কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব ২৫

0
869

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৫

কপালের বামপাশ থেকে গড়ানো দুফোঁটা র*ক্ত হাতের সাহায্যে মুছে ভ*য়া*র্ত চোখে তাকিয়ে রইল পলকের দিকে। পলক তখন অ*গ্নি*শর্মা হয়ে তপার দিকেই নিষ্পলক চেয়ে আছে। তপা শুকনো গলায় ঢোক গিলে নিচের দিকে তাকাল। হাত কচলাতে লাগল অনবরত। চমকে উঠল আকষ্মিক হাতের কবজি শক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ায়। চোখ তুলে দেখার আগেই হেঁচকা টান পরল হাতে। প্রায় দৌড়ে যেতে লাগল পলকের পিছুপিছু। পলক গিয়ে থামল একেবারে লাইব্রেরীর সামনে। দরজা হাট করে খোলাই ছিল। ভেতরে জনা বিশেক ছাত্র ছাত্রী।

ভেতরে ঢুকে গলা ঝেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ঝামেলা মিটে গেছে। তোমরা যেতে পারো এখন।”
দিরুক্তি করতে চাইলেও পলকের মুখাবয়ব দেখে সাহস করল না কেউই।
তপা কে বসিয়ে নিজেই কাঁধ থেকে ব্যাগ টেনে নিল। চেইন খুলে খুঁজে নিল কাঙ্ক্ষিত বক্সটি। মিনি ফার্স্ট এইড বক্স। তপা মাথা নিচু করে থাকলেও আড়চোখে দেখল পলকের কান্ড কারখানা। বক্স খুলে তুলো নিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল কে*টে যাওয়া জায়গাটুকু। তপা নড়াচড়া করলে মুখে কিছু না বলে চোখ দিয়ে শাসাল। এতে তপা ইচ্ছে করে আরও বেশি করে নড়তে শুরু করল। ভাব করতে লাগল এমন, যে সে ব্যথা পাচ্ছে। শুধু ব্যথা নয়। একদম ম*রে যাচ্ছে এমন ব্যথা।
পলক একটু নরম হলো এবারে। ওষুধ লাগিয়ে দেওয়ার সময় মুখ এগিয়ে ফু দিয়ে দিল। তপা পুলকিত হলো। এক নজরে তাকিয়ে রইল পলকের মুখের দিকে। পলক বোধহয় বুঝতে পারল তপার দুষ্টুমি। আবার অ*গ্নি*মূর্তি ধারণ করল চোখের পলকেই।

“আমি বারণ করার পরও তুমি বের হওয়ার সাহস কোথায় পেলে?”
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে এহেন কথা শুনে তপা কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। শুকনো গলায় আবারও ঢোক গিলল।
পলক হুংকার দিয়ে বলল,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। সাহস হলো কি করে? যদি কিছু অঘটন ঘটে যেত? বলেছিলাম আমি আসছি। পাকনামি করতে কে বলেছে?”
তপা মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
“যদি আপনার কিছু হয়ে যেত, তবে?”
একটা বাক্যেই পলক কিছুটা শান্ত হলো যেন। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আমার কি হবে? আর হলেই বা তোমার কি?”
“আপনি যখন আসার কথা বলছিলেন তখনও বোধহয় ঝামেলা থামেনি। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিৎ। আপনি জানেন না কতটা নৃ*শং*স ভাবে মে*রে*ছে ওরা কয়েকজন কে। র*ক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল তাদের শরীর। আমি দেখে রুমে এসে ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম। হাত পা কাঁপছিল ওদের দেখেই। কিন্তু এরমধ্যে আপনি বললেন আসবেন। আমি বুঝতে দিতে চাই নি এখানে ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আগেই জেনে বসে আছেন। আপনার আসার কথা শুনে আমি দিকবিদিক ভুলে বেরিয়ে পরেছিলাম। ওরকম র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় আপনাকে দেখলে আমি সইতে পারব না । তাই তো হন্য হয়ে চেষ্টা করছিলাম আপনি আসার আগেই বের হতে। কিন্তু যেতে আর পারলাম কই? তার আগেই সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথা ফা*টি*য়ে বসে আছি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
“তুমি আমার সেফটির জন্য নিজে বিপদে পরতে যাচ্ছিলে? আর এত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে কেন গেলে? তোমার কি কিছু মনে থাকে না তিয়াশা? কিছুদিন আগে পা ভে*ঙে ঘরে বসেছিলে ভুলে গেলে? এত কিসের তাড়া তোমার? আজ যদি পড়ে না যেতে তাহলে বাইরে মা*রা*মা*রির ভীরে তুমিও আ*ঘা*ত পেয়ে বসতে। ওরা যদি তোমাকে অ্যা*টাক করত তাহলে?”
তপা মৃদু হাসল। ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ধরে রেখেই বলল,
“আপনি আমায় হারানোর ভ*য়ে সিটিয়ে গেছেন। অথচ আপনার আমি ছাড়াও সবই আছে। মা, বাবা, পরিবার সব। কিন্তু আমার? আমার তো এই পলক টা ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই। আঁকড়ে ধরে বাঁচার মত একটা শিকড়বাকরও নেই। শিকড়হীন আমি তো কেবল আঁকড়ে ধরার জন্য আপনাকে পেয়েছি। কি করে বসে থাকতাম?”
পলক নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। কা*টা জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“যাই হয়ে যাক না কেন আর কখনো এরকম খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেবে না। তোমার কোনো ধারণা আছে, তোমাকে ওভাবে টালামাটাল পায়ে হাঁটতে দেখে আমার কি অবস্থা হয়েছিল?”
এতটুকু নরম গলায় বললেও আবার কঠিন হলো কন্ঠস্বর। থতথমে গলায় বলল,
“আর একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার পা ভে*ঙে ঘরে বসিয়ে রাখব। পলক তাজওয়ার কখনো শুকনো থ্রে*ড দেয় না। মাইন্ড ইট।”
তপা পলকের চোখের আড়ালে ঠোঁট টিপে হাসল। মুখটা উঁচু করে পলকের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির উপর টুক করে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিল। চমকে তাকাল পলক। চোখে জড়িয়ে আছে একরাশ বিষ্ময়। তপা পলকের চাহনি দেখে মিটিমিটি হাসছে।
“এসব কোত্থেকে শিখলে?”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোন সব?”
পলক মৃদুস্বরে বলল,
“এই যে রাগ ভাঙাতে চুমু দেওয়া। এসব তো আমি শেখাই নি।”
তপা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“শিখেছি আর কি।”
পলক চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
“সেটাই তো। কে শেখালো?”
তপা বাঁকা হেসে বলল,
“ওই তো, আমাদের ব্যাচমেট একটা ছেলে আছে, সে।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“চড়িয়ে গাল লাল করে দেব। বেয়াদব বউ। আমাকে ছেলের গল্প শোনানো হচ্ছে?”
তপা মুখ এগিয়ে গাল পেতে দিয়ে বলল,
“প্লিজ।”
পলক মৃদু হাসল। বলল,
“চলো। এখানে মা*রা যাবে না। বাসায় চলো তারপর দেখছি, কতক্ষণ এই টসটসে গাল দুটো লোড নিতে পারে।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। পলক পুনরায় বলল,
“রাগ ভাঙানোর টেকনিক তো তুমিই শেখালে। এবার বুঝবে পলক তাজওয়ার কি জিনিস।”
তপা হাসল। চুল ঠিক করার ভান করে বলল,
“ভুলে যাবেন না আমিও পলক তাজওয়ারের বউ। তিয়াশা তাজওয়ার। সো আমার সাথে নো পাঙ্গা।”

তপা সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় বেখেয়ালি হয়ে পা পড়ে যায় দুধাপ পরের সিঁড়িতে। যার দরুন কপাল গিয়ে লাগে রেলিংয়ের সাথে। মূহুর্তেই চাপা আর্তনাদ করে উঠে তপা। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যার গেইটের দিকে।
পলক ভার্সিটির প্রধান ফটক পেরিয়ে দেখতে পায় গুটিকতক ছাত্র ছাত্রী তর্ক বির্তক করছে। পলক আসার আগেই পুলিশ এসে ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। অ্যা*রে*স্ট হয়েছে কিছু শিক্ষার্থী। কিছুজন হসপিটালে। আ*ত*তা*য়ী হামলার রেশ ধরে সং*ঘা*তে লিপ্ত হয়েছে ভার্সিটির দুই ছাত্র দল। একপক্ষের দাবি অপর পক্ষ ভার্সিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন আ*ত*তা*য়ীদের কাছে লিক করে দিয়েছে। অপরপক্ষের দাবি তারা একাজ করে নি। বরং অপরপক্ষই জড়িত এই আকষ্মিক হা*ম*লার সঙ্গে। এটা নিয়েই চলছে বাক বিতর্ক। একপর্যায়ে হাতাহাতি। তারপর হঠাৎই হামলা করেছে আ*ত*তা*য়ীরা। প্রথমে ক্যান্টিনসহ কিছু রুম তালাবন্ধ করে দিয়েছে। তারপর অতর্কিত আ*ঘা*ত করেছে।
জনবহুল জায়গা পেরিয়ে আসতেই তপার দেখা পায় পলক। ছোট ছোট পায়ে দ্রুত এগিয়ে আসার প্রয়াস চালাচ্ছে সে। পলক সামনে দাঁড়াতেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। পলকের চোখ প্রথমেই আঁটকে গেল কপালের কা*টা জায়গাটাতে। খানিকটা র*ক্ত লেগে আছে বাম ভ্রুর উপর। ক্ষ*ত তেমন গভীর না হলেও র*ক্ত ঝরেছে স্বল্প পরিমাণে।
তপা পলককে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
পলক কিছু না বলে চোখ ছোট ছোট তাকিয়ে রইল কপালের দিকে। মূহুর্তেই রগগুলো দপদপ করে উঠল।
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“কপালে র*ক্ত কি করে বের হলো?”
তপা কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কে*টে গেছে।”
পলক ফুঁসে উঠল। কণ্ঠের তেজি ঠাট বজায় রেখেই বলল,
“কা*ট*লে র*ক্ত বের হয় সেটুকু বোঝার মত জ্ঞান আমার আছে। কা*ট*ল কি করে সেটা জিজ্ঞেস করেছি।”
“সিঁড়ি থেকে অসাবধানতা বশত পড়ে গিয়েছিলাম।”
আর একটা শব্দও করে নি পলক। কেবল অ*গ্নি*দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

কেন্দ্রীয় কা*রা*গা*রের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাতসেতে রুমে বসে আছে মামুন। ভা*ঙা হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে সে। সাদা ব্যান্ডেজের ভেতরে কুটকুট করে কামড়াচ্ছে সারাক্ষণ। থালায় পরে থাকা দুটো মোটা রুটির দিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ।
হাজেরা বেগম অনুমতি পেয়ে মামুনের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে আজ মায়ার বদলে ঘৃ*ণা ঝরে পড়ছে তার। একরাশ ক্রো*ধ নিজেদের শক্তিতে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মামুন চোখ তুলে তাকাল। হাজেরা বেগম কে দেখে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। হাজেরা বেগম নিজের ভেতরে থাকা ঘৃণার পাহাড় সরিয়ে রেখে ডাকল,
“মামুন।”
মামুন তাকাল। তবে তার কণ্ঠনালী থেকে উচ্চারিত হলো না কোনো শব্দ।
হাজেরা বেগম আবারও ডাকলেন। কিন্তু মামুন এলো না। নিরাশ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন তিনি। দশ বছরের বিনাশ্রম কা*রা*গা*র জীবনের মাত্র সপ্তম দিন চলছে। বাকি আরও নয় বছর তিনশত আটান্ন দিন।

“আপনি কি আজ আসতে পারবেন?”
পলক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোথায়?”
তপা ওড়নায় গিট দিতে দিতে বলল,
“তাজমহলে। মানে আজ এখানে থাকতে পারবেন?”
পলক কিছুক্ষণ ভাবল। অতঃপর বলল,
“পারব। কিন্তু আসতে রাত হবে। অনেক কাজ পেন্ডিং হয়ে আছে।”
তপা মাথা নাড়িয়ে অভিজ্ঞদের মত বলল,
“ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব।”
বাইক স্টার্ট দিয়ে আবার চলে গেল পলক। এসেছিল তপা কে পৌঁছে দিতে। পৌঁছেই আবার চলে গেল নিজ গন্তব্য অফিসে।

আসমানী রঙা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে তপা। ভীষণ লজ্জা লজ্জা করছে তার। ইচ্ছে করছে কম্বলের তলায় লুকিয়ে থাকতে। যেন মুখটা আবৃত থাকে এই ধরাধামের প্রতিটি সৃষ্টির থেকে।

কলিং বেল বাজতেই তপা হকচকিয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে সাহস যোগালো। আর অপেক্ষা করতে লাগল পলকের রিয়াকশন দেখার।
আচ্ছা সে কি চমকাবে? একটু খানি থমকে দাঁড়াবে? নাকি ঘোর লাগা চোখে মোহনীয় কণ্ঠে বলবে, ‘ ধ্বংস আজ আমি তোমাতেই।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here