#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১১
আমার ভীষণ রাগ বা অভিমান হলো। আমার এ অনুভূতি ভীষণ চেনা। খুব চিনি আমি তাকে। যখন অথৈয়ের সাথে স্মরণকে দেখতাম, নীরব একটা ব্যাথা হুট করে জুড়ে বসতো মনে। তাকে বুক থেকে টেনে সরিয়ে দিতে কষ্ট হতো। বড্ড বেয়ারা এই ব্যাথা আজও অনুভব করছি।
— এভাবে হাঁটার মানেটা কি?
স্মরণের কন্ঠ। সে পেছন থেকে চাপা রাগ নিয়ে ছুড়ে দিলো কথাটা। আমার ইচ্ছে হলো গগন কপিয়ে কেঁদে উঠতে। প্রিয়া এখনো কিছু না বুঝে সে আমার পিছু ছুটেছে। আমার দু-হাত পরে প্রিয়া, তার দু’হাত পেছনে স্মরণ। আমার পাশে আছে শান্ত।
— প্রিয়ার সাথে ওর ক্রাশের কাছে গেলি। তারপর ওখান থেকে এমন কি হলো দোস্ত? এমনে দৌড়ানি দিছোস ক্যান? ঐ বিলাই ব্যাডা কি তোরে পছন্দ করছে? প্রিয়ারে পছন্দ হয়নি ওর? এখন কি করবি দোস্ত? তুই না বিয়াইত্তা?
শান্তর অনর্গল বলে যাওয়া কথাগুলো বেজায় বিরক্ত করলো আমাকে৷ “আমার বর কেন সিগারেট খাবে” শিরোনামের দুঃখটা বুকে যেন তোলপাড় করছে উপরন্তু শান্ত সংযোগ করে দিচ্ছে ” বিলাই নামের জমাইটা আমাকে ভালোবাসে না রে দোস্ত ” শিরোনামের দুঃখ।
— বিলাইটা আমাকে ভালোবাসে না দোস্ত।
হঠাৎ ভাঙা মনের আর্তনাদ লুকাতে অক্ষম হয়ে বলে উঠলাম কথাটা। শান্ত হাঁটা থমকে দিলো। আমি এগিয়ে গেলাম এবার। আমার প্রায় নিকটে চলে এসেছে প্রিয়া। সে বলল
— দোস্ত, কাহিনী কি? তুই আমার ক্রাশকে চিনিস? কিন্তু ব্যাডা মনে হচ্ছে লুচ্চা বুঝলি? দেখ মনে ধরেছে আমার আর সে তোর মনে জায়গা খুঁজছে। ব্যাডা মানুষ আসলেই খারাপ। শুধু সুন্দর সুন্দর সুন্দর খোঁজে। এই ছেলেকেও বয়কট। মন থেকে টেনে ফেলে দিলাম এখনই।.. কিন্তু কষ্ট হচ্ছে রে। তার স্মার্টনেস!
প্রিয়ার কথা শুনে আমার মাথা ঝিমঝিম ভাব ধরলো। রাগ কিংবা ঈর্ষা চেপে বসলো খুব করে। হাঁটার গতি রোধ করে প্রিয়ার পানে তাকিয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে ধরলাম। শুধু অপেক্ষা ছিলো কিছু বলার। কিন্তু আচমকা সে আমার সুযোগ কেড়ে নিয়ে সুবিধা করে বসলো অন্য কেউ। ঝড়ের বেগে এসে আমার শূন্যে তোলা হাতের আঙ্গুল আলগোছে নিচু করে দিয়ে বলল
— বসায় চলো।
আমি ঠাস করে যেন অবাক হলাম। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখ গোল গোল। কোটরের সাথে বিচ্ছেদ করার যেন ইচ্ছে জেগেছে তার চোখের। ঠিক একই অবস্থা শান্তরও।
— ছোঁয়া ওয়েট করছে বাসায়।
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আজ ‘তুমি ‘ সম্বোধন? তার এমন ব্যাবহার মেনে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে আমার। কিন্তু তবুও মানলাম। হা করে তাকিয়ে থাকা থমকে দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম
— আমার সময় হলে আমি যাবো। আপনি যেতে পারেন।
সে আমার কথার ঘোর বিরোধিতা করলো। আমার নির্দেশ অমান্য করলো অবলীলায়। হেঁচকা টান দিয়ে নিজের পথে পা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— ছোঁয়া বাসায় কান্না করছে।
আমি তাল সামলাতে না পেরে টলমলে পায়ে তার সাথে হাটায় যোগ দিলাম। আর রাগ ক্ষোভ লুকাতে না পেরে প্রিয়ার পানে তাকিয়ে বললাম
— আর কখনো নজর দিবি না বলে দিলাম।
প্রিয়া দূর থেকে বলে উঠলো
— যাহ দিলাম না তোর বুইড়া জামাইয়ের ওপর নজর।
প্রিয়ার কথায় আমি কোনো প্রতিক্রিয়া মুখে ফুটিয়ে তোলার পূর্বেই হঠাৎ স্মরণ বলে উঠলো
— বুইড়াটা কে?
বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠলো। শুনে ফেললো নাকি?
— কে?
খুবই নম্র ও শান্ত কন্ঠের বাণী। আমি প্রিয়ার দাড়িয়ে থাকা জায়গায় তাকালাম। প্রিয়া চলে যাচ্ছে। মেয়েটা ফাঁসিয়ে গেলো আমায়।
— কে?
আমিও সব ছাপাছাপি করে দিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম। স্মরণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তার একটু সময় পর বলল
— আমি বুইড়া জামাই?
আমি যেন যক্ষা রোগী হয়ে গেলাম। খক খক করে আচমকা কাশি উঠলো আমার। সে এক পা বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এক পা পিছিয়ে দূরে সরে গেলাম। সে আরো এক পা বাড়িয়ে দিলো। আমি আরো এক পা পিছিয়ে গেলাম। হৃদপিণ্ড ভেতরে বসে ছোটাছুটি শুরু করে দিলো।
— তোমার পেছনে কি আছে জানো?
এ কথা বলার মাঝেই সে আরো দুকদম আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পিছিয়ে গেলাম। অতঃপর বললাম
— কি?
— সমুদ্র।
আমি ভাবতে বসলাম, সমুদ্রে এসেছি। আমাকে ঘিরে সমুদ্রই থাকার কথা। এই যে এখন আমার পায়ের পাতায় সমুদ্রের নোনা পানির আনাগোনা চলছে। কিন্তু এটা আবার প্রশ্ন বানিয়ে আমাকে করার উদ্দেশ্য কি? আমি আঁচ করতে পারলাম না তার উদ্দেশ্য। গভীর করে ভাবতেই লাগলাম শুধু। এরই মাঝে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। চড়ুই পাখির মতো আত্মা যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে চাইলো। স্মরণ হঠাৎ ধাক্কা দিলো আমাকে। স্মরণের অবিশ্বাস্য কান্ডে আমি হতবাক, হতবুদ্ধি। বাঁচার জন্য প্রচেষ্টা করে খপ করে ধরতে চাইলাম কিছু। বন্ধ চোখ খোলার সাহস পেলাম না। কিছুই ধরতে পারলাম না। স্মরণের হাতের নাগাল পাইনি। ঠাস করে হয়তো পরছিলাম। ভেবেছিলাম যাহ! আমি শেষ। সাতার না জানা আমির জীবনটা আজ ইতি হয়ে যাবে নিষ্ঠুর মানুষটার জন্য। কিন্তু অবাক করা কান্ড হলো না। স্মরণ ধরে ফেলল আমাকে। এক হাতে শক্ত করে আমার হাতটা ধরলো। আমি চোখ খুলে তাকালাম। চোখে রাজ্যের ভয়, বিষ্ময় নিয়ে তাকাতেই সে বলে উঠলো
— ছেড়ে দিলে কেমন হবে?
আমি হাশফাশ করে বলে উঠলাম
— দেবেন কেন? আশ্চর্য?
— বুইড়া বলার অপরাধে।
— আপনি কি খুব ইয়াং মনে করেন নিজেকে? মোটেও কিন্তু আপনি অঙ্কনের মতো না। ছয় বছরের একটা বাচ্চার বাবা আপনি। তো বুড়ো হননি?
স্মরণের কপালে ভাজ পরলো। চোখে রাগের অস্তিত্ব। আমি মনে পুষে রাখা রাগ নিয়ে মুচকি হেঁসে তার হাতের ওপর দু’হাত রেখে একটা হেঁচকা টান দিলাম। ঝপাৎ করে সে পরলো পানির মধ্যে। আমিও বাকি রইলাম না। আমিও পানির মধ্যে নাকানিচুবানি খেতে লাগলাম। তবে আফসোস নেই। প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। গলা উঁচিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললাম
— টিট ফর ট্যাট ছোঁয়ার বাবা। আইয়াম নট লাইক আলাভোলা। মাঝে মাঝে হতে পারি বেয়ারা।
স্মরণ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বলল
— ননসেন্স।
বেশ চিৎকার করে বলল। আমি তার কথার বিপরীতে হেসে উঠলাম। সে আমার খুব নিকটেই ছিলো। আমি সাঁতার না জানার দরুন প্রায় বিপদের মুখে এগোচ্ছিলাম। এক হাতে স্মরণের হাত ধরলাম বহু ভেবে চিন্তে। স্মরণ এক ঝটকায় আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই আমি নত সুরে বললাম
— আমি সাঁতার জানি না।
সে আর কিছু বলল না।
.
ভেজা কাপড় নিয়ে কাঠফাটা রোদের মাঝে দাড়িয়ে আছি। এখন নিজেকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছে। আশপাশের মানুষের নজরে পরতে অসুবিধা হচ্ছে না। সবার দৃষ্টিতে অদ্ভুত কিছু ফুটে উঠছে। স্মরণ আমার কাছেই দাড়িয়ে ছিলো। যখন কেউ ডান দিয়ে যাচ্ছে আমি স্মরণের বাম দিকে গিয়ে একটু ওত পাতার চেষ্টা করছি। একই ভাবে বাম দিক দিয়ে গেলে ডান দিকে চলে যাচ্ছি আমি। স্মরণ আমার এমন কান্ড প্রায় পাঁচ মিনিট সহ্য করলো নীরবে। অতঃপর বলল
— সমস্যা কি?
— মানুষ। ভেজা শাড়ি।
— সমুদ্রে ডুব দেওয়ার আগে মনে ছিলো না এই কথা?
আমি জড়সড় হয়ে গেলাম। বললাম
— আপনার শার্টটা খুলে আমাকে দিলেও তো পারেন।
আমার এই বাক্যটা শেষ হতেই স্মরণ কেমনতর একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার প্রতি। বলল
— পাগল নাকি? আমি কি পরবো।
আমি ধমক হজম করে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। যদিও জায়গাটা মোটামুটি নির্জন। কিন্তু দর্শনীয় স্থান। প্রায় সব জায়গাতেই মানুষের আনাগোনা। এমন একটা ঝামেলা মাথায় নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হলো আমি ক্ষুদার্ত। স্মরণের পানে একবার দৃষ্টি রাখলাম। সে হাতে ফোন নিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে। একটু গাঢ় নজর দিয়ে দেখলাম আই ফোন। নষ্ট হয়নি। কিন্তু আমার টাকা ব্যাগ সব সমুদ্রের মাঝে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নিজের জন্য নিজেই সমবেদনা প্রকাশ করলাম।
— এখানে কোথায় এসেছিলেন?
হঠাৎ স্মরণ প্রশ্ন করে বসলো। আমি তার হাতের ফোনের দিকেই নজর রেখে বললাম
— ফ্রেন্ড’দের সাথে ঘুরতে এসেছিলাম।
— মেয়েটা কে?
— প্রিয়া।
— ওহ।
এরপর হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর আমি জানতে চাইলাম
— আপনি কোথায় এসেছিলেন?
হঠাৎ যেন স্মরণের মুখে গাম্ভীর্য ভর করলো। আমি উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলাম। সে সময় নিয়ে বলল
— আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি স্মরণের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। লোকটা এমন কেন? ভাবনা কালেই সে হাতের ফোনটা উঁচু করে ধরলো আমার চোখের সম্মুখে৷ কেউ ফোন করেছে। একটু ভালোভাবে পরখ করলে দেখা যায় ছোঁয়ার ছবি ভাসছে। মানে বুঝলাম ছোঁয়ার কল এসেছে। স্মরণ বড়সড় একটা হাফ ছাড়লো। বলল
— এখন বাজে ঠিক দুপুর তিনটা। ছোঁয়ার স্কুল ছুটি হয় সাড়ে বারোটায়। এসেই আপনার জন্য কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা হলো আপনাকে খুঁজছি।
আমি চমকে উঠলাম। বলার কোনো ভাষা আমি খুঁজে পেলাম না। স্মরণ আবারও বলল
— মেয়েটা আর আমার রাখলেন না।
স্মরণের এ কথায় যেন স্পষ্ট অভিমান ঝড়ে পরলো
চলবে….#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১১
আমার ভীষণ রাগ বা অভিমান হলো। আমার এ অনুভূতি ভীষণ চেনা। খুব চিনি আমি তাকে। যখন অথৈয়ের সাথে স্মরণকে দেখতাম, নীরব একটা ব্যাথা হুট করে জুড়ে বসতো মনে। তাকে বুক থেকে টেনে সরিয়ে দিতে কষ্ট হতো। বড্ড বেয়ারা এই ব্যাথা আজও অনুভব করছি।
— এভাবে হাঁটার মানেটা কি?
স্মরণের কন্ঠ। সে পেছন থেকে চাপা রাগ নিয়ে ছুড়ে দিলো কথাটা। আমার ইচ্ছে হলো গগন কপিয়ে কেঁদে উঠতে। প্রিয়া এখনো কিছু না বুঝে সে আমার পিছু ছুটেছে। আমার দু-হাত পরে প্রিয়া, তার দু’হাত পেছনে স্মরণ। আমার পাশে আছে শান্ত।
— প্রিয়ার সাথে ওর ক্রাশের কাছে গেলি। তারপর ওখান থেকে এমন কি হলো দোস্ত? এমনে দৌড়ানি দিছোস ক্যান? ঐ বিলাই ব্যাডা কি তোরে পছন্দ করছে? প্রিয়ারে পছন্দ হয়নি ওর? এখন কি করবি দোস্ত? তুই না বিয়াইত্তা?
শান্তর অনর্গল বলে যাওয়া কথাগুলো বেজায় বিরক্ত করলো আমাকে৷ “আমার বর কেন সিগারেট খাবে” শিরোনামের দুঃখটা বুকে যেন তোলপাড় করছে উপরন্তু শান্ত সংযোগ করে দিচ্ছে ” বিলাই নামের জমাইটা আমাকে ভালোবাসে না রে দোস্ত ” শিরোনামের দুঃখ।
— বিলাইটা আমাকে ভালোবাসে না দোস্ত।
হঠাৎ ভাঙা মনের আর্তনাদ লুকাতে অক্ষম হয়ে বলে উঠলাম কথাটা। শান্ত হাঁটা থমকে দিলো। আমি এগিয়ে গেলাম এবার। আমার প্রায় নিকটে চলে এসেছে প্রিয়া। সে বলল
— দোস্ত, কাহিনী কি? তুই আমার ক্রাশকে চিনিস? কিন্তু ব্যাডা মনে হচ্ছে লুচ্চা বুঝলি? দেখ মনে ধরেছে আমার আর সে তোর মনে জায়গা খুঁজছে। ব্যাডা মানুষ আসলেই খারাপ। শুধু সুন্দর সুন্দর সুন্দর খোঁজে। এই ছেলেকেও বয়কট। মন থেকে টেনে ফেলে দিলাম এখনই।.. কিন্তু কষ্ট হচ্ছে রে। তার স্মার্টনেস!
প্রিয়ার কথা শুনে আমার মাথা ঝিমঝিম ভাব ধরলো। রাগ কিংবা ঈর্ষা চেপে বসলো খুব করে। হাঁটার গতি রোধ করে প্রিয়ার পানে তাকিয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে ধরলাম। শুধু অপেক্ষা ছিলো কিছু বলার। কিন্তু আচমকা সে আমার সুযোগ কেড়ে নিয়ে সুবিধা করে বসলো অন্য কেউ। ঝড়ের বেগে এসে আমার শূন্যে তোলা হাতের আঙ্গুল আলগোছে নিচু করে দিয়ে বলল
— বসায় চলো।
আমি ঠাস করে যেন অবাক হলাম। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখ গোল গোল। কোটরের সাথে বিচ্ছেদ করার যেন ইচ্ছে জেগেছে তার চোখের। ঠিক একই অবস্থা শান্তরও।
— ছোঁয়া ওয়েট করছে বাসায়।
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আজ ‘তুমি ‘ সম্বোধন? তার এমন ব্যাবহার মেনে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে আমার। কিন্তু তবুও মানলাম। হা করে তাকিয়ে থাকা থমকে দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম
— আমার সময় হলে আমি যাবো। আপনি যেতে পারেন।
সে আমার কথার ঘোর বিরোধিতা করলো। আমার নির্দেশ অমান্য করলো অবলীলায়। হেঁচকা টান দিয়ে নিজের পথে পা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— ছোঁয়া বাসায় কান্না করছে।
আমি তাল সামলাতে না পেরে টলমলে পায়ে তার সাথে হাটায় যোগ দিলাম। আর রাগ ক্ষোভ লুকাতে না পেরে প্রিয়ার পানে তাকিয়ে বললাম
— আর কখনো নজর দিবি না বলে দিলাম।
প্রিয়া দূর থেকে বলে উঠলো
— যাহ দিলাম না তোর বুইড়া জামাইয়ের ওপর নজর।
প্রিয়ার কথায় আমি কোনো প্রতিক্রিয়া মুখে ফুটিয়ে তোলার পূর্বেই হঠাৎ স্মরণ বলে উঠলো
— বুইড়াটা কে?
বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠলো। শুনে ফেললো নাকি?
— কে?
খুবই নম্র ও শান্ত কন্ঠের বাণী। আমি প্রিয়ার দাড়িয়ে থাকা জায়গায় তাকালাম। প্রিয়া চলে যাচ্ছে। মেয়েটা ফাঁসিয়ে গেলো আমায়।
— কে?
আমিও সব ছাপাছাপি করে দিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম। স্মরণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তার একটু সময় পর বলল
— আমি বুইড়া জামাই?
আমি যেন যক্ষা রোগী হয়ে গেলাম। খক খক করে আচমকা কাশি উঠলো আমার। সে এক পা বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এক পা পিছিয়ে দূরে সরে গেলাম। সে আরো এক পা বাড়িয়ে দিলো। আমি আরো এক পা পিছিয়ে গেলাম। হৃদপিণ্ড ভেতরে বসে ছোটাছুটি শুরু করে দিলো।
— তোমার পেছনে কি আছে জানো?
এ কথা বলার মাঝেই সে আরো দুকদম আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পিছিয়ে গেলাম। অতঃপর বললাম
— কি?
— সমুদ্র।
আমি ভাবতে বসলাম, সমুদ্রে এসেছি। আমাকে ঘিরে সমুদ্রই থাকার কথা। এই যে এখন আমার পায়ের পাতায় সমুদ্রের নোনা পানির আনাগোনা চলছে। কিন্তু এটা আবার প্রশ্ন বানিয়ে আমাকে করার উদ্দেশ্য কি? আমি আঁচ করতে পারলাম না তার উদ্দেশ্য। গভীর করে ভাবতেই লাগলাম শুধু। এরই মাঝে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। চড়ুই পাখির মতো আত্মা যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে চাইলো। স্মরণ হঠাৎ ধাক্কা দিলো আমাকে। স্মরণের অবিশ্বাস্য কান্ডে আমি হতবাক, হতবুদ্ধি। বাঁচার জন্য প্রচেষ্টা করে খপ করে ধরতে চাইলাম কিছু। বন্ধ চোখ খোলার সাহস পেলাম না। কিছুই ধরতে পারলাম না। স্মরণের হাতের নাগাল পাইনি। ঠাস করে হয়তো পরছিলাম। ভেবেছিলাম যাহ! আমি শেষ। সাতার না জানা আমির জীবনটা আজ ইতি হয়ে যাবে নিষ্ঠুর মানুষটার জন্য। কিন্তু অবাক করা কান্ড হলো না। স্মরণ ধরে ফেলল আমাকে। এক হাতে শক্ত করে আমার হাতটা ধরলো। আমি চোখ খুলে তাকালাম। চোখে রাজ্যের ভয়, বিষ্ময় নিয়ে তাকাতেই সে বলে উঠলো
— ছেড়ে দিলে কেমন হবে?
আমি হাশফাশ করে বলে উঠলাম
— দেবেন কেন? আশ্চর্য?
— বুইড়া বলার অপরাধে।
— আপনি কি খুব ইয়াং মনে করেন নিজেকে? মোটেও কিন্তু আপনি অঙ্কনের মতো না। ছয় বছরের একটা বাচ্চার বাবা আপনি। তো বুড়ো হননি?
স্মরণের কপালে ভাজ পরলো। চোখে রাগের অস্তিত্ব। আমি মনে পুষে রাখা রাগ নিয়ে মুচকি হেঁসে তার হাতের ওপর দু’হাত রেখে একটা হেঁচকা টান দিলাম। ঝপাৎ করে সে পরলো পানির মধ্যে। আমিও বাকি রইলাম না। আমিও পানির মধ্যে নাকানিচুবানি খেতে লাগলাম। তবে আফসোস নেই। প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। গলা উঁচিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললাম
— টিট ফর ট্যাট ছোঁয়ার বাবা। আইয়াম নট লাইক আলাভোলা। মাঝে মাঝে হতে পারি বেয়ারা।
স্মরণ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বলল
— ননসেন্স।
বেশ চিৎকার করে বলল। আমি তার কথার বিপরীতে হেসে উঠলাম। সে আমার খুব নিকটেই ছিলো। আমি সাঁতার না জানার দরুন প্রায় বিপদের মুখে এগোচ্ছিলাম। এক হাতে স্মরণের হাত ধরলাম বহু ভেবে চিন্তে। স্মরণ এক ঝটকায় আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই আমি নত সুরে বললাম
— আমি সাঁতার জানি না।
সে আর কিছু বলল না।
.
ভেজা কাপড় নিয়ে কাঠফাটা রোদের মাঝে দাড়িয়ে আছি। এখন নিজেকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছে। আশপাশের মানুষের নজরে পরতে অসুবিধা হচ্ছে না। সবার দৃষ্টিতে অদ্ভুত কিছু ফুটে উঠছে। স্মরণ আমার কাছেই দাড়িয়ে ছিলো। যখন কেউ ডান দিয়ে যাচ্ছে আমি স্মরণের বাম দিকে গিয়ে একটু ওত পাতার চেষ্টা করছি। একই ভাবে বাম দিক দিয়ে গেলে ডান দিকে চলে যাচ্ছি আমি। স্মরণ আমার এমন কান্ড প্রায় পাঁচ মিনিট সহ্য করলো নীরবে। অতঃপর বলল
— সমস্যা কি?
— মানুষ। ভেজা শাড়ি।
— সমুদ্রে ডুব দেওয়ার আগে মনে ছিলো না এই কথা?
আমি জড়সড় হয়ে গেলাম। বললাম
— আপনার শার্টটা খুলে আমাকে দিলেও তো পারেন।
আমার এই বাক্যটা শেষ হতেই স্মরণ কেমনতর একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার প্রতি। বলল
— পাগল নাকি? আমি কি পরবো।
আমি ধমক হজম করে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। যদিও জায়গাটা মোটামুটি নির্জন। কিন্তু দর্শনীয় স্থান। প্রায় সব জায়গাতেই মানুষের আনাগোনা। এমন একটা ঝামেলা মাথায় নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হলো আমি ক্ষুদার্ত। স্মরণের পানে একবার দৃষ্টি রাখলাম। সে হাতে ফোন নিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে। একটু গাঢ় নজর দিয়ে দেখলাম আই ফোন। নষ্ট হয়নি। কিন্তু আমার টাকা ব্যাগ সব সমুদ্রের মাঝে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নিজের জন্য নিজেই সমবেদনা প্রকাশ করলাম।
— এখানে কোথায় এসেছিলেন?
হঠাৎ স্মরণ প্রশ্ন করে বসলো। আমি তার হাতের ফোনের দিকেই নজর রেখে বললাম
— ফ্রেন্ড’দের সাথে ঘুরতে এসেছিলাম।
— মেয়েটা কে?
— প্রিয়া।
— ওহ।
এরপর হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর আমি জানতে চাইলাম
— আপনি কোথায় এসেছিলেন?
হঠাৎ যেন স্মরণের মুখে গাম্ভীর্য ভর করলো। আমি উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলাম। সে সময় নিয়ে বলল
— আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি স্মরণের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। লোকটা এমন কেন? ভাবনা কালেই সে হাতের ফোনটা উঁচু করে ধরলো আমার চোখের সম্মুখে৷ কেউ ফোন করেছে। একটু ভালোভাবে পরখ করলে দেখা যায় ছোঁয়ার ছবি ভাসছে। মানে বুঝলাম ছোঁয়ার কল এসেছে। স্মরণ বড়সড় একটা হাফ ছাড়লো। বলল
— এখন বাজে ঠিক দুপুর তিনটা। ছোঁয়ার স্কুল ছুটি হয় সাড়ে বারোটায়। এসেই আপনার জন্য কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা হলো আপনাকে খুঁজছি।
আমি চমকে উঠলাম। বলার কোনো ভাষা আমি খুঁজে পেলাম না। স্মরণ আবারও বলল
— মেয়েটা আর আমার রাখলেন না।
স্মরণের এ কথায় যেন স্পষ্ট অভিমান ঝড়ে পরলো
চলবে….