হৈমন্তীকা
৪.
টেবিলের ওপর মাথা রেখে একমনে সেন্টারফ্রুড চিবুচ্ছে তুষার। তার দৃষ্টি কোথায় যেয়ে ঠেকেছে ঠিক বুঝতে পারছে না হৈমন্তী। সর্তক চাহনিতে পর্যবেক্ষণ করে নিচ্ছে তুষারকে। তাকে দেখলে মনে হয় না সে হৈমন্তীর চেয়ে ছোট। বরং উচ্চতায় ও শারীরিক গঠনে বরাবরই তুষার হৈমন্তীর উর্ধে। গায়ের রঙটাও তার চেয়ে উজ্জ্বল। প্রশস্ত বুক, পেটানো শরীর, দুই বাহু ফুলে ফেঁপে আছে। চেহারায় এক আলাদাই মায়ার ফলন। আঁখি জোড়ার মণি একটু বেশিই বাদামী নয়? হ্যাঁ, অন্যদের থেকে একটু বেশিই বাদামী তুষারের চোখের মণি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে নিলো হৈমন্তী। তুষারের প্রতি আরেকটু মনোযোগী হতেই তুষারের দৈবাৎ কথায় ভড়কে গেল সে।
— “এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন কেন হৈমন্তীকা? আমি তো আপনারই, ভালো ভাবে দেখুন।”
হৈমন্তী হকচকালো। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। খানিক লজ্জাও পেল। এভাবে তাকানো উচিত হয় নি তার। তাকানোর ই-বা কি প্রয়োজন ছিল? নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হলো হৈমন্তীর। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ঘড়ির কাটা নয়টা পঞ্চান্নতে এসে ঠেকেছে। একটু পরেই ক্লাস শুরু হবে। চেয়ার থেকে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। গম্ভীর সুরে বললো,
— “মরীচিকার পেছনে না ছুটে পড়াশোনায় মন দিন তুষার। আপনার না এখন ক্লাস চলছে? ক্লাস বাদ দিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছেন কেন?”
জবাবে বিস্তর হাসলো তুষার। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে দু’হাত উঁচিয়ে আড়মোড়া ভাঙলো। এরপর পেটে হাত রেখে মন খারাপ করে বললো,
— “আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে হৈমন্তীকা। কিছু কিনে দিন তো! খাবো।”
হৈমন্তী চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই পারুকে ইশারায় উঠতে বলে ক্যান্টিনের কর্মরত ছোট্ট ছেলেটিকে ডেকে বললো,
— “মিন্টু, তোর এ ভাই যা চায় তাকে দেয়। আমি ক্লাস শেষে এসে টাকা দিয়ে দেবো।”
মিন্টু অন্যান্য টেবিল মুছছিল তখন। হৈমন্তীর কথা শুনে উপর-নিচ মাথা নাড়ালো শুধু। তুষার উদাসীন গলায় বললো,
— “আমি যা চাই তা এ বাচ্চা ছেলে দিতে পারবে না হৈমন্তীকা।”
— “মানে?” বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো হৈমন্তী।
তুষার আগেই মতোই বললো,
— “আমি তো আপনাকে চাই হৈমন্তীকা। খুব করে চাই। ও কি আমার হৈমন্তীকাকে আমাকে দিতে পারবে?”
হৈমন্তী ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাঁড়লো। এই ছেলের সাথে কথা বলাই বেকার। কিসব উদ্ভট কথাবার্তা বলে! হৈমন্তীর ইচ্ছে করে, তুষারের কান আচ্ছামতো মলে দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে সংযত রাখলো সে। আড়চোখে একবার তুষারকে দেখে পারুকে নিয়ে চলে যেতে লাগল সেখান থেকে।
পেছন থেকে তুষার উঁচানো গলায় বলে উঠল,
— “আমার উত্তরটা এখনো দেন নি হৈমন্তীকা!”
হৈমন্তী দাঁড়ালো। তবে পেছনে ফিরল না। তুষার প্রশ্ন করলো,
— “ছেলেটা কে হৈমন্তীকা?”
তখনকার মতো এবারও প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না হৈমন্তী। পা চালিয়ে তুষারের দৃষ্টির বাহিরে চলে গেল।
___________________
ভার্সিটি শেষে পরিচিত বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই বেশ অনেকখানি ক্লান্ত হয়ে পরলো হৈমন্তী। দারোয়ান চাচা তাকে দেখে মুচকি হাসলেন। স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
— “আইজ তোমারে বেশি কেলান্ত দেখাইতেছে যে? কলেজ আলারা বেশি খাটাইছে নাকি?”
হৈমন্তীও একটু করে হাসলো। বললো,
— “হ্যাঁ চাচা। একেবারে জান বের করে দিছে।”
— “যাও! যাও! তাত্তাড়ি বাসায় গিয়া বিশ্রাম নাও। ভালা লাগবে।”
জবাবে হৈমন্তী মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়। গেট পেরিয়ে উঠোনের দিকে নজর যেতেই দেখতে পায় তুষারকে। মাথা নিচু করে বেঞ্চে বসে আছে সে। তুষারদের ক্লাস বহু আগেই শেষ হয়েছে। ও বাসায় না গিয়ে এখানে বসে আছে কেন? মস্তিষ্কে কৌতূহল জাগলেও বিষয়টা অত ঘাটালো না হৈমন্তী। তবে আরেকটু আগাতেই স্পষ্ট হয়ে এলো তুষারের মুখশ্রী। তার কপালের ডান পাশটা রক্তে শোভিত হয়ে আছে। হাতের আঙ্গুলেও রক্তের খানিক অস্তিত্ব বিরাজমান। হৈমন্তী আঁতকে উঠল। দ্রুত পদে তুষারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁপা স্বরে ডাকলো, “তুষার?”
সে ধীর স্থির ভঙ্গিতে তাকালো। দৃষ্টি অত্যাধিক স্বাভাবিক ও শীতল। হৈমন্তীর কাছে ভালো ঠেকলো না সেই চাহনি। ভেতরটা দারুণ ভাবে কেঁপে উঠল। তুষার তখন মিহি স্বরে জবাব দিলো,
— “হু?”
— “আপনার এ অবস্থা কিভাবে?”
— “জানি না।”
কলেজের সাদা শার্টের বুকের দিকটায় রক্ত লেগে আছে। কপাল বেয়ে রক্তের বিন্দুকণা গড়িয়ে পরতেই ব্যস্ত হয়ে পরলো হৈমন্তী। তুষারে পাশে বসলো। ব্যাগ থেকে কি যেন বের করতে করতে কাঁপা কণ্ঠে তেজের অস্তিত্ব ঢেলে বললো,
— “ডাক্তার দেখান নি কেন এখনো? এখানে এভাবে বসেই-বা আছেন কেন?”
তুষার জবাব দিলো না। নির্নিমেষ চেয়ে রইল হৈমন্তীর ব্যথাতুর আঁখি জোড়ার পানে। হৈমন্তীর সেদিকে খেয়াল নেই। ব্যাগ থেকে বেন্ডেজ বের করে কোনোভাবে লাগিয়ে দিলো তুষারের ক্ষত স্থানে। হাতের ক্ষতগুলোর জন্যও বেন্ডেজ বের করতে গিয়ে জানতে পারলো, তার কাছে আর বেন্ডেজ নেই।
বিরক্তি সূচক নিশ্বাস ফেলল হৈমন্তী। তুষারের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “ডাক্তার না দেখিয়ে এখানে বসে ছিলেন কেন?”
— “আপনার জন্য।” তুষারের সাদামাটা উত্তর।
হৈমন্তীর রাগ আরও বাড়লো। তুষারের হাতের ক্ষত চেপে দিলো সে। তুষার প্রথমে ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলেও, পরক্ষণেই সশব্দে হাসতে লাগল। বাম গালের সূক্ষ্ণ টোলটা বেড়িয়ে এলো তখন। আলতো হাতে হৈমন্তীর নাক ছুঁয়ে দিয়ে মোলায়েম স্বরে তুষার আওড়ালো,
— “সর্বদা নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘোরেন কেন হৈমন্তীকা? ভালোবাসতে পারেন না? একবার ভালোবেসে দেখুন। উজার করে দিব সব!”
কিন্তু তুষারের আবেগী কথায় মন গললো না হৈমন্তীর। সে কাঠাকাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
— “কার সাথে মারামারি করে নিজের এ অবস্থা করেছেন?”
কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল তুষার। চেহারায় পরিবর্তন এলো। গম্ভীর হলো সে। তবে কোনোরূপ জবাব দিলো না। হৈমন্তী আবারও প্রশ্ন করলো,
— “কথা বলছেন না কেন তুষার?”
তুষার এবারও নিশ্চুপ। হৈমন্তী কিছু সময় চুপ থেকে কি যেন ভাবলো। অতঃপর আটকে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি কি ইভানকে কিছু করেছেন তুষার?”
এতক্ষণে তুষার বললো,
— “কোন ইভান হৈমন্তীকা?”
— “মোটেও না চেনার ভান করবেন না তুষার। সত্যি করে বলুন, আপনি কার সঙ্গে মারামারি করে এসেছেন?”
তুষার নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
— “ওই ছেলেটা একদম ভালো না হৈমন্তীকা। আপনার সঙ্গে টাইমপাস করতে চেয়েছিল সে।”
হৈমন্তীর আর বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছু।
___________________
চলবে..
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা