কাঁটায় লেখা ভাগ্য পর্ব ৩

0
513

#কাটায়_লেখা_ভাগ্য
পর্ব—০৩
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

—শুনে রাখ আজকের এই দিনটা দেখার জন্য শুধু আমি মিথ্যা বিয়া করছিলাম তোরে,তোর সাথে আমার বিয়ে হইছিলো ঠিকই কিন্তু এই দশটা বছর তোরে নিজের কাছে আসতে দেই নি।কেনো দেইনি,শুধুমাত্র আজকের এই দিনটার জন্যে…
মান্নাতের বাপরে যেভাবে নিজের হাতে শেষ করছি,মনে রাখিস আমার কথা না শুনলে তোর সাথেও একই ঘটনা ঘটবে….

নিজের মায়ের এহেন রুপ দেখে যেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আমার।এটা কি শুনছি আমি নিজের কানে আর কি দেখছি নিজের চোখে!আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি আম্মা আর আসিফ শেখের কথা শুনতে লাগলাম।

—দেখো আমি তোমার কথামতো ঐ বাচ্চা মেয়েটারে বিয়ে করছি,তোমার পায়ে পড়ি আর কোনো কাজে জোর কইরো না আমায়।

—এতো সহজে তো তোকে ছাড়বো না আমি…তোকে মান্নাতের সাথে বাসর ঘর করতে হইবে,ওর বাচ্চার বাপ হইতে হবে তোর।চিন্তা করিস না এরপর তোকে আমি চিরতরে মুক্তি দিয়ে দেবো।

—না এতোটা কঠোর হতে পারবো না আমি ঐ মেয়েটার ওপর।এতো বড়ো গুনাহের কাজ করিয়ো না আমায় দিয়ে তুমি…

—এখন আমি যা বলবো তোকে তাই করতে হবে তোকে,এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই তোর কাছে।

এই বলে আম্মা আসিফ শেখের গলাটা আবারও শক্ত করে চেপে ধরে।এই দৃশ্য দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়,আমি দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেলাম।তারপর দরজাটা বন্ধ করে দেই।

কিছুক্ষণ পরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে আসে।আমি ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।দরজা খুলতেই দেখতে পাই আসিফ শেখ অর্থাৎ আমার বর দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।সে দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো।

আমি দরজাটা বন্ধ করে খাটের ওপর গিয়ে বসলাম।আসিফ শেখ আমার মাথার ওপর থেকে ঘোমটাটা সরিযে ফেললো,তারপর ধীরে ধীরে আমার কাছে এগিয়ে আসে।আমার নিঃশ্বাস ক্রমশ দ্রুততর হতে থাকে।আমাকে জড়িয়ে ধরে খাটের ওপরে শুইয়ে দিলো সে,চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি আসিফ শেখ আমার আরোও কাছাকাছি চলে এসেছে।তার সাথে আমার দূরত্বের ব্যবধান মাত্র কয়েক ইঞ্চি।

কিছু বোঝার আগেই আসিফ শেখ আমার ওপর থেকে উঠে গেলো!আমিও উঠে তারপাশে বসলাম।

—না,এইটা সম্ভব না।আমার পক্ষে সম্ভব না,আমি পারবো না কিছুতেই করতে।

এরপর আসিফ শেখ একটা ছুরি বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো,আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিছুই।

—ছুরি কেনো আনছেন,ছুরি দিয়ে কি হবে?

—তোমায় একটা কাজ করতে হবে,খুব ছোটো কাজ।এই ছুরিটা আমার বুকে চালিয়ে দাও…আমি বাঁচতে চাই না,মরে যেতে চাই আমি!

আসিফ শেখের কথা শুনে আমার হাত কাঁপতে লাগলো।

—কি বলতেছেন আপনি এগুলো…না আমি এই কাজ করতে পারবো না।

—কেনো পারবে না,তুমি কি এই বিয়ের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাও না,তাহলে এতো এতো দ্বিধাদ্বন্দ তোমার মনে।ছুরিটা আমার বুকে চালিয়ে দাও,শেষ করে দাও আমায়।

—ক্ষমা করবেন।কারোর জীবন নেওয়া তো গুনাহ!আমি এই গুনাহর কাজ করতে পারবো না,তার ওপর আপনি আমার স্বামী!

—বুঝতে পারছি,তুমি আমার কোনো কথাই শুনবে না।যা করার এইবার আমারই করতে হবে।

আমি তাকে বাঁধা দিয়ে বললাম।

—কি করতে চাইতেছেন আপনি?না আমি আপনারে এই কাজ করতে দিবার পারি না।দরকার হলে আমি আপনার সাথে সংসার করতে রাজি আছি,তারপরেও এই কাজ করতে দেবো না!

আফিস শেখ আমাকে অবাক করে দিয়ে ছুরিটা নিজের দিকে তাক করলো,আমি তার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করি।একপর্যায়ে সে আমাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়।

—আমায় ক্ষমা করে দিও!বিয়ের দিনই তোমায় বিধবা বানিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি…না আমার পক্ষে এইভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব না।

এই বলে আসিফ শেখ ছুরিটা নিজের বুকে চালিয়ে দিলো।আমি প্রকান্ড এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম।আমার চিৎকারের শব্দে চারদিক আন্দোলিত হয়ে উঠলো।

—আল্লাহ গো,ও আল্লাহ!
এইডা কি হইলো।তোমরা কে কোথায় আসো, তাড়াতাড়ি এদিকে আসো…

আমার চিৎকারের শব্দ শুনে সবাই ঘরে ছুটে আসলো।আসিফ শেখ ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় বিছানার ওপরে ছটফট করছে।আমার চোখের সামনে এভাবে আমার স্বামী তরপাতে তরপাতে মারা গেলো,কিছুই করতে পারলাম না আমি।একটু পরে আমার আম্মা ছুটে আসলো কোথা থেকে!এসেই মরাকান্না জুড়ে দিলো সে।

—আল্লাগো,এইডা লেখা ছিলো আমার মাইয়ার কপালে।তুমি বিয়ের দিনই বিধবা বানাইয়া দিলা ওরে…কি এমন পাপ করছিলাম আমি,কি পাপ করছিলো আমার মাইয়া।

কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি সবটা আম্মার নাটক।কিন্তু তার দুঃখটা সত্যি।তবে এই দুঃখ আমার বিধবা হওয়ার কারনে নয়,তার এতোদিনের তৈরী করা নোংরা পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার জন্য।

আমার শরীর থেকে সকল গহনা সরিয়ে নেওয়া হলো।লাল শাড়ি খুলে একটা সাদা থান পরিয়ে দেওয়া হলো আমায়।আমাদের বাড়ির সামনেই আসিফ শেখ অর্থাৎ আমার মৃত স্বামীর কবর খোঁড়া হচ্ছে।আমি একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে চলছি।আমার খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়তে লাগলো।ছোটোবেলা থেকে চুল বেণী করে রাখার ভীষণ শখ ছিলো আমার,স্বামী মারা যাওয়াতে আজ সেই শখকে তার লাশের সাথে সাথে কবর চাপা দিতে হচ্ছে।বিধবাদের নাকি বেণী করতে নেই,আজ থেকে সারাজীবনের জন্য আমার চুল খোলাই থাকবে।

একদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কবর খোড়া দেখে চলছি আমি,অতঃপর আসিফ শেখের লাশ কবরে নামানোর সময় এলো।সবাই ধরাধরি করে তার খাটিয়াটা কবরের কাছে নিয়ে যায়।

ঠিক তখন সবাইকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমার আম্মা কোথা থেকে ছুটে আসলো।হাঁফাতে হাঁফাতে সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

—তোমরা কেউ এই লাশ দাফন কইরো না।সর্বনাশ হইবো,ঘোর সর্বনাশ হইবো।

—সর্বনাশ হইবো মানে,কি হইছে আমাগো খুইল্লা কও মান্নাতের মা।
(গ্রামবাসীরা আম্মাকে জিজ্ঞেস করে)

—একটু আগে আমি স্বপ্নে পাইছি,আসিফ শেখ আমায় কইতেছে তার লাশরে একা দাফন করা যাইবো না!সে একা কবরে যাইতে চায় না,

—এই কথার অর্থ কি,সে একা কবরে যাইতে চায় না মানে?তোমারে কে কইলো এটা…

—আমারে আসিফ শেখ স্বপ্নে আইসা সব কইছে।যদি সবাই বাঁচতে চাও আমার কথা শুনতেই হইবো।নয়তো এই গ্রাম ধ্বংস করে দেবে সে!

—আসিফ শেখ কি কইছে তোমারে,সেইডা তো বলো আগে।

—আমি জানি তোমরা সবাই আমার কথা শুইনা চমকাবা,কিন্তু আইজ এইডা করা ছাড়া কোনো উপায় নাই।আমার কাছে আমার মাইয়ার জীবনের থেকে তোমাদের সবার জীবন অনেক বেশী মূল্যবান।আমি তোমাদের ভালোর জন্য নিজের মেয়ের কোরবানি দিতে প্রস্তুত!

—এর ভেতর আবার মান্নাত আসলো কই থেকে?আসিফ শেখ স্বপ্নে আইসা কি কইছে তোমারে।

—সে কইছে,সে একা কবরে যাইবার চায় না।সে তার বৌ মানে আমার মাইয়া মান্নাতরে সাথে নিয়া যাইতে চায়।তাই আমি ঠিক করছি মান্নাতরে ওর লাশের সাথে কবর দিয়া দিমু…!
তোমাদের সবাইরে আর এই গ্রাম বাঁচাইতে হইলে এইডা করতেই হইবো আমারে।আমি আর অন্য কোনো রাস্তা খোলা দেখতেছি না।

আম্মার এই কথা শুনে গ্রামের সবাই হতবাক।আমি শক্ত করে গাটছাকে আঁকড়ে ধরলাম।কারণ কেউ না জানলেও আমি জানি আম্মা যা বলতেছে সব মিথ্যা।মরা মানুষ কোনোদিন ফিরে আসতে পারে না।ত্যাগের নাম করে আম্মা আমায় জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলার পথ পরিষ্কার করে ফেলছে!

কিন্তু কেন?আমি কি এমন ক্ষতি করেছি তার,সে মা হয়ে একের পর এক জালিমের মতো কাজ করে যাচ্ছে আমার সাথে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here