#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_________২৮.
প্রভাতের একফালি মিষ্টি রোদ মুখের উপর পড়তেই চোখ কুঁচকে গেলো রাদের। ফিনাইলের বিশ্রী গন্ধটা তখনই এসে বারি খেলো নাকের ডগায়। একটা ভরাট গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো তার। চোখ-মুখ কুঁচকে পাশ ফিরে বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলেই এলেমেলো তারে টান লেগে আবারও শুয়ে পড়তে হলো তাকে। আধাআধি শোয়া যাকে বলে। একরাশ বি/র/ক্তি/র স্তূপ ঠেলে চোখ জোড়া টেনে মেলে দিলো। অতঃপর অক্ষিপটে স্পষ্ট দেখতে পেলো ক্যানেলার চিকন তারের ন্যায় পাইপটা। লাল র/ঙে আচ্ছন্ন সেই পাইপ। অর্থাৎ, তাকে র//ক্ত দেওয়া হচ্ছে। মাথার ভেতরটা যেন কেটে দু’টুকরোতে পরিণত হয়েছে ঠিক, ওমনই একটা টান লাগাতে অন্যহাতটা তুলে মাথা চাপলো। মাথা চাপতে গিয়ে আরেক প্রশ্ন.. মাথায় কি হলো?
সবটা মনে পড়তে অনেকটা সময় ঠিক এমন করেই কেটে যায়। রাদ হাতের ক্যানেলা খুলে ফেলে দেয় নীচে। অতঃপর, ধীরেধীরে সোজা হয়ে বসে। তীব্র য/ন্ত্র/ণা/য় মাথার ঘিলু-টিলু বেরিয়ে আসবে যেন। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করছে ব্যা/থাগুলো। তার চেয়েও ভ/য়া/ন/ক রা/গ এবং তীব্র য/ন্ত্র/ণা হচ্ছে বক্ষঃপিঞ্জরে। মেয়েটা রাত থেকে নিখোঁজ! ঠিক কোথায় গেলে খুঁজে পাবে তাকে?
—-“এ-কি! তুই হাতের ক্যানেলা কেন খুললি? জানিস কতটা র/;ক্ত ঝড়েছে শরীর থেকে?”
হাতে প্রেসক্রিপশন এবং ঔষধের একটা প্যাকেট নিয়ে কেবিনে ঢুকছিলো প্রণয়। আকস্মাৎ রাদের এহেম অবস্থা দেখে ভ/য়ে কপাল ফুলে উঠলো তার। প্রণয়ের পাশে আকাশ এবং বেলীকেও দেখা যাচ্ছে। ওরা রাদের স্কুল ফ্রেন্ড। বর্তমানে এই হসপিটালের বিশিষ্ট দু’জন ডাক্তার। কথাটা আকাশ বলেছে।
—-“এসব কি রাদ? দিস ইজ সো আনফেয়ার। রাতে তোর কি অবস্থা ছিলো.. ইউ হ্যাভ ন্যো আইডিয়া!”
বলে উঠলো বেলীও। বিস্ময়ে তার কপাল সরু হয়ে আছে। অর্থাৎ কুঁচকে গেছে বেশ খানিকটা।
রাদ মাথা নীচু করে কিছু ভাবছে। ওদের কথা তার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না।
—-“ওর প্রেশারটা চেক করে দে আকাশ! আমি ঔষধ গুলো দেখছি।”
বেলীর কথায় আকাশ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলো রাদের কাছে। প্রেশার মাপার যন্ত্রটা হাতে তুলতে তুলতে রাদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। প্রণয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
—-“ভাগ্যিস, ওর গাড়িটা জঙ্গলের পাশে ছিলো! তাই ছিটকে বেরিয়ে যেতে জঙ্গলের ভেতর পড়ে। নয়তো.. যে হালে এ/ক্সি/ডে/ন্ট/টা হয়েছে ভাই! কপালে নির্ঘাত মৃ//ত্যুই ছিলো।”
প্রণয়ের বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা মেলে। আকাশ নিশ্চুপ হয়ে রাদের প্রেশারটা চেক করে। হাই প্রেশার। আর শরীরের যে অবস্থা, কম করে হলেও আরও ৩-৪দিন এখানে থাকতে হবে।
—-“বেলী? এমডি স্যারের সঙ্গে রাদের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিলি? কি বললো স্যার?”
আকাশের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় না বেলী। বরং ঔষধ গুলো দেখতে দেখতে মাথা ঝুঁকে রেখেই জবাব দেয়,
—-“হু বলেছি। রাদের নাম বলাতেই কাজ হয়ে গেছে। পুলিশ কেস হওয়ার চান্স নাইন্টি পার্সেন্ট থাকলেও এখন টেন পার্সেন্টও নেই।”
—-“ওকে। রাদ? মাত্র দু’টো দিন এখানে থাক প্লিজ। তোর কিন্তু প্রচুর ব্লা/ড লস হয়েছে। সেগুলো ফুলফিল করতে মিনিমান পাঁচ ব্যাগ ব্লাড দরকার। প্লিজ ভাই, মনের দুঃখ বা রা/গ এই ক্যানেলার উপর দেখাসনা!”
—-“হ্যাঁ রে রাদ! আকাশ কিন্তু একদম ঠিক কথা বলেছে! আর আমি একটা কথা বুঝতে পারছিনা, তুই হঠাৎ করে এমন বেসামাল হয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলি কবে থেকে? তুই তো এমন ইরেসপন্সিবল ছিলিস না কখনো?”
রাদ সেই থেকেই মাথা নীচু করে ভেবে যাচ্ছে ইলহামের কথা। বরাবরের মতো এবারেও সে কিছুই শুনতে পায়নি ওদের কথা। শুনতে পায়নি তেমনটা নয়, বলা বাহুল্য শুনতে চায়নি।
—-“আচ্ছা ছাড়! রেস্ট নে এখন। দুপুরে দেখা হচ্ছে।”
এই বলে চলে যায় বেলী। আকাশ ওর হাতের ক্যানেলাটা পূণরায় লাগিয় দিলো। পরক্ষনে স্মিত হেসে সেও চলে গেলো। ওরা দু’জন বেরিয়ে যেতেই ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রণয়। দরজার দিকে একবার তাকিয়ে উঠে এলো রাদের কাছে। নিরাশ, ভাঙা গলায় বলল,
—-“চিন্তা করিসনা ভাই! আমরা ঠিক ভাবিকে খুঁজে পাবো।”
এতক্ষণে বোধকরি রাদের কানের পর্দায় এক তীক্ষ্ণ শব্দের আনাগোনা মিলল। অস্থির দৃষ্টি খানা প্রণয়ের পানে নিক্ষেপ করলো। কিছু বলার চেষ্টা করলো। তবে তার পূর্বেই তার মুখের কথা কেড়ে নিও বলে উঠলো প্রণয়,
—-“তবে অন্য একটা খবর পাওয়া গেছে!”
রাদ প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তাকালো। প্রণয় পূর্বের ন্যায় পূণরায় বলল,
—-“ভাবির ফোনে তোর আর ভাবির পুরনো কিছু ছবি পাওয়া গেছে। অনু বলল, এই ছবি গুলো তাকে কেউ হোয়াটসঅ্যাপ করেছে। কৌতুহল বশত অনু ভাবির হোয়াটসঅ্যাপ ঘাঁটলে দেখতে পায়, কেউ খুব চালাকির সাথে এই ছবি গুলো পাঠিয়েছে ভাবিকে। ভাবির মুখটা ব্লার করা। যেটাই ভাবির ভেঙে পড়ার কারণ। জানিস? ছবির নীচে সুন্দর করে লিখে দিয়েছে “আমি রাদের বউ”। কেউ খুব চালাকির সাথে করেছে এই কাজটা। আর সে খুব ভালো করেই জানে ভাবির পুরনো কথা গুলো মনে নেই। তার মুল উদ্দেশ্যই ভাবিকে আর তোকে আলাদা করা! আচ্ছা? এই কাজ টা কে করলো?”
—-“অন্তু!”
রাদের গম্ভীর কন্ঠটা ভেসে উঠলো। প্রণয় পাশ ফিরে তাকালো রাদের পানে। তিক্ত স্বরে বলল,
—-“অন্তু?”
—-”হু! অন্তু। রনিকে একটা কল দে। টানা তিনদিন কোনো খাবার ব্যাতীত অন্তুকে গোডাউনে রাখার অর্ডার করবি। বলবি আমি বলেছি।”
প্রণয় স্থীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাদের দিকে। ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয় তার আদেশে।
____________________________________________
রাদের বড় কালো গাড়িটা একটা কুটিরের সামনে থামতেই হৈচৈ করতে লাগে বাচ্চারা। এতো বড় গাড়ি তারা আগে কোনোদিন দেখেনি। সব গুলো বাচ্চা একজোট হয়ে ছুটে এলো এদিকটায়। রাদ সেদিকে ভাবাবেগ শূন্য। তার অস্থির দৃষ্টি এঁটে আছে কুটিরের ভেতরে। দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে একটা বাচ্চাকে কাছে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলো,
—-“এটা কি মোতালেব সাহেবের বাসা?”
বাচ্চা টা তুমুল গতিতে উপরনীচ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ হ্যাঁ। মুখ জুড়ে তার আত্মবিশ্বাসের জোড়ালো হাসি। হেসেই জবাব দেয় পূণরায়,
—-“হ এইডাই মুত্তালেব চাচার বাড়ি।”
কথাটা শ্রবণগোচর হতেই বুকের উপর থেকে একটা ভারী বস্তু যেন গলে গেলো। রাদ একহাত কপালে চেপে বড় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বারকয়েক।
দু’দিন পেরিয়ে গেছে। শহরের আনাচে-কানাচে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি ইলহামকে। রাদের ভ//য় ক্রমশ বাড়ছিলো। বড় কোনো ক্ষ//তি হয়ে যায়নি তো ইলহামের? গতকালই একটা বিজ্ঞাপনে ছাপিয়েছে ইলহামের ছবি। নিখোঁজ লিখে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বিজ্ঞাপন পাবলিশড হওয়ার ১২ঘন্টার মধ্যে প্রত্যাশিত কল টি পেয়েছে রাদ। ইলহাম এই মুহুর্তে একটা অজপাড়াগাঁয়ে অবস্থিত। সেদিন রাতে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই ঢুকে পড়ে এই গ্রামে। অতঃপর শুরু হয় তুমুল বর্ষণ। সারারাত এক টানা ভিজতে থাকে সেই কাঁটার বর্ষণে। এক পর্যায়ে তীব্র জ্ব/রে জ্ঞান হারায় ওখানেই। ভোর হলে তাকে কয়েক জন লোক দেখতে পেয়ে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে। অতঃপর সেদিন থেকেই তাদের সাথে আছে ইলহাম। ওমন অজপাড়ায় ডাক্তার পাওয়াটা দূর্লভ বস্তু। তাদের চিকিৎসা তারা নিজেরাই করে। সুতরাং ইলহামের চিকিৎসাও তারা নিজেরাই করেছে ঘরোয়া উপায়ে।
রাদ এগিয়ে যায় ভা/ঙাচোরা কুটির টির দিকে। রাদ এগোতে এগোতে বেরিয়ে আসে এক বয়স্ক লোক। তার বেরিয়ে আসার কারণ অবশ্য ঘরের বাইরে বাচ্চাদের অহেতুক কোলাহল থামানো। কিন্তু বেরিয়ে আসতে এক অপরিচিত লোককে দেখে তার পা জোড়া থেমে পড়ে। এক তীক্ষ্ণ চাহনিতে খানিটা সময় পর্যবেক্ষণ করতে করতে হঠাৎ বলে ওঠে,
—-“আপনে রাদ স্যার? তাই তো!”
রাদ বয়স্ক লোকটির প্রশ্নে একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে। আশেপাশে একবার তাকায়। চোখ ঘোরায়। অতঃপর শার্টের কলারটা টেনে ঠিক করার বাহানায় বলে,
—-“জি। আমি রাদ। মিহাদ আবরিশাম রাদ।”
লোকটা তাজ্জব বনে গেলো যেন। অবিশ্বাসের দৃষ্টি মেলে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পূর্বের কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
—-“স্যার আপনে এইহানে! কোনো দরকার স্যার? কন, আপনেরে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?”
রাদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলো,
—-“আপনি কি মোতালেব সাহেব?”
লোকটা একটু ভাবনায় পড়লো। জড়তা নিয়ে জবাব দিলো,
—-“জে স্যার! আমিই মোতালেব।”
—-“আপনিই আমাকে কল করেছিলেন বিজ্ঞাপনের নাম্বার টা থেকে! তাই তো?”
মোতালেব সাহেব কপাল সরু করলেন। মনে করার চেষ্টা করে বললেন,
—-“এই নতুন বউ আপনের স্যার? যে মাইয়্যারে আমরা পরশুদিন ভোরে উদ্ধার করছি!”
রাদ অসহায় কন্ঠে বলে,
—-“জি। ও আমার বউ।”
মোতালেব সাহেবের ঝাটকা লাগা কমেনা। বরং ক্রমশ বাড়ে। তিনি হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বললেন,
—-“কই গো হুনছনি? নতুন বউরে নিতে আইছে তার সোয়ামী।”
বলতে বলতে রাদের পানে তাকিয়ে তৃপ্তি দায়ক হাসে মোতালেব সাহেব। রাদকে ভেতরে আসার অনুরোধে বলে,
—-“দুফরের ভাত এহনো খায়নাই স্যার। আমার গিন্নি এই যে ভাত বসাইলো।”
রাদ লোকটার পেছন পেছন ঢুকে ছোট্ট কুটিরটায়। তুমুল বর্ষণের তোরজোড় কমে গেলেও তার মাটির ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব এখনও কাটেনি। কিছু জায়গায় তো পা ফেলাটাও ক/ষ্টসাধ্য।
চলবে