হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২

0
1963

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব২
#রাউফুন

‘শিপন ভাই আমাকে ছাড়ুন। কি হয়েছে এমন ভাবে টেনে ছেচড়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

‘তোর এতো বড় সাহস আমার বোনের বিয়ের দিনে তুই মানুষকে বলাবলি করছিস তোকে খেতে দেওয়া হয়নি? এই নাকি বান্ধবীর এতো ভালো চাস তুই? তাহলে বাইরের মানুষের কাছে এরকম ভাবে বলাবলি করছিস কোন সাহসে?’

অন্ধকারের মধ্যে রাগে গজরে গজরে বাইরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শিপন তাকে। শিপন তুলিকার হাত স্পর্শ করাই শরীর যেনো জ্বলে যাচ্ছে তার। এই ঘৃণ্য লোকটা জোর খাটিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। তুলিকার হাত ছিড়ে ফেলার মতো শক্ত করে চেপে ধরেছে বদ,অসভ্য লোক। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে তুলিকা। কিন্তু পারলো না শিপনের শক্তির সাথে। শিপন তাকে একটা ছোট্ট খুপরির মতো রুমে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে ফেললো। দরজা বন্ধ করে পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। বিষফলার মতো বিষাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে শিপন তার দিকে।

‘আমাকে যেতে দিন শিপন ভাই। আমি যদি চিৎকার করি তাহলে কিন্তু সেটা আপনার জন্য খুব একটা ভালো হবে না!’

‘কি করবি তুই হ্যাঁ? মাথা গোজার ঠাই নেই আবার বড় বড় কথা? তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। কোন সাহসে তুই মাইজিনকে বলেছিস তোকে খেতে দেওয়া হয়নি? তোর বোন তো দেখলাম, চেটেপুটে, প্রায় দুই হাতে খাবার খেয়ে নিলো। আবার মাইজিনকে ঠিকই বলেছিস খেতে দেওয়া হয়নি। নাকি সুপুরুষ দেখে মাথা ঠিক ছিলো না? সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য নিজের অসহায়ত্ব অন্যের সামনে তুলে ধরিস লজ্জা করেনা?তোদের মতো মেয়েরা তো ঢলাঢলির তালেই থাকিস শুধু। তার উপর বড়লোক ছেলে। এমন একটা মা’ল পটাতে পারলেই লাইফ স্যাট।’

‘মুখে লাগাম দিন শিপন ভাই। আপনার মতো অসভ্য, বদমাইশ, নোং’রা লোক আমি জীবনে দেখিনি। ছিঃ বোনের মতো বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে এরকম ধরনের কথা কিভাবে বলেন আপনি? আমার সঙ্গে না এসব ছ্যাবলামি করতে আসবেন না। আর যদি এমন করেন তবে আমি নুরী ভাবিকে বলে দিবো আপনার নোংরামির কথা। পারলে আটকে দেখাবেন।’

‘তুই আগে এখান থেকে বেরো তারপর না বলবি কিছু!’

‘আমি চেঁচালে কিন্তু আপনার জন্য খুব বিপদ ডেকে আনবে।’

‘চেঁচা দেখি কত পারিস!’

শিপন কথা শেষ করেই তুলিকার ওড়না দিয়েই তার গলা জোরে পেঁচিয়ে ধরলো৷ তুলিকার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে। প্রথম থেকেই যদি সে চেঁচামেচি করতো তবে যে আশফির বিয়েতে ব্যাঘাত ঘটতো। যদি তার কারণে বিয়েটা ভেঙে যায় তখন?

‘আমি তো জানি তুই এখন চেঁচাবি না। আশফির বিয়েটা ভেঙে যাক এটা তো তুই চাইবি না। যদি সেটাই চাইতি তাহলে তুই প্রথমেই চেঁচাতি। আর সে সুযোগটাই আমি কাজে লাগালাম৷ তোর সব তেজ ফেসবুকিসুর ক্ষণস্থায়ী। তোর দেমাকি কথা বার্তা না আমার কাছে খাটবে না। সব সময় নাকের ডগায় বারুদ নিয়ে ঘুরিস তাই না? আজকে তোর তেজ আমি একেবারে শেষ করে দিবো।’

চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে তুলিকার৷ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। প্রাণ পাখি উড়ে যাবে যাবে ভাব। সে শিপনের জায়গা মতো তার হাটু দিয়ে আঘাত করলো৷ ছাড়া পেতেই জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে।কাশতে কাশতে বসে পরলো নিচে।শিপন কুকিয়ে উঠে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার কাছে এলো৷ শিপনের ফের তার দিকে এগিয়ে আসা দেখে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেও সাহস সঞ্চার করে স্থিরচিত্তে বসে থাকে। সে জানে বাড়িতে মেহমান অনেক। এসবের মাঝে বেশি কোনো ঝামেলায় শিপন করবে না। অন্তত পক্ষে তার মান-সম্মানে হাত বাড়াবে না এটা সে জানে। তবে এখন নুন্যতম সেলফ ডিফেন্স টা জরুরি। তাই সে নিজের হাতে থাকা লাইটার বের করে শিপনের পাঞ্জাবীর এক কোণায় আ’গু’ন লাগিয়ে দিলো। তার কাছে লাইটার চেয়েছিলো আশফির বড় ভাই শিহাব। তাই সে লাইটার টা রান্না ঘর থেকে নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আসার সময় আচানক শিপন তাকে টেনে নিয়ে আসে এখানে৷ সে-সময় রান্না ঘরের আশেপাশে কেউ-ই ছিলো না। তাই হইতো কেউ-ই খেয়াল করেনি তাদেরকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় তাজ্জব বনে গেছে শিপন। আ’গু’ন নেভাতে ব্যস্ত শিপন সেই ফাঁকে তুলিকা দরজা খুলে পালিয়ে চলে আসে। শিপন হিসহিসিয়ে তেড়ে এসে বলে,

‘তুলিকার বাচ্চা, আরেকবার তোকে পেলে তোর জা’ন নিকাল দিবো। তোর এত্তো দেমাক বের করে দিবো আমি। ভালোই ভালোই বিয়েটা মিটে যেতে দে খালি। আশফি এখান থেকে চলে গেলে তোকে কে বাঁচাবে আমার থেকে।’

তুলিকা দৌঁড়াতে গিয়ে সপাটে ধাক্কা খেলো মাইজিনের সঙ্গে। মাইজিন হা করে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে। কি হলো ব্যাপার টা তার কিছুই বোধগম্য হলো না মাইজিনের।

এক পলক মাইজিনকে দেখে কোনো দিকে না তাকিয়ে আবার দৌঁড় লাগালো তুলিকা। এক ছুটে নিজের ছোট্ট বাড়িতে চলে এসেছে। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে রেখে ফুপিয়ে কান্না করছে তুলিকা। এরকম ব্যবহার কেন করে তার সঙ্গে শিপন? কেন? সে গরীব বলে? তার মাথার উপর নিজের বলতে কেউ-ই নেই বলে? ভরসার হাত নেই বলে? এই নিষ্ঠুর দুনিয়াই টেকা বুঝি এতোটাই কষ্টের হয়। হ্যাঁ কষ্টই না শুধু, দুঃসহ! তাদের মতো অভাগীর ভাগ্যে এর চেয়ে ভালো তো হওয়ার নেই।
মিষ্টি বিয়ে বাড়ি থেকে এলো তারাহুরো করে। বোনের এমন অবস্থায় চিন্তিত হয়ে ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘এই বুবুজান কি হইছে তোমার?কাঁনদো ক্যান?’

তুলিকা উঠে বসেই ধুপধাপ করে কিল বসিয়ে দিলো মিষ্টির পিঠে। ঘাড় অব্দি লম্বা চুল টেনে ধরে ফোসফাস করে বললো,

‘কানদি ক্যান হ্যাঁ? এই তোকে কি আমি ভালো ভালো খাবার খাওয়াই না?ওসব খাবার কেন খেলি? আমি তো উঠে এলাম তুই কেন এলি না বল?অন্যের বাড়িতে গিয়ে গোগ্রাসে গিলতে লজ্জা করে না তোর?কেন খেলি বল?কেন খেলি?’

‘উফফ বুবুজান ছাইড়া দেও আমার লাগতাছে।তুমি কাঁনদো কেন এঈডাই তো জিজ্ঞেস করছি তাই এমনে মা’র’বা।’ হা করে হামলে কান্না করে দিলো মিষ্টি।

‘এই কানের গোড়াই ভেঁভেঁ করবি না মিষ্টি।আর জীবনে যদি মানুষের বাড়ি গিয়ে ওইভাবে খেয়েছিস দেখবি সেদিন কি করি।’

তুলিকা ছেড়ে দিলো মিষ্টিকে।টপটপ করে জামিরের রসের ন্যায় চোখের পানি পরছে মিষ্টির।হিচকি কা’ট’ছে ক্ষনে ক্ষনে।থেমে থেমে ভাঙা গলায় বললো, ‘বুবুজান শিপন ভাই আবার কি তোমারে কষ্ট দিয়ে কথা কইছে?তুমি কাইন্দো না বুবুজান। আমি আর কোনোদিনও ভালা ভালা খাওন দেখে লোভ করমু না।’

হাউমাউ করে কাঁন্না করে ছোট বোনকে জাপটে ধরলো তুলিকা।

‘তোর যেটা খেতে ইচ্ছে করবে আমি তোকে এনে দেবো। আর কখনোই অন্যের বাড়ির খাবার খাবি না।আর খোটা-দাড়ি মানুষের বাড়িতে তো নয় ই।’

‘আচ্ছা বুবুজান!তুমি যাবা না আশফি বুবুর তো বিদায়ের সময় হইয়া গেছে।তাই জেঠিমা আমারে দিয়া ডাকতে পাডাইলো।’

‘মিষ্টি তোকে কতদিন বলেছি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি।কেন শুনিস না আমার কথা!’

‘উফফ বুবুজান আমার এরাম কইরা কতা কইতে ভাল্লাগে। কিমন আপন আপন লাগে।’

হেসে উঠে তুলিকা। হাতের বাঁধন শক্ত করে আরও কিছুটা। এক হাতে বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বলে,

‘আমাদের জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন রে মিষ্টি। তুই তো এখনো ছোট তাই বুঝতে পারছিস না।বড় হো বুঝবি তোর বুবুজান কেন এসব বলে। কেন এতো গায়ে মাখে অন্যের কথা।’

বিয়ে পরানো শেষ।বিদায়ের সময় চার পাশে চোখ বুলিয়ে তুলিকাকে খুঁজলো আশফি। কিন্তু পেলো না। সে যখন কবুল বলছিলো অন্তত পক্ষে সে-সময় তুলিকাকে আশা করেছিলো আশফি। মেয়েটা কি নেই এখানে? তার যাওয়ার সময়ও কি দেখা করবে না? আশফি তার মাকে কানে কানে বলে,

‘আম্মু তুলি কোথায়? ওঁকে কি দেখেছো?’

‘নাহ রে। অনেকক্ষন থেকে দেখিনি মেয়েটাকে। মিষ্টিকে তো পাঠালাম ডাকতে।’

কান্না মিশ্রিত চোখ মুছে মাকে জড়িয়ে ধরে আশফি। ভেতরটা কেমন চিনচিন করছে।সে চলে গেলে আশফির পাশে থাকার মতো কেউ-ই থাকবে না। তার অনুপস্থিতিতে তার ভাই যে তুলিকার সঙ্গে বা’জে ব্যবহার করবে সেটাও সে খুব ভালো করেই জানে।শশুরবাড়ি থেকে কিই-বা করতে পারবে সে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here