ছন্দহীন পদ্য পর্ব ৫

0
392

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৫
.
অনিক টিউশনি থেকে ফিরেছে। রোজকার মতো এখন গোসল করে লিখতে বসবে৷ একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে নিয়ে টানতে টানতে তোয়ালে হাতে বাথরুমে ঢুকে গেল সে। তখনই তাড়াহুড়া করে এলো আফরা। রুমে না পেয়ে বাথরুমের দরজায় নক দিয়ে বললো, ‘অনিক, বাথরুমে কি করো?’

অনিক ঠোঁট থেকে সিগারেট আঙুলের ফাঁকে নিয়ে বললো, ‘এটা কেমন অদ্ভুত প্রশ্ন ভাবি? তুমি কি অফিসে যাওনি?’

– ‘না, এইতো যাব।’

– ‘কিছু বলবে আমাকে? না-কি বাথরুমে কি করছি জানতে এসেছো?’

আফরা হেঁসে বললো, ‘আরে না, আমার তো অফিসের লেইট হয়ে যাচ্ছে। তাই জানতে চাইছি গোসলে কি-না। একটা কথা বলার দরকার ছিল।’

অনিক সিগারেট ডাস্টবিনে ফেলে আন্ডারওয়ারের ওপরে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বের হয়ে এসে বললো,

– ‘জরুরি কথাটা কি বলো।’

– ‘হ্যাঁ, তোমাকে বলবো বলবো করেও বলা হয়নি। ইভা আসার আগে আমাকে বলেছিল ওর জন্য টিউশনি দেখতে। তোমার ভাইকে বলেছিলাম। তার তো স্বভাব জানোই। অফিস যাবে আর সোজা বাসায়। কোথাও বেরও হয় না।’

– ‘তোমার মতো বউ থাকতে বাইরে গিয়ে কি করবে, কি দেখবে?’

– ‘হইছে সুযোগ পেলেই পাম্প দিতে হবে না। এখন বলো, তোমার জানাশোনা আছে?’

– ‘না, নেই৷’

– ‘ও আচ্ছা, তবুও তুমি দেইখো। আমি অফিসে গেলাম।’

– ‘যাও, তোমার বোনকে বাসায় একা পেলাম।’

আফরা যেতে যেতে বললো,

– ‘ও ভার্সিটিতে, আর একা পেলেও তুমি কিছু করবে না জানি। তুমি মুখে খারাপ, বুকে না।’

অনিক পেছনে যেতে যেতে বললো,

– ‘তাই? এত চেনো আমাকে?’

‘তোমাদের দুই ভাইকে আমার ভালো করে চেনা আছে’ আফরা কথাটি বলে বের হয়ে যায়। অনিক দরজা লাগিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকে। গোসল শেষে শরীর মুছে তোয়ালে শুকোতে বারান্দায় আসে। এই জায়গাটা বাসার সামনের দিকে। তাই খুব একটা আসা হয় না তার৷ খানিক রোদ থাকায় চুলে আঙুল ডুবিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট কয়েক পর এসে কাপড়-চোপড় পরে লিখতে বসে যায়। সমকালীন উপন্যাসটা লিখছে৷ খানিক লেখার পর বারবার আঁটকে যাচ্ছে লেখা। এগোতেই পারছে না। কিছু তথ্যের প্রয়োজন হচ্ছে। কথাসাহিত্যিকদের এই এক যন্ত্রণা৷ সে লিখবে উপন্যাস। কিন্তু কখনও কোনো একটা চরিত্র অসুস্থ হলে ডাক্তারদের মতো পুরো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। সে একজন লেখক, কিন্তু কোনো চরিত্রের অপরাধের জন্য উকিল, পুলিশ, বিচারক সবকিছুর দায়িত্ব আড়াল থেকে তারই পালন করতে হবে। ফলে এগুলোর ভেতরকার সবকিছু লিখতে গিয়ে এবার জানতে হবে, পড়তে হবে। বড়োই মুশকিল। অবশ্য লেখালেখির শুরুর দিকে পদ্য আপু তাকে এসব বিষয়ে বেশ সহায়তা করতে পারতো। সে নিজেই যেন একটা লাইব্রেরি। সবকিছু অল্প অল্প বুঝতো, জানতো। এখন আর সেই পথ খোলা নেই। বিষয়গুলো মোবাইলে নোট করে নিল সে। পাব্লিক লাইব্রেরিতে গিয়ে কিছু বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। তথ্যগুলো আপাতত এড়িয়ে ঘণ্টা কয়েক লিখে কাটিয়ে দিল। ঠিক বারোটার দিকে বের হয় বাইরে। রিকশা নিয়ে একটা বাসার সামনে এসে নামে। গেইট খুলে ভেতরে গিয়ে কলিংবেল কয়েকবার চাপতেই একজন মধ্যবয়সী মোটা মহিলা দরজা খুলে বিব্রত চেহারায় হেঁসে বললেন, ‘আপনি? আপনি কি মনে করে?’

– ‘জুঁই তো মনে হয় স্কুলে।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘ভেতরে আসি একটু?’

– ‘হ্যাঁ আসুন।’

অনিক ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলো। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। অনিক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘চা-নাশতা কিছু দেবেন না?’

আরও বিব্রত হয়ে তিনি বললেন, ‘ও হ্যাঁ, দিচ্ছি বসুন আপনি।’

– ‘আচ্ছা থাক, কেন এলাম আগে বলি। জুঁইয়ের জন্য তো নতুন টিচার রাখেননি মনে হয়।’

– ‘না এখনও রাখা হয়নি।’

– ‘আমাকে হঠাৎ বাদ দিয়েছেন কেন আমি জানি। পড়ানো থেকে গল্প করি বেশি সেজন্য, তাই তো?’

সরাসরি এমন প্রশ্নের জন্য হয়তো তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। আমতা-আমতা করে বললেন,

– না সেরকম কিছু…।’

– ‘থাক বাদ দিন। বলতে হবে না। জুঁইয়ের জন্য নিশ্চয় একজন ফিমেল টিচার হলে ভালো হয়, তাই না? আর ওর সামনে পরীক্ষা। এই সময়ে টিচার পাওয়া কঠিন। না পেলে ওর পড়ালেখারও ক্ষতি হবে।’

ভদ্রমহিলা কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। অনিক পুনরায় বললো, ‘আমার পরিচিত একটা মেয়ে আছে। তাকে কি আমি বিকেলে নিয়ে আসবো?’

– ‘আচ্ছা আসুন নিয়ে।’

– ‘আমি এখন গেলাম তাহলে।’

– ‘চা-নাশতা খেয়ে যান বসুন..।’

– ‘না ঠিক আছে, আমি গেলাম এখন।’

অনিক বাইরে চলে এলো। হেঁটে হেঁটে গেল পাব্লিক লাইব্রেরিতে। সেখানে ঘণ্টা কয়েক বই ঘাঁটাঘাঁটি করে বের হলো সে। এখন একটা রিকশা নেবে। মহিলা কলেজ ছুটির সময় হয়ে গেছে। ওই রাস্তা দিয়ে রিকশা নিয়ে বাসায় গেলে মন্দ হতো না৷ সাদা সাদা ড্রেস পরে মেয়েগুলো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চড়ুই পাখির মতো কিচিরমিচির করে হাঁটে। বেশ ভালোই লাগে দেখতে। হাঁস আর তাদের মাঝে মিল হলো দলবেঁধে চলাফেরা করা। কিন্তু সেদিকে রিকশা যায় না। হেঁটে হেঁটে গেলে আবার লোকজন দেখলে মন্দ বলবে।
সে রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল লিখতে। আগের লেখাগুলো এডিট করে পুনরায় তথ্য সহ গুছিয়ে নিতে হবে। মিনিট তিরিশেক পর কলিংবেলের শব্দ পায়। উঠে গিয়ে খুলে দেখে ইভা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে বেগুনি রঙের হিজাব। এটা কি বেগুনি রঙই সঠিক? ঠিক ধরতে পারছে না সে। বেগুনির সঙ্গে খানিকটা কালচে ভাব আছে। নিচে কালো হিজাব ক্যাপ। কপালের ডান পাশ দিয়ে খানিকটা নামিয়ে পরায় দেখা যাচ্ছে। কি নান্দনিক দৃশ্য। মাথায় বেগুনি হিজাবের ফাঁক গলে গাঢ় কালো ক্যাপ থাকায় চেহারা আরও বেশি ফরসা আর সুশ্রী দেখাচ্ছে।
সাদা লং ড্রেস কামিজের থ্রি কোয়ার্টার হাত। বাঁ হাতে ক্রিম কালারের ঘড়ি গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে আছে৷ আরও নিচের দিকে যাওয়ার আগেই ক্ষিপ্ত গলা শোনা গেল, ‘কি হলো পথ ছাড়ুন।’

অনিক পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। দরজা ভেজিয়ে পিছু পিছু গিয়ে বললো, ‘শোনো ইভা, তোমাকে তুমি করেই বলি। আমার ছোটই তো হবে।’

ইভা পিছু ফিরে বললো,

– ‘হ্যাঁ, বলুন কি বলবেন।’

– ‘তোমার পরনে যা আছে থাকুক। বাইরে যাব।’

– ‘বাইরে কেন?’

– ‘বলছি পরে, আগে রেস্ট নাও গিয়ে। বাইরে থেকে এসেছো, আবার যেতে হবে।’

ইভা কিছু বলতে গিয়েও থেমে রুমে চলে যায়। অনিক চলে যায় রান্নাঘরে। ভাত-তরকারি সহ সবকিছু একে একে এনে রাখে টেবিলে। তারপর ইভার দরজায় নক দিয়ে বলে,

– ‘ইভা, খাবে আসো। আমিও খাইনি এখনও।’

ইভা দরজা খুলে এসে তাকিয়ে বললো, ‘সে কি ভাইয়া, আপনি খাবার এনেছেন টেবিলে?’

অনিক উত্তর না দিয়ে উলটো প্রশ্ন করলো, ‘হিজাব খুলে ফেললে যে? হিজাব ছাড়া বাইরে যাবে না-কি?’

ইভা শুকনো ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললো, ‘বাইরে কেন যাব ভাইয়া?’

– ‘তালতো ভাইয়ের সাথে বাইরে যেতে সমস্যা কি? ঘুরবো দু’জন।’

এই অদ্ভুত লোকটা তার পিছু নিয়েছে কেন কে জানে। সে ইতস্তত করে বললো, ‘আপনার সাথে বাইরে যাব মানে, কেন যাব।’

– ‘বললাম তো ঘুরবো ফিরবো, এগুলোই আরকি।’

– ‘ওরা কেউ বাসায় তো নাই…।’

– ‘আচ্ছা বাদ দাও, আগে এসে খেয়ে নাও, আসো।’

– ‘আপনি খান ভাইয়া, আমি না হয় পরে খাব।’

– ‘আসো তো, একসঙ্গে খাই।’

– ‘না আমি সবেমাত্র এসেছি, পরে খাব।’

– ‘বাইরে যেতে হবে তো। অনেক ঘুরবো তোমাকে নিয়ে। ফিরতে দেরি হবে। পরে খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।’

ইভার কেমন ভয় লাগছে। না গেলে আবার যদি খালি বাসায় হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়? সে ভয়ে ভয়ে টেবিলে গিয়ে বসে। রাতেও উনার সামনে খেতে তার ভীষণ লজ্জা করেছিল। তখন তো আপুও ছিল। এখন পুরোপুরি একা। নিস্তব্ধ নিঃশব্দ বাসা। ভাত নিতে গিয়ে মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। ধীরে ধীরে ভাত তরকারি প্লেটে নিল সে। তারপর মাখাতে গিয়ে মনে হলো পুরো পৃথিবীর মানুষ আজ তার খাওয়া দেখছে। অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো ইভার। উনিও তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে। মুখে লোকমা দিতে গিয়ে মনে হয় মুখ কি সে একটু বেশি “হা” করে ফেলেছে? যেরকম খা*টাশ লোক খেয়াল করলে বলে বসবে, ‘কি অবস্থা তালতো বোন? আপনি ভাত মুখে দিতে গিয়ে “হা” এত বড়ো করেন কেন বুঝলাম না। গলা অবধি দেখা যায়।’

ইভা বিষম খেল। অনিক তাড়াতাড়ি গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন খান।’

ইভা গ্লাস হাতে নিয়ে খেতে গিয়ে ফেলে দিল প্লেটে।

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here