#শুচিস্মিতা -১১
Tahrim Muntahana
~ বিয়েতে যাবো না কেন আম্মা। ওরা কি ভাববে?
ফাতিনের কথায় মিসেস সেলিনা চুপ রইলেন। তার মনে হচ্ছে বিয়েতে গেলে আনতারা’র সাথে ফাতিন কথা বলবে। তিনি চাইছিলেনই না ফাতিন আসুক। অথচ ছেলে টা তাকে না জানিয়েই বিয়ের আগের দিন চলে এলো। এখন আবার বিয়েতে যাবে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে!
~ আমি তোমারে আনতারা’র থেকে দূরে থাকতে কইছিলাম ফাতিন। আমার কসমের কোনো দাম নাই তোমার কাছে?
ফাতিনের বুঝ এলো কেন তার মা তাকে বারণ করছিলেন। মন টা আবার ভেঙে গেল তার। মা তাকে বিশ্বাস করছে না? একটা মেয়েকে ভালবেসে মায়ের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে সে? বললো,
~ তোমার আগে কেউ না আম্মা। আমি আনতারা’কে চাওয়ার আশা সেদিনই ছেড়ে দিয়েছি। আমার মনের কথা তুমি ছাড়া কেউ জানতে পারবে না, আনতারা’ও না! এবার একটু সবার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে দাও। নাহলে বলো এখনি ঢাকার দিকে রওনা হচ্ছি!
গাঢ় অভিমান টের পেলেন মিসেস সেলিনা। তার আগে কেউ না শুনে খুশিও হলেন আকাশ ছোঁয়া। বললেন,
~ যাও যাও রেডি হও, গাড়ি আইসা পড়ছে।আমি দেইখা আসি আনতারা রেডি হইলো কিনা!
ফাতিন সায় জানিয়ে রেডি হতে গেল। মিসেস সেলিনা চললেন আনতারা’র রুমের দিকে। মেয়েটার সাথে অযহত এতদিন দুরত্ব রেখেছে সে, যেখানে দোষ মেয়েটার না। আনতারা একা একাই তৈরি হচ্ছিল, মিসেস কামরুন্নাহার বিয়ে বাড়িতে কাজের উপর রয়েছে। মিসেস সেলিনা ঘরে ঢুকেই বললেন,
~ এখনো রেডি হয়নি? দেখি কি পড়ছস! এটা না, ছাই রঙের একটা ফ্রক আছে না? ওইটা পড়ে আয়, যা যা!
বড় চাচির পরিবর্তনে আনতারা কষ্ট পেলেও চুপ ছিলো, কোনো প্রশ্নই করেনি। আজ এমন ব্যবহারে আনতারা’র মনে খুশিরা হানা দিলো। কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করে চাচি কথা মতো ড্রেস পড়ে আসলো। মিসেস সেলিনা মেয়েটার খুশি টের পেলেন, একটু বেশীই খারাপ লাগলো তার। খুশিটা আরেকটু বেশী করে দিয়ে নিজের ঘর থেকে একটা জুয়েলারি বক্স আনলেন। হিজাব পড়ার আগেই তিলক টা পড়িয়ে দিয়ে নিজ হাতে সুন্দর করে হিজাব টা পড়িয়ে দিলেন, আনতারা’র চোখ কেমন চিকচিক করে উঠলো। তবে লজ্জায় আর জড়িয়ে ধরতে পারলো না। নৌজপিন ও পড়িয়ে দিলেন। মিসেস কামরুন্নাহার হাতের কাজ সেরে আনতারা’র কাছে এসেছে রেডি করাতে, এসেই এমন দৃশ্য দেখে তার মন আচমকাই ভালো হয়ে গেল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
~ মাশাআল্লাহ আমার মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে!
মিসেস সেলিনা’ও একটু গাঢ় করে পরখ করলেন, সত্যিই অপূর্ব লাগছে! দুই জা ই হেসে আনতারা কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছিলো ফাতিন’রা, ফারাহ, কেয়া একটু আগেই তৈরি হয়ে বসেছে। আনতারা কে দেখে ফাতিন থমকালো! কিছুক্ষণ পলকহীন দেখে গেল, হঠাৎ করেই যখন মায়ের কথা মনে পড়লো, জোর করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। বুকে ঘা হলো, তবে প্রতিষেধক নেই! মিসেস কামরুন্নাহার ফারাহ কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
~ বোন দের দেখে রেখো ফারাহ! অপরিচিত বাড়ি কাছ ছাড়া করবে না। কিরণ সর্বক্ষণ ছোট আপায়ের হাত ধরে থাকবে। কথার নডচড় যেন না হয়!
সবাই বাধ্যগত সন্তানের মতো মাথা নাড়ালো। মিসেস কামরুন্নাহার হেসে ফাতিনের দিকে তাকালেন, ছেলেটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষন্ন হয়ে গেল মন, তিনি একটু হলেও জানেন তো! মিসেস সেলিনা চিন্তিত স্বরে বললেন,
~ তুই গেলেই ভালো হইতো নাহার। গুরুজন থাকলে ভালো হইতো!
~ না গো বড়ভাবী, এখন কি আর সেই বয়স আছে? ফাতিন, রাশিদ, নিয়ন তো আছে। ওরা সামলে নিবে চিন্তা করো না!
মিসেস সেলিনা মাথা নাড়ালেন। ফাতিন সবার আগে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে, এক অটো তে তারাই যাবে তাই কোনো সমস্যা হবে না আনতারা’র। আনতারা’র সমস্যার কথা ভাবছে দেখে ফাতিন নিজের উপরই হাসলো!
~ তোকে পাবো বলে ভালোবেসেছিলাম, তবে জানতাম না কৃষ্ণমায়া আঁধার বেশী ভালোবাসে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে যে!
…
~ আনতারা কে একটু এদিকে আসো না!
কনের কথায় আনতারা’র কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার নাম বলছে? অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে, এমন সময় টের পেল তার হাত কারো মুঠোয়। ঝট করে হাতের দিকে তাকালো , এক নিমিষেই বুঝে ফেললো হাতের মালিক তার মনকুঠিরে থাকা প্রিয়জন! ততক্ষণে রাশিদ হাত ধরে হাঁটা শুরু করেছে। ঝিনুকের সামনে দাঁড় করাতেই ঝিনুক কাছে টেনে নিলো আনতারা’কে। দ্বিধান্বিত নজরে রাশিদের দিকে তাকালো আনতারা। রাশিদ বুঝতে পারলো,
~ ঝিনুক, কি করছিস? তোকে বলেছিলাম আনতারা এসবে অভ্যস্থ নয়!
~ ইশশ সরি ভাইয়া। আমি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম। যাই হোক তুমিই কিন্তু আমার জা হবে।
আস্তে আস্তে বলায় কেউ টের পেল না তিনজনের মধ্যে কি চলছে। রাশিদ আরো কিছুক্ষণ পর আনতারা কে নিয়ে লোক সমাগমের বাইরে এলো। মেয়েটা হাঁসফাঁস করছিলো। জোরে শ্বাস নিয়ে আনতারা বলে উঠলো,
~ আপনি সবাই কেই বলে বেড়িয়েছেন এসব?
রাগ টের পেল না রাশিদ, তাই সেসবে কান ও দিলো। বলে উঠলো,
~ সামনে সুন্দর একটা পুকুর আছে যাবে?
~ চলেন!
রাশিদ যেন এই আঁধার রাতেই আকাশে বিশাল চাঁদ দেখতে পাচ্ছে, আনতারা’র কথাগুলো শুনে। মেয়েটা যাবে? প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিলো? অবাক হয় রাশিদ, আনতারা আর কিছু না বলে ঠোঁটে সম্মতিসূচক একটি হাসি ধরে রাখে।
রাশিদ যা বুঝার বুঝে যায়। তার পাশে থাকা অপরূপা রমনীর প্রত্যেকটা ভাব সে বুঝে নিতে পারে। শরীর নতুন ছন্দে কেঁপে উঠে রাশিদের, নেত্রপল্লব ও যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই মুহূর্তে নিজেকে কোনো জড়বস্তু মনে হচ্ছে রাশিদের, দুটো বছর অপেক্ষা করার পর এই দিনটাই সকল অনুভূতি যেন হারিয়ে ফেললো। কৃষ্ণবর্ণ মুখে আলাদা এক খুশীর ঝলক। রাশিদ কে বার বার আকৃষ্ট করে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় মায়ায়! এই হাসির জন্যই তো সে কতকাল অপেক্ষা করেছে! দুটো বছর কি কম নাকি? হঠাৎ করেই রাশিদ টের পায় তার চোখ ভিজে আসছে, ঠোঁট উল্টে আসছে! তার কি কান্না পাচ্ছে? এতমাস তো পায় নি! তাহলে আজ কেন কান্না পাচ্ছে? মেয়েটার চোখে মুখে নিজের প্রতি ভালোবাসা দেখে তার হৃদয় পুড়ছে, আচানক খুশিতে ভেতরটা খালি লাগছে! ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ে রাশিদ, আনতারা নিবিড় চোখে সবটাই পরখ করে। হঠাৎ করে তার চোখ টাও চিকচিক করে উঠে। তার মতো ভাগ্যবতী কে আছে? তার ভালোবাসা বুঝতে পেরে যে ছেলের চোখে জল আসে, সে ভাগ্যবতী না হয়ে পারে? দু পা এগিয়ে এসে রাশিদের বরাবর দাঁড়ায় আনতারা। বড়বড় ঝাঁকড়া চুলে কাঁপা হাতটা ছুঁয়ে দেয়, মাথা তুলে রাশিদ। করুণ কন্ঠে বলে উঠে,
~ আমি একটু একা থাকতে চাই, এই অনুভূতি’র সাথে তাল মেলাতে পারছি না শুচিস্মিতা!
…
আশ্বিন বাতাসে শীতের স্পর্শ নিয়ে আসে। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস শরীর মন দুলিয়ে দেয়। নির্মল প্রকৃতি নজর কাড়া রূপে ধরা দেয় প্রকৃতি প্রেমী দের কাছে। নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটছে আনতারা! আজ মনটা তার বড্ড ভালো। নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। মাটির সিক্ততাও আশ্বিনের প্রভাবে কমে গেছে। অবিরাম বর্ষণের ধারায় ফুলে ফেঁপে হিংস্র নদীর রূপ আর দেখা যাচ্ছে না! আকাশের গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ, শরতের পুরোদস্তুর নেমে পড়া প্রকৃতি আনন্দের সুর তোলে হৃদয়ে। প্রেমময় অনুভূতি জাগিয়ে দেয় মনে। নিঃসঙ্গ জীবনে আরেকটা সত্তার অস্তিত্ব মনে করিয়ে দেয়। ইচ্ছে জাগে নির্মল প্রকৃতি তে হারিয়ে যেতে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে! আনতারা’র এমন ইচ্ছে জাগলেও বিশেষ ভাবে মাথায় জেঁকে বসতে দিচ্ছে না। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এই ভোরে দুজন কুপোতকুপোতি কে একসাথে দেখলে পুরো গ্রাম থই থই হয়ে যাবে! সেই ভয়েই আনতারা বাড়ির পথ ধরলো, না জানি কখন মানুষটা চলে আসে। আনতারা’র ভয়টাই সত্য হলো, ওইযে হেলেদুলে আসছে। এদিকওদিক তাকালো আনতারা, অনেক চাষীরা কাজ করছে। ভয়ে ঢোক গিললো সে। তবে সেরকম কিছুই হলো না, তার পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বললো,
~ আজ রাত এগারোটায় টাই শিউলি তলায় থাকবে, আমি অপেক্ষা করবো!
কথাটা বলে রাশিদ তাকে না দেখার ভান করেই চলে গেল। হাসলো আনতারা। পেছনে তাকানোর শখ হলেও তাকালো না। কাল রাতে মানুষটা মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলো, একদম গম্ভীর নিশ্চুপ দৃষ্টি ফেলে তাকে দেখে গেছে। ব্যাপার টা বেশ মজা পেয়েছে আনতারা! এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি হয়তো! না করারই কথা! অনেক সাধনার ফল যে! রাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো, মনের মধ্যে শিতল অনুভূতিরা শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে! প্রেমের সুখ বুঝি এমনই হয়?
…
~ আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে ফারাহ, বাড়ি ফিরতে হবে!
নিয়নের কথায় ফারাহ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক করেছিল আর দুদিন থেকে চলে যাবে, শাশুড়ির অসুস্থতার কথা শুনে বিচলিত হলো,
~ কি হয়েছে আম্মার?
~ হাঁটুর ব্যাথা নাকি বেড়েছে। বড়ভাবীর আসতে তো দেরী হবে, মেজ ভাবী একা সব কাজ পারবে না। আমাদের যেতেই হবে। আমাকেও কাজে ফিরতে হবে, এইবারো বেশীদিন রাখতে পারলাম না তোমাকে!
ফারাহ’র মন খারাপ হলেও কিছু বললো না। মায়ের কাছে চলে গেল, বলতে হবে। মিসেস সেলিনা রান্না ঘরে ছিলেন। দুপুরের খাবার খেতে আসবে বাড়ির পুরুষ’রা। ফারাহ মায়ের পাশে দাঁড়িয়েই বললেন,
~ মা আজকে চলে যাবো। শাশুড়ির হাঁটুর ব্যাথা বেড়েছে। ফোন দিয়েছিল!
মিসেস সেলিনা মুখ বেঁকালেন। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,
~ যখনই আহস তখনই ওই মহিলার সমস্যা হয়? বিয়ের পর কয়টা দিন থাকছস ক তো?
মায়ের আচরণ ফারাহ’র ভালো লাগলো না। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
~ অনেকদিন থাকছি মা। তিনবারের মতো আসা হলো এই কয়েকদিনেই। বড়ভাবী বছরে একবার যেতে পারতো না, জানো?
~ হো একেবারে একমাস করে থাইকা গেছো। আমাদের আগেই খুঁজ নেওয়া দরকার আছিল। কোন ঘরে বিয়া দিল আল্লাহ’ই জানে।
~ ভালো ঘরেই বিয়ে দিয়েছে মা, স্বামী ভালো থাকলে আর কিছু লাগে না। কথা বাড়িও না তো, তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করো।
বিরক্তি কন্ঠে কথাগুলো বলেই বোনের ঘরের দিকে রওনা হলো ফারাহ। মেয়েরা হয়তো এমনি শশুড় বাড়িতে যেমন বাবার বাড়ির নিন্দে শুনতে পারে না তেমনি বাবা’র বাড়িতেও শশুড় বাড়ির নিন্দে শুনতে পারে না! দু’বাড়িকেই তারা আপন ভাবে! আনতারা পড়ছিল, ফারাহ ধপাধপ শব্দ করে বসে বিছানায়। বোন কে দেখে বই বন্ধ করে পাশে বসে আনতারা,
~ কি হয়েছে আপায়? রেগে আছো কেন?
~ আর বলিস না তারা, আমার শাশুড়ি একটু খিটখিটে, আগের দিনের ধারণা নিয়ে থাকে, বউ দের তোপের মুখে রাখে, তাই বলে আমার শাশুড়ি কিন্তু খুব খারাপ না। উনি আগে থেকে যেমন দেখে আসছে তেমনি করছে। আমার দাদি শাশুড়ি কি করতো জানিস? বিয়ের পরদিন সকালে সারা ঘর চাল ছিটিয়ে আম্মাকে একটা একটা করে খুঁটতে বলেছিল, ধুয়ে রান্না করতে হবে, ময়লা যেন না থাকে; শুকনো মরিচ একগাদা করে পাটায় বাটাতো, হাতের জ্বলন হয় না? তাহলে তার মনে আর কি ভালো ধারণা জন্মাবে?
বোনের কথায় হেসে উঠলো আনতারা। এই কয়দিনেই কেমন আপন করে নিয়েছে, শাশুড়ির মনের কথাও বুঝে ফেলেছে!
~ আচ্ছা তা বুঝলাম, তবে তুমি রেগে আছো কেন?
~ আম্মার হাঁটুর ব্যাথা বেড়েছে, তাহলে আমাকে যেতে হবে না? মা কে বলছি আর শুরু করছে বকবক!
~ রাইগো না আপায়, বড় চাচীর তো ইচ্ছে করে আরো কয়দিন রাখতে! যাই হোক চলো তেঁতুল ভর্তা খাবো!
ফারাহ’ও হেসে বোনের পিছু নেয়, কেয়া কিরণ ভোর থেকেই তাজওয়ার বাড়ি পড়ে আছে। দু বোন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে তেঁতুল ভর্তা খায়। অনেকদিন পর যেন আনতারা’র কাছে সেই আগের আপায় ফিরে এসেছে। খাওয়ার একপর্যায়ে আনতারা বললো,
~ কয়েকদিন পর তো চলে যাচ্ছি আপায়, যাওয়ার আগে আসবে তো?
ফারাহ দৃষ্টি ঘুরায় আনতারা’র দিকে। বলে উঠে,
~ অবশ্যই আসবো। কোনো ভাবে যদি না আসতে পারি, তুই চলে যাবি কেয়া কিরণ কে নিয়ে।
ওই বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আনতারা’র নেই, তবে আপায় কে বুঝতে দিলো না। মুচকি হেসে বললো,
~ আমি পারবো তো আপায় ছোট চাচীর ভরসার প্রতিদান দিতে?
~ অবশ্যই পারবি! শুচিস্মিতা’রা হারে না, হারতে পারে না! তুই তোর নিজের জন্য স্বপ্নের পথে অগ্রসর হবি, তোকে দেখিয়ে দিতে হবে শুচিস্মিতা চাইলে সব পারে!
…
গভীর রাত! গ্রামে সময় এগারোটা মানে গভীর রাতই! ধীরে ধীরে পা ফেলে তালুকদার বাড়ির গেইট পেরোয় আনতারা। প্রথম দিনের মতো ভয় না করলেও ভয় যে একেবারেই হচ্ছে না তেমন না। কারোর চোখে ধরা পড়ার ভয় ঠিকই হচ্ছে, কি কেলেঙ্কারিই না হবে! শিউলি তলায় দাঁড়িয়ে আছে রাশিদ, আনতারা কে দেখেই ঘাসের উপর বসে পড়ে। বসার ইশারা করতেই আনতারা নিঃশব্দে এদিক ওদিক দেখে বসে। রাশিদ হাসে, মেয়েটা কেমন তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে!
~ শুচিস্মিতা দেখছি অন্যরূপে! আমার মরণ আজ সত্যি সত্যিই হয়ে গেল!
লজ্জা পায় আনতারা, এভাবে সরাসরি বলার কি আছে? বাগান থেকে গোলাপ, বকুলফুলের সুবাস ভেসে আসছে। মনমাতানো এক পরিবেশ। রাশিদ এইবার নিষিদ্ধ এক আবদার করে বসে,
~ আমার হাত টা ধরবে একটু?
পায়ের তলা শিরশির করে উঠে আনতারা’র। মাথা নত করে কাঁপা কাঁপা হাতটা এগিয়ে দেয়, খপ করে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয় রাশিদ। আনতারা এবার রাশিদের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে, কী উজ্জ্বল লাগছে মুখটা এখন। যেন পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি সে। আনতারা’র চোখ মুখ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তাকে পেয়ে কেউ এত সুখী! ভাবতেও আনতারা’র ভেতর টা উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। শূণ্য থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনতারা’র দিকে তাকায় রাশিদ, মাথা টা নিচু করে অপলক তাকিয়েই থাকে। মেয়েটার চোখ মুখে আজ আলাদা জ্যোতি খেলা করছে, যদিও বাগান থেকে আসা লাইটের আলোয় তেমন টা দেখা যাচ্ছে না, তবে যা দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট একজন পাগল প্রেমিকের তৃষ্ণা মেটাতে!
মাঝে মাঝে মেয়েটার মুখে যখন অন্ধকার পুরানো কালিঝুলির মতো লেপ্টে থাকে, দ্বিধায় পড়ে দৃষ্টি করুণ হয়ে আসে তখন রাশিদের বুকের ভেতর কী যে এক কষ্ট হতে থাকে, মেয়েটাকে হয়তো বোঝানো সম্ভব নয়। মেয়ে টা যখন নিজেকে অন্ধকার বলে দূরে সরিয়ে রাখে, মানুষের কটু কথা শুনে মুখ ভার করে রাখে
মনে হয় রাশিদের বুকের বাম পাশে থাকা হৃদপিন্ড নামক যন্ত্রটাই কেউ অনবরত ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে যায়, ছটফট করতে থাকে সে। আজ এই ছটফটানির হয়তো সমাপ্তি হলো, মেয়েটা যে তার আলোতে ধরা দিয়েছে! তার প্রেমের সুধা নিতে তৎপর হয়েছে। নড়েচড়ে উঠে আনতারা, নেত্রপল্লব কেঁপে উঠে রাশিদের। দৃষ্টি ঘুরিয়ে হুট করেই বলে উঠে,
~ কালকে চলে যাচ্ছি!
আনতারা’র উজ্জ্বল মুখটায় আঁধার নেমে আসে, তবে ধরা নেয় না। বললো,
~ ঢাকায় কোথায়?
~ জানিনা!
আনতারা বুঝলো রাশিদ তাকে বলতে ইচ্ছুক নয়! চুপ মেরে গেল! রাশিদ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
~ তোমাকে না দেখার দুঃখটা লুকাবো কোথায় শুচিস্মিতা?
আনতারা’র বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমাকেও নিয়ে যান না আপনার সাথে। লুকিয়ে রাখুন না বুকের ভেতর। বাইরের পৃথিবী থেকে আড়াল করে রাখুন না। সবকিছু ছেড়ে দিবো, স্বপ্ন গুলো জলাঞ্জলি দিয়ে দিবো, শুধু আপনার জন্য!’
বলতে পারে না আনতারা। কোথায় যেন একটা বাঁধা পায়, গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। আনতারা’র নিশ্চুপতা পূর্বে ব্যাথা দিলেও আজ যেন সুখ দিচ্ছে রাশিদকে! মেয়েটা যে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। তার কথা স্মরণেই মেয়েটা এমন করছে, তার উপস্থিতি মেয়েটাকে আনন্দ দিচ্ছে। এর থেকে বড় সুখ বুঝি আছে? নিজের মতো কিছু বলতে নিবে তখনই দুজন কে চমকে কেউ বলে উঠলো,
~ ওইখানে কে? কে কথা বলে?
চলবে…?
(রিয়েক্ট করার অনুরোধ রইলো। আপনাদের কি গল্পটা ভালো লাগছে না? রিয়েক্ট কমে যাচ্ছে!)