#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৩০
#রাউফুন
রৌফ সুলতান দুপুরে খাবার খেয়ে অনেক প্রসংশা করলেন তুলিকার। এরকম রান্না খেয়ে ভীষণ ইমোশনাল হয়ে গেছিলেন তিনি। তার প্রথম স্ত্রীর মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কিভাবে একটা মানুষকে দিনের পর দিন তিনি ঠকিয়ে গেছেন। অথচ আসমা সিদ্দিকা সব জেনেও চুপচাপ ছিলেন তার মায়ের ভয়ে। আর অন্য দিকে শাপলা সেই সুযোগ নিয়ে তার ব্রেইন ওয়াশ করে গেছে যে আসমা, তার মাকে ভীষণ ভাবে জ্বালাতন করেন। খেতে দেই না। বুড়ি বুড়ি বলে লাথি -ঝে’টা পে’টা করে। নিজের মায়ের সঙ্গে ওমন বা’জে আচরণ করে জানতে পেরে সে-সময় রৌফ সুলতানের ভালোবাসাও কমতে থাকে আসমা সিদ্দিকার উপর থেকে। কে সহ্য করবে নিজের জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে ওরা অবিচার। সেও পারেনি সইতে। তার মা ও এসে এটা সেটা বলতেন আসমার নামে,মায়ের কথায় অবিশ্বাস করার জায়গা তিনি পান নি।
সব মিলিয়ে আসমার প্রতি মনটা বিষিয়ে যায় দিন দিন। আর ধীরে ধীরে শাপলার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেন। এক সময় আসমা সিদ্দিকা সবটা জানতে পারেন তার আর শাপলার অবৈধ সম্পর্কের কথা। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নেন তার থেকে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বেষ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢেলে পরেন আসমা। আজ যখন রৌফ সুলতান তুলিকার হাতের রান্না খাচ্ছিলেন খুব, খুব মনে পরছিলো আসমার কথা। আসমার রান্নার হাতও এরকম সুন্দর ছিলো। কি ভীষণ ভালো রান্না করতেন আসমা। গাড়িতে যেতে যেতে তিনি নানান কথা ভেবে চললেন। নিজের ভেতরের অপরাধ বোধ কোনো ভাবেই কমছে না। নিজের ছেলের সঙ্গে অবিরাম, অন্তহীন অত্যাচার হয়েছে তার ছিটেফোঁটাও জানতে পারেন নি। নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন তিনি। নিজের স্ত্রীকে কিভাবে অবিশ্বাস করেছে অন্যের কথায়। কোনো রকম যাচাই বাছাই করার প্রয়োজন মনে করেন নি। আসমাও হইতো তার প্রতি তীব্র অভিমান থেকে কিছু বলেনি। বা ভয়ে কিছু বলার সাহস করেননি।
‘স্পাইনলেস! ইউ আর স্পাইনলেস রৌফ সুলতান। নিজের স্ত্রী,সন্তানের দায়িত্বের প্রতি অপরাগ তুই। তোর কোনো অধিকার নেই কারোর ভালোবাসা পাওয়ার।’ নিজের মনে কথা বলে কাঁন্নায় ভেঙে পরলেন রৌফ সুলতান।
•
মাইজিন কখন থেকে ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে। এখনো বের হওয়ার নাম নেই। তুলিকা দরজায় ঠকঠক করলো।
‘মাইজিন দরজা খুলুন। কি করছেন ভেতরে?’
‘ওঁ আমাকে মা’র’বে! আমি যাবো না। যাবো না কোথাও!’
‘কে মা’র”বে? কি সব বলছেন? দেখি দরজা খুলুন!’
‘না, না তুমি মা’রবে আমি জানি! তুমি ভালো না। পঁচা মহিলা একটা!’
‘আমি? আমি কেন মা’র’বো? মাইজিন কি হয়েছে আপনার?’
এরপর কোনো উত্তর এলো না। বিচলিত হলো তুলিকা। এদিকে চিন্তায় মাথা ফে’টে যাওয়ার যোগাড়। আরও কিছুক্ষন পর মাইজিন বাইরে এলো। সে সম্পুর্ন স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এলো। তুলিকা আশ্চর্যজনক ভাবে তাকিয়ে থাকে কিয়ৎক্ষন তার দিকে। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ভয়ে। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাইজিনকে। মাইজিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
‘আল্লাহ্, আল্লাহ্, আল্লাহ্! আমি কি এখন একটু ওয়াশরুমেও যেতে পারবো না? আমার বউ আমাকে এতোটা চোখে হারাই?’
‘একটু আগে এসব কি আজেবাজে কথা বলছিলেন? আপনি আধ ঘন্টা থেকে ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছেন চিন্তা হবে না?’
‘কি বলছো এসব? আমি তো মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই ওয়াশরুমে গেলাম!’
আপনাআপনি তুলিকার ভ্রুদ্বয় কুচকে যায়। আচ্ছা সমস্যা টা কার? তার নাকি মাইজিনের? সে কি পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু সে তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মাইজিন হুট করেই অস্বাভাবিক আচরণ করছে আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বাভাবিকও হচ্ছে। কাল রিপোর্ট আনতে যেতে হবে মাইজিনের। তার ওমন চরম মাথা ব্যথার উৎস কি ছিলো জানতে হবে।
‘আঃ তুলিকা কাঁদছো কেন? আমার কিছু হয়েছে? হয়নি তো তাইনা? এই দেখো আমি একদম ফীট এন্ড ফাইন!’ মাইজিন তার চোখ মুছে দিলো।
রাত দুটো। মাইজিন লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে চিৎকার শুরু করে। তুলিকা হুরমুরিয়ে উঠে হাতড়ে লাইট জ্বালিয়ে দিলো।
‘আমি কি ম’রে গেছি? আমার শরীরে আত্মা নেই কেন? আমার আত্মা কই? আমি বোধহয় ম’রেই গেছি!’
মিষ্টি পাশের রুম থেকে ছুটে এসে মাইজিনের এমন পা’গ’লের প্রলাপ বকা দেখে ভয় পেয়ে যায়।
‘এই বুবুজান কি হয়েছে?’
‘দেখ না তোর মাইজিন ভাইয়া আবার পা’গ’লামি শুরু করেছে। কেমন ডেস্পারেট হয়ে গেছে। নাফিস ভাইকে কল করে ডাক!’
‘আমি, আমি, আমি মরলাম কেন? বেঁচে নেই কেন? তুমি,এই তুমি আমাকে মে’রে ফেলেছো? কু’চু’টে মহিলা!’
‘মাইজিন, মাইজিন আপনি শান্ত হোন৷ আপনার কিচ্ছুব হয়নি। আপনি একদম সুস্থ আছেন। এই দেখুন আমি আপনাকে ছুঁ’তে পারছি।’
মাইজিন অসম্ভব চ’টে যায়। একটা ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো নিজের হাত। তুলিকা তাল সামলাতে পারে না। মিষ্টি ভয়ে আঁতকে উঠলো। সে ছুটে গিয়ে নিজের বুবুজানকে আঁকড়ে ধরলো দুই হাতে।
‘আমাকে কেউ-ই টাচ্ করবে না। খবরদার কেউ না!’
মাইজিনের ওমন আক্রমনাত্মক অবস্থা দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেছে তারা। দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে। তখনই কলিং বেল বাজে। মিষ্টি কোনো রকমে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অগোছালো নাফিস এক প্রকার হাঁপাচ্ছে। বোঝায় যাচ্ছে মিষ্টির মুখে মাইজিনের কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। তুলিকা দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদছে। কাঁদছে মিষ্টিও।
‘নাফিস ভাই দেখুন না মাইজিন ভাইয়া কেমন করছে।’
নাফিস ভেতরে প্রবেশ করলো। দেখলো সবটা স্বাভাবিক।
‘মিষ্টি! সব তো ঠিকই আছে! মাইজিন ঘুমোচ্ছে!’
‘কি বলছেন এসব? দেখুন!’
তুলিকা আর মিষ্টি দুজনেই হতবাক, হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো ঝ’ড় থেমে গিয়ে সবটা শান্ত, নিস্তব্ধ! যেনো কিছুই হয়নি সব ঠিক ঠাক।
‘ভাবি কিছুই হয়নি। নিশ্চয়ই খুব খা’রাপ স্বপ্ন দেখছিলেন!’
‘উফফ নাফিস ভাই। এক সাথে আমরা দুজনেই স্বপ্ন দেখছিলাম? আপনি জানেন না একটু আগে মাইজিন ভাই কি রকম করছিলো। এখন উনাকে ঠিক যতটা শান্ত দেখাচ্ছে ঠিক ততটাই ভয়ংকর রকমের আচরণ করছিলেন তিনি!’
‘রিল্যাক্স মিষ্টি। কি হয়েছিলো সবটা খুলে বলুন তো ভাবি।’
‘আরে নাফিস? এতো রাতে তুই এখানে? রাত ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে?’
মাইজিনের কন্ঠ পেয়ে নাফিস অপ্রস্তুত বনে যায়। আমতাআমতা করে। কিছু বলতে চেয়েও পারে না। কি বলবে সে? এতো রাতে এখানে কেন এসেছে এটা বললে যদি হিতে বিপরীত হয়!
‘তুই আসতেই পারিস কিন্তু সময় টা দেখবি তো নাকি?’ বললো মাইজিন।
‘আসলে, মানে তুই না-কি অসুস্থ তাই ভাবি ডেকেছিলেন! তোর জন্য চিন্তা করছিলো খুব।’
‘কিহ আমি অসুস্থ? আমাকে দেখে কি তোর অসুস্থ মনে হচ্ছে? এই দেখ আমি একদম সুস্থ আছি! তোর ভাবির আমাকে নিয়ে বেশিই চিন্তা। মাথাটা কি পুরোপুরি গেছে তোমার তুলিকা? এতো রাতে শুধু শুধুই নাফিসকে ডেকেছো!”
‘না, আসলে আপনি কেমন করছিলেন তাই ভয় পেয়ে গেছি!’
‘কেমন করছিলাম আমি?’
‘আপনি ভুলে গেলেন এর মধ্যেই?’
‘আরে কিছু হলে তো মনে রাখবো? মিষ্টি ঘুমোও নি কেন এখনো? যাও ঘুমাও। আর নাফিস যাহ তুইও গিয়ে ঘুম দে। এই মেয়েটা পা’গ’ল বানিয়ে দেবে আমাকে। সাথে তোদেরকেও।’
নাফিস চলে যায়। সে রাতে আর ঘুমাতে পারলো না তুলিকা। প্রিয় মানুষের এমন অসময়ে কি ঘুমানো সম্ভব? মাইজিনের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিলো সে। চোখ থেকে বেরিয়ে এলো নোনা জল। খুব ভয় হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারাতে বসেছে সে। সকালে উঠে তুলিকা প্রথমে নাফিসের সঙ্গে দেখা করে। মাইজিনের বিগত চারদিনের কার্য কলাপ পূঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না দিলো। নাফিসের কপালে চিন্তার ভাজ পরে। তার কিছুই বোধগম্য হয় না কি জন্য এসব হচ্ছে।
‘ভাবি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ডক্টর এর কাছে যাবো। ওঁর রিপোর্টস গুলো নিয়ে আসবো।’
‘আচ্ছা ভাই!’একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুলিকা আবারও বললো, ‘আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি ভাই। আসলে মাইজিনের জন্যই যেতে পারছি না কোথাও। কখন কি করে বসে। সব সময় একটা আতংক তা’ড়া করছে আমায়। মাইজিনের যদি জোড়ালো কিছু হয়?ভেবেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’
‘ভাবি শান্ত হোন। আপনি রুমে যানতো।’
মিষ্টি রেডি হয়ে নিচে নামছিলো। তারও মনটা বিষন্ন হয়ে আছে। মাইজিনের উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণের রেশ এখনো মাথা থেকে বের করতে পারেনি সে।
‘মিষ্টি আসো তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’
মিষ্টি বাঁধা দেইনি। বরং নিরবে গিয়ে গাড়িতে বসেছে। নাফিস গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টিকে অবলোকন করছিলো।
‘চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘মাইজিন ভাইয়ার কি হয়েছে বলুন তো? হঠাৎই এরকম আচরণের মানে টা কি? একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কি হচ্ছে মাঝে মধ্যে?’
‘জানি না মিষ্টি। দেখি ডক্টর এর কাছে যাচ্ছি রিপোর্ট দেখে কি বলেন!’
মিষ্টি মুখ চেপে হুহু করে কাঁন্না করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মাইজিন ভাইয়ার যদি কিছু হয়ে যায় আপু বাঁচবে না। শেষ হয়ে যাবে আপু!’
‘কেঁদো না আমার বাচ্চা মরিচ! সহ্য করতে পারি না!’
মিষ্টি কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নাফিস আলতো হাসে আড়ালে। মিষ্টি এই প্রথম বার নাফিসকে খেয়াল করলো৷ কি সুন্দর মানুষটার মুখটা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরে তাকালো।
‘আজকে স্কুলে না গেলে কি হতো না?’ বলল নাফিস।
‘আজ আমার এক্সাম! নাইনের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়েছে। টেন এ উঠবো আমি। আর বাচ্চা মরিচ বলবেন না আশা করি।’
‘ওহো তাই তো বড় হয়ে গেছে আমার বাচ্চা মরিচ। তা ভালো ভাবে পড়েছো?’
‘হ্যাঁ পড়েছি। ঘটনা তো রাত দুইটা বেজে ঘটেছে। রাতেই পড়া কমপ্লিট করে ঘুমিয়েছিলাম আমি।’
‘গুড। ভালো ভাবে এক্সাম দাও। আমি আনতে যাবো এক্সামের পর।’
‘দরকার নেই আমি চলে আসবো। আপনার যাওয়া লাগবে না। আমার বান্ধবীরা ক্ষ্যাপাবে আমায়।’
‘ক্ষ্যাপাবে কেন?’
‘কারণ আপনি বুড়ো। এমন বুড়োর সঙ্গে দেখলে ওঁরা নির্ঘাত ক্ষ্যাপাবে আমায়।’
‘ক্ষ্যাপালে ক্ষ্যাপাবে। না হয় একটু সহ্য করে নিও। অভ্যাস হয়ে যাবে বিয়ের আগে।’
‘আমি একাই আসবো।’
‘জেদ করো না মিষ্টি! তোমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই।’
আজ আর বেশি বাঁধা দিলো না মিষ্টি। না কোনো রাগ দেখালো নাফিসের কথায়। অন্য সময় হলে হইতো এতক্ষণে একটা কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতো৷ ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে নাফিস। মিষ্টিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নাফিস হসপিটাল গেলো৷ ডক্টর রিপোর্ট দেখে যা জানালেন তা ছিলো অভাবনীয়। মাইজিনের স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ( মাল্টিপল ডিসওর্ডার!) অর্থাৎ একজন মেন্টাল পেসেন্ট!
#চলবে