#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৭
ভোরবেলা উদয়িনীর কল পেলেন সোহান খন্দকার। সিমরানের জ্বর হয়েছে। আরো একদিন কক্সবাজারে কাটানোর কথা থাকলেও মেয়ের ভয়াবহ জ্বর হওয়াতে ফিরে আসছে উদয়িনী৷ ভোর ছ’টায় রওনা দিয়েছে তারা। এখন বাজে ছ’টা পয়তাল্লিশ। স্ত্রীর ফোনকল পেয়ে সোহান খন্দকার ঘামতে শুরু করলেন। মেয়ের জ্বর নিয়ে সে দুশ্চিন্তা করছেন না। স্ত্রী এমবিবিএস ডক্টর। ছেলে মেডিকেল স্টুডেন্ট। সে দু’টো ক্লিনিকের মালিক। তাই সামান্য জ্বর নিয়ে চিন্তা করার মানুষ সে নয়। তার চিন্তা হচ্ছে নামীকে নিয়ে। সুহাস আর নামীর আইনগত ভাবে বিয়ে হয়নি৷ অবিলম্বে ছেলেমেয়ে দু’টো রেজিস্ট্রি করাতে হবে৷ উদয়িনী সাংঘাতিক দাম্ভিক একজন মহিলা। আইনিভাবে ছেলেমেয়ে দুটোর হাত এক না করলে উদয়িনী এই সম্পর্ক কখনোই মেনে নিবে না। যখন জানতে পারবে, নামী নিলুর মেয়ে। তখনকার পরিস্থিতি কী ঘটবে ভাবতেই শিউরে ওঠলেন। বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠল সোহানের। এক নিমিষেই যেন দিশেহারা হয়ে ওঠলেন মানুষটা। ভেবেছিলেন সুহাস, নামীকে নিয়ে আজ ধীরেসুস্থে এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন। এরপর কোর্টে গিয়ে ছেলেমেয়ে দু’টোর রেজিস্ট্রি করিয়ে তারপর বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু উদয়িনীর ফোন তার সমস্ত পরিকল্পনা উলোটপালোট করে দিল। ত্বরিত নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে সুহাসকে ডাকতে লাগলেন তিনি৷
‘ সুহাস, এই সুহাস। ‘
বাবার অস্থির চিত্তের ডাকগুলো শুনে বেঘোরে ঘুমানো সুহাস ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। চোখদুটো ডলে বলল,
‘ কী হয়েছে বাবা! ‘
‘ সিমরানের জ্বর হয়েছে। তোর মা কক্সবাজার থেকে ছ’টায় রওনা দিয়েছে। দ্রুত ব্যাগ গুছা আমরা এক্ষুনি ফিরে যাব। ‘
স্তম্ভিত মুখে ওঠে ঠাঁই বসে রইল সুহাস। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠল তার। গা কাঁপুনি দিয়েও ওঠল। মেরুদণ্ড বেয়ে নিঃসৃত হলো স্বেদজল। শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া জিভ দ্বারা ভিজিয়ে নিল ত্বরিত। থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ নামীর কী হবে বাবা? ‘
ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘর ছাড়তে উদ্যত হয়েও থেমে গেল সোহান খন্দকার। নামীর জন্য ছেলের মুখে দুশ্চিতার ছাপ দেখে প্রচণ্ড খুশি হলেন তিনি। কিন্তু সেই খুশিটাকে আড়ালে রেখে বললেন,
‘ কী হবে আবার? ছেলের বউকে সঙ্গে করেই তো ফিরব। তুই তৈরি হয়ে নে। আমি আখতারুজ্জামান আর নামীকে বলে আসি দ্রুত তৈরি হতে। দশটার মধ্যে কোর্টে পৌঁছাতে হবে আমাদের। এগারোটার মধ্যে তোদের রেজিস্ট্রি করাব। আর শোন, সৌধকে কল করে দ্রুত চলে আসতে বল। ‘
.
.
সৌধ বেশ নিয়মনিষ্ঠ ছেলে। ছোটোবেলা থেকেই দারুণ মেধাবী। পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি বিষয়ে কঠিন নিয়ম মেনে চলাই তার বৈশিষ্ট৷ সর্বদিকে বিশেষ নজর রাখা ছেলেটি নিজ স্বাস্থ্যের প্রতিও বেশ যত্নশীল। আঠারো বছর বয়স থেকেই নিয়মিত ব্যায়াম করে সে। ইউটিউব ঘেঁটে, বড়ো ভাইদের সহায়তা নিয়ে আলাদা করে ব্যায়ামের সমস্ত সরঞ্জাম কিনেছে সে৷ বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাসটা ছেড়েছে তখন থেকেই৷ তিন বছরের পরিশ্রম বৃথা যায়নি৷ বাইশ বছরের আকর্ষণীয় শরীরটাই সে প্রমাণ। তার অন্যান্য বন্ধুদের শরীরে কচি ভাবটা দূর হয়নি এখনো। অথচ একই বয়সী হয়েও তার সুঠাম বলিষ্ঠ দেহখানায় প্রাপ্তবয়স্কের সিলমোহর।
প্রাত্যহিক দিনের ন্যায় আজো ভোরের চমৎকার আলো গায়ে মাখাচ্ছে সৌধ। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে প্রশান্তি ভরে। এমন সময় টের পেল পেছনে কেউ একজন আছে।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিয়ৎকাল পেরোতেই অধর কোণে হাসি ফুটল। দু-হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়াল সোজা হয়ে। চোখ বুজে নিল প্রলম্বিত শ্বাস। বলল,
‘ এত দ্রুত ঘুম ভাঙল যে? ‘
প্রশ্নের উত্তরে কোনো সাড়া পেল না। অথচ পেছনের মানুষটি এসে ঠিক পাশে দাঁড়িয়েছে। মৃদু হাসল সৌধ। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় বলল,
‘ এখনো রাগ কমেনি? ‘
এবারেও কোনো সাড়া পেল না। সৌধ আবারো হাসল। বলল,
‘ চল হেঁটে আসি, ভোরের নির্মল বাতাসে হাঁটলে শরীর মন উভয়ই সতেজ হয়ে যায়। ‘
কথাটা বলেই চোখ খুলে পাশে তাকাল সে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠল। ফোলা ফোলা চোখদুটোর বাদামি রঙের মণি দুটো হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিল এক নিমিষে। নিজের বেগতিক অবস্থা টের পেয়ে ত্বরিত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সৌধ। মনে মনে বলল,
‘ সর্বনাশী একটা! ‘
আর কয়েক সেকেণ্ড ও মুখে তাকিয়ে থাকলে সত্যিই সর্বনাশ ঘটে যেত। সর্বনাশটা ঘটাত সে নিজেই। হৃদয়াকৃতির ও মুখশ্রী এ মুহুর্তে এতটা আদুরে লাগছে। সৌধর ইচ্ছে করছে দু’হাতে গাল চেপে ধরে সাড়া মুখে চুমু খেতে। এত্ত আদর করতে মন চায় কেন নিধিকে? বুকের ভেতর এত এত আদর জমা হয়ে একদিন তো আদুরে পাহাড় তৈরি হয়ে যাবে। তখন এই পাহাড়সম আদর সহ্য করতে পারবে তো মেয়েটা?
সৌধ ভাবনায় বিভোর। বন্ধুত্বের মধ্যে রাগারাগি বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয় না নিধি। গতকালকের রাগ গতকালই ফেলে দিয়েছে সে। তাই ওসব মনে না রেখে বর্তমান নিয়েই কথা বলল সে,
‘ না দেখেই বুঝে ফেললি আমি এসেছি? কী করে বুঝলি বলত! ‘
নিধির কণ্ঠে বিস্ময়। ওর বিস্ময়সূচক প্রশ্ন শুনে আচমকা মুখ ফস্কে সৌধ বলে ফেলল,
‘ তুই হলি আগুনপোকা বুঝলি? কখনো মাথার ভেতর কিলবিল করিস, কখনো বুকের ভেতর। তুই আশপাশে থাকলেই আমি পুড়তে থাকি, জ্বলে যাই। আর আমি যখনি জ্বলতে শুরু করি তখনি বুঝে যাই আশপাশে আগুনপোকা আছে, মানে তুই আছিস। ‘
অবাস্তব কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলল নিধি৷ কী সব বলল সৌধ বোধগম্য হলো না। তবে সে আশপাশে থাকলে সৌধ জ্বলে যায়! এ কথা অহমিকায় লাগল খুব। অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘ কাল থেকে তোর ভাবসাব, কথাবার্তা দেখছি সৌধ।’
হকচকিয়ে গেল সৌধ। চোখ ফিরিয়ে দেখল নিধির ক্রোধান্বিত মুখশ্রী। দমে গেল নিমিষেই। কী যেন হয়েছে তার। ইদানীং নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন নিধিকে দেখতে না পেরেই এই অবস্থা হয়েছে তার। অনুভূতিগুলো যেন এখন আর কোনো বাঁধাই মানতে চায় না৷ তাদের মাঝেকার বন্ধুত্বের যে দেয়ালটি আছে তা এক নিমিষে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। সহসা সে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিল সৌধ। মস্তিষ্ক জুড়ে একটি প্রশ্ন আসতেই, কে বড়ো ভালোবাসা না বন্ধুত্ব? আজ যদি নিধিকে সে নিজের মনের কথাগুলো বলে দেয়। ভুল বুঝে নিধি দূরে সরে যাবে না তো? নষ্ট করে দেবে না তো বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে? সহসা সৌধর মনে পড়ে গেল নিধির বলা সেই কথাটি,
‘ সেম এজ রিলেশন গুলো খুব বিরক্তিকর। সেম এজ সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে, সংসার করা আর বিষ হজম করা একই কথা! ‘
চমকে ওঠল সৌধ৷ রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। আশ্চর্য হয়ে নিধিও ছুটে এলো তার পিছু পিছু। বলল,
‘ দেখ সৌধ, বাড়িতে ডেনে এনে এভাবে অপমান করবি না। আমি কিন্তু এক্ষুনি চলে যাব। ‘
‘ অপমান কোথায় করলাম? তুই ভুল বুঝছিস। ‘
‘ হ্যাঁ আমি তোকে শুধু ভুলই বুঝি। তুই কী বললি ওটা তখন। আমি আগুনপোকা? ‘
‘ মজা করেছি। ‘
হাঁটতে হাঁটতে একদম স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বলল সৌধ। নিধি ওর সঙ্গে পা মিলিয়ে হেঁটে অবাক হয়ে বলল,
‘ আচ্ছা মেনে নিলাম। তাহলে তুই আমার উপস্থিতি টের পেলি কীভাবে? এর আগেও কিন্তু বিষয়টা খেয়াল করেছি। কাহিনীটা কী বল তো? ‘
আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল সৌধ। নিধির মুখে স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কপট স্বরে বলল,
‘ দুনিয়াতে কিছু মানুষ থাকে এক্সট্রর্ডনারি। আমি সেই কিছুদের মধ্যেই একজন। ‘
প্রথমে বিস্মিত হলেও পরোক্ষণেই ভেঙচি কাটল নিধি। বলল,
‘ বেহুদা ভাব মারবি না। তুই…’
বাকি কথা আর বলতে পারল না। সৌধর ফোন বেজে ওঠায়। সৌধ ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করেই দেখল সুহাস কল করেছে। এত সকালে সুহাসের কল! কেন?
.
.
বেলা এগারোটায় সুহাস নামীর রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হলো। সামাজিক, আইনি দু’ভাবেই নামী এখন মিসেস সুহাসিনী খন্দকার। এই খুশিতে সৌধ আর নিধি গিয়ে পোড়াবাড়ির নামকরা তিন কেজি চমচম নিয়ে এলো। উকিলকে এক কেজির প্যাকেট দিয়ে বাকি দুই কেজি সহ সকলেই বেরিয়ে এলো কোর্ট থেকে। উদ্দেশ্য সৌধদের বাড়ি যাওয়া। কোর্ট চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে বসল সৌধ। নিধি সুহাস নামীকে নিয়ে একসঙ্গে এগুচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে সোহান খন্দকার ডাকলেন,
‘ সুহাস, নামী মা এদিকে এসো। ‘
ওরা তিনজনই থেমে গেল। নিধি টের পেল নব দম্পতির সঙ্গে একান্তে কথা বলবেন আংকেল। তাই মৃদু হেসে নামীকে বলল,
‘ আমি গিয়ে গাড়িতে বসছি। তোমরা এসো। ‘
নিধি চলে গেল। সোহান ছেলেকে কোর্ট চত্ত্বরের ডানপাশে নিয়ে গেলেন একান্তে কিছু কথা বলতে। আর আখতারুজ্জামান মেয়েকে নিয়ে গেলেন বাম পাশে। অল্প সময়ে অনেক বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ভবিষ্যত উপরওয়ালার হাতে। তবুও নিজেদের চেষ্টায়ও ত্রুটি রাখা উচিৎ নয়৷ কর্মফল বলেও একটি কথা দুনিয়াতে জীবিত থাকে।
সোহান খন্দকার সুহাসকে বললেন,
‘ সুহাস, এ মুহুর্তে আমি তোকে বেশি কিছু বলতে পারব না বাবা। কিন্তু আমার বিশ্বাস তোরা দু’জন খুব শিঘ্রই সত্যিটা জানতে পারবি। আজ থেকে নামীর সব দায়িত্ব তোর আর আমার। অনেক বছর আগে আমাকে দিয়ে যে পাপ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ থেকে সেই পাপের বোঝা কমতে শুরু করবে। এরজন্য সম্পূর্ণ অবদান তোর বাবা। এক বাবার মাধ্যমে হয়েছিলাম পাপি। আজ আরেক বাবার মাধ্যমেই পাপ থেকে মুক্ত হলাম। যাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। আজ বহু বছর পর তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই পড়ল। নিয়তির খেলায় শেষ হাসি আমি হাসতে পারলাম। ‘
এক মুহুর্ত চুপ করে সুহাসের কাঁধে হাত রেখে পুনরায় সোহান বললেন,
‘ মহান আল্লাহ তায়ালা যা করেন তার পিছনে বান্দার কোনো না কোনো মঙ্গল লুকিয়ে থাকে। আজ বুঝতে পারছি সেদিন ঐ ঘটনা না ঘটলে আজকের মঙ্গলটি হতো না। নামী আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুহাস অনেক। ‘
এদিকে আখতারুজ্জামান মেয়েকে বললেন,
‘ নামী মা, এক সময় এই পৃথিবীতে নিলু সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস আর ভরসা করত সোহানকে। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা, কঠিন পরিস্থিতি ওদের সম্পর্কে দেয়াল তুলে দিয়েছিল৷ সে দেয়ালেই নিলু আমার স্ত্রী হয়। হয়ে ওঠে ভালোবাসার মানুষও। ওর প্রকাশ্য সুখ আর গোপন যন্ত্রণা খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। আমি জানি রাগ, অভিমান শেষে সোহানের প্রতি ওর ভালোবাসার গভীরতা। সব সময় মনে রাখবি মা, বাবা যা করেছে তোর ভালোর জন্য করেছে। বাবা যা করেছে পরপারে থাকা মা এতে সবচেয়ে বেশি খুশি৷ কারণ তার চোখের মণিকে আমি তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটির হাতেই তুলে দিলাম আজ। ‘
নামী জানত তার মায়ের একজন প্রাক্তন ছিল। কিন্তু আজ একদম পরিষ্কার হয়ে গেল সেই প্রাক্তনই সোহান আংকেল। অর্থাৎ তার শশুরই তার মায়ের প্রাক্তন! সহসা চমকাল নামী। তাই যদি হয় সোহান আংকেলের সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক হলো কীভাবে? সে তো জানত তারা কলেজ বন্ধু। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল, তার বাবা ছিল তার মায়ের সিনিয়র ভাই। অর্থাৎ বাবা, মা, সোহান আংকেল একই কলেজের স্টুডেন্টস ছিল? কিন্তু মায়ের বাবার সঙ্গে বিয়ে কীভাবে হলো? সোহান আংকেল মাকে ঠকিয়েছিল বলে? উহুম এমন কোনো কথাত শুনেনি। তাহলে কী? কঠিন পরিস্থিতির জন্য সব হয়েছে?
অসংখ্য প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে রয় নামী এবং সুহাস। তারা উভয়ই বুঝতে পারে বাবা, মায়ের জটিল অতীত রয়েছে। সেই জটিল অতীত স্পষ্ট ভাবে জানতে উদগ্রীবও হয়। দু’জনকেই স্বান্তনা দেয়া হয় এই বলে, ‘ একদিন সব জানতে পারবে। এখন তোমরা ছোটো। আরো বড়ো হও তারপর এসব বড়ো বড়ো জটিল বিষয় গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। ‘
_______________________
আচম্বিতে গাড়ির ব্রেক কষলো সৌধ। সুহাস চোখ বুজে অতীতে ডুবে। রেজিষ্ট্রি করার পর বাবার বলা সেই কথাগুলো। সৌধর গাড়ির পেছনে বসা লাল শাড়ি পরিহিতা নামী, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সে। সাত বছর পর সেসব আজো একদম স্পষ্ট দেখতে পেল সুহাস। বাড়ি যেতে যেতে কতশত কল্পনা করছিল। মনে মনে কঠিন পণ করেছিল, যে ঠোঁট নাড়িয়ে নামী তাকে কবুল বলে স্বামী হিসেবে স্বীকার করেছে সেই ঠোঁটে আজ চুমু খাবেই খাবে। যে হাতে রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করেছে সে হাতেও করবে গাঢ় চুম্বন।
‘ সুহাস, এই সুহাস। ‘
সৌধের ডাকে চমকে ওঠল সুহাস। ভীতিগ্রস্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাল আশপাশে। সৌধ পুনরায় বলে ওঠল,
‘ কোন জগতে তুই? আমরা পৌঁছে গেছি। এই যে দেখ তাকিয়ে। এই হসপিটালেই নামী জয়েন করেছে। ঘটনা বুঝলাম না। আমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়ে ও সুইজারল্যান্ড কেন এলো? ‘
বুকের ভেতর কী যেন একটা কামড়ে ধরল সুহাসের। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির ডোর খুলে বেরিয়ে পড়ল সে। সৌধও ত্বরিত গাড়ি থেকে নেমে গাড়ি লক করল।নামীকে খুঁজে পেতে হলে নিজেদের একটি গাড়ির বিশেষ প্রয়োজন। এ মুহুর্তে গাড়ি কেনা সম্ভব না। তাই এখানে আসার পর পরিচিত এক বড়ো ভাইয়ের গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে ওরা। দুই বন্ধু হসপিটালের গেট পর্যন্ত গিয়ে গেটম্যান হ্যালো করে ইংরেজিতে বলল, ডক্টর নামী রহমান কি আজ এসেছেন? গেটম্যান ইংরেজিতেই জবাব দিলেন,
‘ ম্যাম সপ্তাহে দু’দিন আসে। রবিবার আর মঙ্গলবার।’
আজ বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ ডক্টর নামী রহমান এখানে আসবে রবিবার। সৌধ সময়টা জেনে নিল। কিন্তু সুহাস অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ ও থাকে কোথায়? ‘
মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘উনি থাকেন কোথায়? উনার ঠিকানা দেয়া যাবে? ‘
গেটম্যান কোনোমতেই ঠিকানা দিল না।বরং বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। সৌধ সুহাসকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়িতে ওঠাল। বলল,
‘ কুল ম্যান, এত হাইপার হচ্ছিস কেন। ষোল মাস ধৈর্য ধরতে পারলি আর কটাদিন পারবি না? ‘
সহসা দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরল সুহাস। মুহুর্তেই আবার সিটে গা এলিয়ে দিল। চোখ বুজে শ্বাস নিল ঘনঘন। সৌধ চুপসে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। জেনেভা লেকের কাছাকাছি এক বিলাসবহুল রিসোর্টে ওঠেছে তারা। যাত্রাপথে সুহাস আবারো অতীতে ডুব দিল। স্বচ্ছ পানির মতো অতীত। নিষ্ঠুর অতীত। বিষাক্ত অতীত৷ যেখানে সুখ জিনিসটা ছিল খুব খুব সীমিত। আর এই সীমিত সুখের রেশ ধরেই আজ সে ছুটে এসেছে ভিন দেশের ভিন শহরে। প্রিয়তমার খোঁজে। যার কাছে রয়েছে তার ছোট্ট এক অংশও। নিষ্ঠুর অতীতের নিষ্ঠুর প্রিয়তমা সেই অংশের আগমনী বার্তাও দেয়নি তাকে। বুকটা হুহু করে ওঠল সুহাসের। চোখ বুজে হৃদয়ের চোখে দেখতে লাগল অতীত জীবনটাকে…
_______________________
‘ ও কে, কে ও? নিলু! ওকে নিলুর মতো দেখতে। ওকে নিলুর মতো দেখতে কেন! কাকে সুহাসের বউ করে এনেছ তুমি সোহান। কে ও? ‘
উদয়িনীর কাঁপা কণ্ঠ শুনে সোহান বললেন,
‘ উদয়িনী, শান্ত হও। ও নিলুর মেয়ে, নামী। ‘
মুহুর্তেই দপ করে সোফায় বসে পড়ল উদয়িনী। তীব্র চিৎকারে বলল,
‘ আমার এত বড়ো সর্বনাশ তুমি কীভাবে করলে সোহান! আমার ছেলের জীবনটা তুমি এভাবে কেন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলে? ‘
তীব্র ক্রোধে উদয়িনীর চেহেরাই বদলে গেল। কাঁপতে লাগল থরথর করে। নিধি, সৌধ ভয়ে চুপসে গেল। উদয়িনীর আন্টির এই রূপ দেখে হতভম্ব তারা৷ খানিকপূর্বে ঘরে শুইয়ে আসা হয়েছে সিমরানকে। মায়ের চিৎকার শুনে জ্বর মাথায় ছুটে এলো সে। বলল,
‘ আম্মু, কী হয়েছে তোমার? ‘
নিধি গিয়ে ধরল সিমরানকে। বলল,
‘ সিমরান কিছু হয়নি৷ তুমি আমার সাথে ঘরে চলো।’
জেদি সিমরান সে কথা শুনল না। নিধির থেকে হাত ছাড়িয়ে ছুটে এসে মায়ের কাছে বসল। উদয়িনী মেয়েকে জাপ্টে ধরে ডুকরে ওঠল,
‘ তোর বাবা প্রতিশোধ নিল রে সিমরান। ঐ মেয়েকে নাকি সুহাস বিয়ে করেছে! জানিস ও কে? নিলুর মেয়ে! ‘
নামীর দিকে তর্জনী তুলে কথাটা বলল উদয়িনী। ভয়ে দেহ কেঁপে ওঠল নামীর। থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। সিমরান বিস্মিত হয়ে তাকাল শ্যামলা বর্ণের নামীর দিকে। যাকে কিয়ৎ মুহুর্ত আগে ভাইয়ের বান্ধবী ভেবেছিল সে আর তার মা। উদয়িনী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল,
‘ যেই নিলুর জন্য আমি কোনোদিন স্বামীর ভালোবাসা পাইনি। সেই নিলুর মেয়েকে বিয়ে করেছে আমার ছেলে! ‘
কথাটা বলেই শরীর ছেড়ে দিল উদয়িনী। সিমরান শক্ত করে মাকে ধরে চিৎকার করে ওঠল,
‘ আম্মু! ‘
স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সুহাসের স্তব্ধতা কেটে গেল এক নিমিষে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে মায়ের কাছে ছুটে এলো সে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল,
‘ মা, ও মা প্লিজ শান্ত হও মা। ‘
চলবে…