#কাঁটায়_লেখা_ভাগ্য
পর্ব—০৪
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
আম্মার এই কথা শুনে গ্রামের সবাই হতবাক।আমি শক্ত করে গাটছাকে আঁকড়ে ধরলাম।কারণ কেউ না জানলেও আমি জানি আম্মা যা বলতেছে সব মিথ্যা।মরা মানুষ কোনোদিন ফিরে আসতে পারে না।ত্যাগের নাম করে আম্মা আমায় জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলার পথ পরিষ্কার করে ফেলছে!
কিন্তু কেন?আমি কি এমন ক্ষতি করেছি তার,সে মা হয়ে একের পর এক জালিমের মতো কাজ করে যাচ্ছে আমার সাথে!
একটু পরে আম্মা এগিয়ে আসলো আমার দিকে।আমি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।জানিনা কি হতে চলছে আমার সাথে।আম্মা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলতে লাগলো।
—চল আমার লগে,কবরের কাছে চল।
—না আমিও কোথাও যামু না!
—যাবি না মানে,তোরে যাইতেই হইবো।
এই বলে আম্মা আমায় টানতে টানতে কবরের দিকে নিতে লাগলো।আমি সুযোগ বুঝে তাকে একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দেই।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রানপনে দৌড় লাগালাম।গ্রামের লোকজন আমায় ধাওয়া করতে থাকে।
—ঐ ধর,মান্নাত পালাইলো!ওরে না কবর দিতে পারলে আসিফ শেখ কেউ আমাগো শান্তিতে ঘুমাইতে দেবে না।যেমনে হোক ওরে ধরে আসিফ শেখের সাথে কবর দিতে হইবে।
সমস্ত কথা পেছন থেকে আমার কানে ভেসে আসছে,আমি শুধু একটা কথাই জানি যেরকরেই হোক আমায় এই গ্রাম থেকে বের হতে হবে।নয়তো নিজেকে বাঁচাতে পারবো না আমি!
আমাদের গ্রামের শেষপ্রান্তের বড়ো বাগানটার ভেতরে এসে ঢুকে পড়লাম।এরপর একটা ঝোপের ভেতরে এসে লুকিয়ে পরি।একটু পরে কিছু লোকজন এসে আমাকে পাগলের মতো হন্নে হয়ে খুঁজতে লাগলো।সবাই একে অপরের সাথে কথা বলছে আমি নিজের মুখটা নিজের হাতে চেপে ধরে সবটা শুনে চলেছি।
—কোথায় গেলো,এইটুক সময়ের মধ্যে কোথায় পালাইলো মাইয়াডা!
—আমার মনে হইতেছে এই বাগানের মধ্যেই আছে ও।চল সবাই মিলে ভালো করে খুঁজে দেহি।ঐদিকে লাশ কবর দেওয়ার সময় হয়ে যাইতেছে,কিছুক্ষণ পরে পঁচতে শুরু করবে।
—হ একদম ঠিক কইছো।মান্নাতরে খুঁইজা না বাইর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই আমাগো কাছে।
এরপর আবার সবাই আমায় খুঁজতে শুরু করে।আমি সুযোগ বুঝে ঝোপ থেকে বেরিয়ে পড়ি।তারপর জঙ্গলের পথ ধরে এগোতে থাকি।জঙ্গলের এতোটা গভীরে আগে কখোনো আসিনি আমি।জানিনা শেষ প্রান্তে কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।ছুটতে ছুটতে প্রায় সকাল হয়ে যায়,কিন্তু জঙ্গলের রাস্তা শেষ হলো না।
বেশ কিছুক্ষণ সময় পরে বুঝতে পারি আমি জঙ্গলের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছি।আশপাশ থেকে লোকালয়ের আলো আর শব্দ ভেসে আসছে।জঙ্গলের একেবারে শেষ প্রান্তে আসতেই একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করি আমি।
একটা মেয়ে সাদা শাড়ী পড়ে ঝোপের ভেতরে বসে আসে।আর সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
—বোন কি হইছে তোমার,এইভাবে কান্না করতেছো কেনো তুমি?
—আমার খুব বিপদ!কেউ বাঁচাও আমায়।
—কি হয়েছে তোমার সেইটা বলো বলো।আর তুমি ঝোপের ভেতরে বসে কী করতেছো,বাইরে বেরিয়ে আসো।
—ওরা সবাই কি চলে গেছে?
—কারা,তুমি কাদের কথা বলতেছো?
—ওরা যারা আসছিলো রাতে…
—বোন আমি তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারতেছি না।তুমি ঝোপ থেকে বের হও।আর এভাবে ঘোমটা দিয়ে আছো কেনো।ঘোমটাটা সরাও,একটু দেখি তোমায়।
–না,এই ঘোমটা সরানো যাবে না!ওরা চিনতে পারলে মাইরা ফেলবে আমারে।
—আচ্ছা এখানে কেউ নাই।তুমি বাইরে বেরিয়ে আসো আগে,দেখো আমি ছাড়া কেউ নাই এখানে।
—সত্যি কইতেছো তো তুমি,নাকি তুমিও ওদের লোক?
—আরে আমার অবস্থা তোমার থেকেও খারাপ।আমি আবার কাদের লোক হইতে যাবো।
মেয়েটা আমার কথায় ভরসা করে বেরিযে আসলো।এরপর আমি তাকে আবারও প্রশ্ন করি।
—তুমি না বলছিলে খুব বিপদ তোমার!কিসের বিপদ,আর তুমি কাদের কথা বলতেছিলে?
—জানতে চাও আমার কিসের বিপদ?
—হ জানতে চাই!
—আচ্ছা আসো আমার লগে।তার আগে তুমিও ঘোমটাটা টাইনা লও।নয়তো তোমারও বিপদ হইতে পারে।
—হ,ঠিক কইছো।
আমি ঘোমটাটা টেনে মেয়েটার সাথে হাঁটতে শুরু করলাম।ঘোমটার কারণে সামনের রাস্তা ছাড়া কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।মেয়েটাকে অনুসরণ করে এগোতে থাকলাম আমি,কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না।মেয়েটা একটু পরে আমায় প্রশ্ন করে।
—আচ্ছা তুমি এই জঙ্গলে কি করতেছো?আর কোথা থেকে আসছো তুমি,নাম কি তোমার!
—আমিও একটা বিপদে পড়ে এখানে আসছি।সেই গল্প বলতে গেলে সারাদিন পার হইয়া যাইবে।আর আমার নাম হলো মান্নাত!
—কি বললে তোমার নাম মান্নাত…?
—হ,কেনো?তুমি চমকে উঠলে কেনো আমার নাম শুনে!
—চমকাবো না!আমার নামও তো মান্নাত!
—কি বলতেছো!আমাগো দুইজনেরই এক নাম।আবার আজ এক সাথে এইভাবে দেখা হইলো।
মেয়েটা একটু পরে আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো।
—এই বটগাছের আড়ালে তাকিয়ে দেখো।আমার বাড়িতে ওরা কি করতেছে!
ঘোমটাটা খুলে যেনো আকাশ থেকে পড়লাম আমি।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
এতো আমাদের বাড়ির সামনের সেই বটগাছটা।মেয়েটা আমায় আমার বাড়িতেই নিয়ে আসলো।বাড়ির ভেতরে তাকিয়ে দেখছি সবাই আমাকে খোঁজাখুজি করছে,আসিফ শেখের লাশ কবরের পাশেই পড়ে আছে।আমি মেয়েটাকে কিছু বলতে যাবো ঠিক তখন সে বলতে শুরু করে।
—ঐ যে দেখেছো আমার মৃত স্বামী আসিফ শেখ।গ্রামের লোকজন আর আমার আম্মা আমারে জ্যান্ত কবর দেওয়ার চেষ্টা করতেছে।তাই আমি কোনোমতে পালিয়ে বাঁচতেছি!
মেয়েটার কথা আমাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিলো।এতো সে আমার কাহিনীই আমাকে শোনাচ্ছে।মেয়েটা এরপর মাথার ওপর থেকে ঘোমটাটা সরিয়ে ফেললো।এরপর যে দৃশ্য দেখতে পাই নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না আমি।
আমি আমার সামনে আমাকেই দেখতে পাচ্ছি!মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আমায় বলতে লাগলো।
—ওরা নিশ্চিত আমায় আমার স্বামীর সাথে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে,জানিনা কেমনে বাঁচবো আমি এদের হাত থেকে!
আর জানো তুমি এই সবকিছুর পেছনে আমার আম্মা।ও আমার ভালো চায়না!
মেয়েটার দিকে হতবাক হয়ে আমি তাকিয়ে আছি।আমার মুখ বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না!
চলবে….