তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ৩১

0
1056

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩১

বিরস মুখে বারান্দায় বসে বই হাতে নিয়ে সামনে বৃষ্টি দেখছে ঈশা। এমন ভাগ্য কয়জনের হয় বিয়ের পরেরদিন সন্ধ্যা বেলায় শশুর বাড়ির লোকজন জোর করে ধরে পড়তে নিয়ে বসায়। তাও আবার এতো রোম্যান্টিক একটা ওয়েদারে। আর ইভানের এমন বিরক্তিকর আচরনেও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে সে। বিয়ের আগে কতো ভালো ছিল। বিয়ের আগে তো গায়ে এসে পড়তো। আর বিয়ের পরে পাত্তাই দিচ্ছে না। এমন ব্যবহার করছে যেন বাবা মা জোর করে ধরে বিয়ে দিয়েছে। আর সেই বউকে মানতে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ মুখ কুচকে ধপ শব্দে বইটা বন্ধ করে ফেলল। সমস্ত রাগ যেন উপচে বেরিয়ে আসছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। রাগে শরীরটা কেমন জলে যাচ্ছে। মাথার ভিতরেও কেমন দপ দপ করছে।

–বইএর উপরে এভাবে রাগ দেখালে হবে? কাল তোর পরিক্ষা। বিয়ের জন্য তো পড়ালেখা সব তুলে রেখেছিস।

ইভানের এমন কথা শুনে রাগটা যেন আরও চাড়া দিয়ে উঠলো। দাতে দাত চেপে বলল
–আমার পড়ালেখা নিয়ে যখন এতই চিন্তা তাহলে বিয়েটা করলে কেন?

ইভান ঠোট চেপে হেসে গ্রিলের সাথে পিঠটা ঠেকিয়ে দিলো। ঈশা সামনেই তাকিয়ে আছে। ইভানের দিকে তাকাল না। ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–নিজের কাছে রেখে ভালো করে পড়ালেখা করানর জন্য। ওই বাড়িতে থেকে কেমন পড়ছিস সেটা তো দেখতে পেতাম না। তাই সবটা খেয়াল করার জন্যই এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছি।

ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিজের রাগটা দমন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো। চোখ খুলে ইভানের দিকে তাকাল। বৃষ্টির ফোটা ফোটা পানি গ্রিল বেয়ে পড়ছে। তার পুরো পিঠ ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে চোখ রেখেই স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তুমি ভিজে যাচ্ছ।

ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তাতে কি আমার তো আর পরিক্ষা না। আমি অসুস্থ হয়ে গেলেও সমস্যা নেই।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। উঠে ইভানের হাত ধরে টানতে লাগলো। কিন্তু ইভান সরল না। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে রাগি সরে বলল
–তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে সেবা তো আমাকেই করতে হবে। এতে আমার পড়ার ডিস্টার্ব হবে। আমার না পরিক্ষা!

ইভান শব্দ করে হেসে ফেলল। ঈশাকে টেনে গ্রিলের দিকে ঘুরিয়ে দাড় করে দিলো। ঈশার রাগ কমে গেলো। একটু হেসে গ্রিলে লেপটে থাকা বৃষ্টির ফোটা গুলো আঙ্গুলে ছুয়ে দিলো। দুই হাত বের করে বৃষ্টি ধরছে। ইভান পেছন থেকে গ্রিলে হাত রাখল। ঈশার গালের সাথে নিজের গাল স্পর্শ করে সামনে তাকিয়েই বলল
–এতো পছন্দ বৃষ্টি?

ঈশা ছোট্ট করে ‘হুম’ বলল। ইভান আবার জিজ্ঞেস করলো
–আমার থেকেও বেশী?

ঈশা নিজের ভেজা হাত গুলো ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো। গ্রিলে রাখা ইভানের হাতে রেখে বলল
–যদি বেশী পছন্দ হয়েই থাকে তাহলে কি করবে?

ইভান একটু ভাবল। তারপর খুব শান্ত কণ্ঠে বলল
–বৃষ্টিকে তো আমি আটকাতে পারব না। কিন্তু যখন বৃষ্টি আসবে তখন আমার ভালবাসা দিয়ে সেই মুহূর্তটা ভুলিয়ে দিতে পারব। বৃষ্টির কথা মনে পড়বে না আর।

–এতো ভরসা নিজের উপরে?

–উহু। ভালবাসার উপরে বিশ্বাস। আমি আমার ভালবাসা দিয়ে তোকে পুরো দুনিয়া থেকে আলাদা করে রাখতে পারব। তুই কোনদিন কোন কিছুর অভাব বোধ করার সুযোগ পাবি না। আমার ভালবাসার চাদরে তোকে এমন ভাবে মুড়িয়ে রাখবো তুই নিজেও সেখান থেকে বের হতে চাইবি না। আমি আমার অবাধ্য ভালবাসা দিয়ে তোকেও ভালবাসতে বাধ্য করেছি জান। আমার ভালবাসার উপরে অগাধ বিশ্বাস আমার।

ঈশা হেসে বলল
–আমি এই ভালবাসার বাধন থেকে বের হতেও চাই না।

ইভান এবার একটু কঠিন গলায় বলল
–অনেক হয়েছে বৃষ্টি বিলাস। এবার পড়তে বসেন। সব সময় এতো আবেগের মধ্যে থাকলে কি জীবন চলে?

ঈশার মেজাজ টা আবার আগের মতো হয়ে গেলো। সে এক ঝটকায় ইভান কে সরিয়ে দিয়ে চলে গেলো ঘরে। ইভান ঘাড় বেকিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিছুক্ষন বারান্দায় দাড়িয়ে থাকলো একা একা। তারপর ভিতরে চলে এলো। ভিজে যাওয়া টি শার্ট চেঞ্জ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। খানিকবাদে দুই কাপ কফি নিয়ে এলো। ঈশার সামনে একটা কাপ ধরল। ঈশা বই থেকে মুখ তুলে বিরক্তিকর গলায় বলল
–খাবনা।

ইভান সামনে বসে পড়ল। একটু কঠিন গলায় বলল
–না শুনতে আমি অভ্যস্ত না। এটা এতদিনে বুঝে গেছিস।

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। এভাবে কথা বলার কি আছে। ভালো করে বললে কি হতো। ঈশাকে বই এর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান আবার সামনে কাপটা ধরল। শান্ত গলায় বলল
–এটা খেলে মাথা ব্যাথাটা কমে যাবে। প্লিজ জান।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। বলল
–তোমাকে কে বলল আমার মাথা ব্যথা করছে?

–আমাকে কেউ বলবে তারপর সেটা আমি জানব? তোর কি তাই মনে হয়?

ঈশা কোন কথা বলল না। কফির কাপটা নিয়ে তাতে চুমুক দিচ্ছে আর বই এর পাতা উলটাচ্ছে। তার সামনে বসেই ইভান ফোনে কি যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ঈশা বই রেখে ইভানের দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর ইভান ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল
–আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। কিন্তু সারাজীবন ধরে তোর এক্সাম নেয়ার জন্য কেউ বসে থাকবে না। তাই আমার দিকে মনোযোগ না দিয়ে বই এর দিকে দে। কাজে দিবে।

ঈশা চোখ মুখ খিচে আবার পড়তে শুরু করলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল।

—————
রাত ১২ টা বাজে এখনো ঈশা পড়ছেই। কখনও হেটে হেটে পড়ছে। কখনও বিছানায় বসে। কিন্তু কোনভাবেই পড়া থামাচ্ছে না। সে ঠিক করেছে আজ সারা রাত পড়বে। পড়ে পড়ে মরে গেলেও কোন আফসোস নাই। পিছনে হেলানি দিয়ে অসহায়ের মতো বসলো। তার নিজের বাড়িতেও এতো অত্যাচারিত হয়নি পড়া নিয়ে যতটা না শশুর বাড়িতে হচ্ছে। তার মা তো তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়েছিল যে শশুর বাড়ির লোকজনের সেবা করতে। কিন্তু এখানে তো পুরোই উলটো। পড়ার ঠেলায় তারাই তার সেবা করতে ব্যস্ত। তাকে নিচে খেতেও যেতে দেয়নি। শাশুড়ি মা নিজে হাতে উপরে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে। আর কড়াভাবে বলে গেছে কিছু লাগলে যেন কাউকে ডাকে। সময় নষ্ট করার কোন দরকার নেই। আর ইফতিটাও আজব। ছেলেরা এতো পড়ে নাকি? পরিক্ষার সময় দুই তিন দিন নাকি ঘর থেকেই বের হয়না। কই একটু বসে আড্ডা দিবে তা না। পড়া নিয়ে ব্যস্ত। ঈশা অধৈর্য হয়ে গেলো। প্রায় সাড়ে ১২ টা নাগাদ ইভান রুমে ঢুকল। ঈশা দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকলো। ইভান ঈশার পাশে বসলো। ঈশা তাতেও কোন কথা বলল না। এমন কি মুখটা তুলেও দেখল না। ইভান বইটা ঈশার হাত থেকে নিয়ে বন্ধ করে ফেলল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি পড়ছি। বিরক্ত করছ কেন?

ইভান উঠে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিতে দিতে বলল
–অনেক হয়েছে পড়ালেখা। আর না।

ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–কেন? অনেক হবে কেন? কেবল তো শুরু। এখনো পুরো রাতটা পড়ে আছে।

ইভান কোন কথা বলল না। জানালাটা বন্ধ করে এসি টা অন করে বিছানায় বসে পড়ল। ইভান কে বসতে দেখে ঈশা উঠে যেতে নিলো। ইভান হাত ধরে ফেলে। ঈশা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল
–ছাড়ো আমাকে?

ইভান ঈশাকে টেনে কোলে বসিয়ে নিলো। ঈশার দুই গালে হাত রেখে বলল
–ছাড়বো কেন? বউকে ছেড়ে রাখার জন্য বিয়ে করেছি?

ঈশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–ওহ! বিয়ে করেছ বউ আছে সেটা মনে আছে তোমার?

ইভান ঠোট টিপে হেসে বলল
–ভুলতে চাইলেই কি তুই দিবি?

ঈশা ইভানের কথা শুনে রেগে গেলো। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। কঠিন গলায় বলল
–আমি কি তোমাকে বেধে রেখেছি? ছেড়েই রেখেছি। ভুলতে চাইলে ভুলে যাও।

ইভান ঈশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–বেধে রাখিস নি কিন্তু ছেড়েও তো দিস নি। পাগল করে রেখেছিস আমাকে।

ঈশা অভিমানি কণ্ঠে বলল
–আমার ভালো লাগছে না। ছাড়ো। আমি ঘুমাব।

ইভান ছেড়ে দিলো। ঈশা দু পা বাড়াতেই ইভান আবার তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। কোমরে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
–কাল ঘুমাতে দিয়েছি বলে আজকেও ঘুমাতে দিবো সেটা কিভাবে ভাবলি?

কথা শেষ করে ঈশাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঈশা উঠতে চাইলে ইভান তাকে চেপে ধরল বিছানার সাথে। ঈশা মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। ইভান ঈশার গালে নাক ঘসে বলল
–আমি প্রতিদিন সকালে চোখ খুলেই তোর মুখটা দেখতে চাই জান। তোর চেহারা দেখেই আমি আমার দিন শুরু করতে চাই।

ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান ঈশার ঠোঁটে ঠোট ছোঁয়াতে যাবে ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হল সে। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার উপরে টর্চার করার জন্য সবাই সব সময় রেডি থাকে। একটা মিনিটও দেরি হয়না কারও।

ঈশা ঠোট টিপে হাসল। ইভান তীক্ষ্ণ চোখে ঈশার দিকে তাকাল। তারপর বলল
–আজ কোন ফোন ধরব না। ফোনটাকেই বন্ধ করে দিবো।

বলেই পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলো। নাম্বারটা দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলো। ঈশা ইভান কে এভাবে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো
–কার ফোন?

ইভান কোন কথা বলল না। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। ঈশা সেটা শুনতে পেলো না। কিন্তু ইভান সেটা শুনেই চিৎকার করে বলল
–হোয়াট?

ঈশা ইভানের চিৎকার শুনেই বুঝে গেলো কিছু একটা হয়েছে। ইভান একটু থেমে আবারো বলল
–আমি আসছি।

বলেই ফোনটা রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশা ইভানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–কোন সমস্যা?

ইভান ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল
–মেঘলা সুইসাইড করেছে।

ঈশা আঁতকে উঠলো। বিচলিত হয়ে বলল
–সুইসাইড করেছে মানে?

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার গালে হাত রাখল। করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–শুয়ে পড় জান। আমাকে যেতে হবে।

চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here