#শেষ_বিকেল_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_২
মাঝের একটা দিন দ্রুতই চলে গেলো। সময় হয়ে এলো উনার যাওয়ার। আজ বিকেলেই তার ফ্লাইট। সন্ধ্যা সাতটায়। ছোঁয়াকে দেখলাম খুব কাদলো তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। প্রত্যহ তার বাবা চলে যাওয়ার পূর্বে সে চোখ ভিজিয়ে বিদায় দেয় বাবাকে। এবারও নাকি তার বত্যায় ঘটলো না। তবে ঘটলো এর চাইতে একটু বেশি কিছু। আচমকাই এবার ছোঁয়া জেদ তুলল সে তার বাবার সাথে যাবে। স্মরণ অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। ছোঁয়ার জেদ ক্রমে ক্রমে বাড়তেই লাগলো। আমি তখন ড্রইং রুমে নিশ্চুপ একপ্রান্তে দাড়িয়ে। বাবা ছোয়াকে বোঝাতে গেলে শুনতে হলো
” দাদু, আমি বাবার সাথে যাবোই যাবো। এই আন্টিকে আমার ভালো লাগে না। ”
আমি তাকে কাছে ডাকতে চেয়েও এমন উক্তির পর আর ডাকিনি। তোষামোদ করতে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয়? কেন যে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আদোতেই আমাকে মেনে নিতে পারে না তা আমার সত্যিই অজানা। তার ছোট হৃদয় যেন ভুলেও চায় না আমাকে তার মায়ের জায়গা দিতে। ভাবনা যখন গাঢ় হচ্ছিল আমার ঠিক এমন সময় বাবা বলে উঠে
” স্মরণ, ছোঁয়াকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাও। খেয়ার সাথে যাক। আবার গাড়িতে করে ওরা ফিরে আসবে। ”
কথাটা শুনেই ইষত চমকে উঠেছিলাম আমি। আচমকা যখন তাকালাম স্মরণের দিকে তখন তারও দৃষ্টিতে আমি বাঁধা পরে ছিলাম। সেকেন্ড সময়ের মতো একবার চোখাচোখি তখন ছিলো অবশ্যপ্রাপ্ত।
.
— মা, আমি তাহলে আসি?
এয়ারপোর্টের মেইন দরজা হতে একটু দূরে দাড়িয়ে ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে বলল স্মরণ। ছোঁয়ার মুখটাতে মন খারাপের সন্ধি গুলো গাঢ় হলো। ফুটে উঠলো তারা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে। স্মরণ মেয়ের কপালে ছোট একটা চুমু দিয়ে সম্মুখ পথ ধরলো। সেখানে যদিওবা আমি উপস্থিত ছিলাম কিন্তু তা গণ্য করা হলো না। আমার কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই এমন এক ভাবনা মনে জায়গা দিয়ে স্মরণ চলে গেলো। আমি উন্মুক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার পানে। একহাতে ধরে রাখালম ছোঁয়ার হাত। অবশেষে বাসায় বাবর সাথে একঝাঁক তর্ক আর বিতর্ক করে চরম অনিচ্ছা নিয়ে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে আসে স্মরণ। আমি যে ভীষণ ইচ্ছুক ছিলাম আসতে তেমন কিছুও না। নেহায়েত বাবার কথা আর কিছু অভ্যাসের দরুন আসা। যে মেয়ে অন্যের বাড়িতে খেয়ে পরে বেড়ে ওঠে তার কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই। দীর্ঘ এক নিশ্বাস কে মুক্তি দিয়ে ক্ষত হৃদয় নিয়ে সামনের পথে চাইলাম। স্মরণ যাওয়ার পথে বারংবার চাইছে মেয়ের পানে। কেবল যেন সে দেখছে না আমাকেই। ঠিক অবহেলায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ আমার মন শুধালো আমাকে আমি কি তার থেকে ভালোবাসা চাই? তার সাথে সংসার করতে চাই? প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরগুলো রইলো ধোঁয়াসার চাদরে মোড়ানো।
— আন্টি বাসায় যাই চলো।
সময়টা যেন তব্দায় কাটলো। ছোঁয়ার ডাকে নড়েচড়ে উঠলাম। মলিন একটা হাসি ঠোঁটে নিয়ে বললাম
— চলো।
বলেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলাম। ছোট মিষ্টি মুখটা তখন অবাক হলো। হঠাৎই ধমকে উঠে বলল আমাকে
— কোলে নিলে কেনো তুমি? আমি কি উঠতে চেয়েছি?
আমি কখনো তার কর্নকান্ডে ক্ষুব্ধ হতে পারিনি। এবারও হতে পারলাম না। বললাম মিষ্টি করে
— কেন? মা কি মেয়েকে কোলে নিতে পারে না?
— তুমি আমার মা? তোমাকে তো আমার মায়ের মতো লাগে না। আমার মা অনেক দূরে। ঐ মাটির নিচে শুয়ে আছে।
হন্টন দশায় ছোট মেয়েটার কথা কর্ণকুহরে পৌছাতেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো। তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারলাম না। আমারও যে মনে পড়ে গেলো মায়ের কথা।
— তুমি কিন্তু চাইলে আমাকে মা বলতে পারো।
ছোঁয়া কে পুনরায় স্বাভাবিক দশায় ফিরে আনতে একথা বলতেই সে জবাব দিলো
— ভেবো দেখবো।
আমি তার এমন অপটু মুখের পাকা কথা শুনে হাসলাম খানিক। ভীষণ চালাক। কার মতো হয়েছে এই মেয়ে? ওর মায়ের মতো? নাকি ওর বাবার মতো?
ভাবতে ভাবতেই আরো কিছু গল্প হলো ছোঁয়ার সাথে। বাসায় আাসার পুরোটা পথ জুড়ে সে হঠাৎই আমার সাথে বড্ড সহজ হয়ে গেলো। কথায় কথায় বলে ফেলল
— তোমাকে আমি আন্টি বলেই ডাকবো এখন। তুমি না এতটুকু ভালো তাই। আর যখন তুমি এত্তগুলো ভালো হবে তখন আমি তোমাকে মা ডাকবো। বুঝলে?
আমি মৃদু শব্দে না হেঁসে পারিনি।
.
— আন্টি কাল আমাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবে? বাবা না আমাকে বেশি কোথাও নিয়েই যায় না।
বেলকনিতে বসে রাতের আঁধারের পানে তাকিয়ে ছিলাম। ছোঁয়া আমার কোলে বসা ছিলো। তার হাতের মুঠোয় ফোন। স্মরণের ফোনের অপেক্ষায় সে। তার বাবা পৌছে তাকে নাকি ভিডিও কল করবে। অতঃপর সে ঘুমোবে। এর আগে একটুও না।
— কোথায় যাবে?
— তুমি যেখানে নিয়ে যাবে। আমরা কিন্তু আইসক্রিম খাবো আন্টি। ঠিক আছে?
প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই আচমকা ছোঁয়ার হাতের ফোন বেজে উঠলো। আনন্দ যেন এসময় আর ধরে না তার মনে। সে কোল থেকে নেমে নেলে ছুটে গেলো ঘরের বাইরে। আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। সে সোজা চলে এসেছে বাবার ঘরে। ততক্ষণে ফেন ধরা হয়েছে। তিনজনেই যখব মেতে উঠলো কথার আসরে তখন আমি দূর হতেই চলে এলাম। মানুষের জীবন কি বিচিত্রময়। চেয়েছিলাম শুধু একটা ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু পেয়েছি ভালো রাখার মানুষ। যে আমাকে বলেছে টাকা দিয়ে জীবনের পথ খুঁজে দেবে, ভালো থাকার ব্যাবস্থা করবে। কিন্তু আমাকে ভালোবাসবে না।
— বাবা জানো? ঐ আন্টিটা না এইটুকু ভালো। আমাকে আজকে অনেক কিছু রান্না করে খাইয়েছে।
ফিরে আসার পথে ছোঁয়ার কন্ঠ কানে এলো। এরপর ভীষণ ইচ্ছে হলো ওপাশের মানুষটার মন্তব্য শোনার। কিন্তু তা আর সাধ হলেও সাধ্য হলো না।
.
রক্তিমা আকাশে সূর্য উঁকি দিলো বলে। পাখির কন্ঠ কানে ধরা দিলো। কি যেন এক সুবাসের আনাগোনা বাতাসে। এমন একটা ক্ষেত্রেই ঘুম ছুটে গেলো আমার। চোখ খুলে প্রথমেই দৃষ্টি ছুটে গেলো জানালার দিকে। এক চিলতে মৃদু তেজের সূর্য রশ্মি উঁকি দিয়েছে আমার ঘরে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে চাইতে অনুভব করলাম আমি এক মূর্ছিত বাঁধনে আবদ্ধ। খুবই হালকা এক বাঁধন। কে আমাকে এমন দূর্বল বাঁধনে বাঁধলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাশে দৃষ্টি দিতেই দেখি ছোঁয়া ঘুমের মাঝে আমাকে বেঁধে রেখেছে তার ছোট হাত দিয়ে। নিজের খামখেয়ালি পনায় একটু বিরক্ত হলাম আমি। কাল ঘরে এসে কখন ঘুমিয়ে গেছি কে জানে? ছোয়ার কথা খেয়ালেই ছিলো না। কিন্তু এখন তো আমার উঠতে হবে৷ ফজরের নামাজটাও হঠাৎ কাযা হয়ে গেলো। ভাবনার অন্তরালে ডুবে গিয়ে ছোঁয়ার হাত থেকে মুক্ত হলাম। এবারে যখনই না বিছানা থেকে নামতে যাবো ঠিক তখনই দরকল্পনা ভাবে শুনতে পেলাম কেউ ডাকছে
— ছোঁয়া, ছোঁয়া? মা ঘুম থেকে উঠেছো? আম্মু?
আমার চোখ চরক গাছ হলো। ছোঁয়ার হাতের নিচে পরে থাকা ফোন হলো এই কন্ঠের উৎস। তারা বাবা মেয়ে কি সারারাত ফোনের সংযোগ রেখেই ঘুমিয়েছে?
— এই ছোঁয়া? মা, শুনছো?
আবারও ডাক এলো। ছোঁয়া ঘুমের সাথে বেশ করে সন্ধি করেছে। আমার এবার অজান্তে অদ্ভুত এক ইচ্ছে হলো। বেমানান এক কান্ড ঘটাতে মন চাইলো। নিরন্তর বাধাহীন ছুটে চলা মন চাইলো,
ইশ! আমার যদি এমন মিষ্টি একটা সংসার থাকতো? কত মিষ্টি না তারা? বাবা তার মেয়েকে এতোটা ভালোবাসে! ছোঁয়া নিশ্চয়ই বায়না করেছিলো অডিও ফোন কলে থাকতে। সে থেকেই স্মরণ ফোনের সংযোগ গোটা রাত নিরবচ্ছিন্ন রেখেছে। সে কি ঘুমিয়েছিলো? ভাবনা নিয়েই বিছানার ফোন উঠিয়ে কানের পাশে ধরে বললাম
— ছোঁয়া ঘুমোচ্ছে। আমি একটু পর ওকে ডেকে তুলে নাস্তা করিয়ে দেবো। আপনি চিন্তা করবেন না।
চলবে……
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্প দিতে লেইট সরি। কিন্তু হয়তো বেশিরভাগ এমন সময়েই গল্প দিতে হবে 🥲)