#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_০৭
#অধির_রায়
নিধিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রাগান্বিত চাপা স্বরে শাওন বলল,
“এত রাতে ছাঁদে কি করছিলে? তুমি একজন গোয়েন্দা গিন্নি হয়ে গেছো! আমার বিষয়ে তোমার এত পরিমাণ ইন্টারেস্টি কেন?”
নিধি শাওনের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না৷ শাওনের অগ্নি দৃষ্টির দিকে তাকানো মানেই সেই অগ্নিতে নিধিকে জ্বালানি দিবে৷ নিধি মাথা নিচু করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে৷ নিধিও আজ ছেড়ে কথা বলবে না৷ কেন নিধির প্রতি উনার এত অধিকার? আজ সব জেনেই নিবে৷ সব সময় ভয়ে ভীতু হয়ে থাকবে না৷ নিধি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আমি মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম। আমার ঘুম আসছিল না৷ আমি দোষের কিছু দেখছি না৷ আর আমার উপর কেন এত অধিকার দেখান?
শাওন নিধির চোখে চোখ রেখে রাগী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“পিচ্চি নিধি তুমি এতটাও বড় হওনি যে মিথ্যা বলবে? তোমার বয়স আমি পার করে এসেছি৷ ছাঁদে কেন ছিলে এত রাতে?”
নিধির ভীষণ রাগ হয়৷ ধাক্কা দিয়ে শাওনকে দূরে ঠেলে দেয়৷ রাগ নিয়ে কিছুটা উঁচু গলায় বলল,
“আমি কতবার বলব, আমার ঘুম আসছিল না৷ ছাঁদে মুগ্ধ ভাইয়া ছিল, উনার সাথে কিছু কথা বলছিলাম৷”
নিধির অবহেলা যেন শাওনের রাগকে দ্বিগুণ করে দিল৷ নিধির দিকে ফোন এগিয়ে দিল৷ ফোনের স্কিনে সিসি ক্যামেরার সকল কিছু দেখা যাচ্ছে৷ নিধি শাওনের ঘরে আঁড়ি পেতে রয়েছে৷ নিধি শুকনো ঠুক গিলে বলল,
“আমি পূর্ণিমাকে দেখতে গেছিলাম৷ আপনি তো বললেন আপনার ঘরে পূর্ণিমা আছে৷ পূর্ণিমায় আলোয় আলোকিত আপনার ঘর৷ আমি প্রথমে চাঁদ ভাবছিলাম৷ কিন্তু এখন অমাবস্যা৷ পূর্ণিমার জ্যােৎসা নেই৷ আলোকিত হয় কিভাবে? আমি ভেবেছিলাম আপনি প্রতি রাতে কাউকে না কাউকে বাসায় নিয়ে আসেন৷”
শাওন উদাস হয়ে বিছানায় বসে পড়ল৷ পিচ্চির ভাবনা এতোটা পা/গ/লের মতো হবে বুঝতে পারেনি৷ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে করার আপ্রাণ চেষ্টা করল। নিজেকে শান্ত করে বলল,
“যদি জানতে আমি রেগুলার মেয়েদের সাথে শারীরিক চাহিদা মেটায় তাহলে আমায় ঘৃণা করতে৷”
“ঘৃণা করতাম মানে কি? আপনাকে সেদিন থেকেই ঘৃণা করি যেদিন আপনি আমার সম্মানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন৷ আমি জানি আপনার নিষিদ্ধ পল্লীতে আসা যাওয়া লেগেই থাকে৷ ইদানীং নেই৷”
নিধির কথা শুনে শাওন কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না? সে নিষিদ্ধ পল্লীতে শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য অনেক বার গিয়েছে৷ কিন্তু নিধি কিভাবে জানল? শাওন আমতা আমতা করে বলল,
“আমি অনেকবার গিয়েছি৷ কিন্তু এখন যেতে ইচ্ছা করে না৷ কারণ এখন আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। তার মায়ায় নিজেকে বেঁধে রেখেছি৷ আল্লাহর কাছে একটাই চাওনা যেন সে আমার অতীত ভুলে আমায় ভালোবাসতে পারে৷”
শাওন চৌধুরী কোন কথা বাড়াল না৷ কথা বাড়ালে বিপরীত কিছু ঘটতে পারে। নিধি এক ধ্যানে ভাবতে থাকে শাওন চৌধুরী কার সাথে প্রেম করে৷ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
_____________________
হাসিখুশি নিধির মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ বাংলার পাঁচ করে শায়লা চৌধুরী পায়ে গরম তেল মালিশ করছে৷ শায়লা চৌধুরী নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ক্লাসে কোন সমস্যা হয়েছে? স্কুল থেকে আসার পর থেকে মুখে কুলো পেটে বসে আছো৷”
শায়লা চৌধুরীর পায়ের অনেক উন্নতি হয়েছে৷ উনি এখন পা নাড়ালে পারেন৷ নিজে থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেন৷ কিন্তু পা ফেলতে পারেন না৷ পায়ের উপর এখনও কোন শক্তি নেই৷ নিধি মলিন হাসার চেষ্টা করল৷ তবুও হাসি বিরল হয়ে গেল৷ মনমরা কন্ঠে বলল,
“শাওন চৌধুরী সব সময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন৷ আমাকে সহ্য করতেই পারেন না৷ আমার যেন কোন স্বাধীনতা নেই৷”
কথাটুকু বলেই নিধি কেঁদে ফেলল৷ শায়লা চৌধুরী বুঝতে পারল শাওন অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে৷ যার জন্য নিধি মনে বাজে ইফেক্ট পড়েছে৷ নিধিকে এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মায়াভরা কন্ঠে বলল,
“যাকে বেশি ভালোবাসে তাকে শাসনে রাখা কোন অন্যায় নয়৷ শাওন তোমাকে অনেক ভালোবাসে সেজন্য তোমাকে একটু বকাবকি করে৷ শাওন কোনদিন কোন মেয়েকে ভালো নজরে দেখে না৷ সেখানে তোমার অনেক খেয়াল রাখে৷ কখন কি করছো সব কিছু জানা লাগবে? ঠিকভাবে খাবার খাচ্ছো কিনা? তোমার পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখে৷ তোমার জন্য তো শাওন বাজে স্বভাব থেকে ফিরে এসেছে৷ এজন্য আল্লাহকে হাজার হাজার শুকরিয়া জানায়৷”
নিধি তবুও কিছু বুঝতে পারল না৷ শাওনের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতি নিধির মনে সাড়া ফেলল না৷ নিধি অভিমানী কন্ঠে বলল,
“মুগ্ধ ভাইয়াও আমাকে অনেক ভালোবাসেন। তিনি কখনও আমায় বকা দেননি৷ আপনিও শাওন চৌধুরীর মতো। মুগ্ধ ভাইয়ার বিষয় নিয়ে ভাবেন না৷ ভাইয়ার খেয়াল রাখেন না৷ ভাইয়া প্রতিদিন বিরহে থাকে সেদিকে খেয়াল নেই৷”
শায়লা চৌধুরী ব্রো কুঁচকিয়ে বলল,
“আমি মুগ্ধর বিষয়ে খেয়াল রাখি না৷ আমি মুগ্ধকে অনেক ভালোবাসি। তার প্রতিটি বিষয়ে খেয়াল রাখি৷”
“ভাইয়ার বিষয়ে খেয়াল রাখলে এতদিন মাধবী ভাবীর সাথে বিয়ে হতো৷ ছলে বলে নানা কৌশলে মাধবী ভাবীর বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে৷ একটা মেয়ের কত আশা নিয়ে বসে আছে৷ ভাইয়া প্রায় ক্লান্ত হয়ে গেছে৷ আপনাকে বলার সাহস নেই৷ আপনি তো গম্ভীর শাওন চৌধুরীকে নিয়ে পড়ে থাকেন৷”
শায়লা চৌধুরী নিধির কথা শুনে নিজেকে অপরাধী ভাবল৷ সত্যিই তো মুগ্ধ মুখ ফুটিয়ে অনেকবার বিয়ের কথা বলেছে৷ সত্যিই মাধবী তার জন্য কত অপেক্ষা করবে? শায়লা চৌধুরী অপরাধী কন্ঠে বলল,
“আজ রাতে আমি মুগ্ধর সাথে কথা বলব৷ তাদের বিয়ে খুব দ্রুত দেওয়ার চেষ্টা করব৷ মুগ্ধ, শাওন দু’জন অফিস থেকে ফিরলে আমায় কাছে নিয়ে আসবি৷”
নিধি খুশিতে শায়লা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরল৷ নিধির খুশি দেখে কে? মাধবীকে এবার নিজের চোখে দেখতে পারবে৷ দৌড়ে নিজের রুমে আসে৷ মুগ্ধকে ফোন দিয়ে বলল,
“ভাইয়া তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে৷ রাতে বাসায় আসলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিব৷”
______________________
রুমের মাঝে কোন কথা নেই৷ চোখাচোখি কিছু কথা হচ্ছে৷ মুগ্ধ তো রীতিমতো ঘেমে একাকার। তার জন্য সভা বসেছে৷ কোন অন্যায় কাজ করেনি তো৷ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শায়লা চৌধুরী বললেন,
“আমি মুগ্ধর বিয়ে ঠিক করেছি৷ তবে আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে৷ মাধবীকে আমার পছন্দ নয়৷”
মুগ্ধর চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে। মাধবীকে সে ভীষণ ভালোবাসে৷ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি কখনও তোমার অবাধ্য হয়নি। আমি মাধবীকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না৷”
শায়ল চৌধুরী কঠিন কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার মতামত জানতে চাইনি৷ আমার কথা শেষ হওয়ার আগে কোন কথা বলতে মানা করছি৷”
নিধিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“নিধি ওই মেয়েকে নিয়ে আসো৷ যার সাথে আমি মুগ্ধর বিয়ে ঠিক করেছি৷”
নিধি মাথা নাড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া একটা মেয়েকে নিয়ে আসে৷ এদিকে মুগ্ধ রাগে ফুসফুস করছে৷ যেন তার ধম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কিছুতেই মাধবীর সাথে অন্যায় করতে পারবে না৷ মুগ্ধর দৃষ্টি নিচের দিকে নিবন্ধ। মুগ্ধর অগ্নি দৃষ্টি যেন ফ্লোর জ্বালানি ছারখার করে দিবে৷ মুগ্ধর এমন কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে৷ শায়লা চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মুগ্ধ উপরের দিকে তাকাও৷”
মুগ্ধ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উপরে দিকে দৃষ্টি মেলে তাকায়৷ নিধি ঘোমটা সরিয়ে দেয়। ঘেমটার আড়ালে মাধবীকে দেখে চোখে ভালোভাবে ঠলে নিল৷ সে ভুল দেখছে না তো৷ শাওন মুগ্ধর পীঠস্থানে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
“ভুল নয়৷ এটা তোমার ভালোবাসার মানুষ মাধবী৷ এখনও রাগ করে থাকবে। এবার নিজের ভালোবাসা আগলে রাখার চেষ্টা কর৷”
মাহির আহমেদ মুগ্ধ মাধবীর দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে৷ নারীকে শাড়ীতে এত সুন্দর লাগে বুঝাতে পারবে না৷ মুগ্ধর মনে কবি প্রীতি জেগে উঠল৷ মাধবীকে নিয়ে কল্পনায় উপন্যাস রচনা করে ফেলল৷ নিধি হালকা কাশি দিয়ে বলল,
“ভাইয়া হবু বউয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে নেই৷ নজর লেগে যাবে৷”
নিধির কথায় মুগ্ধ, মাধবী দু’জনই লজ্জা পেল৷ শায়লা চৌধুরী গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“কাল মাধবীর মা বাবার সাথে কথা বলে তোমাদের বিয়ের কথা ফাইনাল করব৷ শাওন নিধি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে মাধবীদের বাড়িতে৷ বিয়ের আগে কেউ কারো সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না৷ শাওন তুমি মাধবীকে বাড়িতে দিয়ে আসো৷”
মুগ্ধর মুখটা চুপসে গেল। তবুও কিছুই বলল না৷ কিছুদিন পরেই তো সারাজীবনের জন্য কাছে পাবে৷ প্রাণ ভরে দেখে নিবে৷ ডাইনিং রুমে এসে শাওন মুগ্ধর হাতে চাবি দিয়ে বলল,
“চালিয়ে যাও কয়েক মুহুর্তের ছোট ভাই৷ তবে নিজেকে সংযত রাখবে৷ বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাকে সব বলে দিব৷”
মুগ্ধ শাওনকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল৷
________________
নিধি নিজের লেখাপড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ রাত এগারোটা বাজে৷ মনে হচ্ছে একজোড়া চোখ নিধিকে প্রাণ ভরে দেখে যাচ্ছে৷ কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কে আপনি? আমি ভুত দেখে ভয় পাইনা৷ সাহস থাকলে সামনে আসেন।”
শাওন অট্টহাসি দিয়ে রুমে প্রবেশ করে৷ হাসিতে ঝর্ণার শব্দ ভেসে আসছে৷ নিধি আয়াতুল্লাহ কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিল৷ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“এভাবে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? আমি ভুতে ভয় পাইনা৷ আমি অনেক সাহসী৷”
শাওন আচমকা নিধিকে হেঁচকা টান দিল৷ নিধি টাল সামলাতে না পেরে শাওনের বুকে লুটে পড়ে৷ অদ্ভুত অনুভূতির ঝড় বয়ে গেল৷ নিধি সরে যেতে নিলে শাওন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলল,
“পিচ্চি বিয়ে করে নাও। ভুতে ভয় পাবে না৷ তোমায় আমি আগলে রাখব৷ মুগ্ধ নয়নে তোমায় দেখে যাব সারাজীবন।”
নিধি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ অসভ্য লোক কোন মতলবে এখানে এসেছেন। নিধি ছটফট করছে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। শাওন আরও শক্ত করে নিধিকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে নেশা ভরা কন্ঠে বলল,
“এই পিচ্চি একটু শান্ত হয়ে থাকো না৷ আমার অক্সিজেন যে তোমার মাঝে৷ তোমায় ছাড়া আমি শূন্য৷ তুমিময় শাওন চৌধুরী। তুমিময় আসক্ত আমি। কেন তুমি বুঝতে পারো না আমার মনের অনুভুতি৷ আমি কি এতই খারাপ? আমাকে ভালোবাসার সুযোগ দেওয়া যাবে না৷ তোমায় ভালোবাসায় কোন অভিযোগ রাখব না পিচ্ছি৷”
চলবে……
দয়া করে কমেন্ট করবেন৷ আপনার ছোট কমেন্ট আমাকে লেখায় উৎসাহিত করে৷ খুবই ব্যস্ততার মাঝে লিখছি৷ ভুল ত্রুটিগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন।