#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
বোনাস পর্ব
চারিদিকে থম্থমে নিস্তব্ধতা। ঠিক কয়টা বাজে কারো খেয়াল নেই। থেমে থেমে চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে কোথাও থেকে। হয়তো খুব আপনজনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখা আর্তনাদ বাস্তবে রুপ নিচ্ছে। কিন্তু আবার পর মুহূর্তেই থেমে যাচ্ছে আশে পাশের পরিবেশের কথা ভেবে। এয়ারকন্ডিশনের বাতাসে ঠাণ্ডা ভাবটা জোরালো হয়ে উঠেছে। অনুভুতিশুন্য হয়ে সামনের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ঈশার মা। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে ঈশার বাবা। আশে পাশে চেয়ারে ইলু, ইরিনা, ঈশান বসে আছে। ইফতি গেছে তার মাকে আনতে। ভিতরে ঈশার অপারেশন হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ভেজার পরে ঈশার গলার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। টনসিল বেড়ে যায়। শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। ডক্টর আগেই বলে দিয়েছিল যে খুব সাবধানে থাকতে। ঠাণ্ডা লেগে যদি টনসিল কোনভাবে বেড়ে যায় তাহলে অপারেশন ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। ঈশার বোকামির কারনে আজ সে নিজেই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন। খুব জটিল কোন অপারেশন না হলেও সেটা অপারেশন তো। আর তাছাড়াও ঈশার প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছিলো। শ্বাস নিতে না পারায় সেন্স হারিয়ে ফেলেছিল। এতেই সবাই অনেক বেশী ভয় পায়। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে সবাই অপেক্ষা করছে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ডক্টর বলেছে খুব বেশী হলে ১ ঘণ্টাই লাগতে পারে। ঠিক তাই। সবার অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে অবশেষে ডক্টর বের হয়ে এলো। ঈশার বাবা বিচলিত হয়ে বললেন
–আমার মেয়ে কেমন আছেন ডক্টর?
ডক্টর মৃদু হেসে বললেন
–একদম ঠিক আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তবে চিন্তার কোন কারন নেই। সন্ধ্যার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।
বলেই ডক্টর এগিয়ে যেতেই ঈশার মা অসহায় কণ্ঠে বললেন
–আমার মেয়ে কথা বলতে পারবে তো?
ডক্টর মৃদু হাসলেন। ঈশার মায়ের সামনে দাড়িয়ে বললেন
–তিন দিন পর্যন্ত কথা বলতে একটু প্রব্লেম হবে। ব্যথা হবে। ধিরে ধিরে ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর জটিল কোন সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে।
সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ঈশা ঠিক আছে এটাই এই মুহূর্তে সব থেকে বড় খবর। ইভানের মা এসে দাঁড়ালো। সবার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা এখন কেমন আছে?
ইরিনা তাকে বসাল চেয়ারে। শান্ত কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে বড় মা। জ্ঞান এখনও ফেরেনি। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরবে নাকি। বড় কোন ঝামেলা নেই।
ইভানের মা সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঈশার মায়ের ঘাড়ে হাত রাখতেই ডুকরে কেদে উঠলেন তিনি। আর যাই হোক সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পাওয়া কোন মায়ের জন্য ভালো অনুভুতি হতে পারেনা। ইভানের মা তাকে যথেষ্ট শান্তনা দিলেন। তিনি বুঝে চুপ করে গেলেও মন তো অস্থির হয়েই আছে। এর মাঝেই ঈশাকে কেবিনে দেয়া হল। সবাই এক এক করে দেখে আসলো তাকে। সবার দেখা শেষ হতেই ইরিনা সবার উদ্দেশ্যে বলল
–ইভান ভাইয়া কোথায়? অনেক্ষন থেকেই দেখছি না।
সবাই বিচলিত হয়ে তাকাল। আসলেই তো। হসপিটালে ঈশাকে ভর্তি করানোর পর থেকেই ইভানের কোন খবর নেই। এতো টেনশনের মধ্যে কেউ তার খবর নিতেই ভুলে গেছে। অথচ সেই কাল রাতে ঈশার বাবাকে ফোন করে তার অসুস্থতার কথা জানায়। তারপর তাদের সাথেই ঈশাকে নিয়ে হসপিটালে চলে আসে। ঈশার অবস্থা তখন ভালো ছিল না। ধিরে ধিরে আরও খারাপের দিকে যায়। সবাই তখন ঈশাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপর থেকে ইভানকে কেউ দেখেনি। এমন কি ঈশার অপারেশন হল তবুও ইভানের কোন খবর নেই। বিষয়টা আসলেই অবাক করার মতো। ঈশান বলল
–আমি ফোন দিচ্ছি।
ফোন বের করে ইভানের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। ঈশান অসহায় ভঙ্গিতে ফোনটা কেটে দিয়ে নিচে তাকিয়েই বলল
–বন্ধ।
এবার সবার মাথায় একটু চিন্তা খেলে গেলো। ঈশাকে এই অবস্থায় দেখে ইভান ঠিক কতটুকু ঠিক রাখতে পারবে নিজেকে সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠল। কারন ইভানের মনে ঈশার জন্য যে অনুভুতি সেটা কাররি অজানা নয়। আর সেটা ঠিক কোন পর্যায়ে সেটাও সবাই ভালভাবেই বুঝতে পারে। তাই এখন ইভান কে নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে সবার। কি অবস্থায় আছে। আবার ফোনটাও বন্ধ। ঈশান বেশ কয়েক জায়গায় ফোন দিলো ইভানের খোজ নিতে। কিন্তু কারো কাছেই কোন খোজ পেল না। ব্যর্থ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–ইভান ভাইয়া কি বাসায় যায়নি বড় মা?
ইভানের মা না সুচক মাথা নাড়ল। হতাশ হয়ে বলল
–আমি তো ভেবেছিলাম এখানেই আছে। তাই আর ফোন দেইনি।
ইলু বুঝতে পারল এখন পরিস্থিতি অনুকুলে নয়। তাই সব কিছু সামলাতে বলল
–এতো চিন্তার কিছু নেই। ইভান ভাইয়া চলে আসবে। হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছে।
তার কথাতেও কারো কোন ভাবান্তর হল না। তাই আশস্তের কণ্ঠে বলল
–ইভান ভাইয়া অনেক বোঝে। সে কোন ভুল করতে পারে সেটা আমি অন্তত মানি না। হয়তো এমন কোন পরিস্থিতি হয়েছে জার কারনে ফোনটা বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ঠিক চলে আসবে। আমি জানি।
সবাই বেশ চুপচাপ। কেউ ইলুর কথার উত্তরে কোন কথা বলল না। সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন ইভান ঠিক আছে তো?
——————–
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। হসপিটালে কোলাহল বেড়ে গেলো হঠাৎ করেই। কোন সিরিয়াস কন্ডিশনের রোগী এসেছে মনে হচ্ছে। ডক্টর নার্স সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। রোগীর আত্মীয় স্বজনরা বিচলিত হয়ে ঘুরছে। কেউ ঔষধ নিতে ছুটে চলেছে। আবার কেউ দরজায় দাড়িয়ে মুখে আচল চেপে কান্না আটকাতে ব্যস্ত। সেই দৃশ্যই চেয়ারে বসে দেখছে ঈশার মা। গত রাতে তার অবস্থাও এমন হয়েছিলো। মেয়ের অবস্থা দেখে তিনিও এভাবেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন মেয়ে ভালো আছে শুনে কিছুটা আশস্ত হলেও পুরটা হতে পারেনি। কারন এখনও ঈশার জ্ঞান ফেরেনি। বুক চিরে লুকান দীর্ঘশ্বাস টা বেরিয়ে এলো তার। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সামনে। এমন সময় ইভানের মা কোথা থেকে এসে বললেন
–ঈশার জ্ঞান ফিরেছে। তাড়াতাড়ি ভিতরে যাও।
ঈশার মায়ের খুশিটা চোখের পানির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো। কয়েক ফোটা পানি ফেলে তারপর চোখ মুছে নিয়ে ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই দেখলেন ঈশার বাবা মেয়ের পাশে বসে আছেন। তার মা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
–এখন কেমন আছিস মা?
ঈশা অসহায় চোখে তাকাল। তিনি নিজের বোকামিটা বুঝতে পেরেই মন খারাপ হয়ে গেলো। ঈশা যে এখন কথা বলতে পারবে না সেটা তার মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। তবুও তিনি বোকার মতো তাকে প্রশ্ন করলেন। পরিস্থিতি সামলাতেই বলল
–ডক্টর বলেছে তুই রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবি। আর কোন সমস্যা নেই। একদম আগের মতো হয়ে যাবি।
ঈশার চোখ ছলছল করে উঠল। সাথে সাথেই ইলু, ইরিনা ঢুকে পড়ল ভিতরে। রীতিমত তারা সেখানে আড্ডায় মেতে উঠল। তাদের এরকম করতে দেখে নার্স এসে ধমক দিয়ে গম্ভির গলায় বললেন
–এভাবে বাচ্চাদের মতো আচরন করবেন না। পেশেন্ট কে রেস্ট নিতে দিন। সবাই বাইরে যান।
নার্সের কথা শেষ হতেই ইভান ভিতরে ঢুকল। নার্স তাকে দেখে খুব বিরক্ত হয়ে বললেন
–এতজন কেন একসাথে ভিতরে ঢুকেছেন। বাইরে যান। পেশেন্ট এখন রেস্ট নিবে।
ইভান কোন কথা বলল না। তার আগেই একজন ডক্টর ভিতরে ঢুকে বলল
–প্রব্লেম নেই সিস্টার। আমি দেখছি। আপনি বাইরে যান।
ডক্টরের কথা শুনে নার্স আর কোন কথা বলল না। বাইরে চলে গেলো। ডক্টর ইভানের পাশে এসে দাঁড়ালো। কাধে হাত রেখে বলল
–বেশী সময় নিবি না। ঈশার রেস্ট দরকার।
ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–হুম। রেস্টই নিবে। এখন থেকে ওর সব দায়িত্ব শেষ।
সবাই ইভানের দিকে তাকাল। তার কথার মানে কেউ বুঝতে পারল না। ঈশার বাবা এগিয়ে এসে ডক্টরের সামনে দাড়িয়ে বলল
–আরে ইলহাম তুই এখানে? এখানে কি করছিস?
ইলহাম হালকা হেসে বলল
–আমি এখন এই হসপিটালেই জয়েন করেছি মামা। কিছুদিন হল। তোমাদেরকে জানানোর সুযোগ হয়নি। নতুন জব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই। ভেবেছিলাম সময় করে যাব বাসায়। কিন্তু তার আগেই তো ঈশার এই অবস্থা।
ইলহাম এগিয়ে ঈশার কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলল
–এখন ভালো লাগছে?
ঈশা মাথা নাড়াল। ইলহাম একটু গম্ভির হয়ে বলল
–তুই কিন্তু কাজটা একদম ঠিক ক……।
ইভান মাঝ পথেই তাকে থামিয়ে দিলো। গম্ভির সরে বলল
–ভাইয়া এখন এসব থাক। আমি আমার কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি। ঈশার আবার রেস্ট দরকার।
ইলহাম আর কথা বাড়াল না। মুচকি হেসে ইভান কে সম্মতি দিলো। ইভান ঈশার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথা নামিয়ে নরম সুরে বলল
–মেজ বাবা আমি ঈশাকে বিয়ে করতে চাই।
চলবে…………
(সবাই অনেক টেনশনে ছিলেন। তাই টেনশন কমাতে ছোট্ট করে একটা বোনাস পার্ট দিলাম। অনেকেই বোনাস পার্টের জন্য অবশ্য বলেছিলেন।)