#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
পর্ব_________১০.
রাত পৌঁনে বারোটা। ছিমছাম অন্ধকার হাতড়ে গাড়ি এগোচ্ছে অন্তুদের বাড়ির উদ্দেশ্য। পথ যত কমছে ইলহামের শ/ঙ্কা, ভ/য়-ভীতি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে একরাশ অস্বস্তির জাতাঁকলে পিষে আছে। অন্তু তাকে দেখলে ঠিক কেমন রিয়াক্ট করবে জানেনা সে। এমনকি যে কটা দিন সে থাকবে এ বাড়িতে আদৌও কখনোও তাকে শান্তিতে থাকতে দিবে কি না সেকথাও জানেনা! তার মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ছে। কেন যে রাদের জোড়াজুড়িতে আসতে গেলো? বেশি না আর একটু বেঁকে বসলে রাদ নিশ্চয়ই তাকে এতোটাও জোর করতো না।
আচমকা গাড়ি থামতেই ইলহামের ভাবনাদের ছুটি মিলল। পূর্বে চমকে উঠতেই অবশ্য এতো আটঘাট বেঁধে ছুটি দিতে পারলো তাদের। হঠাৎ গাড়ি থামাতে গিয়ে রাদ নিজেও কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে বাইরের ছোট্ট মিরোরটার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—-“এটা হলো প্রাথমিক ইঙ্গিত, যে এ বাড়িতে না আসাটাই বেটার হতো। (বিরবির করে) এই যে ম্যাম, নামতে হবে। আমরা এসে গেছি।”
সরু গলিতে দাঁড়িয়ে আছে তাদের গাড়ি। রাদ ইলহামের দিকে না তাকিয়েই বলল কথাটা। অতঃপর নেমে গেলো সে। ইলহাম ভাবুক মনে দেখছিলো সামনের দিকে। ভাবছিলো, এই সরু গলিতে থাকে অন্তু? কিন্তু রাদের বিরক্ত সূচক কন্ঠে কপাল কুঁচকে তাকায়। নামতে নামতে জানতে চায়,
—-“আমরা পৌঁছে গেছি?”
রাদ চেকিং করছিলো তার গাড়ি। হয়তো ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইলহামের প্রশ্নে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
—-“উমম.. না! হ্যাঁ, পৌঁছেছি। তবে একদম কাছাকাছি। এই যে গলি পেরিয়েই চাচিদের বাসা।”
—-“তাহলে আমরা এখানে কেন নামলাম?”
ইলহামের বোকা গলায় রাদ পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো ইলহামের পানে। ইলহাম তখন চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখায় ব্যস্ত। রাদ দুুরন্ত হাসলো। গাড়ির ডিকিটা খুলতে যেয়েও খুললো না। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি এঁটে কদম ফেলে সামনে এসে দাঁড়াল ইলহামের। রাদ আকস্মিক সামনে এসে দাঁড়াতে চোখ বড় বড় করে তাকায় ইলহাম। তার ড্যাবড্যাব করা চাহনি দেখে রাদ মনেমনে হাসে। আকস্মাৎ তার কোমর চেপে কাছে টেনে এনে ফিসফিসিয়ে বলে,
—-“রোমান্স করবো বলে!”
ইলহাম অষ্টম আশ্চর্যের ন্যায় চমকে ওঠে। হতভম্বের ন্যায় কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছিটকে পড়ে তার থেকে। কাঁপা কাঁপা স্বরে আমতাআমতা করে বলে,
—-“ক..কি! আ..আমি কিন্তু যাবোনা আপনার সাথে, এই বলে দিলাম।”
ইলহামের রিয়াকশনে হো হো শব্দ করে হেসে ওঠে রাদ। ইলহাম অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকে তার পানে। হাসতে হাসতে রাদ পেট চেপে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় গাড়ির সাথে। বড় বড় করে বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে থামাতে চেষ্টা করে হাসিটুকু। অতঃপর বলে,
—-“তুমি এতো কিউট না, সুইটহার্ট। এর জন্যই বারবার প্রেমে পড়ি তোমার। একটা সেকেন্ডও ঠিকঠাক অতিবাহিত হতে পারেনা। ওকে, আর ভয় পেতে হবেনা। গাড়ির ইঞ্জিনে প্রবলেম হয়েছে। তাই হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। মনে হয়না ঠিক হবে। চলো, বাকি পথ টুকু হাঁটা ধরি।”
রাদের বর্ননায় মুখ কুঁচকে যায় ইলহামের। কি পাঁজি লোক রে বাবা! ইচ্ছে করছে হাতুড়ির এক বারিতে ঘিলু হাতে ধরিয়ে দিতে।
—-“উমম.. বাই দ্য ওয়ে, হেঁটে যেতে প্রবলেম নেই তো? নাকি কোলে তুলে নিবো?”
রাদ দুষ্ট হেসে ভ্রু নাচায়। ইলহাম আঁ;তকে ওঠে। আ;তংকিত স্বরে চেঁচিয়ে বলে,
—-“ন..ননন-না! আমি প..পারবো।”
রাদ আবারও হেসে ওঠে সশব্দে। উপর নীচ করে মাথা নাচিয়ে বলে,
—-“কোলে তুলে নিতে হলে মাইন্ড করতাম না, সত্যি!”
ইলহামকে ক্ষেপানোর জন্যই বলল কথাটা। ইলহাম ক্ষেপলো ঠিকই। তবে জবাব দিলো না। তাকে পিছে রেখে জোরেজোরে হাঁটা শুরু করলো। পেছন থেকে এখনও রাদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। যাতে ইলহামের রাগ বাড়ছে বৈ কমছে না।
____________________________________________
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুললো অন্তু। রাদের সাথে রাগ করে হেঁটে আসতে আসতে ইলহাম ভুলেই গিয়েছিল অন্তুর কথা। অন্তুকে দেখতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। ভেতরের ভ*য়ানক রা*গ এবং ঘৃ*না একত্রেই যেন উপচে পড়লো।
ইলহামের পরনে সাদা কূর্তি এবং সাদা প্লাজু। লাল ওড়নাটা বেশ মার্জিত আকারেই পড়ে আছে সে। লম্বা বিনুনিটা ঝুলছে ডান কাঁধের উপর। অন্তু, বাঁকা নজরে দেখলো পুরোটাই। ইলহামের অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে উঠলো। ইচ্ছে থাকলেও ভেতরে যেতে পারছেনা। কেননা, এটা রাদের বাড়ি নয়। যতটা কমফোর্ট সে ওখানে পায়, এর এক চিমটিও এখানে নেই। অবশ্য তার কারন, সে আজই প্রথম এসেছে এখানে।
—-“শুভ্রপরী লাগছে তোমায়। মনে হচ্ছে তোমার সাথে ব্রেকআপ করার পর থেকেই আরও বেশি কাম্য হয়ে উঠেছো তুমি!”
ইলহামের শরীরে কাটা বসলো অন্তুর এহেম কথায়। বি*স্ফো*রিত নয়নে তার দিকে তাকানোর মাঝেই তার পেছন থেকে এসে দাঁড়ালো রাদ। রাদকে সে না দেখলেও অন্তু বেশ ভালো করেই দেখলো। তাই মুহুর্তেই পাল্টে ফেললো নিজের ভোল। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
—-“বললেন না তো ভাবি? কেমন আছেন? আরে রাদ! অনেক অপেক্ষা করিয়েছিস ব্রো! কি, ভাবিকে নিয়ে কি লং-ড্রাউভে যাওয়া হয়েছিলো নাকি?”
শেষোক্ত প্রশ্নটা অন্তু ইলহামের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল। রাদের নাম শুনতেই ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো ইলহাম। সে চায়না, নিজের কাছের মানুষের কোনো খারাপ দিক রাদের সামনে চলে আসুক। আর যার দ্বারা সে, ক*ষ্ট পাক।
রাদ ছোট্ট শব্দে হাসলো। এগিয়ে এসে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,
—-“যেহেতু মোক্ষম সুযোগ ছিলো, সেহেতু লং ড্রাইভ তো বানতা হ্যায়। আর ম্যাডামের মুড অফ ছিলো, তাই একটু..”
—-“কেন কেন? ভাবি, কোনো সমস্যা?”
অন্তুর কন্ঠে বেশ আগ্রহ দেখা গেলো। তবে ইলহামের কপালে জুটলো তার বিশ্রী দৃষ্টি,এবং উর্বর মস্তিষ্কের প্রমান। রাদ আশেপাশে দেখলো। কাউকে দেখতে না পেয়ে বলল,
—-“কাউকে দেখছি না যে? আমাদের বুড়ি কই?”
❝ভাইয়া!❞
বুড়ির নাম নিতেই বুড়ি হাজির। অর্থাৎ, অনন্যা। সিঁড়ির উপর থেকে এক দৌড়ে নেমে এলো, রাদকে ডেকে। রাদ তার ডাক পেয়ে গাল ভরে হাসলো। অনন্যা ছুট্টে এসে ঝাপটে ধরলো তাকে। অভিমানী সুরে অভিযোগ করলো,
—-“তোমার এতো রা/গ আমাদের উপর? এভাবে আমাদের পর করে রাখলে? পারলে বলো? ক/ষ্ট হয়নি?”
রাদ অনন্যাকে বুকে আগলে ধরে মাথায় হাত রাখলো। আহ্লাদ করে বলল,
—-“ধুর পা/গলি! কিসের রা/গ? তুই তো আমার অর্ধেক জান। কেবল, তোর কথা ভেবে তোর জন্যই আমি চলে এসেছি দেখ! এরপরও বলবি, আমি রে/গে আছি।”
—-“আমি জানি ভাইয়া, বড় মা-র কথা ফেলতে পারোনি বলে এসেছো তুমি। নয়তো..”
—-“মোটেই না। আমি আসতে চেয়েছি বলেই এসেছি। আর আমার একমাত্র বোনটার বিয়েতে তার ভাই আসবে না, এটা তুই ভাবলি কেমন করে?”
অনন্যা রাদকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। গাল ফুলিয়ে বলল,
—-“এসব তুমি আমার মন রাখার জন্য বলছো। আমি জানি। ওমা.. ওটা কে গো? আমাদের ভাবি?”
ভাবি নামটা নিতেই আনন্দ যেন উপচে এলো অনন্যার কন্ঠ থেকে। রাদ পাশ ফিরে তাকালো ইলহামের দিকে। ইলহাম হাস্যজ্বল মুখে তাদের পানেই তাকিয়ে ছিলো। কি সুমিষ্ট সম্পর্ক দুই ভাই-বোনের। দেখেও চোখ জুড়িয়ে আসে যেন।
তবে তার ধ্যান ভাঙে অনন্যার উৎসাহ ঘেরা কন্ঠের ডাকে। রাদ স্মিত হেসে মাথা নাড়ে। অনন্যা দিগুণ উৎসাহ নিয়ে ছুট্টে যায় ইলহামের দিকে। কিছু না বলেই আচমকা একবার জড়িয়ে ধরে তাকে। ইলহাম ভড়কে যায় অনন্যার কাজে। তবে নিজকে সামলে নিতে নিতে বুঝে নেয়, এটা অনন্যার ন্যাচার।
—-“ইশশ! কি মিষ্টি গো ভাইয়া। এমন ভাবি কোথায় পেলে বলো তো?”
রাদ হাসে। হাসে ইলহামও। অনন্যা আকস্মিক ইলহামের চুল টেনে বলে,
—-“ওমা! এতো বড় চুল.. ভাবি এটা কি রিয়েল?”
ইলহাম না পেরে হেসে ওঠে শব্দ করে। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলে,
—-“একদম রিয়েল।”
—-“সরি গো। কিছু মনো করোনা( দাঁত কেলিয়ে হেসে)।”
ইলহাম হেসে পড়লো অনন্যার হাসিতে। হাসলো রাদও। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখাটা ধরে রেখেই এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ইলহামের পাশে। একবার বিমুগ্ধ নয়নে তার প্রিয়দর্শিনীর দর্শন দিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-“তোর মতো একই কৌতুহল আমারও ছিলো। এতো লম্বা চুল। চোখ ধাঁধিয়ে আসার মতো। বিশ্বাসই হচ্ছিলোনা যেন। তারপর একদিন চেক করার জন্য দিলাম এক টান। টান দিয়ে নিজেও বোকা বনে গেলাম। চুলে হঠাৎ টান পড়াতে ইলহাম সামলাতে না পেরে এরকম পড়ে গেলো আমার উপর। তারপর আর কি? মাথায় মাথায় সংঘর্ষন! আমি ভাবলাম ব্যা’থা পেলো বোধহয় খুব! কিন্তু না, সে উঠে দাঁড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলছে, এবার যদি আমার মাথায় শিং গজায়? এর দায় কে নিবে? আপনি!”
রাদের কথা শুনে শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করলো অনন্যা। তাল মেলালো রাদও। এদিকে ইলহাম রাদের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। এই তো সেদিনের ঘটনা। তার মাথার চুলগুলো আসল কিনা দেখতে ঠিক বাচ্চাদের মতো কান্ড করে বসলো রাদ। দিলো সজোরে এক টান। আর অমনি ইলহাম টাল সামলাতে না পেরে এসে পড়লো রাদের উপর। অতঃপর রাদের মাথায় বারি খেয়ে অবস্থা পুরোই খারাপ।
—-“রাদ?”
ভাইবোনের হাসাহাসির মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসে রাজিয়া বেগমের গলা। ডাক পেয়ে রাদ পেছন মুড়ে রাজিয়া বেগমকে দেখতেই তার মুখের হাসিটুকু উবে যায় যেন। পুরোনো কিছু স্মৃতি আর চাপা আর্তনাদগুলো মনে পড়ে যায় তৎক্ষনাৎ। তার মলিন মুখখানা দেখতে মলিন হয়ে ওঠে মান্নাত বেগমের মুখখানাও। একই সাথে ইলহামেরও। ইলহাম ভাবনায় নিমজ্জিত হয়,
—-“কি এমন অতীত আছে, যার জন্য মানুষটা এতো অপছন্দ করেন নিজের চাচা এবং চাচীকে?”
#চলবে_____