ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৫
.
নাঈম ভীষণ ক্লান্ত। অফিস শেষে হসপিটালে না গিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো সে। আর ভালো লাগছে না তার। দুপুরে একবার আফরা কল দিয়ে প্রায় কান্নাকাটি করেছে। পদ্যও অনিককে ভালোবাসে৷ ওর পরিবারকে জানিয়েছে কথাটা। তাতেই না-কি ওর বাবার আজ এই অবস্থা৷ মেয়েটা কী বিপদে পড়েছে ভাবো? এখন পরিবারের পছন্দের ছেলেকে তার বিয়ে করতে হবে।
সবকিছু ধৈর্য ধরে শুনেছে নাঈম। শুনতে হয় বলে শোনা। সন্ধ্যার আগে বাবা কল দিলেন। অনিক না-কি গ্রামে চলে গেছে৷ এখন পদ্যদের হাসপাতাল থেকে বাসায় নিতে হবে। ভালো এক যন্ত্রণায় পড়া গেছে৷ সে ঝামেলা একদম পছন্দ করে না। অফিস থেকে বাসা, তারপর নাটক-টাটক কিছু একটা দেখে অবসর সময় কাটিয়ে দেয়৷ এটাই তার জীবন। ক্লান্ত অবস্থায় কলিংবেল চাপলো এসে। আফরা দরজা খুলে দিয়ে বললো, ‘এ কী? একা চলে এলে যে, ওদের একেবারে নিয়ে আসলেই পারতে।’
নাঈম ভেতরে এসে বললো, ‘তুমি পারবে না গিয়ে আনতে? না হয় আমি একটু পরে যাব।’
– ‘আচ্ছা আমিই গিয়ে আনবো৷ তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো, চা দেই?’
– ‘না বাদ দাও, তুমি বরং ওদের আনতে চলে যাও। ওরা এলে একসাথে খাওয়া যাবে।’
– ‘যদি আন্টি থাকেন ওখানে। তাহলে তো পদ্য আসবে। এখন এলে তো তোমার সমস্যা নেই? সমস্যা যে ছিল, সে তো চলে গেছে।
নাঈম শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে হেঁসে ফেললো,
– ‘আচ্ছা আমাকে খোঁচাচ্ছ কেন বলো তো? এখানে আমার আবার সমস্যার কী আছে?’
– ‘তুমি আর আব্বাই তো চেষ্টা না করে উলটো বিরোধিতা করছো।’
– ‘তুমি আসলে বোকা। অন্য ফ্যামিলি হলে এই ব্যাপারে আরও বেশি ঝামেলা করতো। আমরা তবুও তো কিছুটা উদার।’
– ‘ও আচ্ছা, তোমরা উদার? উদারের কী করেছো শুনি?’
– ‘এই যে তুমি বাড়াবাড়ি করো আমি কী বাঁধা দেই বলো?’
– ‘তারমানে কী বলতে চাইছো? আমি বাঁধা দেয়ার মতো কাজ করছি?’
– ‘সেরকম বলিনি।’
– ‘সেরকমই তো বললে তুমি। আমার কী এখানে। আমি তোমাদের এসবে আর নাই। বাড়াবাড়ি যখন করি। আমি আর এসব নিয়ে কথাই বলবো না। আর তোমার পাড়া-পড়শী হাসপাতাল। এরা আমার কেউ না। আমি এই রাত-বিরেতে এদের আনতেও যাব না।’
– ‘যাহ বাবা, এখন আরেকটা ঝামেলা তৈরি হলো দেখছি। যাও তো প্লিজ, গিয়ে নিয়ে আসো। আর না হয় আমিই যাচ্ছি।’
আফরা গাল ফুলিয়ে সোফায় বসে রইল। লুঙ্গি হাতে নিয়ে এসে নাঈম পাশে বসে বললো, ‘তুমি গেলে লুঙ্গি পরবো৷ না হলে আবার শার্ট পরে বের হতে হবে।’
আফরা কোনো জবাব দিল না। নাঈম পুনরায় বললো, ‘কেন এমন করছো বলো তো? অফিস শেষে বাসায় ফিরে কয়েকদিন থেকে শান্তি পাচ্ছি না’
– ‘কেন আমি অশান্তির কী করি?’
– ‘এই যে অকারণ রাগারাগি করো। সারাক্ষণ অনিকের ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে থাকো। এগুলো ভালো লাগে?’
– ‘তুমি আসলে একটা স্বার্থপর।’
– ‘ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। আমার আসলে কী করার আছে তুমি বলো? আব্বা-আম্মা আছেন। তাছাড়া এতদিন জানতাম পদ্য পছন্দ করে না অনিককে। যখন জানলাম করে, তখন ভাবলাম আচ্ছা তাহলে স্যারের সঙ্গে কথা বলা যাবে। আব্বাকেও বলবো। এখন আবার শুনি পদ্য ফ্যামিলিকে বলে দিয়েছিল। তাই ওর বাবা মাইল্ড স্ট্রোক করেছেন। এখন উনার কথা না শুনলে প্রব্লেম হতে পারে। এই অবস্থায় আর কী করার আছে?’
– ‘সাধু সাজবে না। পদ্য ওর পরিবারকে জানানোর পর যদি ওরা রাজি হয়ে যেত। তখন তোমরা ঠিকই রাজি হতে না।’
– ‘কে বলেছে তোমায়? আমি ঠিকই রাজি হতাম। আব্বাকেও রাজি করিয়ে ছাড়তাম।’
– ‘আজাইরা চাপা মা*রবে না। ব্যাটা মানুষদের কাজই হলো বউয়ের কাছে চাপা মা*রা। তোমার পরিবার আমাদেরই তো মানতে চাইছিল না, আর ওদের তো বয়স ফ্যাক্ট আছে।’
– ‘আমাদের তো ম্যাডাম পালিয়ে বিয়ে, তাই রাগারাগি করেছে। তোমার পরিবার মানলে আনুষ্ঠানিক বিয়েতে আপত্তি করতো না। আর আসল কথা হলো পদ্যের ফ্যামিলি মানলে কেউই আঁটকে রাখতে পারতো না। অনিক ঠিকই বিয়ে করে নিত। ওকে চেনো না তুমি।’
– ‘পদ্যের বাবাও এরকম বিয়ে দিতে চাইতো না হয়তো। ওরা চাইবে অনিকের পরিবারও রাজি থাকুক।’
– ‘আচ্ছা এসব বাদ দাও। এরকম তো হয়নি। হলে আমি রাজি থাকতাম। অন্যেরটা জানি না। এবার আমাকে মাফ করা হোক। আমি যু*দ্ধ চাই না, শান্তি চাই।’
– ‘বেশি শান্তিপ্রিয় মানুষই স্বার্থপর হয়।’
– ‘এবার কিন্তু রাগ উঠে যাচ্ছে।’
আফরা হেঁসে ওর গলা টিপে ধরে বললো, ‘রাগ উঠলে কী করবে? মা*রবে? মা*রবে আমাকে?’
– ‘মা*রলে তো আরও অশান্তি শুরু হবে। বাড়ি থেকে চলে যাবে। আর থাকলেও বাসায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তখন ব*ম মে*রেও মুখ থেকে কথা বের করা যাবে না।’
– ‘ও তার মানে মা*রার ইচ্ছা আছে।’
নাঈম গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি খুঁজে খুঁজে ঝগড়ার ইস্যু বের করো না প্লিজ। এমনিতেই ভালো লাগছে না আজ।’
– ‘কেন?’
– ‘কেমন একটা ঝামেলায় আছি না? অফিস, তারপর অনিক, এদিকে ওদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ছোটাছুটি। তাছাড়া অফিসে কিছু ঝামেলাও আছে।’
– ‘অফিসে কীসের ঝামেলা?’
– ‘বাদ দাও, এখন যাও ওদের নিয়ে আসো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে আফরা রেডি হয়ে একজনের খাবার নিয়ে বের হয়ে গেল৷ ওদের রুমের দরজা ভেজানোই ছিল। সে নক দিয়ে ভেতরে গেল। মনিরা বেগম বললেন, ‘হায় আল্লাহ, বউমা কষ্ট করে রাতে আসতে গেলে কেন?’
– ‘নাঈম সবে অফিস থেকে এসেছে তো। অনিকও গ্রামে৷ তাই নিজেই চলে এলাম।’
– ‘অনিক বাবা গ্রামে চইলা গেছে না-কি?’
– ‘হ্যাঁ আন্টি, আর এখানে খাবার আছে। আগের টিফিন দিয়ে দেন। আর আঙ্কেলের সাথে কে থাকবেন। একজন থেকে আমার সাথে দু’জন চলে আসুন।’
মনিরা বেগম স্বামীকে রেখে যেতে চাইলেন না। অনিক নেই যেহেতু তিনি পদ্যকে বললেন, ‘তোমরা দুইবোন চইলা যাও।’
পদ্য আমতা-আমতা করে বললো, ‘আম্মা তুমি চলে যাও। এখানে একা একা তোমার অসুবিধা হবে।’
– ‘না, এখানে আর কীসের অসুবিধা৷ কোনো অসুবিধা হইলে ডিউটি ডাক্তার তো আছেই।’
আফরা বললো, ‘হ্যাঁ, এখানে কোনো অসুবিধা হবে না। তোমরা চলে আসো। ভোরে এসে না হয় আন্টিকে পাঠিয়ে দিবে বাসায়৷ হাসপাতালে সারাক্ষণ ভালো লাগবে না।’
– ‘না না বউমা। পদ্যের বাপকে এখানে রাইখা আমি কোথাও যাব না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ওরা দু’জন চলে গেলে তো ঘুমানোর সীটও খালি পাবেন। চলো পদ্য।’
পদ্য চুল খোপা বেঁধে নিল। অতিরিক্ত কোনো কাপড় আনতেও মাথায় আসেনি। পরনের সেলোয়ার-কামিজ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে। মনিসা আর পদ্য রেডি হয়ে ভোরের টিফিনও হাতে নিল। আফরা বের হতে গিয়েও পুনরায় ফিরে এসে বললো, ‘আর হ্যাঁ, অনিক বললো আপনারা বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিতে পারবেন। আরও দু-একদিন পর নাঈম কথা বলে বাসায় নিয়ে যাবে আপনাদের।’
মনিরা বেগম মাথা নাড়লেন। তারা বের হয়ে এলো রাস্তায়৷ একটা রিকশায় তিনজন অসুবিধা হওয়ায় সিএনজি নিয়ে আসতে হলো। নাঈম শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে৷ পদ্য ঢুকতে গিয়েও সরে গেল৷ কেমন অস্বস্তি লাগছে। নাঈম ভাই নিশ্চয় সবকিছু জেনে গেছে। সে সিটিং রুমের সোফায় গিয়ে বসলো। নাঈম ডেকে নিল মনিসাকে৷ দু’জন বসে এটা-ওটা নিয়ে কথা বলছে। আফরা ফিরে এসে পদ্যের পাশে বসে বললো, ‘কী হলো?’
– ‘নাঈম ভাই সবকিছু জানেন তাই না?’
– ‘তা তো ওর বাবাও জানেন।’
– ‘সেটা না, আমিও পছন্দ করি সেটাও নিশ্চয় বলে দিয়েছেন।’
আফরা মুচকি হেঁসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তবে আসল মানুষটাকে বলিনি।’
– ‘ও হুট করে গ্রামে চলে গেল কেন?’
– ‘দুপুরে এসে ওর বাবাকে কল দিয়ে বললো তোমাদের বাসায় আনাতে। সে গ্রামে চলে যাবে।’
– ‘এগুলো কেন করছে ভাবি? অকারণ আমার কষ্টের বোঝা বাড়ানো৷ ওর জন্য তো কিছুই করার নেই আমার।’
– ‘অনিক যাওয়ার পর ওর রুম পরিষ্কার করিনি। ওর উশৃংখল রুমটা দেখবে আসো।’
– ‘রুম আবার উশৃংখল হয় না-কি?’
আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘আসো না, দেখো এসে।’
পদ্য পিছু পিছু গেল। দরজা খুলেই আফরা নাক-মুখ কুঁচকে বললো, ‘সারাদিন দরজা জানালা বন্ধ করে থাকে। বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ হয়ে গেছে রুমে।’
পদ্যকে নাক-মুখ কুঁচকাতে দেখা গেল না। সে ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করলো। নাঈম তখন ডাক দিল, ‘আফরা এদিকে আসো একটু, কই তুমি?’
আফরা পদ্যকে রেখে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল। পদ্য বাতি জ্বালিয়ে চারদিকে মন্ত্র-মুগ্ধের মতো তাকাচ্ছে৷ সে একা অনিকের রুমে এটা ভাবতেই গা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। মেঝেতে সিগারেটের টুকরোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। টেবিলের চেয়ারে উলটো হয়ে ঝুলে আছে একটা প্যান্ট। এলোমেলো বিছানা, কোলবালিশ মাঝখানে পড়ে আছে। মাথার বালিশের পাশে খোলা বই। এই এলোমেলো রুমটাকেও পদ্যের কেমন ভীষণ আপন লাগছে। সবকিছু ইচ্ছা করছে গায়ে মাখিয়ে নিতে। পদ্য ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানায় বসে। কোলবালিশটা হাতে নিয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে চোখবুজে থাকে খানিকক্ষণ। পুরো শরীরে কেমন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ইস এই বালিশটাকেই তো অনিক জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। পদ্য মাথা বিছানায় গা হেলিয়ে দিল। কোলবালিশটা শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ চোখবন্ধ করে শুয়ে রইল। তারপর বিছানা থেকে গেল আলনার দিকে৷ নেভি ব্লু একটা গেঞ্জি উলটো হয়ে ঝুলে আছে। হাতে নিয়ে মুখে চেপে ধরলো সে। এই গন্ধগুলো এত আপন লাগছে কেন? অনিক বুঝি এই কারণেই ছোটবেলায় তার কাপড় পেলেই নাকে চেপে ধরতো? পদ্যের আবার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হয়। মানুষটাকে আর আপন করে পাবে না সে। এরকম একটা একলা রুমে, একান্তভাবে ওর সঙ্গে থাকা যাবে না। ওর স্পর্শ পেয়ে এই জন্মটাকে স্বার্থক করা যাবে না। পদ্যের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। তখনই আবার ভেজানো দরজা আর্তনাদ করে খুলে গেল। সে অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে নিল। আফরা কাছে এসে কাঁধ ধরে টেনে ওর দিকে ফিরিয়ে বললো, ‘তুমি একা একা কাঁদো অনেক তাই না?’
পদ্য ফ্যাকাশে মুখে হেঁসে বললো, ‘কেন?’
– ‘আমারই কান্না পায় তোমাদের কষ্ট দেখে। একটা ডায়েরি ওইদিন পড়েছিলাম অনিকের। তোমাকে কত ভালোবাসে ছেলেটা।’
– ‘কোথায় ডায়েরি?’
আফরা টেবিল, বিছানার নিচ সহ সবকিছু দেখে বললো, ‘মনে হয় তালা মে*রে রেখেছে ওয়ার্ডরোবে। চাবি কোথায় জানি না।’
– ‘ও আচ্ছা, ডায়েরিটা কী নীল?’
– ‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কীভাবে?’
– ‘অনেক পুরাতন ডায়েরি এটা। এটা পড়েই জেনেছিলাম সবকিছু।’
– ‘ও বুঝেছি, আচ্ছা যাও, তুমি সিটিং রুমে গিয়ে বসো। আমি ওর রুম গুছিয়ে রেখে আসছি।’
পদ্য চারদিকে তাকিয়ে মনে হলো এই অগোছালো রুমে এখনও অনিক মিশে আছে। এলোমেলো কাপড়গুলো অনিকের নিজ হাতে রাখা৷ মেঝেতে সিগারেটের টুকরো অনিকই খেয়ে ফেলেছে। একবার সবকিছু গুছানো হয়ে গেলে এই রুমে এসে আর অনিককে পাবে না সে। আফরার হাত ধরে বললো, ‘ভাবি থাকুক যেরকম আছে। সে আসার আগেরদিন পরিষ্কার করে নিবেন না হয়।’
– ‘কেন?’
– ‘এমনিই।’
– ‘আহা অগোছালো রুমের প্রতি মায়া পড়ে গেছে বুঝি?’
পদ্য লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে ফেললো। আফরা ওর থুতনি ধরে মুখ তুলে ধরে বললো, ‘তুমি চাইলে এই রুমে থাকতেও পারো। তারপর অনিক এসে যখন জানবে তুমি থেকেছিলে। সেও বলবে ভাবি এই রুম যেরকম আছে সেরকম থাকুক। কোনোদিন ঝাড়ু-টারু দিয়ো না। আজীবন এরকম থাকবে।’
পদ্য ফিক করে হেঁসে ফেললো। আফরা তারপর সিরিয়াস চেহারায় বললো, ‘সত্যিই থাকতে পারো এখানে। সমস্যা নেই। আমি মনিসার কাছে থাকবো।’
‘কি যে বলো ভাবি, চলো তো যাই।’
দু’জন দরজা লাগিয়ে বাইরে এলো। মনিসাকে নাঈম গ্রামের নানান বিষয় জিজ্ঞেস করছে৷ দু’জন মেতে উঠেছে গল্পে। আফরা গিয়ে ডেকে নিল মনিসাকে। দু’জনকে খুলে দিল ইভার রুম। তারপর বললো, ‘তোমরা চাইলে আমার কাপড় পরতে পারবে, দেই এনে?’
মনিসা বিছানায় বসে বললো, ‘আপনার কামিজ আমার পরনে তো বোরখা হয়ে যাবে।’
আফরা হেঁসে বললো, ‘তাও ঠিক। তবে পদ্যের লাগবে।’
পদ্য আমতা-আমতা করে বললো, ‘আজ থাক ভাবি। কাল দিলে হবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি ভাত দিচ্ছি।’
রাতের খাওয়ার শেষে ওরা দু’জন রুমে চলে গেছে। আফরা রান্নাঘরের কাজ শেষ করে রুমে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অনিক বেশ কয়েকটা কল দিয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে সিটিং রুমে এসে কল ব্যাক করলো সে। একবার রিং হতেই অনিক ওপাশ থেকে রিসিভ করলো।
– ‘হ্যালো ভাবি।’
– ‘হ্যাঁ অনিক, কী খবর? বাড়িতে গিয়ে আর কল দাওনি যে।’
– ‘হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছিলাম।’
– ‘ডাটা অফ ছিল, খেয়াল করিনি।’
– ‘ওরা এসেছে?’
– ‘ওরা বলতে হবে না। যার কথা জানতে চাচ্ছ সে এসেছে। তুমি যেরকম রুম ফেলে গিয়েছিলে। সেই অবস্থায় তোমার রুমে নিয়ে নাজেহাল অবস্থাটাও পদ্যকে দেখিয়ে দিয়েছি।
– ‘এটা কী করলে ভাবি। তুমি শ*ত্রু না বন্ধু?’
– ‘শ*ত্রু হতে যাব কেন?’
– ‘এমনিতেই তো পছন্দ করে না। অপছন্দের পরিমাণটা আরেকটু বাড়িয়ে না দিলেও পারতে।’
– ‘অপছন্দ করে কীভাবে বুঝলে?’
– ‘পছন্দ করলে এরকম হতো?’
– ‘কাউকে পছন্দ না করার মানে কী অপছন্দ করা?’
– ‘না, কাউকে পছন্দ না করার মানেই অপছন্দ করা নয়। তবে শেষের দিন ওর কথাবার্তা থেকে তাইই মনে হয়েছিল।’
আফরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। অনিক পুনরায় বললো,
– ‘ওর সঙ্গে আর কে এসেছে?’
– ‘মনিসা।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তুমি কোথায় এখন?’
– ‘ছাদে, তোমাকে মিস করছিলাম তাই কল দিলাম।’
– ‘ও আচ্ছা তাই? ছাদে গিয়ে আমাকে মিস করছিলে বুঝি? ছাদ থেকে সোজা কার বাড়িটা দেখা যায়? আমার না-কি পদ্যের?’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘আহা তুমি এই ব্যাপারগুলো ভালো বুঝতে পারো। সত্যিই গ্রামে এসে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। কত স্মৃতি চারদিকে। পদ্যের হয়তো এসব মনে নাই।’
আফরা আবার চুপ হয়ে যায়। অনিক পদ্যের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তারও কিছু করারও নেই। খানিক পর বললো,
– ‘ওকে দেখবে অনিক?’
– ‘দেখাও।’
– ‘কিন্তু দেখাবো কীভাবে? ওরা দরজা ভেজিয়ে বাতি অফ করে শুয়ে আছে। গেলে তো জেগে যাবে।’
অনিক খানিক ভেবে বললো, ‘রুম তো অন্ধকার তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তুমি ভিডিয়ো অন করে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে যাও। যেহেতু রুম অন্ধকার। ওরা জেগে গেলেও ভাববে মোবাইলের বাতি জ্বালিয়েছো।’
– ‘ওরা বলবে রুমের বাতি জ্বালাও।’
– ‘তুমি তখন জ্বালাবে। এর ভেতরে তো ভিডিয়ো হয়ে গেল।’
– ‘তবুও দেখতেই হবে?’
– ‘আমি বলছি না-কি? তুমি নিজেই বললে দেখবো কি-না৷ আমি জাস্ট বুদ্ধি দিলাম।’
– ‘কিন্তু এটা কী ঠিক হবে? লুকিয়ে ভিডিয়ো করে দেওয়া।’
‘আমি বলছি না-কি দিতে। তোমার ইচ্ছা হলে দাও না দিলে নাই’ বলেই অনিক কল কেটে দিল। চাঁদনি রাত। ছাদের রেলিঙে কনুই ঠেকিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। এখান থেকে পদ্যের বাড়ি, উঠান, পুকুর, রাস্তা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। এই ছাদে মাদুরে বিছিয়ে তারা গল্প রেকর্ড করতো। পদ্যের কালো চুলগুলো কখনও খোলা আবার কখনও খোঁপা বাঁধা। খোলা থাকলেই সে খুশি হত ভীষণ। পড়ার সময় সে বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে। খোলা চুলে কী যে মায়াবী লাগতো। ওর কথা-বার্তা, চাল-চলন সবকিছু কেমন যেন শৈল্পিক, কাব্যিক ছিল। কথা বললে তার ইচ্ছা করতো হাত বাড়িয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেখতে। ওর চোখের দিকে চোখ পড়লে হিপনোটাইজ হয়ে যেত। হাতটা বিদ্রোহ করতো ওর মুখটা ধরার জন্য। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ টিউন বাজতেই অনিক সিন করলো। ভাবি ভিডিয়ো পাঠিয়েছে। সিগারেট দূরে ছুড়ে ফেললো সে। রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্লিক করলো ভিডিয়োতে। দেখলো আফরা দরজা খুলতে “খ্যাক” করে শব্দ করলো। এরপর অন্ধকার রুম আলোকিত করে বাতি বিছানার দিকে গেল৷
পদ্য তাড়াতাড়ি উঠে বসে আকাশি কালার ওড়না ঠিক করে বললো, ‘কে?’
– ‘তোমরা ঘুমিয়ে গেছো না-কি? আমি আরও আসলাম গল্প করতে।’
– ‘না ঘুমাইনি। বাতি জ্বালাও ভাবি।’
ভিডিয়ো এটুকুই। কিন্তু অনিক বারবার একই ভিডিয়ো খুব মনযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলো।
_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম