ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১৩
.
মনিরা বেগম পদ্যের মাথায় হাত রেখে বললেন,
– ‘ঘুমানোর চেষ্টা কর মা। তাহলে কমে যাবে।’
– ‘হ্যাঁ আম্মা, তুমিও যাও, ঘুমাও গিয়ে।’
মনিরা বেগম আবার বাতি বন্ধ করে চলে গেলেন। খানিক পর পদ্যও ঘুমিয়ে যায়। ভোরে ঘুম ভাঙলো বারান্দায় কথা-বার্তা শুনে। উঠে বসলো সে। অনিকের বাবা মিরাজুল ইসলাম এসেছেন। মতিন মাস্টারের সঙ্গে বারান্দায় বসা।
মনিরা বেগমও চা নিয়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছেন। পদ্য তাদের কথোপকথনে মনযোগ দিল। মিরাজুল ইসলাম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তাহলে ছেলে দেইখা আসছেন গতকাল?’
– ‘হ্যাঁ, ঘটক বললো, বিকালে বাজারে আসেন, ছেলের সাথে দেখা করিয়ে দিব।’
– ‘ভালো করছেন। আমিও কয়েকদিন আগে ঘটককে বাজারে পেয়ে তাড়া দিয়ে এসেছিলাম।’
– ‘গতকাল দেখলাম না যে, কোথায় ছিলে?’
– ‘বাড়িতে ছিলাম না তো। ভোরে উঠে চলে গেলাম। আমার বড়ো বোনের জামাই মারা গেছেন।’
– ‘কি বলো, জানি না তো।’
মনিরা বেগম বললেন, ‘কেন, দেখোনি তাদের ঘর তালা।’
– ‘খেয়াল করিনি।’
মিরাজুল ইসলাম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এবার বলুন, বিয়ের কথা কি ভাবলেন? ছেলে কি পছন্দ হইল?’
মতিন মাস্টার বললেন,
– ‘তা হয়েছে। ঘটককে বলবো ওরা এসে মেয়েকে দেখে যাক। তুমিও থাকবে, আলাপ-আলোচনা করে নিব।’
– ‘হ্যাঁ তাই করো। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় মাস্টার ভাই। কয়েক মাস আগে নাঈমের মা’কে নিয়ে বাসায় গিয়েছিলাম মনে আছে?
মনিরা বেগম বললেন, ‘হ্যাঁ।’
– ‘গিয়েছিলাম অনিককে বিয়েতে রাজি করাতে। নাঈমের এক শালী আছে। ওদের সাথেই থাকে। দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ ভালো। ভাবলাম অনিক পছন্দ করবে। কাজ হলো না। কোনো কথাই শোনেনি। উলটো বললো, জব করি না, ঠিক আছে এখন জব করবো। কিন্তু বিয়ে করবো না। কি আজব দুনিয়া আসলো মাস্টার ভাই ভাবুন তো। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা বিয়ে-শাদি করতেই চায় না।’
– ‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। তাছাড়া অনিক তো বাড়িতেও আসে না।’
পদ্য বিছানা থেকে সবকিছুই শুনছে। অনিক আজও কি তার জন্য অপেক্ষা করে? বিয়ে করছে না কেন পাগলটা? তার বিয়ে হয়ে গেলে কি করবে তখন? আবার পদ্যের বুকটা বেদনায় ‘হু হু’ করে উঠে। ছেলেটা শেষদিকে একদিন মেসেজে দিয়ে বলেছিল, ‘পদ্য আপু, তুমি ডায়েরিটা তো পড়েছো। সবকিছু এখন তো জানোই। লুকোচুরির আর কিছুই নেই। তোমাকে আর এভাবে মেসেজ বা কল দেয়াও হয়তো ঠিক হচ্ছে না। সব জেনেও যে দূরে ঠেলে দেয়, তাকে আর বলার কি থাকে? তখন বারবার তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা মানে উলটো বিরক্ত করা। আমি বিরক্তির কারণ হচ্ছি। শুধু এটুকু বলি, আমি তোমার পায়ে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম। এটাই আমার জীবনের প্রথম চুম্বন। কখনও ভুলতে পারবো না। এখনও মনে পড়লে গা কাটা দেয়। এ ছাড়াও আমি বহুদিন, বহুভাবে তোমাকে স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছি, জানো তুমি? মনে আছে তোমার? প্রতি বছরই প্রবল বৃষ্টির কারণে শুরুতে বিলে অল্প পানি বাড়তো। সেই পানিতে ডুবে যেত চর। কিন্তু চরে পানি কম থাকায় সেদিকে খেয়া যেতে পারতো না। ফলে স্কুলে যাবার সময় আমরা সবাই প্যান্ট ভাঁজ করে অনেকটা জায়গা হেঁটে রাস্তায় গিয়ে উঠতাম। নতুন পানিতে তখন প্রচুর জোঁক। তুমি জোঁক ভয় পেতে। আমি সেই সুযোগটা নিতাম। কখনও কাঁধে করে, আবার কখনও পাঁজাকোলা করে শেওড়া গাছের পাশ দিয়ে উঠতাম গিয়ে রাস্তায়। অন্য সবাই শুরুর দিকে হাসতো, মনে আছে তোমার? তুমি জোঁকের ভয়ে ঠিকই কোলে চড়ে যেতে মানা করতে না। কয়েকদিন যাবার পর কেউ হাসেনি আর। এটাই নিয়ম। কোনোকিছু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চালিয়ে গেলে মানুষ হাসি বন্ধ করে দেয়। এটাই নিয়ম পদ্য আপু। যাইহোক, আমি নিজেকে সামলে নিচ্ছি। তবুও পারি না। অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করে। অজান্তেই মেসেজ, কল দিয়ে বসি। একদিন দেবো না হয়তো। তবে বিশ্বাস করো। আর কখনও কোনো নারী আমার জীবনে আসবে না। বিয়েও করবো না। জীবনের এই ক্ষুদ্র সময়ে তোমাকে যে ক’বার ছোঁয়া হলো আমার। এই জন্মে নারীকে ছোঁয়া, পাওয়া বলতে না হয় সেটুকুই থাকলো আমার। এযাবৎকালে অনিচ্ছায় তুমি যা দিয়েছো আমায়, তা দিয়েই কাটিয়ে দেবো গোটা একটা জীবন। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? বিশ্বাস করো, ওইযে পায়ে চুমু খেয়েছিলাম। যতবার মনে করি সেই অনুভূতিটা নতুন করে হয়। কি মিষ্টি অনুভূতি। তোমাকে কোলে নিতাম না? এই যে এখনও চোখে ভাসছে। আমি তোমার সেই বিশেষ ঘ্রাণটা পাচ্ছি। তোমার নরম, কোমল শরীর আমার সঙ্গে মিশে আছে। সেই উষ্ণতা এখনও গায়ে লেগে আছে যেন। সেই বিশেষ ঘ্রাণ, ‘ওম ওম’ উষ্ণতা, সবকিছু মৃত্যুর আগ অবধি পাব আমি। আচ্ছা তুমি এত মিষ্টি কেন? কেমন কোমল, নরম, পবিত্র। যখন ঠোঁট নেড়ে কথা বলো আমি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকি জানো? তোমার দাঁত যেন শিউলি ফুল। কথা বলার সময় মনে হয় কোনো একটা ফুল বারবার আমার চোখের সামনে ফুটছে। কতবার, কতদিন যে তোমার মুখটা একবার ছুঁতে ইচ্ছা করেছে। একবার আঁজলা করে ধরতে ইচ্ছা হয়েছে। তার কোনো হিসাব নেই পদ্য আপু। এই অল্প বয়সের সবটুকু আমার এসব লোভের সঙ্গে সংগ্রাম করেই কেটে গেল।
যাইহোক, আবার বেশি কথা বলে বিরক্ত করছি। তুমি বললে না, সবকিছুতে ব্লক দেবে আমাকে, দিয়ে দিয়ো। আমিও চাই কাউকে আর বিরক্ত না করতে। ভালো থেকো।’
অনিক কি সেই কথাগুলো এখনও মনে রেখেছে? পদ্য ভেবে পায় না। সেই অল্প বয়সের প্রেম কি একইরকম রয়ে গেল অনিকের বুকের ভেতর? হয়তো রয়েছে। না হলে বিয়ে করতে চায় না কেন ছেলেটা? কষ্ট লাগে পদ্যের। বুকটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে উঠে। আগে ভাবতো বয়স কম তাই এত আবেগ অনিকের। এক সময় চলে যাবে। এখন বুঝতে পারছে ছেলেটা কত কষ্টে কথাগুলো বলতো। ব্লক দেয়ার পর একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে রাতে কল এলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নাক টানার শব্দ পাচ্ছিল সে। যেন ঠাণ্ডায় কারও নাক বন্ধ। মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাঁপিয়ে গেছে। পদ্য চিনতে পেরেছিল মানুষটাকে। রূঢ় গলায় বললো, ‘তুমি কি এখন এভাবে রং নাম্বার দিয়ে বিরক্ত করা শুরু করেছো অনিক?’
ওপাশ থেকে হাঁপানো গলায় বললো, ‘দিতে চাইনি। তুমি প্লিজ সবকিছুতে আনব্লক করো আপু। ব্লক থাকলে আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগে। তুমি আনব্লক করে রাখো।’
– ‘পাগলের মতো কথা বলবে না অনিক। এখন রং নাম্বার দিয়ে কল দিচ্ছ। আনব্লক করলে তো তখন আরও বেশি দেবে।’
– ‘না আপু দেবো না। প্লিজ আনব্লক করে রাখো। যখন খুব ইচ্ছা করবে, তখন শুধু মেসেজ দেবো। তুমি সিন করে রেখে দিয়ো। রিপ্লাই দিতে হবে না৷ তুমি আমার মেসেজ দেখতে পাচ্ছ এটা ভেবেই শান্তি পাব।’
– ‘তো এসবের শেষ কোথায়?’
– ‘আমি ধীরে ধীরে একেবারে মেসেজ দেয়া বন্ধ করে দেবো।’
– ‘তোমার যা ইচ্ছা তা করলে তো হবে না, ফোন রাখো। আর বিরক্ত করো না। আপু ডাকো আবার এসব বলতে লজ্জা করে না?’
বলেই পদ্য কল কেটে দিয়েছিল। দম-বন্ধ ব্যাপারটার পুরো অনুভূতি এখনও পদ্যের হয়তো হয়নি৷ কারণ সে চাইলেই অনিককে কল দিতে পারবে। দিচ্ছে না। সামলে নিচ্ছে নিজেকে। কিন্তু অনিক চাইলেই পারতো না৷ ব্লক ছিল সবকিছুতে। দু’একবার বাড়িতে এসেও পারেনি। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হওয়ার পর সুযোগ না পাওয়ার কষ্ট আসলে কেমন?
ভীষণ কথা বলার ইচ্ছা। কিন্তু বলার কোনো পথ খোলা নেই? তখন আসলে কেমন লাগে? পদ্য বুঝতে পারে এখন, আগে পারতো না। অনিকের কষ্ট বুঝতে পারে। বুঝতে পারে বলেই হয়তো কান্না পায়। শক্ত মেয়ে পদ্য, কখনও এমন ছিল না সে। কিন্ত সেই যে ঈদের আগের দিন ওকে কয়েক পলক দেখা, এরপর থেকে অনিকটার জন্য মন বড়ো পুড়তে শুরু করলো। এখনও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দিনে-দুপুরে তো কাঁদা যায় না। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছলছল চোখকে সামলে নিতে চেষ্টা করছে। অনিকের চিন্তা মাথা থেকে সরাতে হবে। আজ স্কুলে কি যাবে না সে? টাইম কয়টা হয়েছে কে জানে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো এগারোটা। মনিসা নেই, চলে গেছে হয়তো। মনিরা বেগম তাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘উঠেছিস মা, মাথা ধরা কি কমেছে?’
পদ্য মাথা নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ মা, কমেছে।’
– ‘যা মুখ-হাত ধুয়ে আয়।’
পদ্য উঠে চুলের খোঁপা বেঁধে ওড়না মাথায় দিয়ে ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বাইরে এলো। মিরাজুল সাহেব দেখে বললেন, ‘পদ্য মায়ের শরীর খারাপ না-কি?’
মনিরা বেগম বললেন, ‘হ্যাঁ, রাত থেকে ওর মাথা ধরেছে।’
সে উঠান পেরিয়ে পুকুরে চলে এলো। ক’টা হাস পুরো পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে। পদ্য কামিজ এঁটো করে বসে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এলো ঘরে। মনিরা বেগম ভাত দিলেন তাকে। পদ্যের খেতে ইচ্ছা করছিল না। বেলা এগারোটা হয়ে যাচ্ছে। রাতেও খায়নি। মনিরা বেগম তাই বকাবকি করে খাওয়ালেন। খাবার পর সে সিন্দুক খুলে ডায়েরি নিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো পুনরায়। মতিন মাস্টার আর মিরাজুল সাহেব কোথাও গিয়েছেন। মনিসা নেই। মনিরা বেগম রান্নাঘরে। সে আবছা আলো ছায়ার রুমে ডায়েরি জড়িয়ে ধরে চোখবুজে রইল। ডায়েরি খুলে কি পড়বে? সবকিছুই তো মাথায় গেঁথে আছে। চোখে ভাসছে। অনিকের ডায়েরির লেখাগুলোও মনে আছে। সেসবের অনেক কিছু নিজের ডায়েরিতেও লিখেছে পদ্য। অনিকের মতো হয়তো হয়নি। প্রতিটা বিষয় নিয়ে ছেলেটা কি অসীম ভালোবাসা নিয়ে লিখে রেখেছিল। তাদের সাতার শেখার বিষয়টা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা। সেবার বাইসাইকেল কিনেছিল। এইটে পাস করে নাইনে উঠার পর তার চাচার উপহার। সাইকেল চালানো শিখলো পশ্চিমের মাঠে। সেই সাইকেল নিয়েও লেখা ছিল। লেখাটার কথা মনে পড়লে হাসি পাবার কথা। অনিকের এখন পাবে কি-না কে জানে। আসলে প্রতিটি বয়সের আলাদা একটা আবহ থাকে। তার কাছে তার অনুভূতি সেই বয়সে গাঢ় হয়। বড় হবার পর সেটা নিয়ে হাসে মানুষ। তুচ্ছ করে দেখে। মনে হতে পারে বাইক হলে একটা ব্যাপার ছিল, তাই বলে বাইসাইকেল নিয়ে? অনিকের ডায়েরির লেখাটায় সেই চিহ্ন ছিল না। কেবলই আবেগ, ভালোবাসা ছিল। লেখাটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে পদ্যের,
“কয়েক মাস হলো আমি সাইকেল চালানো শিখেছি। ক’দিন আগে অর্নবকে পেছনের সিটে বসিয়ে বাজারে নিয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম, ডাবল টানতে কোনো অসুবিধা হয়নি আমার। তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাইকেলের মতো এত জটিল একটা যন্ত্র আমি চালানো শিখলাম। এটার পেছনে সিটও আছে। অথচ পদ্য আপুকে নিয়ে ঘুরতে পারবো না। এটা কেমন কথা? পদ্য আপু লজ্জা পায় সাইকেলে উঠতে। তা আমি জানি। রাস্তায় আমার সঙ্গে সাইকেলের পেছনে বসে সে যাবে তা কল্পনাও করতে পারবে না। ওর সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের লজ্জা। লোকে কি বলবে তা নিয়ে অতি ভাবনা। আমি পরশু ওদের উঠানে নানানভাবে সাইকেল চালিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমি কত দক্ষ চালক। স্যার বারান্দায় বসে মুখ কামাচ্ছিলেন। চাচি পাটিতে বসে কাঁথা সেলাই করছেন। পদ্য পাশে বসা। সে ভালোভাবে দেখছেই না চালানো। আমি বারবার সাইকেলের টুংটাং শব্দ তুলছিলাম। স্যার বললেন ‘কিরে অনিক? এত হর্ন কেন দিচ্ছিস?’
চাচি বললেন, ‘তা দিক, নতুন কিছু শিখলে প্রথম প্রথম এমন করেই সবাই। তুমি বাড়িতে মাস্টারি ফলাতে শুরু করো না।’
স্যার হাসলেন। আমি সাইকেল বারান্দার কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘নতুন শিখলেও চাচি। আমি ভালো চালাতে পারি। গতকাল অর্ণবকে নিয়ে বাজারে গেলাম।’
স্যার বললেন, ‘বাজার থেকে কি চাল আনতে পারবি পেছনের সিটে বেঁধে?’
আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ পারবো। চাল কেন? পদ্য আপুকেও পেছনে নিয়ে চালাতে পারবো। আপু উঠে দেখবে? আসো।’
পদ্য আপু লজ্জা পেয়ে বললো, ‘বাবা আমি এসবে নাই। ভয় লাগে।’
আমিও স্যারের সামনে আর কিছু বললাম না। কিন্তু এরপর থেকে স্যার চাল আনতে আমাকে পাঠান।
আজ চাঁদনি রাত ছিল। আমি পদ্য আপুদের ঘরে রাত নয়টার দিকে গিয়ে বললাম, ‘আপু বাইরে এসে দেখো কি সুন্দর চাঁদনি রাত।’
সে বাইরে এলো। এসে বললো, ‘তাই তো। দিনের মতো লাগছে সবকিছু। উঠানে কি সুন্দর ছায়া পড়েছে দেখো।’
আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘রইসু চাচাদের বাড়ির পরে কদম গাছের পাশ দিয়ে বিলের পাড়ে যাওয়ার একটা সরু রাস্তা আছে না?’
পদ্য আপু উঠানে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘হ্যাঁ।’
আমি মিথ্যে করে বললাম, ‘ওদিকে ধান খেতের উপর আজ এত জোনাক পোকা কোত্থেকে যেন এসেছে। আমি গিয়ে দেখে তো অবাক। এত জোনাক পোকা! চারদিকে শুধু জ্বলজ্বল করছে৷ বিলের উপরেও।’
সে অবাক হয়ে বললো, ‘তাই?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখতে যাবে না-কি?’
– ‘কিভাবে যাব। আম্মা জানলে বকা দেবে।’
– ‘আরে জানবে না। তুমি আমাকে ধরে সাইকেলে বসবে। আমি চোখের পলকে গিয়েই আবার চলে আসবো। এসে বলবে আমাদের ঘরে গিয়েছিলে। আর রাতে তো কেউ দেখবেও না।’
সে ইতি-উতি করছিল। আমি হাত ধরে বললাম, ‘চলো তো, আসো।’
সে এলো। আমি সাইকেলে উঠে বললাম, ‘আমাকে ধরে বসো।’
ভয়ে ভয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে বসলো সে। আমি দ্রত চালিয়ে কদম গাছের নিচ দিয়ে চলে গেলাম বিলের পাড়ে। পদ্য আপু বারবার বলছিল, ‘কিরে জোনাক পোকা কই?’
আমি বিলের পাড়ে গিয়ে বললাম, ‘বুঝলাম না, ছিল তো। চলে গেল মনে হয়।’
ওর মন খারাপ হলো। আমি ঘাসে বসে বললাম, ‘এসেছো যখন বসো এখানে। এখন কেউ এদিকে আসবে না। একটু পর জোনাক পোকা আবার আসতেও পারে।’
সে চারদিকে তাকিয়ে পাশে বসে বললো,
– ‘আহ পরিবেশটা কি সুন্দর লাগছে অনিক। বিলের টলোমলো জল চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে৷ পেছনে সবুজ ধানক্ষেত। ছেলেদের অনেক মজা তাই না? যখন তখন বাড়ি থেকে বের হতে পারে।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললাম, ‘তোমার ইচ্ছা হলে বের হও, কে বাঁধা দেয়?’
– ‘হ্যাঁ বের হই আর আম্মার বকা খাই।’
– ‘কে দেখবে, এই যে নিয়ে আসলাম। আমাকে বলবে দেইখো। কিভাবে নিয়ে আসি। তোমার যা ইচ্ছা হয় সব আমাকে বলো না কেন?’
সে ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘আচ্ছা বলবো।’
তারপর বিলের দিকে তাকিয়ে রইল। আমাদের ছায়া পড়েছিল পেছনে। আমার ইচ্ছা করছিল ওর পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বসি। সে মাথা রাখুক আমার কাঁধে৷ তা পারিনি। সম্ভবও নয়। তবে হাত ধরার বুদ্ধি বের করলাম। সুন্দর হাত, নখগুলো অল্প লম্বা। কোনো রঙ নেই। পরিষ্কার ফরসা ঈষৎ লম্বা নখ। এমন নখে ওর হাত-পায়ের আঙুল যে কি ভীষণ মায়াবী লাগে। আমি ওর হাতটা আলগোছে মুঠোয় নিলাম। সে কেঁপে উঠে বললো, ‘কিরে?’
আমি বললাম চাঁদের সামনে পাঁচটা আঙুল ফাঁক করে দেখো পেছনের ঘাসে কি সুন্দর ছায়া পড়ে। সে ঠোঁট টিপে হেঁসে তাই করলো। ছায়ায় নিজের লম্বা লম্বা আঙুল দেখে হাসছে। আমি তাকে দেখছি মুগ্ধ নয়নে। সে আঙুল বন্ধ করছে আর খুলছে। নানাভাবে দেখছে। হঠাৎ বললো,
– ‘চলো অনিক, যাই এবার, আম্মা জানলে আগুন লেগে যাবে।’
আমি আবার তাকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসলাম। আমাকে আঁকড়ে ধরে বসেছিল। একেকটা দিন হুট করে এত সুন্দর হয়। ইচ্ছা করে দিনটা ছবির মতো কোনভাবে দেয়ালে যদি টাঙিয়ে রাখা যেত৷ কি সুন্দর হাতটা ধরেছি ওর। কি সুন্দর আমাকে ধরে বসেছিল। আহা, মনে থাকবে আজীবন। মনে রাখতে চাইও। তাই যত্ন করে লিখে রাখলাম।”
পদ্য চোখ মুছে নিল। ডায়েরিটা ফিরিয়ে দিয়েছিল সে৷ অথচ সবকিছুই মনে আছে৷ ডায়েরিটা না পেলে আসলে কি হতো? অনিক কি তার অনুভূতিগুলো জানাতো এক সময়? তখন পদ্য স্কুলে টিচার হয়ে গেছে। ডিগ্রিও শেষ৷ বাড়ি থেকেই পড়েছে। অনিক অনার্সের জন্য শহরে চলে গেল তখন। কিন্তু প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন লেখা নিয়ে আসতো। রাতে ছাদে গিয়ে দু’জন ডুয়েল ভয়েজে রেকর্ড করে৷ শেষবার শহর থেকে ফিরে তাদের উঠানে এসেই ডেকে বললো, ‘পদ্য আপু আমাদের ঘরে আসো, সুখবর আছে।’
পদ্য শুনে একটু পরই ছুটে গেল। গিয়ে দেখে অনিক টেবিলে ব্যাগ রেখে বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে যাচ্ছে। সে বিছানায় গিয়ে বসে বললো, ‘তোমার সুসংবাদটা কি আগে বলো অনিক।’
– ‘ইউটিউবে মনিটাইজ পেয়ে গেছি আপু। এখন থেকে যা ইনকাম হবে অর্ধেক তোমার।’
– ‘ওরে বাবা তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, আরেকটা সুসংবাদও আছে। পাণ্ডুলিপি রেডি করতে হবে। আগামী বইমেলায়ই বই বের হবে আমার। একটা প্রকাশনী নিজ থেকে চাইছে।’
– ‘বাহ দারুণ তো। তা লেখা কতদূর?’
– ‘তোমাকে অল্প লিখে লিখে দেবো, পড়ার সময় আছে তো? হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবো।’
– ‘হোয়াটসঅ্যাপে যে পাঠাবে সেই লেখা যদি পরে বলি আমার? আমি যদি তোমার আগেই প্রকাশ করে ফেলি?’
– ‘কি যে বলো। আর শোনো তোমার জন্য একটা গিফট আছে।’
– ‘কি গিফট তাড়াতাড়ি দাও।’
‘হাত-মুখ ধুয়ে আসি দিব’ বলেই অনিক বাথরুমে ঢুকে গেল।
গিফট কি এনেছে দেখার জন্য পদ্য ব্যাগ খুলে দেখে একটা শাড়ি।
– ‘ও আচ্ছা শাড়ি এনেছো। আমি ভাবলাম অন্যকিছু।’
অনিক বাথরুম থেকে বললো,
– ‘অন্যকিছুটা কি? শাড়ি এনেছি তুমি তো এখন আবার স্কুলের ম্যাডাম। কাজে লাগবে।’
– ‘ঠিক আছে, সুন্দর হয়েছে।’
– ‘কিনতে গিয়ে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। কালার-টালারও ভালো বুঝি না।’
– ‘কেন বুঝো না, না বুঝলে লিখো কিভাবে? লিখতে গেলে তো সবই লাগে।’
– ‘শোনো আপু, শিল্পী মানেই সাংসারিক সবকিছুতে আনাড়ি। সে লেখক, কবি, গায়ক, চিত্রকার যেই হোক। এরা জন্মগত অকর্ম হয়। তারা ফুল-ফল, লতা-পাতা এগুলো ছাড়া সাংসারিক জটিলতার কিছুই বুঝে না। দূর থেকে মনে হয় সবকিছু জানে।’
‘ও আচ্ছা’ বলে নীল ডায়েরিটা নিল পদ্য। শাড়ির সঙ্গে বের হয়ে এসেছে ব্যাগ থেকে। ভেবেছিল ডায়েরিতে হয়তো নতুন গল্প। সে ডায়েরি মেলে বললো, ‘ইউটিউবের জন্য নতুন কি গল্প লিখলে অনিক?’
– ‘লিখেছি, তোমাকে দেবো এসে। পড়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে আজ সন্ধ্যায়ই রেকর্ড করে নিব।’
এরকমই কাজ করে তারা। আগে গল্প পদ্যকে দেয় পড়ে রাখার জন্য। পদ্য সেই ভাবনা থেকে ডায়েরিটা খুলেছে। কিন্তু প্রথম পাতায় বিস্মিত হয়ে দেখে তাকে নিয়ে কি যেন লেখা। না পড়ে একের পর এক পেইজ উলটে চোখ বুলাতে থাকে। স্পষ্ট পুরো ব্যাপারটা তখনও বোঝেনি। তবে মনে হচ্ছিল তাকে নিয়ে অনেক কিছুই লেখা আছে এই ডায়েরিতে। পদ্য কৌতূহলী হয়ে শাড়ির ভাঁজে নিয়ে নেয় ডায়েরি। অনিক হয়তো কিছু সময়ের জন্য ডায়েরির কথা ভুলে গিয়েছিল। বের হয়ে এসে ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে দিয়ে বললো, ‘এই নাও গল্প। সন্ধ্যার আগে পড়ে নিয়ো।’
পদ্য খাতা হাতে নিয়ে বললো,
‘তাহলে এখন যাই’ বলে সে পুরো ডায়েরি পড়ে ফেলে সন্ধ্যার আগেই। রাগে শরীর জ্বলতে শুরু করে। এসব কি দেখছে সে? অনিক তাকে অন্যচোখে দেখে। এসব ভাবে তাকে নিয়ে? লজ্জায়-ঘৃণায় সে অনিকের সামনে যায়নি আর। দরজা বন্ধ করে পড়ে রয় রুমে। খানিক পর রেকর্ড করার জন্য অনিক এসে ডাকে তাকে। পদ্য ডায়েরি, গল্পের খাতা, শাড়ি নিয়ে উঠানে এসে বললো, ‘আজ থেকে তুমি আমার আশেপাশেই আসবে না। তুমি একটা বেয়াদব, অসভ্য। এই নাও এগুলো।’ অনিক ডায়েরি দেখে বুঝে ফেলে সব। তবুও না ঘাবড়ে বললো, ‘ডায়েরি পড়ে রাগ করেছো তাই না? কিন্তু সব কিছুই সত্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
– ‘আর কখনও এমন কথা মুখ থেকে বের করলে, থা*প্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো নির্লজ্জ কোথাকার। তোমার বয়সে আমি বড়ো। আপু বলে ডাকো তুমি আমাকে।’
সে চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আস্তে কথা বলো আপু, কেউ শুনে ফেলবে। তুমি ব্যাপারটা..।’
পদ্য থামিয়ে দেয়, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ‘এসব নিয়ে এখান থেকে যাও অনিক৷ অকারণ আমাকে রাগাবে না। এতদিন তোমার সাথে মিশেছি ভেবে নিজের ঘেন্না লাগছে এখন।’
অনিক সবকিছু হাতে নিয়ে আমতা-আমতা করে বললো, ‘আচ্ছা তোমার মাথা ঠাণ্ডা হলে আমি আসব। এখন গেলাম।’
অনিক চলে গিয়েছিল৷ সেদিন পদ্য বা অনিক কেউ বুঝতে পারেনি। মিরাজুল ইসলাম নামাজ পড়ে একটু দেরিতে মসজিদ থেকে ফিরছিলেন। বাতি ছিল না, তাই অন্ধকারে খানিকটা ধীরে ধীরেই হাঁটছিলেন। হঠাৎ তাদের কথোপকথন শুনে একটা গাছের আঁড়ালে দাঁড়িয়ে থাকেন।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম