My First Crush পর্ব ৫

0
409

#My_First_Crush
#পর্ব-০৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

মিঁয়োটা আজাকল খুব দুষ্ট হয়েছে। খেতেই চায় না। তাকে পেটে হাত বুলিয়ে আদর করে তারপর খাওয়াতে হয়। এদিকে আমার এতো সময় কই? সকালের নাস্তা বানিয়ে, বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তারপর আবার কফিশপে গিয়ে সব সামলাতে হয়। মিঁয়োকে আদরের মাঝেই খানিকটা শাসিয়ে আমি সেটাই বোঝাতে লাগলাম তাকে। মাঝে আমার ফোনে একটা নোটিফিকেশন এলো। সেটা চেক করতে নজরটা একটু ফোনের দিকে যেতেই এক ছুটে আমার হাত থেকে বেড়িয়ে গেলো মিঁয়ো। ধরতে গিয়েও আবার ধরতে পারলাম না৷ আমি বলে উঠলাম,
‘মিঁয়ো, তুমি কিছুই খাওনি। এখানে আসো। তোমার খাবার শেষ করো।’
মিঁয়ো আমার কথা শুনলো না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেইন দরজাটা অল্প খোলা ছিল। মিঁয়ো তার সাদা লোমশ পা গুলো ফেলে দরজার দিকে আগাতে লাগলো। আমি ব্যগ্র হয়ে ডাকতে লাগলাম,
‘মিঁয়ো, মিঁয়ো, যাবে না বলছি। মিঁয়ো!’
আমি মিঁয়োর পেছন পেছন পা বাড়ালাম। কিন্তু ততক্ষণে মিঁয়ো দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেলো। ধৈর্যচ্যুত হয়ে আমি দু হাত ঝাঁকিয়ে অতিষ্ঠ গলায় বললাম, ‘মিঁয়ো! উফ! আমি পাগল হয়ে যাবো!’

দরজা খুলে দ্রুত মিঁয়োর পেছনে বাইরে এসেই দেখলাম মিঁয়ো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্টে আসার পর এই একটা সমস্যা আমার হয়েছে। পূর্বে আমার একতলা বিশিষ্ট কাঠের বাড়িটা আর তার সামনেই ছোট্ট একটা বাগান জুড়ে অনেকটা খোলামেলা পরিবেশ ছিল। মিঁয়ো যখন তখন বাইরে যেয়ে ইচ্ছেমতো বাগানে ঘোরাঘুরি করতো। যেই সুবিধাটা চার তলার উপর অ্যাপার্টমেন্টে মিঁয়ো একদমই পায় না। তাই তো যখনই একটু দরজা খোলা পায় সে এক ছুটে চলে যায় বাইরে। তারপর কিছুক্ষণ অ্যাপার্টমেন্টের সামনের বাগানটায় ঘোরাঘুরি করে নিজে থেকেই চলে আসে। সেখানটা সেফ জোন বলেই মিঁয়োর যাওয়া দেখে ততটা চিন্তিত হলাম না। সিঁড়িপথে মিঁয়ো পুরোপুরি চোখের আড়াল হলে একটা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। পুনরায় পেছনে ঘুরতেই একজন মধ্যবয়স্ক লোককে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিক চমকে উঠলাম আমি। নিজেকে ধাতস্থ করে জোর করে একটা সৌজন্যতামূলক হাসি দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে চাইলাম। লোকটি গুরুগম্ভীর জ্ঞানী ভাব নিয়ে নিজ ভাষায় বলতে লাগলো,
‘সবকিছু কিন্তু একটা স্থির বিন্দু থেকেই শুরু হয়। স্থির থেকেই আমরা চলমান হই। তাই চলতে গেলে অবশ্যই আমাদের আগে স্থির হওয়া দরকার। তাই তাড়াহুড়ো না করে আমরা যদি মানে কিছুক্ষণের জন্য একটু স্থির থাকি তাহলে ক্ষতি কি? এই যেমন লিফট থেকে বের হয়েই বাসার মধ্যে না গিয়ে একটু দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম, চারপাশটা দেখলাম। উপভোগ করলাম। আমরা কি তা করি? ইয়াং গার্ল, বুঝেছো আমাদের শুধু তাড়াহুড়ো, সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো। বুঝেছো এই অভ্যেসটা আমাদের সবার করা উচিত। তোমাদের বাসার সবাইও কিন্তু এই অভ্যেসটা বানাতে পারে।’
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, ‘আমাদের বাসায়ও একজনের এই অভ্যেস আছে। মিঁয়োও ঠিক এরকম করে।’
লোকটি পুলকিত হয়ে বলল, ‘বাহ! নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। অবশ্যই তার সাথে একদিন কথা বলা উচিত।’
‘কিন্তু মিঁয়ো কথা বলবে কিভাবে?’
‘আহারে! বোবা বুঝি? চিন্তা করো না। এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তি বের হয়েছে। চিকিৎসা করালেই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু এমন প্রযুক্তিও কি বের হয়েছে বিড়ালকে দিয়ে কথা বলাতে পারবে!’
লোকটি অবাক হয়ে বলল,
‘মিঁয়ো কি?’
‘বিড়াল। ওর কথাই তো বলছিলাম৷ এতো পাঁজি! সিঁড়ি দিয়ে উঠে সরাসরি বাসায় ঢুকবে না। চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। এরকম বদমায়েশি করলে কিরকম লাগে বলেন?’
ভদ্রলোকটি খুকখুক করে কেশে উঠলো। আমারও হুঁশ হলো যে, আমার কথা আসলে আলাপের বিপরীতে যাচ্ছে। এবার দুজনেই অস্বস্তি ঢাকতে আবারও সৌজন্যতামূলক হাসি দিলাম। ভদ্রলোক বললেন,
‘তোমাদের এই বাসাই বুঝি। নেইবার দেখছি আমরা।’
‘হুম, আমি আর আমার হাজবেন্ড থাকি। আমি হৃদি।’
‘আমি মি. ডেভিড….’ ভদ্রলোক এতটুকু বলতেই তার বাসার ভেতর থেকে একটি মেয়েলি কর্কশ গলা ভেসে এলো, ‘অপদার্থ, অপদার্থ! একেবারেই অপদার্থ। অপদার্থটা আজকে আসুক। আজ তার একদিন কি আমার একদিন।’
আমি চমকে উঠে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে পুনরায় মি. ডেভিডের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে মিনমিনিয়ে হাসতে লাগলেন।
কখন যেন রাইয়ানও বাইরে এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এতক্ষণে আমিও অনুধাবন করতে পারলাম তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার স্থির যুক্তির আসল কারণটি। ভেতর থেকে একনাগাড়ে ইংরেজি গালাগালি ভেসে আসছে। মি. ডেভিড দরজা আলতো করে খুলতেই একটা বাসন ঝনঝন শব্দ তুলে গড়িয়ে গড়িয়ে বাইরে চলে এলো। মি. ডেভিড একটা সৌজন্যতামূলক হাসি দিয়ে বললেন, ‘আজকের মতো স্থির থাকা সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমি তাহলে ভেতরে যাই।’
আমিও জোর করে সৌজন্যতামূলক হাসি দিলাম। মি. ডেভিড ভেতরে ঢুকতেই থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ আরও বেড়ে গেলো। কৌতূহল হয়ে আমি সামনে এক পা বাড়াতেই রাইয়ান আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো আমাকে। দরজা ভিজিয়ে বলল, ‘হেই, তাদের ম্যাটার তাদের সলভ করতে দাও।’
কিন্তু সেসব কথা আর আমার কানে ঢুকলো না। আমার তখন মুখ হা আর চোখ বড় বড় অবস্থায় পুলকিত হয়ে আছে। রাইয়ান আমার হাত ধরেছে! ইনফ্যাক্ট এখনও ধরে আছে! আমি আর আমার মধ্যে তখন কই! রাইয়ান চলে যাবার পরও আমি কিছুক্ষণ সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর নিজে নিজের হাত ধরেই লাজুকতায় উৎফুল্ল হয়ে মুখ লুকালাম।

কফিশপে গিয়েও আমার হাত ধরে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলাম আমি। জেরিন কাউন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বলল, ‘কিরে কিছু হলো?’
আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে লাজুক ভাব নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘হুম।’
জেরিন পুলকিত হয়ে শব্দের সাথে মুখ হা করতেই আমি বললাম, ‘রাইয়ান আজকে আমার হাত ধরেছে।’
জেরিনের মুখের হাসি ভাব গায়েব হয়ে গেলো। আস্তের উপর হা হয়ে থাকা মুখটা বন্ধ করে জেরিন নিরস গলায় বলল, ‘শুধু হাত ধরেছে?’
আমি লজ্জার সাথে মাথা নাড়ালাম। জেরিন বলল,
‘তো? প্রথমবার তো আর না৷ তুই না বলেছিলি তোদের প্রথম দেখাতেও রাইয়ান তোর হাত ধরেছিল!’
‘ওহ হো! এখন হাত ধরা আর তখন হাত ধরাটা আলাদা। তখন রাইয়ান আমাকে চিনতো না। আমি তার কাছে একটা অপরিচিত মেয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন আমি তার স্ত্রী। সে আমাকে এখন চিনে ও খুব ভালো মতো জানেও। বিয়ের পর এটা আমাদের প্রথম হাত ধরা। অবশ্যই এটা স্পেশাল। উফ! আমার তো ইচ্ছে করছে আমার হাতটাকে কেটে একটা কাঁচের বাক্সে সাজিয়ে রাখি। আর অন্য কোন কিছুর স্পর্শ না লাগতে দেই।’
জেরিন ঠোঁট চেপে হেসে বিড়বিড় করে বলল, ‘বিয়ের এতদিনে মাত্র হাত ধরেছে তাতেই এই অবস্থা, না জানি সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে এই মেয়ে কি করতো!’

ঠিক তখনই কাউন্টারের ডেস্কের উপরে থাকা আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে রাইয়ানের নাম দেখেই আমি খুশি হয়ে দ্রুত রিসিভ করলাম। রাইয়ান ওপাশ থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি অ্যাপার্টমেন্টের বাড়তি চাবি নিয়ে এসেছি কিনা। লক পাসওয়ার্ড কাজ করছে না। রাইয়ানের একটা আর্জেন্ট ফাইল নেওয়া প্রয়োজন। আমি ফোনেই ‘ওকে’ বলে ব্যাগ নিয়ে এক ছুটে কফিশপ থেকে বেড়িয়ে এলাম। জেরিন আমাকে পেছন থেকে ডেকে বলল,
‘এমনিতেও দেরি করে আসলি, আর এখনই আবার চলে যাচ্ছিস! কফিশপের কি হবে?’
আমি হেসে বললাম, ‘একটু ম্যানেজ করে নে প্লিজ! সমস্যা নেই, তোর যখন নতুন নতুন বিয়ে হবে তখন আমিও পুষিয়ে দেবো।’
এই বলে আমি সেখান থেকে চলে আসতে লাগলাম। জেরিন হেসে বলল, ‘পাগল একটা!’

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যেতেই রাইয়ান আমার থেকে চাবি নিয়ে লক খুলে ভেতরে ঢুকলো। আমিও গেলাম তার সাথে। সময় মতো চাবি নিয়ে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তিই পেলো রাইয়ান। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধলো একটু পর। কবাটের দরজা লাগাতে গিয়ে দূর্ঘটনাটাবশত রাইয়ানের হাতের সাথে ধাক্কা লেগে পাশে কেবিনেটের উপর থাকা ফুলদানিটা বিন ব্যাগের উপর পড়ে গেলো। বিন ব্যাগের উপর আগে থেকেই ভাঁজ করা একটা সাদা শার্ট রাখা ছিল। যার উপর ফুলদানিতে থাকা নীল পানি পড়ে গিয়ে শার্টে দাগ লেগে গেলো। রাইয়ান ফাইল রেখে হম্বিতম্বি করে শার্টটি হাতে নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমি বললাম,
‘কি হয়েছে রাইয়ান?’
রাইয়ান বলল, ‘বিকেলে রয়েল প্যালেস হোটেলে আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। ফরেইন ক্লায়েন্ট আসার কথা। ভেবেছিলাম এই শার্টটা পরে যাবো। আগে থেকে রেডি করেও রেখেছিলাম। কিন্তু এখন তো দাগ লেগে গেছে। এদিকে আমার সব ভালো ভালো শার্টও আজ সকালেই লন্ড্রিতে দিয়ে দিয়েছি। আমার হাতেও একদম সময় নেই। এখনই অফিসে যেতে হবে।’
‘যে শার্টগুলো আছে সেগুলো দিয়ে কি ম্যানেজ করা যায় না?’
‘আসলে, এই শার্টটা আমার বস আমাকে গিফট করেছিলো। আমি সবার সামনে বলেছি আজ মিটিংয়ে আমি এটা পরেই যাবো। এখন যদি না যাই ব্যাপারটা অন্য রকম দেখাবে।’
রাইয়ানকে খানিক চিন্তিত দেখালো। আমি এগিয়ে গিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললাম,
‘একটা কাজ করা যায়, আমি এখন শার্ট টা ধুয়ে দেই। আজ অনেক ভালো রোদ উঠেছে। বিকেল পর্যন্ত শুকিয়ে যাবে।’
‘না থাক, এতো ঝামেলার প্রয়োজন নেই। তোমারও তো কাজ আছে।’
‘ঝামেলার কি আছে! আমার কোন সমস্যা হবে না। তুমি চিন্তা করো না। অফিসে যাও। আমি সামলাতে পারবো।’
রাইয়ান কাঁচুমাচু করতে লাগলো। আমি তাকে আশ্বস্ত করে অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর আমি বাথরুমে গিয়ে বসলাম শার্টটি নিয়ে। মিউজিক প্লেয়ারে আমার প্লে লিস্ট দিয়ে এসেছি। যেখানে একটার পর একটা রোমান্টিক গান বেজে চলেছে। একা বাসায় কাজের একঘেয়েমি দূর করার এটা আমার একটা পদ্ধতি। শার্টের কলার দু হাত দিয়ে ডলতে গিয়ে আমি হঠাৎ থেমে গেলাম। কলার খুলে ধরতেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতে গিয়েই কড়া ডিটারজেন্টের গন্ধে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। আমি হেসে ফেললাম। হাতে জমে থাকা ফেনাগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। সাদা শার্ট ধোয়া শেষে বারান্দার রোদে শুকাতে দিয়ে দিলাম। ওয়াশরুমের মধ্যে কাপড়ের বাকেটের মধ্যে রাইয়ানের আরো কয়েকটি ক্যাসুয়াল শার্ট পরে ছিল। সেগুলোও ধুয়ে দিলাম আমি। বাসায় আমি সম্পূর্ণ একা। এখনতো সময় নিজের মধ্যকার লুকায়িত জগৎটাকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করার। গানের ভলিউম আরো বাড়িয়ে দিয়ে নাচের ভঙ্গিমা করে রুমের অগোছালো জিনিসপত্র গোছাতে লাগলাম আমি। সব শেষ হতে হতে অনেকটাই বেলা হয়ে গেলো। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম সাদা শার্টটি শুকিয়ে গেছে। হ্যাংকার থেকে নামিয়ে আমি শার্টটি নিজের দু হাত দিয়ে মেলে ধরলাম। দাগগুলো সব পরিষ্কার। আমার হাতে রাইয়ানের শার্ট। আর আমার মনে তার তৈরিকৃত সুরেলা আভাস। তখনই মিউজিক প্লেয়ারে যেই গানটি শুরু হলো তার প্রথম সুর শুনেই আমি চমকে উঠলাম। এটা তো সেই রেকর্ড করা গানটাই যেটা আমি আমার ইউনিভার্সিটির ফ্রেশার্স ডে তে গেয়েছিলাম। নিশ্চয়ই বলতে হবে না কাকে মনে করে গেয়েছিলাম! আমি লাজুক হেসে শার্টটি দু হাত দিয়ে গালের সাথে চেপে ধরলাম।

Why is it you? Always you?
Even though I close my eyes,
I’m still thinking about you
Just like a bird being enchanted by the sky.
Why is it you? Why is it still all about you?
We haven’t even started
But I already feel lost.
I can’t help myself falling in love with you.
You’re in every second of my life story.
It’s suddenly raining in my world
That’s because you became the wind
And gently touch my heart.
I will always be there for you
No matter how hard I feel
I’m willing to do everything for you.

শার্টের এক হাতা আমার কাঁধে তুলে দিয়ে আরেক হাতা হাতে রেখে গানের সাথে সাথে নাচতে লাগলাম আমি। একসময় শার্ট নিজের গায়ে পরে নিয়ে লাফাতে লাগলাম৷ এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আয়রন করার জন্য নিয়ে গেলাম৷ আমার এই কান্ডগুলো জেরিন অথবা যে কেউই শুনে বলবে আমি কতো বোকা! সেধে সেধে নিজের মাথায় কষ্ট নেই। কিন্তু তারা এটা কখনোই বুঝবে না, রাইয়ানের জন্য কিছু করতে পারলে আমার ঠিক কতোটা ভালো লাগে। আমার মন কতটা শান্তি পায়! আমি যতোই ক্লান্ত থাকি, তার জন্য কিছু করতে আমার মন কখনো ক্লান্ত হয় না। ক্লান্ত…..হতেই পারে না।

কলিংবেল বেজে উঠলে সেই শব্দে ডিস্ট্রাক্ট হতেই আয়রন মেশিনের সাথে হাত লেগে আমার আঙ্গুল জ্বলে উঠলো। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমি আঙ্গুল চেপে ধরে হাসি মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ওয়েল… আমি জানি না, আমি তাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি এবং ঠিক কেন আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। শুধু জানি, আমার শত কষ্ট হোক বিনিময়ে তার মুখে একটু হাসি দেখতে পাওয়া, আমার জন্য……..এতটুকুই যথেষ্ট।
___________________________________________________

ঘড়ির কাটায় সবে মাত্র নয়টা। ফ্লোরিডার হিসেবে খুব বেশি গভীর রাত নয়। উজ্জ্বল কৃত্রিম লাইটের আলোয় ফ্লোরিডার রাস্তাঘাট একদম ঝকঝকে পরিষ্কার। বড় বড় দালানগুলো থেকে ঠিকরে আসছে রং বেরঙের আলো। ফ্লোরিডার মধ্যে এরকম সুউচ্চ বিল্ডিং মায়ামি শহরেই সর্বাধিক। বারান্দা থেকে রাতের শহর তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য। হৃদি বসে আছে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং এরিয়ায়। কাঁচের সেন্টার টেবিলটায় ল্যাপটপ রেখে ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে পরেই গভীর মনোযোগের সাথে লেখালেখিতে ব্যস্ত আছে সে। ফেসবুকে তার একটা বাংলায় গল্প লেখার পেজ আছে। মাত্র দেঢ় বছরেই সেখানে যুক্ত হয়েছে ফিফটি কে ফলোয়ার। বেশিরভাগই বাংলাদেশি। তার এই অনলাইনে গল্প লেখার বিষয়টি সে ব্যতিত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি জানে না। এমনকি জেরিনও না। কেন সে জানায় নি সেটা একটা রহস্যের বিষয়। হৃদি যখন ল্যপটপের কি বোর্ডে অনবরত আঙ্গুলগুলো চালিয়ে তার মনরাজ্যের গল্পকথা ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত ঠিক সে সময় দরজা ঠেলে রাইয়ান এলো ভেতরে। রাইয়ানকে দেখেই হৃদি ঝটপট ল্যাপটপের স্ক্রিন নামিয়ে ফেললো। স্মিত হাসলোও তার দিকে তাকিয়ে। রাইয়ান পা থেকে জুতা মোজা খুলে হৃদির সামনে একটা পেস্ট্রি বক্স রেখে বলল,
‘থ্যাংক ইউ হৃদি। তুমি আজকে আমার অনেক হেল্প করেছো। এটা তোমার জন্য।’
হৃদি হাসিমুখে পেস্ট্রি বক্স খুলতে খুলতে বলল,
‘এতটুকুর জন্য থ্যাংক ইউ বলার কি আছে!’
এরপর চামচ দিয়ে একটু পেস্ট্রি মুখে দিয়ে হৃদি বলল,
‘উমম! পেস্ট্রিটা তো অনেক মজা। থ্যাংক ইউ রাইয়ান।’
রাইয়ান গলার টাই আলগা করতে করতে বলল,
‘আমি তোমাকে থ্যাংক ইউ বলার জন্য পেস্ট্রি নিয়ে আসলাম আর তুমিই আমাকে উল্টো থ্যাংক ইউ বলছো!’
হৃদি আর রাইয়ান দুজনেই হেসে ফেললো। খানিক বাদেই হৃদি ডেকে উঠলো,
‘রাইয়ান!’
হৃদির দিকে দৃষ্টি নিয়ে রাইয়ান বলল,
‘হুম?’
‘আজকে সকালে যে আমাদের নেইবার মি. অ্যান্ড মিসেস ডেভিডের ঝগড়া দেখলাম মিসেস ডেভিড আসলে কি নিয়ে এতো ক্ষেপেছিল জানো?’
‘কেন?’
‘মি. ডেভিড মিসেস ডেভিডকে না জানিয়ে নতুন ইন্সট্রাগ্রাম একাউন্ট খুলেছে। তারপর আবার এই অ্যাপার্টমেন্টের নিচ তলার লেডি মিস গোমজ এর ছবিতে লাভ রিয়্যাক্ট দিয়েছে তাই।’
বলতে বলতে হৃদি হেসে ফেললো। রাইয়ানও মৃদু হাসলো তার সাথে। তারপর হৃদির সামনে সোফায় বসে বলল, ‘কিন্তু এই, তুমি আবার কারো ঝগড়া লাগলে এভাবে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। যদি একটা বাসন তোমার গায়ে এসেও লাগতো তখন কি করতে?’
হৃদি মাথা নেড়ে সায় দিল রাইয়ানের কথায়। তারপর বলল, ‘কিন্তু এই জিনিসটা যদি আমাদের বাংলাদেশে হতো তাহলে কিন্তু তুমি কাউকে বোঝাতে পারতে না। সেখানে সবাই বিশ্বকাপ ম্যাচের মতো কৌতূহল হয়ে ঝগড়া দেখে।’
‘তোমার বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে?’
‘অবশ্যই। আমার পুরো শৈশবটাই তো কেটেছে সেখানে আমি খুব মিস করি বাংলাদেশকে। তুমি কখনো বাংলাদেশে যাওনি?’
‘গিয়েছিলাম একবার। আমার যখন তিন বছর বয়স দাদীমা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার কিছু মনে নেই। বাংলাদেশে তোমার কোন আত্মীয় আছে?’
‘তেমন কেউ নেই। আমার মা আর বাবা দুজনেই এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। দাদা, দাদু, নানা, নানুর মৃত্যুর পর এখন আর কেউই নেই। তবে শুনেছি আমার একটা ফুফু ছিল। কলেজে পড়াকালীন সে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করায় আমার দাদা তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন। তখন থেকেই তার সাথে আর কারো যোগাযোগ নেই।’
কিছুক্ষণ পর রাইয়ান বলল, ‘আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
রাইয়ান সোফা ছেড়ে উঠতেই যাবে হৃদি বাঁধা দিয়ে বলল, ‘তুমি এখন ওয়াশরুমে যাবে?’
‘হুম।’
‘কিন্তু ওয়াশরুমে তো লাইট নষ্ট হয়ে গেছে।’
আজ দুপুরে ওয়াশরুমের মধ্যে মপেট স্টিকটাকে গিটার বানিয়ে নাচতে গিয়েই যে বারি লেগে লাইটটা ভেঙে গেছে সেই কথাটা আস্তের উপর চেপে গেল হৃদি। রাইয়ান বলল, ‘সমস্যা নেই কিছু নিয়ে যাবো সাথে।’
‘নিলে ফোন নিয়ে যেয়ো। অন্ধকারে মোমবাতি নিয়ে যেও না আবার।’
‘কেন মোমবাতি নিলে কি হবে?’
হৃদি সপ্তাশ্চর্যের মতো অবাক হয়ে বলল,
‘কেন তুমি জানো না? অন্ধকারে বাথরুমে মোমবাতি নিয়ে গেলে সেই জায়গাটা হন্টেড হয়ে যায়। ‘রিয়েল হরর এক্সপেরিয়েন্স’ শো’য়ের একটা এপিসোডই তে এটা দেখালো!’
রাইয়ান ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘তুমি এগুলো বিশ্বাস করো?’
‘করবো না কেন? এটাতে তো সব সত্যি কাহিনীগুলোই দেখায়।’
‘উহুম! এগুলো স্ক্রিপটেড।’
হৃদি জোরগলায় বলল,
‘না। এগুলো সত্যি।’
রাইয়ান মানলো না। হৃদি আরো জোর দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা আমি তোমাকে গুগল করে দেখাচ্ছি।’
এই বলে হৃদি ল্যাপটপটা ওপেন করে গুগল সার্চ দিয়ে দেখলো এগুলো সত্যিই স্ক্রিপটেড। হৃদির মুখ ভোতা হয়ে গেলো। স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেই করুন গলায় সে বলল,
‘এখানে তো দেখছি সত্যিই স্ক্রিপটেড লেখা! আর আমি এতদিন এগুলো সত্যি ভেবে ফোনের চার্জ আর লাইট দুটোই একসাথে চলে গেলে কতো মোমবাতি থাকতেও না নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বাথরুমে উষ্টা খেয়ে পড়ে গেছি।’
হৃদির বলার ভঙ্গিমা দেখে রাইয়ান মজা পেলো। জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলো সে। রাইয়ানের হাসির শব্দ কানে যেতে তার দিকে তাকাতেই হৃদির মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। হৃদি খেয়াল করলো রাইয়ানের সাথে আজকেই সবথেকে বেশি কথা বলা হলো তার। ধীরে ধীরে কাছে আসার শুরুটা কি তবে এভাবেই?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here