ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৮
.
পরেরদিন পদ্য যখন ঘুম থেকে উঠেছে৷ তখন অনিক আর বাসায় নেই। রাতে একটু দেরিতেই ঘুমিয়েছিল সে। কী এক অসহ্যকর যন্ত্রণায়, অস্থিরতায় ছটফট করে রাত কাটিয়েছে। পদ্য রান্নাঘরে যাওয়ার পর আফরা নিজেই ফিসফিস করে বললো, ‘সন্ধ্যায় কী এমন হলো পদ্য? অনিক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তোমার আব্বার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি বললাম নাশতা করে যাও। সে বললো বাইরে করবে।’
পদ্য কোনো জবাব দিল না। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়৷ পাহাড় আর গাছাগাছালি দেখা যাচ্ছে। দূরে, বহুদূরের গহিন কোনো বন থেকে তখন ঘুঘু পাখির ডাক শোনা গেল৷ খানিক পরে কাকেরও কা-কা ডাক। বিষণ্ণ হয়ে উঠলো যেন চারপাশ। হাহাকারে ভরে উঠলো পদ্যের বুক। চাপা এক কষ্ট। তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে এলো সে। মোবাইল হাতে নিয়ে অনিককে মেসেজ দিল, ‘তোমাকে আমি কী বলেছিলাম চলে যেতে? ব্লকও তো করিনি। আমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে এমন করেছো তাই না?’
কোনো রিপ্লাই এলো না। পদ্য পায়চারি করতে লাগলো রুমে। দমবন্ধ লাগছে। মনিসা তাকে দেখে বললো, ‘কী হয়েছে আপু?’
– ‘তুই রুম থেকে যা।’
– ‘কেন যাব?’
– ‘যাবি কি-না বল।’
মনিসা উঠে চলে যায়। পদ্য দরজা বন্ধ করে কল দিল। দু’বার রিং হতেই রিসিভ করলো অনিক। পদ্য কান্নায় কথা বলতে পারছে না৷ বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা ধরে আসছে। অনিক ওপাশ থেকে বললো, ‘হঠাৎ কল দিয়েছো যে, শুধু ফোঁপানোর শব্দ পাচ্ছি, কথা বলো।’
পদ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– ‘তোমাকে আমি কী বলেছিলাম চলে যেতে?’
– ‘থাকতেও তো বলোনি।’
– ‘তোমার বাসায় তুমি থাকবে এখানে আমার কী? ব্লকও তো করিনি আর।’
– ‘কী হয়েছে বলো তো পদ্য। কাঁদছো তুমি! কেন কাঁদছো?’
– ‘তুমি ভোরে উঠেই চলে গেলে কেন? মানুষকে কষ্ট দিতে তুমি ভালোই জানো তাই না?’
– ‘তুমি এভাবে বললে কিন্তু পাখি হতে ইচ্ছা করবে।’
– ‘পাখি হতে কেন?’
– ‘তোমার কাছে তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য।’
– ‘তুমি এখন কোথায়?’
– ‘শহরেই আছি। একটা কাজ ছিল, তাই এটা সারতে দেরি হচ্ছে। একটু পরেই বাসে উঠে রসুল পুর চলে যাব। তারপর তুমি রসুল পুর গেলে আমি ফিরে আসবো এই শহরে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
অনিকের হাসি শোনা গেল। হাসতে হাসতে বললো, ‘ও আচ্ছা বলে আবার নিজেকে শক্ত করছো তাই না? পদ্য নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। তোমার আর আমার কষ্ট একই। আমাদের কষ্ট আমাদের থেকে আর কেউই ভালো বুঝবে না। পাই আর না পাই, মনখুলে দু’টো কথা তো বলতে পারি আমরা, তাই না? এই যে তোমার কান্না পাচ্ছে, আমারও তো পায়। কান্না পেলে তো জড়িয়ে ধরেও করতে পারি। তুমি সেটা থেকেও নিজেকে বিরত রাখো কেন? আসো, দেখা করি। তারপর চলে যাব।’
– ‘কোথায় আসবো? আমি এলে তো সত্যিই কাঁদবো। কান্না ছাড়া আর তো কিছু বলার নেই।’
অনিক খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘ব্যস্ত শহরে হাসাহাসির অনেক জায়গা থাকে, কিন্তু মনখুলে কাঁদার জায়গা নেই। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। তুমি বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি বা রিকশা নিয়ে আম্বরখানা আসো।’
– ‘তারপর?’
– ‘আসো আগে, তারপর দেখা যাবে।’
পদ্য তাড়াতাড়ি দাঁত ব্রাশ করে, মুখ ধুয়ে, শাড়ি ঠিকঠাক করে পরে আফরাকে গিয়ে বললো, ‘ভাবি আমি বাইরে যাচ্ছি।’
আফরা তার জন্যই চা ঢালছিল। ফ্ল্যাক্স রেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, ‘কোথায়?’
– ‘ভাবি অনিক এখনও শহরে আছে। আমার ভালো লাগছে না৷ সন্ধ্যায় মানুষটা আমার সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ফুসকা, বাদাম খেতে বলেছিল। সেই সুযোগটাও আমি দেইনি৷ আমার চাপা কষ্ট হচ্ছে ভাবি। তুমি আব্বা-আম্মাকে সামলে নিয়ো আমি যাই?’
– ‘আচ্ছা চা খেয়ে যাও।’
– ‘না যাই, ও অপেক্ষায় আছে।’
– ‘আচ্ছা যাও।’
পদ্য আম্বরখানা এসে কল দিল।
– ‘কোথায় তুমি?’
– ‘মসজিদের সামনে আসো।’
পদ্য সেদিকে গেল৷ অনিক একটা গাড়ির সামনে থেকে হাত তুলে নিজের জানান দিল। কাঁধে ব্যাগ। এলোমেলো চুল। বিষণ্ণ চোখ। রাতের সেই সাদা পাঞ্জাবি। সে কাছে যেতেই অনিক বললো, ‘তুমি কী ঘুম থেকে উঠেই কল দিয়েছিলে। চোখ-মুখ ফুলে আছে যে?’
– ‘হ্যাঁ, ঘুম থেকে উঠেই দিয়েছি।’
‘বাহ, গুড। কোথাও পড়েছিলাম মানুষের ভোরবেলা জরুরি সিদ্ধান্তগুলো নেয়া উচিত। তখন না-কি মাথা অন্য সময়ের তুলনায় বেশি ভালো কাজ করে। সুতরাং তুমি আজ যাই সিদ্ধান্ত নিয়েছো, ভালোই নিয়েছো’ তারপর অনিক গাড়িতে উঠে বললো, ‘আসো, উঠে বসো।’
– ‘কিন্তু যাব কোথায়? বাসায় তো ওরা অপেক্ষা করবে।’
‘আসো, উঠে বসো আগে।’ পদ্য উঠার পর পুনরায় বললো, ‘বেশি সময় থাকতে পারবে না জানি। তাই গাড়ি নিয়েছি৷ এদিকে নিরিবিলি রাস্তা আছে। গাড়ি আস্তে-আস্তে যাবে। আমরা গল্প করবো। তুমি নিশ্চয় কিছু বলতে চাচ্ছ। না হলে কল দিতে না। এখন গাড়ি যেতে বলি?’
পদ্য ভালোভাবে বসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। অনিক ড্রাইভারকে বললো, ‘আপনি যান ভাই।’
গাড়ি ধীর গতিতে এগোচ্ছে। অনিক এক পা সীটে তুলে পদ্যের দিকে ঘুরে বসে বললো, ‘এবার বলো তুমি কিছু বলবে কি-না। গাড়িতে এসেছি যাতে শান্তিমতো বলতে পারো। রেস্টুরেন্টে গেলেও মানুষ থাকে চারদিকে।’
পদ্য শাড়ির আঁচল খুঁটতে খুঁটতে বললো, ‘কী বলবো এখন আসলে বুঝতে পারছি না।’
অনিক সীট থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে এত তাড়া নেই’ তারপর ড্রাইভারকে বললো, ‘একটা গান ছাড়েন ভাই। অবশ্যই স্যাড গান।’
– ‘স্যাড গান কেন ভাই?’
– ‘পৃথিবীতে এখন স্যাড গানিই বেশি বাজা উচিত। মানুষের মন আর মন নেই, পাথর হয়ে গেছে। স্যাড গান শুনলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’
পদ্য মুখে হাত দিয়ে স্মিথ হাসলো। অনিক পানির বোতল পদ্যের হাতে দিয়ে বললো, ‘খাও’ তারপর একটা ব্যাগ খুলতে খুলতে পুনরায় বললো, ‘তুমি তো মনে হয় নাশতা করেও আসোনি? সামনে কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে আর কিছু নিই? এখানে শুধু পিৎজ্জা।’
– ‘না আর কিছু লাগবে না।’
অনিক ড্রাইভারকে দিয়ে আবার বসে বললো,
– ‘নাও নিজের হাতে খাও।’
পদ্য ইতস্তত করে বললো, ‘আচ্ছা পরে খাব। একটা কাজ করা যায় না। সামনে কোথাও গাড়ি রাস্তার একপাশে রেখে উনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না?’
– ‘পারবে, আরেকটু সামনে যাক।’
গাড়ি আরও কিছুদূর যাওয়ার পর অনিক বললো, ‘ভাই একটা কাজ করুন। রাস্তার একপাশে গাড়ি থামান।’
ড্রাইভার থামানোর পর বললো, ‘আপনি ওই দোকানে গিয়ে সিগারেট, চা খান, মোবাইল টিপুন। আমরা কিছু কথা বলবো। তাই আরকি৷ রাস্তার পাশে আছে। গ্লাসও খোলা থাকবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে ড্রাইভার গাড়ি একপাশে রেখে চলে গেল। দুইপাশে চা বাগান, পাহাড়। মানুষের আনাগোনা কম। শুধু সাই-সাই করে গাড়ি যাচ্ছে-আসছে।
নির্জন, নিরিবিলি এই জায়গায় অনিকের সঙ্গে একা আছে ভাবতেই কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করেছে পদ্যের। সে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল৷
– ‘পদ্য শোনো।’
অনিকের কথা শুনে পদ্য মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।
– ‘কী।’
ক্ষীণ সময় নিয়ে বললো, ‘আমি যা বলার গতকাল বলেছি। আমার সবকিছুই তুমি জানো। এখন যা বলার তুমিই বলতে হবে। তুমি তো আর এমনিই নিজ থেকে কল দাওনি।’
– ‘তোমার কিছু বলার নেই?’
– ‘তা আছে, বলার, চাওয়ার কতকিছু আছে৷ কিন্তু সেই অধিকার আমার নেই।’
– ‘কী চাওয়ার আছে বলো শুনি।’
– ‘যেমন আমরা একসঙ্গে বসে আছি। আমার ইচ্ছা করছিল হাত ধরে বসতে। পিৎজা বের করে ইচ্ছা করছিল খাইয়ে দিতে। কিন্তু এগুলোর তো মানে হয় না। এগুলো বললেই তো একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। এর ভবিষ্যৎ কী? তাই না?’
পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘অনিক, আমি গতকাল রাতে ফিরে এসে একা একা অনেক কেঁদেছি। তুমি তো জেনেই গেছো সব। আমিও তোমাকে ভালোবাসি৷ আমার অনেক কষ্ট হয় অনিক। গতকাল সন্ধ্যায় তুমি আমার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছো। তুমি হাত ধরতে চাও ধরো, খাইয়ে দিতে চাও, দাও। কিন্তু আমাকে বলো না কী করবো। কী করতে চাই। আসলে আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না। তুমিই বলো পারলে কী করবো।’
অনিক তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে। পদ্য খানিক পর বললো, ‘কী হলো?’
অনিক ব্যগ্র গলায় বললো, ‘সত্যিই তোমার হাতটা ধরবো একটু?’
পদ্য চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। মুখ গুঁজে ফেললো অনিকের বাহুতে। তারপর, ভেজা গলায় বললো, ‘তুমি প্লিজ এভাবে আর বলো না। আমার অনেক কষ্ট লাগে অনিক। তুমি এবার বলো আমি কী করবো। আমিও বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আবার ওদিকে আব্বার অবস্থা তুমি জানোই।’
অনিকের চোখগুলো ছলছল করে উঠলো। পদ্যের চুলগুলো তার ভীষণ প্রিয়। তার বাহুতে কপাল ঠেকিয়ে থাকায় পদ্যের চুলগুলো চোখের সামনে। সে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আমরা চেষ্টা করবো পদ্য, পাই না পাই চেষ্টা করে দেখবো। তুমি আগে আমাকে সবকিছু খুলে বলো। তুমি এত ভালোবেসে থাকলে এতদিন এভাবে গোপন রেখেছিলে কেন? আর আগে পিৎজা খাও। খেতে খেতে বলো।’
পদ্য মাথা তুলে নাক টেনে চোখ মুছতে নিচ্ছিল। অনিক হাত ধরে ফেললো। পদ্য ভেজা গলায় বললো, ‘কী হয়েছে?’
– ‘কান্না কান্না ভাব থাকায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তোমার৷ একটা মানুষ এত মায়াবী হয় কীভাবে পদ্য? আমি একটু চোখের পানি মুছে দেই তোমার?’
পদ্য মাথা নাড়লো। অনিক আরেকটু নিবিড় হয়ে বসে আঁজলা করে ওর মুখটা ধরলো। তারপর দুই হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে দুই চোখের জল মুছে দিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, ‘চোখ মুছে দেওয়ার সুযোগে তোমার কোমল মুখটা আঁজলা করে ধরার লোভটা সামলাতে পারলাম না।’
পদ্য হেঁসে আবার কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘এই যে এত ভালোবাসছো, যদি না পাই এই ভয়টা ঠিকই ভেতরে খুঁড়ছে আমার।’
– ‘আমার সেই ভয় করছে না। উলটো তুমি যে হুট করে আমাকে এতকিছু দিচ্ছ, আমি হঠাৎ সুখে বুক ফেটে মরে যাব মনে হচ্ছে। বুকে এত সুখের জায়গা কোথায় বলো।’
পদ্য কাঁধ থেকে মাথা তুলে ছলছল চোখে অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বিশ্বাস করো তোমাকে প্রশ্রয় দিতে চাইনি বলেই এত কঠিন করে কথা বলতাম। কিন্তু রোজই মনে হতো ইস পৃথিবীতে কতই না অলিক ঘটনা ঘটে। কত রহস্যময় এই পৃথিবী। কোনো দৈব ইশারায় যদি তোমাকে আমি পাইতাম৷’ তারপর চোখের পানি মুছে পুনরায় বললো, ‘তোমাকে কী কোনোভাবে পাওয়ার সুযোগ নেই অনিক? আমি আসলে নিজেকে অনেক সামলে রেখেছি। আমার আর সহ্য ক্ষমতা নেই। বাঁধ ভেঙে গেছে আমার।’
অনিক বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুমি হুট করে আমাকে এভাবে বলা শুরু করেছো কী খু*ন করতে পদ্য? আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে সবকিছু।’
পদ্য নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক করে বললো, ‘আচ্ছা পিৎজা খাইয়ে দাও।’
অনিক এক পিস পিৎজা হাতে নিয়ে বললো, ‘খেতে খেতে আমাকে বলো সবকিছু। কেন এতদিন এভাবে চেপে রেখেছিলে।’
দু’জন খেতে খেতে কথা বলছে।
পদ্য মিরাজুল সাহেবের পুরো ঘটনা খুলে বললো তাকে। অনিক সবকিছু শুনে খানিক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘বুঝেছি, আব্বাও যে খুব খারাপ কিছু করেছেন তা না।’
– ‘এবার বলো কী করার। দুই পরিবারই তো রাজি না।’
– ‘পদ্য আগে আমাদের নিজেদের ভেতরের হীনমন্যতা দূর করা দরকার। কে রাজি, কে না সেটা পরে।’
– ‘বুঝিনি।’
– ‘আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি তা ঠিক তো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসা কোনো অদ্ভুত কিছু না৷ খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সমাজে এগুলো আছে বলেই নাটক, সিনেমা হয়। প্রেম-ভালোবাসাও যে সত্য। সেটার প্রমাণও হলো পৃথিবীতে বহু মানুষ এর জন্য জীবন দিয়েছে।’
– ‘এগুলো এখন শুনে কী হবে?’
– ‘আগে সব কথা শোনো। শুধু যে আমাদের পরিবার মানবে না তা তো না। সমাজও মানবে না৷ পরিবারকে বুঝাতে হলেও আমাদের মন পরিষ্কার থাকতে হবে। আমরা যে আশ্চর্য কোনো কাজ করে ফেলেছি তা না। হ্যাঁ, অসম প্রেম। সেটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক। অন্যদের কাছে অস্বাভাবিক হলে আমাদের বুঝাক। আমি আমার কথা বলবো৷ ওরা ওদের কথা। আগে তো আমাদের শক্ত হতে হবে। তোমার বাবাকে এখন না বলে আমরা অন্যদের মুখোমুখি হই। তোমাকে আমার আব্বা বলেছিল আমাকে প্রশ্রয় না দিতে। এবং তাকে সবকিছু বলতে। তুমি এবার কল দিয়ে বলো, ‘চাচা আমি এখন নিজেই অনিকের প্রেমে পড়ে গেছি, আমি সত্যিই চাই ওকে বিয়ে করতে কিন্তু আমার আব্বার যে অসুখ এগুলোর জন্য মুখ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।’ তারপর সে দেখো কী বলে।’
– ‘কী বলো! এভাবে বলবো?’
– ‘একটু আগে বলেছি না হীনমন্যতা দূর করতে। এজন্য বলেছি। নিজে, নিজের পক্ষ থাকতে হয়। আমি প্রেম করেছি, ভুল হলে আমাকে বুঝিয়ে দিন। বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা? আমার আব্বা তো নিজেই মাঝখানে ঢুকছেন তাই না? তো এখন সে মাথা ঘামাক। তুমি যখন বলবে ওই কথা তখন উনি কী বলবে জানো?’
– ‘কী?’
– ‘বলবে কী বলো মা? মানুষ কী বলবে। মানে এই লাইনে কথা এগুবে।’
– ‘তখন কী বলবো আমি।’
– ‘এই তো লাইনে এসেছো। তোমার আব্বা সুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা আব্বার সাথে কথা বলবো। উনি সমাধান করুক এই সমস্যার।’
– ‘আচ্ছা উনি যখন বলবে তোমার লজ্জা নেই, বয়সে ছোট একটা ছেলের প্রেমে পড়লে কীভাবে?’
– ‘তুমি বলবে আমি তো চাচা আপনার কথায় ওকে সব সময় তাড়িয়ে দিয়েছি। তাকে কখনও বলিনি পছন্দ করি। ওর কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। আমি চাচ্ছি জানিয়ে দিতে। আর না হয় আপনি একটা কিছু করেন। আমাদের বিয়ে দেন। অথবা অনিককে নিজে বুঝিয়ে দেখুন। তুমি এভাবে জবাব দিবে। তোমাকে দিয়ে যাতে আর কিছু করতে না পারে।’
– ‘আমার লজ্জা লাগবে এভাবে বলতে।’
– ‘তাহলে তুমি বলবে আচ্ছা চাচা আপনি আমাকে একা বুঝিয়ে তো লাভ নেই। অনিক আর আমাকে নিয়ে বসুন। দু’জনকে বুঝান। এভাবে তো আর হচ্ছে না।’
– ‘ওরা তো ওদের মতো বোঝাবে।’
– ‘ওরা যদি আসলেই বুঝাতে পারে তাহলে বুঝলাম, না হলে তো নাই। মানে আমরা তো পালিয়ে, লুকিয়ে বিয়ে করতে পারি, পারি না? তবুও তো তাদের সাথে কথা বলবো। ওরা বুঝাতে না পেরে কী করবে? বলতে তো পারবে না যা ইচ্ছা করো। কারণ জানে আমরা বিয়ে করে নিব। তাই আমরা নিজেদের দুশ্চিন্তা ওদের উপরও দেই।’
– ‘আচ্ছা ধরলাম তোমার আব্বা মেনে নিলেন, তারপর কী হবে? আমার আব্বা এসব শুনে যদি আবার স্ট্রোক করেন।’
– ‘তোমার আব্বা অসুস্থ তাই একেবারে পরে উনার চিন্তা। আগে আমার আব্বা যেহেতু নিজেই মাঝখানে ঢুকেছেন, উনার মুখোমুখি হই। তোমার আব্বা রাজি হওয়ার পর তুমি ঠিকই বলবে সমাজ কী বলবে। এজন্য বলেছি তুমি আগে নিজের মন পরিষ্কার করো।’
– ‘আমার মন পরিষ্কার কী করবো?’
– ‘বয়সে ছোট-বড় ব্যাপার যে স্বাভাবিক সেটা নিজে বিশ্বাস করো কি-না বলো। শোনো, পৃথিবীতে সমকামীও তো আছে। আছে না? আমরা অনেকে ব্যাপারটা ভাবলেই বমি আসে। কিন্তু ওরা তো এই জীবন যাপন করছে। যার যার রাষ্ট্রে তাদের স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছে। করছে না? আর আমরা তো ছেলে-মেয়ে। পৃথিবীর কোনো মানুষই এসবের বাইরে না। আর বয়সে বড়ো যে ব্যাপারটা। ডিভোর্স হওয়ার পরও তো বয়সে ছোট ছেলেকে বিয়ে করে অনেকে। তখন কেউ কিছু বলে না। বড়ো ছেলে মা*রা গেলে অনেক পিতা নিজেই তার ছোট সন্তানকে বলে ভাবিকে বিয়ে করতে। তখন বয়স কোথায় থাকে? আর আপু ডাকতাম তো কী হয়েছে? রক্তের কোনো সম্পর্ক আমাদের নেই। আমি যদি মন থেকে তোমাকে নিজের বড়ো বোন ভাবতাম তাহলে তো আমার এই অনুভূতি আসতো না, তাই না? তাহলে আমরা কেন লজ্জা পাব? আর সমাজের মানুষ হাসাহাসি করবে তাতে আমাদের কী? আমরা উলটো হাসাহাসি করবো তাদের নিয়ে।’
– ‘এত মানুষ নিয়ে তুমি হাসাহাসি করবে?’
– ‘হ্যাঁ করবো, বিয়ে হোক তারপর দেইখো মানুষের নিজের মুখ থেকে কী বের করি।’
– ‘কী বের করবে?’
– ‘সেটা বিয়ে হলে দেখা যাবে। এখন তোমার কাজ হচ্ছে আব্বার সাথে কথা বলা। আর আমার সাথে চ্যাটে কথা বলবে রোজ।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘দাও আব্বাকে কল দাও এখন।’
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম