১.
“মানুষ কতটা নির্দয় হলে নিজের স্বামী, এক কালীন ভালোবাসার মানুষটার দ্বিতীয় বিয়ের হলুদের অনুষ্ঠান দু’চোখ মেলে দেখতে পারে, আপা? তোমার কী বুকে একটুও ব্যাথা হচ্ছে না! নিজেকে এমন পৈচাশিক দুঃখ দিয়ে কী মজা পাচ্ছো?”
চিত্রার চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা অথচ যাকে প্রশ্ন করা হলো তার ভেতর কোনো হেলদোল নেই, সে নিরলস তাকিয়ে আছে তার পাশের বিল্ডিং এর ছাঁদে। দারুণ সাজসজ্জা আর বিয়ের অনুষ্ঠানে মুখরিত সেই ছাদ। বর বেশে বসে থাকা মানুষটাও ভীষণ হেসেখেলেই যে নিজের বিয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। চিত্রার সামনে দাঁড়ানো মানবী নিরুত্তর। চিত্রা অধৈর্য্য হলো , কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠেই বললো,
“চাঁদ আপা, এখন ভর সন্ধ্যা বেলা, চারপাশে কুয়াশার ছড়াছড়ি, এ অবস্থায় কেবল পাতলা একটা শাড়ি জড়িয়ে আছো শরীরে। শরীরটার এত অযত্ন করছো কেন?”
“যার মনই সাথে নেই, তার আর শরীরের যত্ন দিয়ে কী হবে চিতাবাঘ? মৃত মনের মানুষকে ওসব ছুঁতে পারে না।”
চিত্রা থমকে গেলো। ততক্ষণে তার চাঁদনী আপার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা মুক্তোর দানার মতন অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চিত্রা বড্ড নাজুক ধরণের মেয়ে। কারো কান্না তার সহ্য হয় না। তার উপর যদি মানুষটা প্রিয় হয় তবে তো হলোই। চাঁদনী আপার কান্না দেখে কেঁদে দিলো মেয়েটাও। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
“আমি কষ্ট পাচ্ছি, আপা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শাহাদাৎ ভাই কেন তোমারে বুঝলো না?”
ছোটো বোনের কান্না দেখে চমকে গেলো চাঁদনী। তাড়াতাড়ি বোনকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছিস কেন পাগলি? প্রেমে পড়লে ঐ একটু কষ্ট পেতেই হয়। কষ্ট যদি সহ্য করতেই না পারলাম তবে কেমন ভালোবাসলাম বল তো?”
চাঁদনী আপার ছোট্টো কথায় চিত্রার মনে তোলপাড় করে ঝড় তুললো। প্রেমে পড়লে কষ্ট পেতেই হবে ! প্রেম অনুভূতি টা এত সুন্দর তবে কষ্ট কেন পেতে হবে? চাঁদনী আপা আরেকটু শক্ত হাতে জড়িয়ে রাখলো তার বোনটাকে। দৃষ্টি তার সেই পাশের ছাদ টাতেই। লোকটা কী সুন্দর হেসেখেলেই না বিয়েটা করছে! অথচ এদিকে যে একটা মেয়ে জিন্দা লাশ হয়ে যাচ্ছে, সে খবর কী লোকটার আছে! চিত্রাও বোনের বুক থেকে মুখ তুললো, বেশ ফিসফিসিয়ে বললো,
“আপা, তোমাদের বিয়ের খবর না কেউ জানলো আর না এমন বিচ্ছেদের কথা কেউ জানবে। তুমি একটু স্বার্থপর হতে পারলে না, আপা? জানিয়ে দিতে তোমার আর শাহাদাৎ ভাইয়ের এত বছরের সম্পর্কের কথা। আট টা বছর তো মুখের কথা না! সে বিদেশ যাবে বলে তোমাকে বিয়েও করে গেলো, অথচ বিদেশের হাওয়া গায়ে লাগতেই তুমি এমন অপছন্দের হয়ে গেলে! ভালোবাসা এতটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো?”
“বোকা বোকা কথা বলিস না, চিতাবাঘ। আট বছর ভালোবেসেছে বলেই আমার সাথে তার চিরজীবন থাকতে হবে এমনটা তো কোথাও লিখা নেই তাই না? ভালোবাসতে যেহেতু পেরেছি তবে দুচোখ মেলে তার সুখও আমি দেখতে পারবো। কাঁদিস না, এক জীবনে সব পেয়ে গেলে তো জীবনের মজা নেই তাই না বল? কিছুটা থাক অপ্রাপ্তি।”
“অথচ তুমি তো তার জন্য জীবনের আঠাশ টা বসন্ত অপেক্ষা করলে, সেটা?”
“অপেক্ষা সবসময় মিষ্টিই কেন হতে হবে, চিতাবাঘ? কখনো কখনো অপেক্ষা তিতে হোক, পানসে হোক, রঙহীন হোক। কিছু প্রেম উত্তাপ থাক।”
চিত্রা মহা বিরক্ত হলো, কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে আপার জন্য অথচ আপা নিজেই নিজের প্রতি কত নির্দয়! চিত্রার আর সাহস হলো না এই বিচ্ছেদের গল্প দেখার, সে দ্রুত ছাঁদ পেড়িয়ে চলে গেলো নিজেদের ফ্লাটে। ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদনী তা দেখে হাসলো। আঠারো বছরের বোকা মেয়েটা কেমন আবেগে কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে বোনের কথা ভেবে! এই মেয়েটার জীবনে কখনো এমন দিন না আসুক, মেয়েটা যে সহ্য করতে পারবে না।
চাঁদনী চোখ বন্ধ করলো, তার কাঁধ গলিয়ে পড়ে থাকা নীল রঙের জামদানী শাড়ির আঁচল টা তখন বাঁধা হীন উড়ছে। শীতের কনকনে ঠান্ডা বাতাসে চাঁদনী কেঁপে কেঁপে উঠলো। চোখে ভেসে উঠলো কতো সুখের স্মৃতি। যে-ই মানুষটাকে বিশ বছর বয়সে খুব যত্নে বুকে এঁকেছিল তাকে যে সে চাইলেও মুছতে পারবে না। কিন্তু মানুষটা তাকে মুছে ফেলেছে নিঃসংকোচে। বিবেকেও বাঁধে নি, হৃদয়েও না। অথচ সেই মানুষটার প্রিয় রঙটাই শরীরে জড়িয়ে আছে আজ। ভালোবাসার মানুষটার সুখ দেখতেও ভালো লাগে, এটা কী আর আবেগীয় চিত্রা বুঝবে!
“আরে, পাশের ছাঁদে দেখি নীল জোছনার হাট! ব্যাপার কী? রাত বিরাতে চাঁদের এমন সৌন্দর্যতার কারণ কী?”
চাঁদনী নিজের ব্যাক্তিগত সময়টায় অন্যকারো হস্তক্ষেপে ভ্রু কুঁচকালো, ঘাঁড় ঘুরিয়ে তার পেছনের দিকে তাকাতেই গোলাপের ন্যায় সুদর্শন এক ছেলেকে চোখে পড়লো। ছেলেটাকে দেখেই সে অবাক হলো, কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললো,
“মৃন্ময়, তুমি এভাবে কথা বললে! হ্যাঁ?”
চাঁদনীর প্রশ্নের বিপরীতে মৃন্ময় নামের ছেলেটা ভীষণ আদুরে এক চিলতে হাসি দিলো। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল গুলো ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,
“আমি না, আমার অসভ্য মুখটা বলেছে। সিনিয়র আপু দেখলেই এই বেয়াদবটা আমার কথা শুনে না, ঠুসঠাস বেফাঁস বলে ফেলে, ইন্দুবালা।”
চাঁদনী বেশ বিরক্ত হলো মৃন্ময়ের কথায়, কিছুটা ধমকেই বললো,
“তোমাকে না বলেছি এসব অদ্ভুত নামে ডাকবে না আমাকে। তোমার থেকে ঠিক চার বছরের বড়ো আমি। আমাকে যেখানে তোমার আপু ডাকা উচিৎ, সম্মান করা উচিৎ সেখানে তুমি এসব নামে ডাকছো! এত বেয়াদব কেন তুমি?”
“সব আমার অসভ্য মুখের দোষ ইন্দুবালা। আর ইন্দুবালা নামটা কই অদ্ভুত? ‘ইন্দুবালার ভাতের হোটেল’ নামের একটা উপন্যাস আছে তো জানেন না? কবি লিখেছে ইন্দুবালার ভাতের হোটেল আর আমি লিখবো ‘ইন্দুবালার রাগের হোটেল’। সুন্দর হবে না?”
“দিন দিন বেয়াদব হচ্ছো। যাও, তোমার ভাইয়ের ওখানে গায়ের হলুদ হচ্ছে আর তুমি এখানে কী করছো? যাও ওখানে।”
“আপনার পরিবার এখানে অনুষ্ঠানে এসেছে আর আপনি ওখানে ছাঁদে এমন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ও হো, সাজতে বেশি সময় নিয়ে ছিলেন নাকি? সে জন্য তারা আনে নি? আহা, আসুন, এখান থেকে একটা লাফ দিয়ে আমার কোলে ওহ্ সরি আমাদের ছাঁদে চলে আসুন।”
চাঁদনী মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। এমনেতে তার মন খারাপ তার উপর মেজাজ বিগড়ে দিতে এই ছেলে চলে এসেছে। বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠলো তার ভেতর। সে মুখ দিয়ে অসহ্য রকমের একটা শব্দ করে হনহনিয়ে নেমে গেলো ছাঁদ থেকে। তা দেখে খিলখিল করে হাসলো মৃন্ময়, সিনিয়দের সাথে হেয়ালি করতে এত মজা এই ইন্দুবালাকে না দেখলে সে জানতোই না। কঠিন, রাগী রাগী মেয়েটা কেমন একটুতেই ফুঁসে উঠে! মৃন্ময়ের বড্ড ভালো লাগে। এসব ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে মৃন্ময়ের ডাক আসতেই সে ছুটে সেখানে চলে গেলো। তার বেশ কাজ আছে, আজ তার বড়ো ভাইয়ের গায়ের হলুদ। সব দায়িত্ব তো তার উপরই।
–
পড়ার টেবিলে গম্ভীর মুখে বসে আছে বাহার ভাই। তার সামনে চিত্রা বারংবার একটা অংক ভুল করছে আর বাহার ভাই চুপচাপ সেটা দেখে চলছে। এক পর্যায়ে চিত্রা অধৈর্য্য হয়ে লিখা থামিয়ে দিলো। ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ গোলগোল করে তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে, আহ্লাদী স্বরে বললো,
“বাহার ভাই, হচ্ছে না তো!”
“এটা কী মাস?”
নিজের কথার বিপরীতে বাহারের অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকালো চিত্রা। আনমনেই বললো, “এ্যা!”
“এটা কী মাস?” বাহারের কণ্ঠে আগের মতনই গম্ভীরতা।
চিত্রা ঝটপট উত্তর দিলো, “ডিসেম্বর। জানেন না এটা? জানবেন কীভাবে! সারাদিন চোখে-মুখে রাগ লেপ্টে রাখলে আর কিছু কী পড়বে চোখে? পড়বে না।”
“ডিসেম্বরের কত তারিখ?”
চিত্রা এবার নড়েচড়ে বসলো। বাহার ভাই অহেতুক কথার লোক না, যেহেতু সে জিজ্ঞেস করছে তার মানে কোনো জরুরী কিছু। কিন্তু কী! আজকে কী কোনো বিশেষ দিন? কই চিত্রার তো মনে পড়ছে না। তার তো পড়া বাদে পৃথিবীর সব কথাই মনে থাকে, তাহলে আজকের দিনটার গুরুত্বটার কথা তার মনে পড়ছে না কেন? চিত্রা মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে গেলো, ছোটো স্বরে বললো,
“আজ ডিসেম্বরের সতেরো তারিখ, বৃহস্পতিবার। রাত সাড়ে সাতটা বাজছে। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছেন?”
প্রশ্নটা করেছে ঠিক কিন্তু উত্তর শোনার অপেক্ষা করলো না সে। বরং খুব দ্রুতই টেবিলের সাথে লাগোয়া ক্যালেন্ডারের কাছে ছুটে গেলো। তারিখটা বার বার ঘুরিয়ে দেখলো৷ কই, সে তো এখানে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয় নি। বিশেষ কোনো দিন হলে তো দাগ দিয়ে রাখতোই। তাহলে বাহার ভাই এত করে জিজ্ঞেস করছে কেন?
চিত্রা আবার ব্যস্ত পায়ে ছুটে এসে চেয়ারে বসলো। আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
“সতেরো তারিখই তো। আজ তো কোনো বিশেষ দিন না, বাহার ভাই। তবে জিজ্ঞেস করলেন যে?”
চিত্রার প্রশ্নটা করতে দেরি অথচ তার ফর্সা হাতটাতে কাঠের স্কিলের বাড়ি পড়তে দেরি হলো না। তাও একটা না, পর পর দু’টো প্রহার করলো। চিত্রা হতভম্ব, বিস্মিত চোখে কেবল তাকিয়ে রইলো। তার মস্তিষ্কে তখনো ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। বাহার ভাই তাকে মারলো কেন? কিন্তু কষ্ট করে চিত্রাকে মারের রহস্য বের করতে হলো না তার আগেই বাহার বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলে উঠলো,
“তোমাকে তারিখ জিজ্ঞেস করেছি আর তুমি চলে গেছো বিশেষ দিন খুঁজতে অথচ আর তিন চার মাস পর যে তোমার বোর্ড পরীক্ষা তা তোমার মাথাতেই নেই। কী অদ্ভুত! ফেইল তো করবেই সাথে আমার মান ইজ্জত ডুবাবে। খাতায় বড়ো বড়ো ডিম নিয়ে আসবে। তারপর সবাই আমাকে বলবে ঐ যে দেখ, খাতায় ডিম পাওয়া চিত্রার টিচার যাচ্ছে। তাই না? এটাই চাচ্ছো তুমি? এলাকায় আমার নাম খারাপ করতে তাই না?”
চিত্রার চোখে তখন অভিমানী অশ্রু হানা দিলো। সে আর কিছু না বলেই চোখ মুখ ফুলিয়ে বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলো। বাহার ভাই টা সবসময় বেশি বেশি করে। আজকে বাড়ির সবাই শাহাদাৎ ভাইয়ের গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছে, কই সে তো গেলো না। একমাত্র বাহার ভাই রাগ করবে ভেবেই তো যায় নি। তাছাড়া অবশ্য চাঁদনী আপার কথা ভেবেও সে যায় নি। কিন্তু সে যাই হোক, প্রথম কারণ তো বাহার ভাই। কিন্তু লোকটা তা বুঝলে তো!
ঠিক পাঁচ মিনিট খুব নিরবে অতিবাহিত হলো। দুষ্ট চিত্রা দুষ্টুমি করলো না। ভাব এমন যে, খুব বেশিই মনযোগ দিয়ে ফেলেছে পড়ার টেবিলে। বাহারও চুপ করে চিত্রার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা বোধহয় বেশিই ব্যাথা পেয়েছে নাহয় তো এমন চুপ করে থাকার পাত্রী সে না। তার মাঝেই বাহির থেকে তুমুল শব্দের গান ভেসে এলো। নিরব চিত্রাকে মুহূর্তেই সরব করে দিলো। সে সুন্দর দুই হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গাইতে শুরু করলো,
“দিলবার দিলবার, ও দিলবার দিলবার।”
বাহার হতাশার শ্বাস ফেললো। কপাল চাপড়ে বলে উঠলো,
“একটা কথা আছে না, ময়লা যায়না ধুইলে, স্বভাব যায় না মরলে।”
ঠিক সেই মুহুর্তে পাশের রুম থেকে বেশ শব্দ করেই কিছু পড়ার শব্দ হলো। চিত্রা আচমকাই থমকে গেলো। মাথায় খেলে গেলো চাঁদনী আপার কথা। কোনো অঘটন হলো না তো!
#চলবে,,,,,,
#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
[প্রথম পর্বে রেসপন্সের আশাবাদী। ভালোবাসা নিবেন]