#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৩
#রাউফুন
পুরো বিয়ে বাড়িতে কানাঘুঁষা চলছে, “নতুন বউ তার
বান্ধবীকে ছাড়া শশুরবাড়ি যাবে না।” আশফি জেদ ধরে বসে আছে তুলিকাকে ছাড়া সে কোথাও যাবে না। এক কথায় সে নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ়! কিন্তু তুলিকা তো আসছেই না। তার দুচোখ ছাঁপানো জলের রাশি। শরীর মৃদুভাবে কাঁপছে। হঠাৎই তার মনে হয় সে তুলিকার কাছে যাবে। অন্ধকারে হাতড়ে নিজের লাগেজ থেকে একটা জিনিস হাতে নিয়ে তার স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
‘নীরব আপনি আমায় বিশ্বাস করেন?’
‘ হ্যাঁ মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি।’
‘তাহলে আপনি এই গাড়িতেই অপেক্ষা করুন আমি যাবো আর আসবো।’
‘ঠিক আছে আমি অপেক্ষায় আছি আপনি যান।’
স্বামীর অনুমতি পেয়ে ছুটে চলে গেলো তুলিকার বাড়িতে। দৌঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীরের গহনাও ঝমঝম শব্দ তুলে বাজছিলো। হাতে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ হচ্ছে। ভারী লেহেঙ্গা এক হাতে উঁচু করে ধরে প্রাণ পণে দৌঁড়াচ্ছে। রাস্তার ওপাশেই দশ মিনিট গেলেই তুলিকার ছোট্ট বাসা। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেই দরজায় কড়া নাড়লো আশফি।
‘তুলি দরজা খোল। তুই যদি না যাস আমার সঙ্গে আমি যাচ্ছি না কোথাও। তুই কিন্তু জানিস আমার জেদ কতটা। ইতিমধ্যে আমার বদনাম ছড়ে গেছে। তুই কি আমার বদনাম করবি বলেই যাস নি ওখানে?’
ধড়াস করে দরজা খুলে তুলিকা। অস্থিরতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, ‘একি কান্ড করেছিস আশু তুই এখনো যাস নি?’
‘নাহ!’ গম্ভীরমুখে জবাব দিলো আশফি। মিষ্টি ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রইলো আশফির দিকে।
‘এসব কি পাগলামি করছিস? আমি যায়নি বলে তুই শশুরবাড়ি যাচ্ছিস না? এটা কোনো কথা?’
‘হ্যাঁ কথা। তুইও আমার সঙ্গে যাবি আমার শশুর বাড়িতে।’
‘দেখ আমি কি করে যাবো। বাড়িতে মিষ্টি একা। উম তাছাড়া আমার ভালো একটা ড্রেস নেই।’ দোনামোনা করে বলেই মাথা নিচু করে ফেলে তুলিকা। আশফি হাতে থাকা শাড়ীটা তুলিকার হাতে দিয়ে গম্ভীরমুখেই বলেই,
‘দশ মিনিট সময় দিলাম, এটা পরে রেডি হবি। তোর জন্য সবার কাছে আমি খারাপ হয়ে গেছি এর মধ্যেই। যদি না চাস আর কেউ-ই আমাকে খারাপ বলুক তবে এক্ষুনি শাড়ীটা নিয়ে পরে আয়। আমি মিষ্টিকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি।’
হাবভাব ভালো লাগছে না আশফির। আর তুলিকা তার বেস্টফ্রেন্ডকে খুব ভালো ভাবেই চেনে। সে যখন বলেছে তখন এখান থেকে এক পা ও নড়বে না। তাই বাধ্যতামূলক তাকে শাড়ি পরে বের হতে হলো। ছোট্ট ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো তুলিকা। তার এখান থেকে যেতেও কেমন একটা লাগছে। যদি তার যাওয়ার পর শিপন কিছু করে? সে এসে সবকিছু ঠিকঠাক দেখবে তো? বুকের ভেতর টা কেমন খচখচ করছে। কেন মনে হচ্ছে ওখানে যাওয়ার পর এখানে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। এরকম অদ্ভুত ভীতি কেন জাগছে তার মনে?
তারা যখন পৌঁছায় তখন সারে বারোটা বাজে। এতক্ষণে আশফির মুখে হাসি ফুটেছে। মনে হচ্ছে হাতে চাঁদ পেয়েছে। মাইজিন তুলিকাকে দেখে মিষ্টি স্বরে বলে,
‘লুকিং গর্জিয়াস!’
তুলিকা লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে গাড়িতে বসে। মাইজিন গাড়িতে উঠার আগে শিপনের কানে কানে বলে,
‘মিষ্টার শিপন, আজ শুধু পাঞ্জাবী পুঁড়েছে এরপর সারা শরীর পুঁ’ড়’বে। সো সাবধান হ্যাঁ?’
শিপন মাইজিনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। শুধু তুলিকার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু সেই দৃষ্টির মুখে পরতে হলো না তুলিকার। তার আগেই মাইজিন নির্দেশ দিতেই মুহুর্তের মধ্যে তাদের গাড়িটা শাঁ শাঁ শব্দ তুলে চলে গেলো। তুলিকা, মিষ্টি, মাইজিন এক গাড়িতে বসেছে। গাড়ির পেছনের সিটে মাইজিনের মা শাপলা বেগম, তার খালা, খালাতো বোন শারমিন বসেছে। মাইজিন জোর করেই এখানে উঠে বসেছে। তুলিকাকে আশফি নিজের কাছে বসাতে চেয়েছিলো কিন্তু তুলিকাই নতুন দম্পত্তির মাঝখানে যেতে চাইনি। ব্যাপারটা ভালো দেখাই না। সে ঘুনাক্ষরেও আচ করতে পারেনি মাইজিন তার সঙ্গে বসবে। আশফি আর তার স্বামী নীরব সামনের গাড়িতে। বাকিরা অন্যান্য গাড়িতে আছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই মিষ্টি ঘুমে ঢলে পরলো তুলিকার কোলের উপর৷ দুই হাতে আগলে ধরলো তুলিকা নিজের ছোট্ট বোনের মাথা। পেছন থেকে মাইজিনের মা কিছুটা বিরুপ গলায় বললেন,
‘এই মেয়ে আমাদের সঙ্গে যাবেই তাহলে এতো নাটক করার কি ছিলো হ্যাঁ? তোমার জন্য শুধু শুধুই কত দেরি হলো। আমাদের বাড়ির বউকে নিয়ে নানান কথা বললো নানান জনে। আশ্চর্য নাটুকে মেয়ে মানুষ তো তোমরা। সব সময় এই চিন্তা নিয়েই থাকো যেনো হাতে পায়ে ধরে তোল্লায় দিয়ে নিয়ে যাক তোমাদের। কি যে করে সব! সব সময় নিজেকে উপরে রাখার চেষ্টা তাই না?’
‘উফফ খালামনি এসব এঁদের মতো মিডিল ক্লাস মেয়েদেরকে বলে লাভ নেই। দেখো না সুযোগ বুঝে কেমন মাইজিন ভাইয়ার পাশে বসেছে। সব সময় সুন্দর, বড়লোক পুরুষ মানুষকে পটানোর ধান্দা। বুঝলে?’ মুখ ঝামটে বললো শারমিন।
তুলিকার দু চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসতে চাইলো তাদের এমন ধারা কথা শুনে। ছিঃ কি বিকৃত ভাষ্য মেয়েটির। বড়লোকদের মুখের ভাষা বুঝি এরকম নোং’রা হয়? অবশ্য সবাই এরকম হয় না। যেমন মাইজিন! মাইজিন ছেলেটাকে তার শুরু থেকেই ওমন দাম্ভিক মনে হয়নি। কেমন ডিসেণ্ট ছেলে। সে নিজেকে সামলে নিলো। কথাটার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বললো না৷ মুখ বুজে হজম করে নিলো সবকিছুই। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করা তার ধাঁতে নেই। তার উপর এনারা আশফির শশুর বাড়ির মানুষজন৷ মুখে মুখে তর্ক করলে আশফির সমস্যা হয় যদি! আশফির জন্য সে এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু সইতে পারে। তবে সে যে কেন যেতে চাইনি এটা কিভাবে কাউকে বুঝাবে?
খালাতো বোন শারমিন এবং মায়ের এমন ধ্যাটা কথা শুনে স্পষ্ট বিরক্তির ছাঁপ ফুটে উঠেছে মাইজিনের মুখে। সে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে তার মায়ের কথায়৷ কিন্তু মায়ের মুখের উপরে কথা বলার মতো অভদ্র ছেলে সে না। কিন্তু খালাতো বোনের কথার উত্তর দিতেই পারে।
‘শারমিন তোকে কে বললো যে তুলিকা আমার সঙ্গে বসেছে? বরং আমিই তার সঙ্গে বসেছি। না জেনে, বুঝে কাউকে এমন ধরনের চিপ কথা বলবি না। তুই যে বড়লোক বাপের বেটি তাহলে তোর মুখ থেকে এই ধরনের চিপ কথা কিভাবে বের হয়? সে না হয় মিডিল ক্লাস মেয়ে তুই তো বড়লোকের বেটি। নাকি টাকার জোরে এমন বিগড়ে গেছিস শিক্ষা-দীক্ষা সব মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে।’
মাইজিনের কথায় শারমিনের মাথা গরম হয়ে গেলো। রাগে ক্ষোভে গর্জে উঠে কিছু বলতে নিলেই শারমিনের হাত চেপে ধরে শাপলা বাঁধা দিলেন। তিনি ইশারায় কিছু বুঝালেন যার দরুন শারমিন আর কথা বারালো না। গাড়িতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেলো তখন মাইজিন সুযোগ পেয়ে তুলিকাকে ফিসফিস করে শুধাই,
‘শিপন আপনার সঙ্গে মিস-বিহেভ করেছিলো তাই না? তাই তখন ওভাবে ছুটে চলে গেলেন। সত্যিটা বলবেন কিন্তু তুলিকা!’
‘আ-আপনাকে এ-এসব কে বললো?’
‘আপনি যাওয়ার পর আমি সেখান থেকে শিপনকে বেরিয়ে আসতে দেখি। সে পানি দিয়ে নিজের পাঞ্জাবী ভেজাচ্ছিলো। ভালো করে দেখতেই বুঝতে পারি তার পাঞ্জাবী পুঁড়েছে! এখন বলুন কি এমন করেছিলো শিপন যে তার পাঞ্জাবী পুঁড়ালেন?’
তুলিকা থমথমে মুখে বসে রইলো। কোনো কথায় বলেনি সে আর এরপর। মাইজিন ও ঘাটাইনি তাকে। তুলিকার মাইন্ড রিফ্রেশের প্রয়োজন বলে মনে করলো মাইজিন। তাই আর প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে চাইলো না। তবে সে তো সত্যিটা জেনেই ছাড়বে শিপন কি এমন করেছিলো তুলিকার সঙ্গে? দেখে তো মনে হয়নি তুলিকার মান সম্মান নষ্ট করতে চাইছিলো শিপন। কারণ শিপনের ওরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিলো বলে মাইজিন লক্ষ্য করেনি। সে একজন ছেলে তাই সে ভালো ভাবেই বুঝতে পারবে অন্য একটা ছেলের গতিবিধি! অন্য কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে। কি সেটা তাকে জানতে হবে ব্যাপারটা।
ঘন্টা দুয়েক এর বেশি সময় লাগলো আশফির শশুর বাড়িতে পৌঁছাতে। নীরবের বড় ভাবি বউ বরনে ব্যস্ত। আশফির শাশুড়ী মা নেই৷ নীরবরা দুই ভাই, ভাইয়ের বউ আর তার বাবা।এই চারজনের সংসার৷ তাই খালা, ফুপুরাই সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছেন। আশফির মনে শাশুড়ী মা না থাকাই আক্ষেপের শেষ নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে সে তুলিকাকে খুঁজে যাচ্ছে। তুলিকা ঝটপট এসে আশফির পাশে দাঁড়িয়ে পরলো। অন্য হাতে মিষ্টির হাত ধরা। তুলিকার উপস্থিতি টের পেতেই আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলো,
‘কোথায় ছিলি তুলি?আমি আরও তোকে খুঁজছিলাম।’
‘এতো ব্যস্ত কেন হচ্ছিস। এখন নিজেকে নিয়ে আর দুলাভাইকে নিয়ে ভাব না। নাকি নিজের ফুলসজ্জার ঘরে আমাকেও নিবি কথাও কিন্তু সেটাই ছিলো আশু!’
বসার রুমে এসে বসার পর আশফি আড়ালে তপ্ত চিমটি কা’টলো তুলিকার হাতে।তুলিকা মৃদু আওয়াজ করলো এতে। ফিসফিস করে বললো,
‘এখন কি হলো হ্যাঁ?না,না,এটা বল না যে তোকে ছাড়া শশুর বাড়িতে আসতে চাইনি এখন ফুলসজ্জার ঘরেও যাবো না।আমি কিন্তু তোর ফুলসজ্জার ঘরে ঢুকে তোদের মধ্যে দেয়াল হবোই এখন। আমি কিন্তু এখানে আসতে চাইনি। তুই নিয়ে এলি জোর করে। এবার বুঝবি ঠ্যালা!’
‘দেবো একটা কি’ল। যাহ ব’দ মেয়ে। বেশি ফ্যাচর ফ্যাচর করিস না। কি নির্লজ্জ হয়েছিস রে তুলি তুই। ষিহ্!’
‘কি সাংঘাতিক!মেয়ে দেখি কথা ঘুরাই। নিয়ে যখন এসেছিস তখন তো আমি ঢুকবোই সে ঘরে। হাহাহা!’
‘হাসিস নাতো বে’ডি।’
#চলবে