ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৬
.
যার সঙ্গে বিচ্ছেদ নিশ্চিত, তার স্মৃতিবিজড়িত তল্লাটে থাকাটা মোটেও সুখকর নয়। তখন ভোলার চেষ্টা করাতেই মঙ্গল। অথচ স্মৃতির সাগরে সাতার কেটেই দিন যাচ্ছে অনিকের। গ্রামে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল তার।
রোজই আফরা ভাবির সঙ্গে টুকটাক কথা হয়, খবর নেয় ওদের। গ্রামের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা খুবই কম হয়। দু’দিন আগে একটা পুরাতন বাইকও কিনে নিল সে। কেউ একজন বিক্রি করবে শুনেই হুট করে ইচ্ছা হলো, তারপর কিনে নেয়া। এখন বাইক নিয়ে কখনও খেয়া পাড় হয়ে রসুল পুর বাজারে যায়। আবার কখনও সন্ধ্যায় রইসু চাচার শিমুল গাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা নদীর পাড়ে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। রাতে লিখতে বসে মাঝে মাঝে। লেখা আসে না। লিখতে বসলেই লেখা থেকে স্মৃতি রোমন্থনই বেশি হয়ে যায়৷ সে জানে, শুধু সময়েরই অপেক্ষা, তারপর হঠাৎ একদিন তার চোখের সামনে পদ্যের বিয়ে হয়ে যাবে। এটাই হওয়ার কথা। পদ্য যেখানে তাকে চায় না, তার আসলে সেখানে কিছুই করার নেই। দিনকাল এভাবেই যাচ্ছিল৷ অনেকটা ঘোরের ভেতর দিয়ে। কিন্তু সামান্য পরিবর্তন হলো আজ, পৃথিবী ভেসে যাওয়া এই চাঁদনি রাতে। রসুল পুর বাজার থেকে সোজা নদীর পাড়ে এসে বসেছিল। পেছনে সবুজ ধান ক্ষেত। সামনে যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া নদী। আর মাথায় কিছু মিষ্টি স্মৃতি৷ এই জায়গাটাকে পদ্য একদিন ‘বেশ সুন্দর’ বলে তার পাশে বসেছিল। পদ্য সুন্দর বলেছে মানে সুন্দর। গোধূলিলগ্নে এসে বসে পুরো রাত কাটিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দর। পদ্যের থেকে রুচিশীল মানুষ তো আর কেউ হতে পারে না। অনিকও সেই সন্ধ্যার আগে এসে রাত ন’টা এখানে। চাঁদের মুখোমুখি হাত তুলে পেছনে ছায়া ফেলছে, দেখছে। নিজের হাতকে বারবার পদ্যের সেই হাত বলে ভ্রম হচ্ছে। এরকমই সময় যাচ্ছিল। হঠাৎ আফরা ভাবির থেকে কল এলো। আর পালটে গেল যেন তার পৃথিবী। এক অবিশ্বাস্য তথ্য দিল আফরা ভাবি। সেটা হলো পদ্যও তাকে ভালোবাসে৷ এবং শুধু ভালোবাসে না। ওর বাবার অসুস্থতার পেছনে তারা দু’জনই দায়ী। পদ্য পরিবারকে তার কথা বলে দিয়েছিল। এসব কথা অনেকদিন কষ্ট করে গোপন রেখেছে। বারবার বলতে গিয়েও বলেনি। আজ নাঈমের সঙ্গে পরামর্শ করে বলে দিয়েছে। তাদেরও কিছু করার নেই আর। কারণ মতিন মাস্টারের যে অসুখ। তাতে উনার মনে প্রভাব পড়ে এমন আলাপই করা যাবে না। অনিক ফোন রাখার পর থেকে এখানে থ মেরে বসে আছে। পদ্য তাকে ভালোবাসে! তার কথা পরিবারকেও বলেছিল? এরচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা যেন আর নেই। কোনোভাবেই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এখন সে কী করবে? চাইলেই তার বাবাকে বলতে পারে। এতটুকু সাহসী কিংবা বেয়াদব সে জন্ম থেকেই আছে। কিন্তু পদ্যের বাবা? ওর বাবাকে তো উত্তেজিত করা যাবে না। আর পদ্যকে কী সে দেখবে না? এখন যে দেখতে আরও বেশি ইচ্ছা করছে। আরও বেশি আপন মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। তাকেও যে ভালোবাসে তার পদ্য। সাহস করে পরিবারকেও বলে দিয়েছিল তার কথা। সে কালই সিলেট যাবে। অবশ্যই যাবে। দু’চোখ ভরে দেখে আবার চলে আসবে। আজ থেকে তো পদ্য তার স্ত্রী। অলিখিত, অসাংবিধানিক, অস্বীকৃত স্ত্রী৷ দু’জনের মন যখন একে অন্যকে গ্রহণ করে নেয় তখন আর বাকি থাকে কী? বাকি শুধু খাতা-কলম, লোক-দেখানো অনুষ্ঠান। সেই সুযোগ যদি কোনোদিন তার নাও হয়৷ সে অবিবাহিত থাকবে। মনে করবে পদ্যই তার স্ত্রী। নিষ্ঠুর এই সমাজ মনগড়া নিয়ম-কানুন বানিয়ে তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়েছে, নিক। পদ্য তাকে ভালোবাসে, এর থেকে বড়ো পাওয়া আর কোনোকিছুই হতে পারে না। অনিক আফরাকে কল দিল। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করলো সে। কিছু একটা নিয়ে খিলখিল করে হাসছে ওরা।
– ‘হ্যালো ভাবি।’
– ‘হ্যাঁ বলো।’
– ‘এত হাসাহাসি কি নিয়ে?’
– ‘লুডু খেলছি তিনজন মিলে।’
– ‘ভাবি আমি তো কাল একটা কাজে সিলেট আসব। ওদের কি কোনো দরকার আছে বাড়িতে?’
আফরা ওদের মাঝখান থেকে উঠে বারান্দায় এসে বললো,
– ‘কীসের দরকার থাকবে?’
– ‘আমার ধারণা ওদের কাপড় বেশি নেয়নি। আমি যখন যাচ্ছি ওদের কাপড় নিয়ে যেতে পারবো। আম্মার কাছে ওদের ঘরের চাবি আছে।’
– ‘অনিক পাগলামি করো না। এখানে এসে কোনো পাগলামি করলে তোমার ভাই আমাকে দোষারোপ করবে।’
– ‘তুমি না বললে ভাইয়ার সাথে কথা বলে আমাকে জানিয়েছো।’
– ‘সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করার পর বলেছে আচ্ছা জানাও, জেনে-বুঝে ভাবুক কী করবে। এভাবে থাকবে না-কি এসে জবে জয়েন করবে। পদ্যের চিন্তা বাদ, নিজের বিয়ের কথা ভাবুক। সে তো তার দিক থেকে বলেছে।’
– ‘আচ্ছা বুঝেছি, আমি পাগলামি কিছু করবো না। যাচ্ছি একটা কাজেই।’
– ‘মিথ্যে বলবে না অনিক। তোমাকে জানানো ভুল হয়েছে তাহলে।’
– ‘আহা যাও তো ভাবি। জিজ্ঞেস করো ওদের।’
আফরা গিয়ে বললো, ‘পদ্য তোমাদের বাড়ি থেকে কিছু কী আনাবে? অনিক সিলেট আসবে তো তাই জিজ্ঞেস করছে।’
মনিসা আগেই বললো, ‘আমার ড্রেস আনতে হবে।’
পদ্য ইতস্তত করে বললো, ‘আমার লাগবে না, তোমার এগুলোতেই চলে যাবে।’
অনিক ওপাশ থেকে বললো, ‘ভাবি তাহলে কাল আমি ভিডিয়ো কল দেবো৷ মনিসা কাপড় দেখিয়ে দিতে হবে কী আনবো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
পরেরদিন অনিক রেডি হয়ে বের হলো এগারোটায়৷ মিরাজুল সাহেব বারান্দায়। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদের কাপড়-চোপড় নিয়ে যাচ্ছ না-কি?’
– ‘হ্যাঁ আব্বা।’
– ‘আজই চলে আসবে তো?’
সে ঘাড়ের চুলগুলো ঠিক করে বললো, ‘আমি বাসায় থাকলে কী সমস্যা?’
– ‘না তা হবে কেন? বাসায় তো যথেষ্ট রুম খালি আছে।’
– ‘সমস্যা থাকলে বলো আব্বা, থাকবো না। কিন্তু মুখে যদি সমস্যা না বলে আবার ওদের বাসা থেকে বের করে দেওয়ার চিন্তা করো তাহলে কাজটা ঠিক হবে না।’
– ‘অনিক বেয়াদবের মতো কথা বলো না। কেউ কারও বাসায় এতদিন জায়গা দেবে না। আমি দিয়েছি। আর তুমি এসব কী বলছো?’
– ‘না তো বুঝেছি৷ তাহলে আমি দু-একদিন থাকবো বাসায়। আমার কাজ আছে।’
– ‘কী কাজ?’
– ‘একটা অনুষ্ঠান আছে। ইন্টারভিউ আছে। লেখালেখি নিয়ে কাজ আছে। তাই থাকা লাগবে। যদি সমস্যা থাকে আমি হোটেলে থাকবো।’
– ‘তুমি সমস্যা, সমস্যা করছো কেন অনিক। কীসের সমস্যা থাকবে?’
‘আচ্ছা তাহলে গেলাম।’ বলে সে বেরিয়ে পড়লো। বাবার এমন কোনোকিছু না জানার ভান ধরে থাকা নিয়ে তার বেশ সন্দেহ হয়। উনি জানেন, অথচ তাকে কোনো বকাঝকা করছেন না। এদিকে পদ্যের বাবা হসপিটাল সেটা তাকে জানাতে নিষেধ করেছেন। স্যারের সঙ্গে এত খাতির। তারই কারণে বাসায় থাকতে দিতে চাচ্ছিলেন না৷ এগুলো তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে এত সজাগ থাকলেও তাকে কিছু বলছেন না কেন? এই ভাবনা থেকেই এভাবে কথা বলেছে আজ৷ সন্দেহ আরও গাঢ় হয়েছে।
দু’টার দিকে বাসায় এসে পৌঁছে গেল সে৷ কলিংবেল কয়েকবার চাপতেই এসে দরজা খুলে দিল পদ্য। পরনে আফরার শাড়ি। সদ্য স্নান করা স্নিগ্ধ, লাবণ্যময় চেহারা। চকিত দু’জোড়া চোখের মিলনকাল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর পদ্য চোখ সরিয়ে চলে গেল। অনিক সিটিং রুমে বসার পর মনিসা এলো রুম থেকে বের হয়ে। অনিক তাকে ডেকে এনে বললো, ‘এই ব্যাগে আছে তোমাদের কাপড়।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘ব্যাগ নিয়েই চলে যাবে না-কি? বসো, গল্প করি।’
মনিসা লাজুক হেঁসে পাশে বসলো। তারপর পলিথিনের ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এই নাও, এখানে স্যারের জন্য আলাদা আছে। তোমার জন্যও চকলেট আইসক্রিম আছে।’
মনিসা মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা।’
আফরা বের হয়ে এলো খানিক পর।
– ‘তুমি এসে মেহমানের মতো বসে আছো যে, ডাকলে না।’
– ‘আহত মন নিয়ে বসে আছি৷ মেহমানকে দরজা খুলে দিয়ে বাড়ির মানুষ কোনো কথাই বলেনি।’
আফরা মুচকি হেঁসে সোফায় বসে বললো,
– ‘কে খুলে দিল।’
– ‘রসুল পুর প্রাইমারি স্কুলের বোবা ম্যাডাম।’
মনিসা ঠোঁট টিপে হাসছে৷ আফরা ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার আপুকে গিয়ে বইলো বোবা ডাকছে।’
মনিসা ব্যাগ নিয়ে উঠে চলে গেল। অনিক আফরাকে ফিসফিস করে বললো, ‘ও এত লজ্জা পায় কেন? সব জেনে গেছে তাই না?’
– ‘হ্যাঁ, জানে হয়তো।’
– ‘আচ্ছা আমি কী তাহলে চলে যাব?’
– ‘দুইতলায় থাকলে, থাকতে পারো। তোমার রুম তো পদ্য আর মনিসা দখল করেছে।’
– ‘স্যার আর চাচি কোথায়?’
– ‘ইভার রুমে।’
– ‘আচ্ছা তুমি এখন মনিসাকে কোনো দরকার দেখিয়ে ডেকে নিতে পারবে?’
আফরা চোখ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কেন?’
– ‘আমার রুমে কিছু দরকারি জিনিস আছে নেব।’
– ‘পদ্য যে রুমে তাহলে..।
– ‘সে থাকুক, চিন্তা করো না। তুমি জাস্ট মনিসাকে নিয়ে আসো।’
– ‘প্লিজ কোনো সিন ক্রিয়েট করো না অনিক। ওর মা-বাবা দেখবে।’
– ‘দেখলে বলবে ওর দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে উপরে যাবে তাই গেছে।
প্লিজ ভাবি, মনিসাকে জাস্ট বের করে নিয়ে যাও।’
আফরা ইতি-উতি করে উঠে গিয়ে মনিসাকে নিয়ে ওর রুমে চলে গেল। অনিক ধীরে ধীরে তার রুমে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে রাখলো। পদ্য বিছানায় বসা ছিল। আঁতকে উঠলো সে। অনিক মুহূর্তে পরনের ব্লেজার বিছানায় ছুড়ে ফেলে পদ্যের দিকে ধেয়ে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো পদ্য..।’
পদ্য পলকে তার হাত ধরে থামিয়ে বললো, ‘প্লিজ অনিক আস্তে-আস্তে। কী করছো তুমি? আব্বা-আম্মা শুনবে তো। তুমি কী পাগল হয়ে গেছো? এখানে কেন এসেছো?’
– ‘শুনলে শুনবে, তোমার কারণেই শুন..
পদ্য আবার থামিয়ে বললো, ‘তুমি জানো না আব্বার এসব শুনলে ক্ষতি হবে?’
– ‘আমি তা জানতে চাই না। আমি নিজেই তো ম*রে যাচ্ছি৷ তুমি তো শুধু নিজের বাবারটা দেখছো..।’
– ‘তুমি কী পা*গল হয়েছো অনিক? প্লিজ এখান থেকে যাও।’
– ‘পাগল হওয়া কী অস্বাভাবিক? তুমি যা আচরণ করছো আত্মহ*ত্যা করাও তো অস্বাভাবিক না।’
– ‘প্লিজ এখান থেকে যাও, তুমি বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা।’
– ‘শোনো পদ্য, আমার মাথা কিন্তু ঠিক নাই। আমি গিয়ে তোমার আব্বার কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেবো।’
– ‘কি বলো এসব! দেখো এরকম করলে তোমাদের বাসা থেকে চলে যাব।’
– ‘কোথায় যাবে? বাড়িতে গেলেও আমি যাব। গ্রাম, বাড়ি, পাড়া-মহল্লায় পাগলামি করবো। তোমার আব্বা সেগুলো শুনলে কী হবে?’
– ‘আস্তে কথা বলো, তুমি এগুলো করবে কেন অনিক? শান্ত হয়ে বসো এখানে।’
– ‘আমি বসবো না। আমার কথা আছে। আপাতত তুমি সবকিছুতে আনব্লক করো। তাহলে সকল পাগলামি তোমার কাছে থাকবে। না হলে পাগলামি ছড়িয়ে পড়বে।
গিয়ে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেবো তোমার আব্বার কাছে। আর সহ্য করতে পারবো না আমি। মাথা কিন্তু ঠিক নাই। পাগল হয়ে গেলে কিন্তু কার বাবা স্ট্রোক করবে সেটা ভেবে কেউ কাজ করে না।’
পদ্য দরজার দিকে উঁকি দিয়ে বিছানা থেকে ব্লেজার তুলে তার হাতে দিয়ে বললো, ‘প্লিজ যাও তুমি এখন, আমি আনব্লক করছি। প্লিজ যাও, মেসেজে বলো যা বলার।’
অনিক ব্লেজার হাতে নিয়ে। আলনা থেকে কিছু কাপড় হাতে নিয়ে আবার পিছু ফিরে তাকিয়ে বুকটা কেমন চিনচিনে এক ব্যথায় ভরে উঠলো। পদ্যের সঙ্গে এরকম আচরণ করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার। শুধু আনব্লক করানোর জন্য এই অভিনয়টুকু দরকার ছিল। বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কোন বালিশে ঘুমাও তুমি।’
পদ্য কাঁপা কাঁপা আঙুলে দেখালো বালিশটি। অনিক হাতে নিয়ে বালিশে চুমু খেয়ে বুকে চেপে রেখে কাতর চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এই বালিশটা আমি নিয়ে যাই পদ্য? ভাবিকে বললে অন্য একটা দেবে তোমাকে।’
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম