ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৩২ (শেষাংশ)
.
এখন গোধূলিলগ্ন। অনিক ঘণ্টা খানেক আগে থেকে নদীর পাড়ে এসে সবুজ ঘাসে বসে আছে৷ সামনে টলটলে পানি। সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবে যাওয়ার প্রভাব সেখানেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সময়ে ক্ষণে ক্ষণে রূপ পালটায় আকাশ। তার ছায়া পড়ে নদীতে। অনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে এসে বসেনি। এসেছে ভেতরের অস্থিরতা দূর করতে। পদ্য তার বাবাকে চিঠি দিয়েছে বলে জানিয়েছে। এরপর থেকে কেমন ভয় কাজ করছে। সেটা অবশ্য পদ্যকে বুঝতে দেয়নি সে। বলেছে ব্যাপার না, দেখো কী বলেন, একদম ভয় বা লজ্জা পাবে না। কিন্তু তার ভয় করছে৷ এই সমাজটাকে সে জানে। তাদের ব্যাপারটা জটিলভাবে চিন্তা করলে, সত্যিই অনেক জটিল, সহজভাবে নিলে সহজ। সে জানে আজ তাকে ডেকে নেয়া হবে পদ্যের পেছন ছাড়ানোর জন্য। অথচ সেখানে তার উলটো বুঝাতে হবে পদ্যের পেছন ছাড়ার কোনো যুক্তি নেই। সে ওকে বিয়ে করতে চায়। তারা একে অন্যকে পছন্দ করে। ওরা মানতে না চাইলে এসব বলে বুঝানো মোটেও সহজ নয়। কিন্তু পদ্যের বাবা এখানে অনেক বড়ো একটা অবদান রাখতে পারেন। যদি মেনে নেন। তাহলে পদ্যের দিক থেকে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তার বাবা না মানলেও পদ্যের বিয়ে আঁটকে রাখা যাবে। তখন অন্তত আজ না হয় কাল পদ্যকে বুঝিয়ে লুকিয়ে বা পালিয়ে বিয়ে করবে। আপাতত পদ্যকে শক্ত রাখা জরুরি, সঙ্গে সে নিজেও। বয়স ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, এটা অন্তত নিজেদের বিশ্বাস করা জরুরি। সে নিজেকে এখানে বসে সেভাবেই মানসিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছে। মানুষ মাত্রই লজ্জা, জড়তা আছে, সেটা থাকা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পাওয়া। সে তা প্রকাশ হতে দেবে না। সাতটার দিকে তাকে কল দিল নাঈম। দিয়ে বললো, ‘অনিক তুই কোথায়? পদ্যদের ঘরে আসতে বলছে আব্বা।’
অনিক মোবাইল পকেটে পুরে বাইক নিয়ে দ্রুত পদ্যদের উঠানে এলো। গিয়ে দরজা খুলে দেখে নাঈম, আফরা সহ সবাইই আছে সেখানে। পালঙ্ক এবং বেঞ্চে বসে আছে সবাই। সে সালাম করে খুবই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গিয়ে চেয়ারে বসলো। এই পুরো আয়োজন যে পদ্যের মাধ্যমে সে করিয়েছে সেটা তার বাবা জানেন না, এটা অনিক জানে। তাই প্রথমেই সে বললো,
– ‘আব্বা বলো এবার কী বলবে। আর এত মানুষ জড়ো করার কী হয়েছে। বাসায়ও সেম করেছিলে, এখন আবার, বুঝলাম না তো কিছু।’
– ‘তুমি বুঝতে পারছো না কেন?’
– ‘একেবারেই যে বুঝতে পারিনি তা না। কিন্তু সেটার জন্য এরকম করার কিছু আছে বলে তো মনে করছি না। অকারণ একটা বিষয় বড়ো করার দরকার কী ছিল?’
– ‘দরকার আছে। তুমি না-কি পদ্যকে ভালোবাসো?’
– ‘এটা সবার জেনে কী হবে? দরকার থাকলে তো আমি নিজেই বলতাম। পদ্যের বিয়ে ঠিক হয়েছে দেখে তাকে এসে বলেছিলাম, আমি তোমাকে পছন্দ করি, বিয়ে করতে চাই। সে আমাকে না করে দিয়েছে। আমি চলে গেছি। রাজি থাকলে নিজেই তোমাকে বলতাম।’
– ‘তুমি চলে গিয়েই কী শেষ? তুমি তো এরপর অনেক পাগলামি করেছো।’
– ‘তা করেছি আব্বা। এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোনোদিন বিয়ে-শাদি করবো না। মাঝে মাঝে মরে যেতেও ইচ্ছা করে। তবুও তো পদ্য যেখানে রাজি না, সেখানে আমার কিছু করার নেই। পদ্য রাজিই তো আসল ব্যাপার। পাত্র-পাত্রী দু’জন রাজিই তো গুরুত্বপূর্ণ। সে রাজি না, তাই এটা নিয়ে আমার যেমন কিছু করার নেই। তোমারও নেই। খামোখা এসব লোক জানিয়ে কী হবে?’
– ‘পদ্য রাজি থাকলে তুমি বিয়ের জন্য আমাকে জানাতে?’
– ‘হ্যাঁ, তা না হলে কাকে জানাবো?’
– ‘লজ্জা-শরম কী দুনিয়া থেকে উঠে গেছে, লজ্জা করে না?’
– ‘তা কেন করবে? তোমরাই তো আমাকে বিয়ে করাতে চাও। তো বিয়ে যখন ছেলেকে একটা করাবেই। সেটা তার পছন্দের হলে সমস্যা কী?’
– ‘তোমাকে বিয়ের কথায় লজ্জা পেতে বলিনি বলিনি গর্দভ, বলেছি পদ্যকে বিয়ে করবে বলতে লজ্জা করে না?’
– ‘হ্যাঁ তা তো করে। বিয়ের কথা বলতেই লজ্জা করে যেখানে, পছন্দের মেয়েকে করার কথা বলতে তো করবেই। কিন্তু লজ্জা পাওয়া উচিত না৷ বিয়ে ব্যাপারটা তো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ জীবনের অনেক বড়ো অধ্যায়। এগুলো নিয়ে লজ্জা পাওয়া তো উচিত না।’
– ‘তোমাকে আমি বলেছি পদ্যকে বিয়ের কথা বলতে লজ্জা করে না?’
– ‘কেন করবে৷ একটু আগে বললাম না পদ্য রাজি না। তাই সে অন্য ছেলেকে বিয়ে করবে, তা করুক। আমার কিছু করার নেই। তবে আমি আর কোনোদিন বিয়ে-শাদি করবো না। মরে যেতেও ইচ্ছা করে। তো যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন আমার। সেটায় লজ্জা পেলে চলবে না-কি? পদ্য রাজি থাকলে অবশ্যই আমি বলতাম সবাইকে।’
– ‘শুনছো মাস্টার ভাই। লজ্জা-শরমের বিন্দুমাত্র কী চিহ্ন আছে তার চেহারায়?’
অনিক বাঁধা দিয়ে বললো,
– ‘আহা আব্বা, তুমি এই অসুস্থ মানুষকে প্রেশার দিচ্ছ কেন। এসব কথা বলে কী কোনো লাভ আছে আর? এখানে সবাইকে ডাকারই তো দরকার ছিল না।’
– ‘তুমি বেশি বুঝতে যেও না। ডেকেছি কেন আমি জানি। তোমাকে বুঝানোর জন্য ডেকেছি।’
– ‘আমাকে কী বোঝাবে। আমি কী পদ্যের বিয়েতে ঝামেলা করেছি?’
– ‘তা না, তুমি নিজে পাগলামি বাদ দিতে হবে। সেটা মাস্টার ভাই তোমাকে বোঝাবে।’
– ‘ও আচ্ছা, সেটা ভালো। কারণ এমন অসহায় হয়েছি। নিজেই ইউটিউবে গিয়ে মোটিভেশনাল বক্তব্য শুনি। আসলে আমিও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাই। পদ্য যেহেতু রাজি না। এখন তাকে ছাড়া তো থাকতে হবে। জব, লেখালেখি কোনোকিছুই ভালো লাগে না। এখন যদি তোমরা বুঝিয়ে পারো। তাহলে তো সত্যিই অনেক ভালো হয়।’
– ‘এইতো ভালো, নিজে যেহেতু বুঝতে চাচ্ছ। তাহলে অবশ্যই বুঝবে। মাস্টার ভাই ওকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি, তাকে বুঝান তো। এসব পাগলামি ছাড়তে বলেন।’
মতিন সাহেব এতক্ষণ নীরব ছিলেন৷ মনিরা বেগম অনিকের নির্লজ্জের মতো কথাবার্তা শুনে নির্বাক। পদ্য আর আফরা নাঈমের পেছনে বসে আছে। আফরা মিটমাট করে হাসলেও পদ্যের গলা শুকিয়ে গেছে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। মতিন সাহেব বললেন, ‘তুমিই বুঝাও আগে কী বোঝাতে চাও।’
মিরাজুল সাহেব ইতস্তত করে অনিককে বললেন, ‘তুমি যে বলছো পদ্য রাজি হলে আমাদেরকে বিয়ের কথা বলবে৷ তোমার কী মনে হয় আমি বা মাস্টার ভাই তাতেই রাজি হয়ে যেতাম?’
অনিক মুচকি হেঁসে বললো, ‘রাজি না হওয়াটাও স্বাভাবিক। ধরো স্যারের ব্যাপারটা। উনি মেয়েকে তো চাইবেন একটা যোগ্য পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে। পাত্রের আর্থিক অবস্থা, স্বভাব-চরিত্র, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি তো সকল অবিভাবকই দেখেন। সেদিক থেকে আমাকে যোগ্য মনে না হলে অসম্মতি জানানোটাই স্বাভাবিক। সবাইই তো চায় তার মেয়ে ভালো থাকুক।’
– ‘আমি সেই যোগ্যতার কথা বলিনি গর্দভ৷ তোমার বয়সের কী হবে?’
– ‘কেন আমার কী বিয়ের বয়স হয়নি?’
– ‘ইয়ার্কি করছো না-কি তুমি?’
– ‘কীসের ইয়ার্কি আব্বা। তুমি কীসের কথা বলছো ক্লিয়ার বলো।’
– ‘তুমি পদ্যের ছোটো। পদ্য রাজি হলেও এই বিয়ে আমরা কেন মানবো?’
– ‘পদ্য রাজি থাকলে কেন মানবে সেটা বলছো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আশ্চর্য! পদ্য রাজি থাকলে আমি বয়সে ছোটো বলে তোমরা মানবে না কেন? যেখানে তোমাদের সন্তান বলছে তার ম*রে যেতে মন চায়। কোনোদিন পদ্যকে ছাড়া বিয়ে করবে না কাউকে। অতীতেও চেষ্টা করে বিয়ে করাতে পারোনি। এমন সিরিয়াস বিষয়ে তোমরা সামান্য বয়স নিয়ে পড়ে থাকবে কেন?’
– ‘মানে তুমি কী বুঝাতে চাও? বয়স তোমার কাছে কিছুই না?’
– ‘অবশ্যই না। আমার কাছে বয়স কিছু হলে প্রেমে পড়তাম কীভাবে? আমাকে প্রশ্ন না করে তোমাদের কথা বলো। পদ্য রাজি থাকলে কেন মানবে না? যেখানে নিজের চোখে দেখেছো তোমার ছেলে জব ছেড়ে দিয়েছে, পাগলের মতো ঘুরছে, বহু বছর থেকে একটা মেয়ের জন্য বিয়ে না করে বসে আছে। সেখানে মেয়েটিকে পাওয়ার পথে তোমরা কেন বাঁধা হবে? সামান্য বয়সের জন্য?’
– ‘তোমার কী বিন্দুমাত্র শরম করছে না এসব বলতে? যে মেয়েকে সব সময় আপু বলে ডেকেছো, তাকেই বিয়ে করতে চাও।’
– ‘বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে আপু ডাকতে হয় তাই ডাকতাম। রাস্তায় অচেনা ছোটো মেয়েদেরও তো ডাকি আমরা। তাছাড়া ইভা তো আমাকে ভাইয়া ডাকতো। তাহলে ওর সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছিলে কেন? ভাইয়া ডাকলে যদি আপন ভাই না হয়। আপু ডাকলেই আপন বোন হয়ে যায় কীভাবে?
আসল কথা হলো আপু/ভাই শুধুমাত্র সম্মোধন। ডাকের সঙ্গে অনুভূতি সব সময় জড়িত থাকে না। থাকলে শিক্ষক ছাত্রীকে বিয়ে করতে পারতো না। একটা মেয়ে তার ফুপাতো-খালাতো ভাইকে সারাজীবন ভাইয়া ডেকে বিয়ে করতে পারতো না। সবচেয়ে বড়ো কথা আপু ডাক যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে আমি কেন পদ্যের প্রেমে পড়বো? ন্যাচারালি আমার কাছে আপু আপু ফিল হলো না কেন?’
– ‘এত বেশি কথা বলো না। দুনিয়াতে মেয়ের কী অভাব পড়ছে যে বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে তোমার?’
– ‘এটা কোন ধরনের কথা বুঝলাম না আব্বা। দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে ওকে আমার ভালো লাগে বলেই তো করবো।’
– ‘লোকে কী বলবে জানো?’
– ‘লোকে কিছু বলবে এটা চিন্তা করে যেসব পিতা-মাতা, ভাই-ভাবি আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারবে। সেই পরিবারকে আমি ত্যাগ করবো। এমন মা-বাবা কিংবা পরিবার আমার লাগবে না।’
– ‘বেয়াদবের মতো কী বলছো তুমি এসব?’
– ‘যা বলছি সত্য বলছি। একটা সন্তান যদি গুরুতর এক্সি*ডেন্ট করে। তাকে বাঁচানোর জন্য পরিবার সবই করে। জন্মের পর থেকে বাহ্যিক সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু সন্তানের মন, হৃদয় নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা থাকে না। একটা মানুষের বাহ্যিক শরীরের মতো মনেরও সুস্থতা, ভালো-মন্দ, দূর্ঘটনা আছে। হৃদয়ঘটিত এসবকেও গুরুত্ব দিতে হয়। আমি যেখানে পদ্যকে ছাড়া বাঁচাবোই না৷ সুস্থ-স্বাভাবিক, জীবন-যাপন করতে পারবো না। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তোমাদের কার কাছে আমার থেকে সমাজের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ আমার জানার খুব দরকার। একজন একজন করে বলো। পদ্য বিয়েতে রাজি থাকলে। আমি মরে গেলেও কে কে বিয়েতে রাজি হতে না। আমি জানতে চাই। ভাবি তুমি প্রথমে বলো।’
আফরা থমথমে খেল প্রথমে। তারপর বললো, ‘কী বলবো?’
– ‘এইযে আমি এত বছর থেকে পদ্যকে ছাড়া বিয়ে করিনি। এবং পদ্যের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। জবও ছেড়ে দিয়েছি। স্বাভাবিকভাবে বুঝা যাচ্ছে এর সঙ্গে আমার স্বাভাবিক জীবন, কেরিয়ার, বেঁচে থাকা জড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় যদি পদ্য আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। তুমি কী বয়স নিয়ে সমাজের লোক হাসাহাসি করবে বলে বিয়েতে রাজি হতে না?’
– ‘আমি রাজি হতাম।’
– ‘কেন হতে?’
– ‘বয়স আবার কী। দু’জন সুখে-শান্তিতে থাকলেই হলো। আমি তো ভাবি হিসাবে তোমার ভালোই চাই।’
– ‘ভাইয়া বলো।’
নাঈম অবাক হয়ে বললো, ‘আমি কী বলবো?’
– ‘তোমার কিছু বলার নেই?’
– ‘আব্বা বলুক।’
আফরা পেছন থেকে চিমটি দিল তাকে। নাঈম আমতা-আমতা করে বললো, ‘আমার এসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বিয়ে হলেও সমস্যা নেই, না হলেও সমস্যা নেই।’
অনিক এবার বললো, ‘আব্বা এবার তুমি বলো।’
মিরাজুল সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘এই বেয়াদবের বাচ্চা, এখানে কী নাটক চলছে? বাপ-চাচা, বড়ো ভাই কাউকে চোখে লাগছে না?’ তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কীভাবে কথা বলছে দেখো।’
অনিক খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, ‘আমার কথা তো আমাকেই বলতে হবে তাই না? সেটা বেয়াদবের মতো হোক কিংবা নির্লজ্জের মতো হোক। বলা তো লাগবেই। না বললে তোমরা বুঝবে কীভাবে?
– ‘তুমি কী বুঝাবে? তোমাকে এখানে এনেছি সবাই মিলে বুঝাবো বলে।’
– ‘পদ্য যেখানে রাজি নাই, বুঝানোরও তো দরকার আসে না।’
– ‘পদ্য রাজি হলেও বুঝানোর আছে।’
– ‘পদ্য রাজি হলে তো উলটো আমি বুঝানোর চেষ্টা করতাম।’
– ‘কিরকম বুঝাতে তুমি?’
– ‘এইযে একটু আগে বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম। তুমি তো তার আগেই রেগে গিয়েছিলে।’
– ‘তুমি আমাকে কী বোঝাবে বেয়াদব কোথাকার!’
– ‘তাহলে কী পদ্য রাজি হলে তোমাদের না বুঝিয়ে বলে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাব? মানে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি নিজেই আনলে বুঝাতে। আবার কাল্পনিক কথাবার্তা বলছো, পদ্য রাজি হলে কী করতাম। আবার কখনও বলছো পদ্য, রাজি হলেও তোমরা মানতে না। কী হয়েছে আব্বা বলো তো। এত রাগারাগির তো কিছু নেই। কথা বলছি, এটা ভালো বিষয়৷ পদ্য রাজি না দেখে তো আমি আমার মতো একা পু*ড়ে ম*রছি। তারপরও আমাকে ডেকে এনে আবার যন্ত্রণা দিচ্ছ কেন। আর দুই পরিবারের সকল মানুষ একত্র করেছো। আমাকে বুঝাতে না-কি লজ্জা দিতে।’
– ‘দেখুন তো মাস্টার ভাই। ওর কথা বলার স্টাইল দেখে তো জুতা-পেটা করতে মন চায়। এত লজ্জার কথাগুলো এমনভাবে বলছে যেন খুবই স্বাভাবিক।’
মতিন সাহেব মিরাজুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অদ্ভুত এক হাসি। তারপর গাল চুলকে বললেন, ‘অনিককে আসলে কিছু বুঝানোর নাই। অনিক বা পদ্য আমাদের থেকে কম বুঝে না।’
– ‘কী বলেন মাস্টার ভাই?’
– ‘তোমার কী ধারণা পদ্যের থেকে আমি অনেক বেশি বুঝি? আর তুমি অনিক থেকে? তাদের একটা বয়স হয়েছে। এখন ভালো-মন্দ সবই বুঝে। তুমি যে অনিকের এই স্বাভাবিকভাবে কথা বলা দেখে অবাক হচ্ছ। আমিও হচ্ছি, একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে৷ নিজের কথা বুঝাতে চাচ্ছে। একজন অভিভাবক হিসাবে আমরা আসলে সন্তানদের পড়ালেখা কেন করাই? শুধু কী চাকরি একটা করার জন্য? জ্ঞান-বুদ্ধি হোক কেন চাই? শুধু কী অন্যকে ঠকানোর জন্য? তা না তো। সন্তান নিজের ভালো-মন্দ বুঝাও জরুরি। তারা বুঝেছে ঠিকই। আমার মেয়ে আমাকে তার কাছে ছোটো করে ফেলেছে। মেয়েটা এতটা বছর অনিককে বলেনি সেও পছন্দ করে। সে একা একা ঠিকই কষ্ট পেয়েছে। আমরা অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করলাম। রাতে দেখি পেছনে বসে একা কাঁদছে৷ কেন কাঁদে বলে না। জোরাজুরি করার পর বললো। আমি করে ফেললাম স্ট্রো*ক। এখন আবার আমাকে তো প্রেশার দিতে পারে না৷ তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। সে যদি এই বৃদ্ধ বাপের জীবনকে এত মূল্যায়ন করে আমি কেন পারছি না? পদ্য কী চাইলেই পালিয়ে যেতে পারতো না? কেন সে আমাদের রাজি হলে বিয়ে বসবে বলে বসে আছে?
যাইহোক এসব কথা বাদ দেই। তুমি তোমার ছেলের ব্যাপার কী করবে জানি না। তবে আমার মেয়েকে সারাজীবন কাঁদাতে আমি রাজি নই। যেদিন অসুস্থ হলাম। সেদিন রাতে আমি ওর কান্না দেখেছি। অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে সারাজীবন যদি এভাবে কাঁদে, তাহল এত ইজ্জত দিয়ে আমার কী লাভ হবে? সমাজের মন রক্ষা করে যদি তুমি ছেলের পছন্দের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে না দাও। এরপর যদি বি*ষ খেয়ে বা গলায় দ*ড়ি দিয়ে মরে, সমাজ কী ফিরিয়ে দেবে তোমার ছেলেকে? তোমার কী মনে হয় আজ পদ্যের অন্য জায়গায় বিয়ে হলে অনিক স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবে? আমার মেয়ে অন্য ছেলেকে মন থেকে গ্রহণ করবে? মিরাজুল তুমি কী করবে জানি না। আমি আমার মেয়েকে অনিকের সাথে বিয়ে দিতে রাজি। তুমি কী করবে সেটা তোমার বিষয়।’
মনিরা বেগম এতক্ষণ নীরব ছিলেন। স্বামীর কথা শুনে রেগে-মেগে বললেন,
– ‘এটা কি বলতাছো তুমি? তোমার কী মাথা ঠিক আছে? এলাকার মানুষ হাসাহাসি করবে শুনলে।’
মতিন সাহেব ধমক দিয়ে বললেন,
– ‘লোকের হাসি বন্ধের জন্য কী তোমার মেয়েকে সারাজীবন কাঁদাবে? তুমি মনে করো তোমার মেয়েকে একদল ডাকাত মা*রতে আসছে? তুমি তাকে বাঁচাতে কী লড়াই করতে না। এটাও তেমন। আমার মেয়ে কষ্ট পেয়ে কাঁদবে, আমি তার কান্না বন্ধ করে সমাজের মানুষের হাসাহাসি সহ্য করবো।’
– ‘সে আরেক ছেলের জন্য কানবো কেন? কান্নাকাটির হইছেটা কী..।’
আর কিছু বলার আগেই আফরা থামিয়ে দিল৷ সে উঠে এসে হাত ধরে ফিসফিস করে বললো, ‘চাচি চুপ থাকেন, চাচার অবাধ্য কিছুই করা যাবে না, বেশি উত্তেজিত হলে স্ট্রো*ক করতে পারেন। আবার স্ট্রো*ক করলে কিন্তু সর্বনাশ। দেখলেন না পদ্য তার বাবার পছন্দের পাত্রের কাছে বিয়ে বসতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কেন হয়েছিল? ওই স্ট্রো*কের জন্যই। আপনিও এখন অনিকের সঙ্গে বিয়ে না মানলে সেম হবে।’
মনিরা বেগম হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মিরাজুল ইসলাম বসা থেকে উঠে, ‘আচ্ছা যাই মাস্টার ভাই। ভেবে দেখি ব্যাপারটা’ বলে বাইরে চলে গেলেন। অনিক একটা ঘোরের ভেতর আছে। একটু আগে আসলে কী ঘটেছে। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না সে। পালঙ্কের দিকে তাকিয়ে দেখে পদ্য নেই। আফরা বসে আছে মনিরা বেগমের পাশে। মনিসা রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। নাঈমও উঠে চলে গেল বাইরে। অনিকের হুট করে কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করেছে৷ সে অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘স্যার তাহলে আমি যাই।’
– ‘আচ্ছা যাও, কিন্তু মুখে এত ঘাস কেন? চুলেও কাঁচি লাগাওনি কতদিন? না-কি এগুলো নিয়েও যুক্তি-তর্ক করবে?’
সে আরও লজ্জিত হয়ে বিনয়ের গলায় বললো,
– ‘না স্যার, কেটে ফেলবো।’
– ‘আচ্ছা যাও।’
অনিকও বের হয়ে গেল৷
মিরাজুল সাহেব বারান্দায় পায়চারি করলেন খানিকক্ষণ৷ মতিন মাস্টারের প্রতি হুট করে কেমন হিংসা লাগতে শুরু করেছে। তিনি চাইলে এই আজ জায়গায় থাকতে পারতেন। ব্যাপারটা মেনে নিয়ে সন্তানদের কাছে হিরো হতে পারতেন। তিনি সব সময় নিজেকে সেরকম বুদ্ধিমান, আধুনিক পিতা হিসাবেই জানতেন। অথচ সময় মতো কাজটা করে ফেলেছেন মতিন মাস্টার। এখন পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে অযথা ঝামেলা পাকিয়েছেন৷ তিনি ছাড়া তো সবাইই বিয়েতে রাজি। বিয়েটা হলে তো ভালোই। অনিক সংসারী হবে। স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে৷ কিন্তু তিনি তো হারার দলে এভাবে থাকতে পারেন না৷ গেলেন রান্নাঘরে। স্ত্রী সুফিয়াকে গিয়ে রাগিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য। তাকে দেখে সুফিয়া বেগম বললেন,
– ‘কী হইতাছে কিছুই তো বলো না৷ সবাই পদ্যদের ঘরে কী করো?’
– ‘কী করি জানলে আসমান ভেঙে পড়বে। তোমার অনিক পদ্যকে বিয়ে করতে চায়। ভাবো একবার। বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে না-কি বিয়ে করবে।’
সুফিয়া বেগমের হাতে পাতিলের ঢাকনা ছিল। সেটা পড়ে গেল মেঝেতে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘বলো কী? এইটা শোনার জন্য বুঝি বাঁইচা আছি আমি?’
– ‘আমি তো কাউকে বুঝিয়ে পারলাম না। নাঈম আফরাও ওদের কথায়, তুমি গিয়ে বুঝাও।’
সুফিয়া বেগম চিল্লাচিল্লি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। নাঈম, আফরা আর অনিক চলে এসেছে তখন। তিনি অনিকের দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন, ‘তুই না-কি পদ্যরে বিয়া করবি? তোর কী স্বাদ এখনো মিটে নাই? তোর কারণে নাঈম মুখে চুন-কালি মাখিয়ে বিয়ে করলো। এখন কী আরও বাকি আছে?’
মিরাজুল সাহেব তাড়াতাড়ি গিয়ে সুফিয়াকে ধরে বললেন, ‘কী করছো সুফিয়া?’
– ‘কী করছি মানে? বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বিয়া করতে বলবে আর আমি চুপ কইরা থাকবো না-কি? এলাকার মানুষ কী বলবে? মুখ দেখানো যাবে? হাসি-তামাশা করবে না?’
মিরাজুল সাহেব তাকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বললেন,
– ‘তাতে কী হয়েছে? এলাকার লোকের জন্য কী নিজের সন্তানের খুশি দেখবে না? কী বলো এসব তুমি?’
– ‘তুমি কী বলছো এসব? ‘
– ‘সত্যই বলছি, লোকের হাসাহাসিকে কী মিরাজুল ইসলাম কখনও পাত্তা দিয়েছে। টানা কয়েকবার মেম্বার হলাম। তারপর চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে হারলাম৷ একবার ফেইল মারার পর আবার যখন দাঁড়াইলাম লোকে তখন থেকে হাসতো। তাতে কী আমি পিছিয়ে থেকেছি। বারবার দাঁড়িয়েছি।’
– ‘তোমার কী মাথা ঠিক আছে?’
– ‘হ্যাঁ আছে, তুমি রুমে আসো। এই অনিক, নাঈম ঘরে যাও। আমি দেখছি ব্যাপারটা। যাও, দাঁড়িয়ে আছো কেন।’
ওরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ভেতরে চলে গেল।
পরেরদিন মিরাজুল ইসলাম নিজেই ঘটককে ফোন করে পদ্যের বিয়ে ভেঙে দিলেন। মতিন সাহেবকে সম্মতি দিলেন। খুবই সাদামাটাভাবে তাদের বিয়ে হলো পরের শুক্রবার জুম্মার পর। বিয়েটা সাদামাটাভাবে তাড়াতাড়ি করার ব্যাপারেও অনিক পেছন থেকে কল-কাঠি নাড়লো। বিয়ের আগেই লোকজনের হাসি-তামাশার মুখোমুখি পরিবার দাঁড়াক সে চায়নি। তাতে ঝামেলা হতে পারে। একবার বিয়ে হয়ে গেলে পরে যা হবার হবে। বিয়ের সকল কাজ শেষ হতে হতে বিকেল চারটা হয়ে গেল। দক্ষিণের সেই ঘরেই পদ্যকে নিয়ে রাখা হয়েছে। আফরা আর মনিসা তার সঙ্গে বসা। পদ্যের পুরোটা দিন অসম্ভব রকম লজ্জায় বারবার কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। লজ্জাটা বিয়ের নয়। অস্বাভাবিকতার। সবকিছু কেমন অস্বাভাবিকভাবে হয়েছে। রাত দশটায় অনিককে নিয়ে আফরা বাসর ঘরের দরজার সামনে বললো, ‘যাও, কিন্তু একটা কথা শোনো, এক বছরের ভেতরে ফুটফুটে সন্তান চাই। আমাদের হয়নি এখনও। তোমার হলে আব্বা-আম্মা খুশি হবেন।’
আফরা মোটামুটি হাসির কথাই বলেছে। কিন্তু অনিক হাসলো না৷ আফরার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে রইল৷ চোখ জলে ছলছল করছে। আফরা পুনরায় বললো, ‘আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেন? যাও পদ্য অপেক্ষা করছে।’
– ‘ভাবি মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবে।’
আফরা মুচকি হেঁসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অনিক মাথা তুলে বললো, ‘সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ ভাবি।’
– ‘যাও তো, এত পাম্প দিতে হবে না।’
অনিক ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। পদ্য বিয়ের শাড়ি পরে খাটের মাঝখানে বসে আছে। অনিক এসেছে দেখে সে বিছানা থেকে নেমে এলো সালাম করতে। অনিক ভদ্রতা করে তাকে আঁটকে দিতে চাইল না৷ সে বয়সে ছোটো এই ব্যাপারটা এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ আরও বেশি পদ্যের ভেতর থেকে মিটিয়ে ফেলবে। সালাম করার পর পদ্যকে ধরে দাঁড় করায়। পদ্য থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নীচু করে রইল। অনিক ওর মুখটা ধরে তুলে চোখে চোখে তাকায়। ভেবেছিল পদ্য লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু না, ওর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। সে চোখের পানি মুছে দিয়ে খানিক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, ‘আমি ভীষণ শক্ত করে একবার তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই পদ্য৷’
.
পরেরদিন ভোরে দরজায় নক শুনে প্রথমেই ঘুম ভাঙলো অনিকের। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে আফরা।
– ‘কী হয়েছে ভাবি? এত ভোরে ডাকছো কেন?’
আফরা রহস্য করে হেঁসে বললো,
– ‘দুনিয়ায় তো নাই। নয়টা বেজে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নাশতা করতে নিচে আসো।’
– ‘বলো কী ভাবি। আচ্ছা যাও ওকে নিয়ে আসছি আমি।’
অনিক গিয়ে জানালাটা খুলে দিল। নির্মল, স্নিগ্ধ ভোর। চড়ুই পাখি কয়েকটা আমগাছের পাতায় কিচির-মিচির করছে। অনিক ফিরে এসে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। পদ্য কী সুন্দর ঘুমিয়ে আছে। কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমু খেতে ঠোঁট এগিয়ে নিতেই পদ্যের ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে তাকিয়ে উঠে বসলো সে। অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘চুমুটা খাওয়ার পর না হয় ঘুম ভাঙতে পারতো।’
পদ্য ভয়ার্ত গলায় বললো, ‘পানি দাও তো, গলা শুকিয়ে গেছে।’
অনিক টেবিলের উপর থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে বাড়িয়ে দিল। পদ্য এক চুমুকে খেয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছি।’
অনিক গ্লাস রেখে পাশে গিয়ে বসে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কী দেখেছো বলো তো।’
– ‘দেখলাম আমি স্কুলে যাচ্ছি। বাচ্চারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। যাওয়ার পথে মহিলারা বাড়ির সামনে থেকে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে খিলখিল করে হাসে।’
– ‘আমি থাকতে, তুমি এই স্বপ্ন দেখলে কেন?’
– ‘আমি কী ইচ্ছা করে দেখেছি?’
– ‘না, কিন্তু ভয় পাচ্ছ বলেই দেখেছো। আমি থাকতে ভয় পাও কেন বলো তো।’
– ‘আসলে স্কুলে গিয়ে কীভাবে ক্লাস করাবো আর। কেমন ভয় লাগে।’
– ‘কি যে বলো পদ্য। আমি কমপক্ষে তিন মাস গ্রামে থাকবো। রোজ তোমাকে নিয়ে যাব আর আনবো। কোনো চিন্তা করবে না। আর শোনো, যা ভয় পাবে সেটার যত তাড়াতাড়ি মুখোমুখি দাঁড়াবে তত শান্তি। না হয় ভয় আর শঙ্কা নিয়ে থাকতে হয়। তোমার আনন্দের মুহূর্তগুলো সেই দুশ্চিন্তা উপভোগ করতে দেবে না। আমি ইচ্ছা আজই তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাব। বিয়ের ছুটি লাগবে না তোমার।’
– ‘কী বলো?’
– ‘হ্যাঁ, আমরা আগে থেকে এখন আরও ভালো থাকবো। আর জানো, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর কিন্তু আমি আর সিগারেট খাইনি। ছেড়ে দিয়েছি৷ এখন থেকে সবকিছু দুজনের আরও গোছানো চাই। তোমাকে স্কুলে দিয়ে এসে লিখতে বসবো। তুমি রোজ এসে আমার রানিং উপন্যাসটা পড়বে। তুমি বের হওয়ার আগে কল দেবে আমি যাব আনতে। কে কী বললো ভাবার দরকার নেই৷ কিছুদিন পর দেখবে সবকিছু স্বাভাবিক। যাও গোসল করো, স্কুলের জন্য রেডি হও। টাইম নাই।’
– ‘সত্যিই স্কুলে যাব?’
– ‘হ্যাঁ যাবে, স্কুলে যাও ছুটি পরে নেয়া যাবে। আগে তোমার সকল অস্বস্তি কাটুক। দরকার হয় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে কোথাও বেড়াতে যাব৷ ভয় নিয়ে তোমার কোনো কিছু ভালো লাগবে না।’
– ‘আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি? তুমি এরপর একেবারে গোসল করে রেডি হয়ে আমার সঙ্গে নিচে যাবে।’
– ‘আচ্ছা।’
অনিক দাঁত ব্রাশ করে মুখ-হাত ধুয়ে বের হয়ে বললো, ‘যাও, গোসল করে নাও তাড়াতাড়ি।’
পদ্য সবকিছু নিয়ে গেল বাথরুমে। অনিক টেবিলে বসলো কাগজ কলম নিয়ে। বাবার জন্য সে কিছু কথা কাগজে লিখবে। পদ্য বের হওয়ার আগেই লিখে সে পকেটে রাখলো। পদ্য শাড়ি পরে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে তার সঙ্গে নিচে গেল। নাশতা করলো সবাই এক সঙ্গেই। পদ্য পুরোটা সময় মাথা নিচের দিকে দিয়ে আছে। কারো দিকেই লজ্জায় ঠিকঠাক তাকাতে পারছে না। অনিক আগেই নাশতা শেষ করে বাবার রুমে গিয়ে দেখে মিরাজুল ইসলাম বিছানায় বসে আছেন। সে আমতা-আমতা করে বললো, ‘আব্বা কী করছো?’
তিনি উঠে বললেন, ‘কিছু বলবি?’
– ‘না আব্বা, এই কাগজটা রাখো।’
– ‘কী এটা?’
– ‘পড়বে একবার সময় হলে।’
তিনি হাত বাড়িয়ে নিলেন। অনিক বের হয়ে এলো করিডরে। বাইক নিয়ে বাইরে গেল সে। পদ্য এসে ফিসফিস করে বললো, ‘বাইক ছাড়া গেলে হয় না?’
– ‘বাইক ছাড়া আরও বেশি সমস্যা হবে। তবে ছাড়াই চলো। আমি চাই সমস্যা ফেস করো আরও বেশি।’
– ‘কী যে বলো। এমনিতেই লজ্জা লাগছে।’
– ‘লাগুক। বাইক ছাড়া চলো।’
পদ্য লাজুক চেহারায় পিছু পিছু গেল। তাদের বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো বারান্দায় বেশ কয়েকজন মহিলা। রাস্তায় এসেও দেখে দু’জন মহিলা এদিকে আসছে। এরা পদ্যদের বাড়িতেই যাবে বলে মনে হচ্ছে। দূর থেকে “হা” করে তাকিয়ে ফিসফিস করছে। পদ্য অনিককে আস্তে-আস্তে বললো, ‘এরা দেখো কীভাবে তাকাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে সবাই যাওয়া ধরেছে মনে হয়।’
অনিক কোনো জবাব দিল না। হেঁটে হেঁটে মহিলা দু’জনের সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘কোথায় যান চাচি?’
জবাব না দিয়ে দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। অনিক পুনরায় বললো, ‘বয়সে ছোটো একটা ছেলের কাছে মাইয়া বিয়া দিছে মনিরা বেগম। এখন তাকে দেখতে যাচ্ছেন, তাই তো?’
– ‘আমরা মনিরার বাড়ি যাইতেছি কে কইল তোমারে? এই রাস্তা দিয়া কি শুধু মনিরা বেগমের বাড়ির যায় মানুষ?’
পদ্য তাকে হাত ধরে টানছে, সে পাত্তা না দিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
– ‘বলেন কী চাচি, বয়সে ছোটো একটা ছেলের কাছে মাইয়া বিয়া দিছে মনিরা বেগম তার মাথায় শিং গজাইছে কি-না দেখতে যাইবেন না? এইটা কি কইলেন?’
একজন মহিলা তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘কেন আমাদের কী খাইয়া-দাইয়া কাজ-কাম নাই? কে কার মাইয়া কার কাছে বিয়া দিছে তাতে আমাদের কী? এই আয় তো রশিদা। দাঁড়াইয়া আছিস কেন?’
ওরা চলে যাওয়ার পর পদ্য অনিকের দিকে দাঁত কটমট করে বললো, ‘এরকম করতে গেলে কেন?’
– ‘তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখানোর জন্য।’
– ‘কী ম্যাজিক?’
– ‘ওই মহিলা কী বলে গেছে দেখেছো? যেখানে আমাদের বলার কথা, ‘আমরা কে কাকে বিয়ে করেছি তাতে তোমাদের কী? তোমাদের কী খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই? কিন্তু যখন আমি লজ্জা না পেয়ে তাকে নিয়ে মশকরা শুরু করেছি৷ এখন নিজেরাই বলছে তাদের কী খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই। কে কার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে তাতে তাদের কী। এটাই হলো সিস্টেম। হয় মুখোমুখি দাঁড়াও, না হয় চুপ থাকো। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের কাজ করো। কিন্তু লজ্জা, ভয়, লুকোচুরি করতে গেলে ওরা আরও বেশি মজা পাবে। আবার গালাগাল করলেও মজা পাবে। মূল কাজ হলো আমি যা করেছি, হ্যাঁ করেছি, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেটা করা। তুমি স্কুলে গিয়েও সেরকম ক্লাস করাবে। একেবারে অন্যদিনের মতো।’
– ‘কিন্তু আম্মাকে গিয়ে পাগল করে দেবে এরা।’
– ‘সমস্যা নেই, আমি যাব তোমাদের ঘরে।’
– ‘গিয়ে কী করবে।’
– ‘পরে দেখা যাবে চলো তো।
দু’জন গল্প করতে করতে স্কুলে চলে এলো।
.
মিরাজুল ইসলাম কাগজটা মেলে একা একা পড়লেন,
“আব্বা, পদ্যের প্রতি আমার দূর্বলতা জেনে বেশ কয়েক বছর আগে তুমি যা করেছিলে। তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। তোমার প্রতি আমার কোনো অশ্রদ্ধাও নেই। বরং পদ্যকে পাওয়ার জন্য হয়তো নানাভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি৷ বেয়াদবের মতো যুক্তি-তর্ক করেছি। সবকিছুর জন্য আমি ক্ষমা চাই। কয়েকদিন থেকে খুবই কষ্ট হচ্ছে আব্বা। নিজের স্বার্থের জন্য হয়তো তোমাদের অনেক সমস্যায়ও ফেলেছি, কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি অন্য পরিবার হলেও এই বিয়ে সহজে মেনে নিতো না৷ তোমরা মেনে নিয়ে আমাকে ঋণী করে দিয়েছো। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই আব্বা৷ আমি তোমাদের সন্তান হিসাবে গর্ববোধ করছি। ওইদিন রাতে পদ্যদের ঘরে হয়তো কষ্ট পাওয়ার মতো অনেক কিছুই বলেছি৷ সবই ছিল দীর্ঘ একটা প্রস্তুতির মঞ্চায়ন। কষ্ট পেয়ে থাকলে মাফ করে দিয়ো আব্বা। আমি নিজের সুখের জন্য এগুলো করেছি৷ তুমি তো সন্তানের সুখই চাও। তাই আমার সুখের দিকে চেয়ে সবকিছু ক্ষমা করে দিয়ো। সামনা-সামনিই কথাগুলো বলা যেত। পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মধ্যখানে কিন্তু কী এক আশ্চর্য দেয়াল থাকে। রাগারাগি, চিল্লাচিল্লি করার সময় সেই দেয়াল থাকে না৷ অস্বস্তির সেই দেয়ালটা দৃশ্যমান হয় বাবা পুত্রকে, পুত্র বাবাকে এসব কথা বলতে গেলে। সেই অস্বস্তির জন্য সরাসরি বলতে পারিনি। তাই কাগজের আশ্রয় নিয়েছি। দেখে নিয়ো আব্বা, আমি এখন থেকে খুবই সংসারী ছেলে হব। তুমি শুধু দোয়া করো। আর পারলে ক্ষমা করে দিয়ো তোমার বেয়াদব ছেলেটাকে।”
কাগজটা মিরাজুল সাহেব একবারে পড়তে পারলেন না৷ চোখ বারবার জলে ঝাপসা হয়ে আসছিল৷ বেশ কয়েকবার কষ্ট করে পড়ে শেষ করে তিনি একা একা খানিকক্ষণ কেঁদে চোখ মুছে নিলেন।
.
আজ শুক্রবার। প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে বিয়ের। সবকিছু ক্রমশই স্বাভাবিকও হতে শুরু করেছে। অনিকের ঘুম ভাঙলো খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনে৷ সে বিছানায় উঠে বসে দেখে পদ্য জানালার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হাসছে।
– ‘এভাবে চুল ছেড়ে রূপবতী কোনো নারী জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ভূ*তে তো ধরবেই।’
পদ্য মাথা ঘুরে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘তুমি উঠে গেছো না-কি? আর ভূ*তের কথা কী বললে যেন?’
– ‘বলেছি একা একা খিলখিল করছো কেন? ভূ*তে ধরেছে না-কি?’
– ‘আরে না, মুখ ধুয়ে এসে জানালা খুলে দেখি মনিসা কল পাড়ে বসে দাঁত ব্রাশ করছে। আর আমাকে যখনই দেখলো, ভেংচি কাটতে শুরু করেছে।’
অনিক উঠে এসে তাকিয়ে বললো, ‘কই?’
– ‘বুঝে ফেলছে তোমার সঙ্গে কথা বলছি। চলে গেছে ঘরে। ও তোমাকে অনেক লজ্জা পায়।’
– ‘তুমি ছুটি নাও, তোমাকে নিয়ে ঘুরতে গেলে ওকে সাথে নেব। লজ্জা ভেঙে যাবে।’
– ‘জি আচ্ছা জনাব। এখন হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি নাশতা দিচ্ছি।’
অনিক পিছু থেকে জড়িয়ে ধরে জানালার পর্দা টান দিয়ে বললো, ‘আজ শুক্রবার। এত তাড়াতাড়ি না উঠলেই পারতে।’
– ‘ঘুম ভেঙে গেল।’
এবার চুলে নাক ডুবিয়ে ঘোর লাগা গলায় বললো, ‘এক সপ্তাহ হয়ে গেল৷ এখনও আমার স্বপ্নের মতো লাগে সবকিছু পদ্য।
– ‘ঢং।’
– ‘ঢং না, সত্যিই, এই যে তোমার চুলগুলোও আমার ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড ভালো লাগতো। এখন চাইলেই আমি নাক ডুবিয়ে দিতে পারছি। তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি৷ পৃথিবীটা হুট করে কত সুন্দর হয়ে গেছে। তুমি আমাকে যেদিন চ*ড় মে*রে বিদায় করে দিয়েছিলে। এরপর থেকে এতটা বছর আমার কীভাবে গেছে বলে বুঝাতে পারবো না। তোমাকে পাব সেই আশাটুকুও ছিল না৷ হুট করে কীভাবে যেন পেয়ে গেলাম।’
পদ্য ঘুরে অনিকের দিকে তাকিয়ে চোখবুজে কপাল পেতে রাখলো৷ অনিক মুচকি হেঁসে কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরলো৷ পদ্য আদুরে বিড়ালের মতো বুকে মিশে থাকলো খানিক্ষণ। তারপর কোমল গলায় বললো, ‘অনিক প্লিজ তুমি আর কোনোদিন পেছনের ওই কথাগুলো বলবে না৷ আমার প্রচণ্ড লজ্জা লাগে। তুমি বয়সে ছোটো হলেও তোমার প্রতি সব সময় আমার অন্যরকম শ্রদ্ধা ছিল। চ*ড় মেরেছি তোমাকে একদিন। এটা ভাবলেই আমার লজ্জা লাগে। সেগুলো অভিনয় ছিল। যাতে তুমি আমাকে ভুলতে পারো। তুমি যে পায়ে চুমু খেয়েছিলে না? কিংবা এই কয়দিন আমার ব্যবহার করা রুমাল নিয়ে ঘুরেছো যে৷ এগুলোও আমার ভালো লাগেনি৷ তুমি এভাবে নিজেকে ছোটো করলে আমার কষ্ট হয়। তোমাকে পেয়েছি এটা আমার কাছেও স্বপ্নের মতো। তোমাকে চ*ড় মে*রে বিদায় করার পর এই ক’টা বছর আমিও ভালো ছিলাম না।’
– ‘ছিলে না? তুমি ঠিক কবে থেকে আমার প্রেমে পড়েছো?
– ‘তা ঠিক বলতে পারবো না। তুমি সেবার গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি কেমন যেন কষ্ট পেতাম৷ কিন্তু একবার ঈদে যখন দেখেছিলাম। এরপর আমি আরও বেশি দূর্বল হয়ে যাই। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে মনে পড়তো। হয়তো আমি তখন থেকে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।’
– ‘তাহলে এতটা বছর কীভাবে পারলে নিজেকে সামলে রাখতে? কখনও আনব্লকও করোনি।’
– ‘শুধু নিজেকে কোনোভাবে সামলে রেখেছি আরকি। সারাক্ষণ স্মৃতি রোমন্থন করতাম৷ আসলে হয়েছি কী। তোমার রানিং লেখা ‘ছন্দহীন কবিতা’ আছে না। সেটা তো এই কয়েকদিন পড়ছি আমি। আজ রাতে ফিনিশিংও বললে
সেটার নায়িকা কবিতা শেষদিকে নায়ককে না পেয়ে ছন্দহীন কবিতার মতো হয়ে যাবে। আমিও কিন্তু তেমন। তোমাকে ছাড়াও ওই ক’টা বছর আমি ‘ছন্দহীন পদ্য’ ছিলাম। ছন্দহীন কবিতার মতো প্রাণহীন, তালহীন। এখন আমি সেই প্রাণ ফিরে পেয়েছি।’
– ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ, তুমি হচ্ছ এই পদ্যের জীবনের ছন্দ। তুমি ছাড়া আমি ছন্দহীন পদ্য।’
অনিক চোখবুজে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পদ্যকে। সবকিছু এতো ভালো লাগছে কেন আজকাল! এই নিরস জীবনটা হুট করে অদ্ভুত সুন্দর হয়ে গেল কীভাবে! সে দীর্ঘ কোনো স্বপ্নের ভেতরে আছে না-কি পদ্যকে পেয়ে জীবনটাই তার স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে কে জানে!
________সমাপ