো। কে জানে মেয়েটা ঠিক কতক্ষণ অপেক্ষা করেছে!
রাদ বিছানারা দিকে তাকালো। ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট ভেসে আছে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো লাভ সেডটা। তার মাঝে রাদ এবং ইলহামের নামের প্রথম অক্ষর দুটো তীক্ষ্ণ এক ব্যা/থার সৃষ্টি করলো অক্ষিপটে। পুরো ঘর গোলাপের সাগর বলে ঠাহর হচ্ছে রাদের। এ যেন ঘর নয়, সর্গ। কিন্তু ইলহাম কোথায়!
রাদ হাতের ব্যাগ, ব্লেজার, ঘড়ি আর মানিব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ব্যালকনির দিকে পা বাড়াতেই কিছু একটার সাথে হোঁ/চট খেয়ে পড়ে যেতে নিলে কোনো ভাবে সামলালো নিজেকে। নীচে তাকাতেই চমকে উঠলো রাদ। ইলহাম ফ্লোরে পড়ে আছে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তার। কি হয়েছে ওর? জটজলদি ইলহামকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো রাদ। অস্থির হয়ে উঠলো তার ভেতরটা। ঠিকাছে তো তার ইলহাম? ভাবতে ভাবতে ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিতেই চোখ ধাঁধিয়ে এলো রাদের। পরক্ষণেই সামলে নিলো নিজেকে। নিজেকে ভুলে এবার ইলহামকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ইলহামের কপালে গালে হাত দিয়ে দেখলো শরীরের টেম্পারেচারের বাড়াবাড়ি নেই। ঠিকই আছে। নার্ভও ঠিক চলছে। হঠাৎ রাদের চোখ ঝলকালো ইলহামের পড়নের শাড়িটায়। ঠোঁটের কড়া লাল লিপস্টিকে। খোলা চুলগুলোর সাথে ছেঁড়া কাঁচা ফুলের গাজরাটায়! এমনকি ইলহামের চোখের কোনে শুকিয়ে থাকা জলটুকুও চোখ এড়ালোনা তার। রাদ বুঝতে পারলো ইলহাম কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি সব ঠিকাছে। দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। রাদ উঠে আবার লাইটটা অফ করে দিলো। শুধু জ্বালিয়ে রাখলো একটা ড্রিম লাইট। বিছানার উপর সাজানো গোলাপের পাপড়ি গুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে গোসল করে চেঞ্জ করে নিলো। অতঃপর শোয়ার আগে ইলহামের কপালে ছোট্ট একটা ভালোবাসার পরশ একে ইলহামকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাসের পাহাড় ঠেলে ঘুমিয়ে পড়লো।
________________
#চলবে